উন্নয়ন দর্শন ও বিউপনিবেশীকরণ: ঈশ্বর কিংবা পুঁজির মুখোমুখি মানুষ ও প্রকৃতি

কদিন পর বর্তমান অর্থমন্ত্রী উন্নয়ন দর্শনের বার্ষিক দলিল হিসেবে বাজেট উপস্থাপন করবেন। এই ভদ্রলোকের কাজের অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের, বাজেট প্রস্তাবনারও। তিনি প্রথম বাজেট পেশ করেন ১৯৮২৮৩ অর্থবছরের এবং পরে ১৯৮৩৮৪ সালের। তিনি তখন হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ছিলেন। এর মধ্যে অনেক সরকার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু উন্নয়ন দর্শনের ধারাবাহিকতা খর্ব হয়নি।

বস্তুত ৮০ দশকটি অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান গতিমুখ ও চেহারা নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেইসময়ে রেগ্যান ও থেচারের নেতৃত্বাধীন বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনায় নয়া উদারতাবাদী (নিও লিবারেল), সঠিকভাবে বললে গোঁড়া ডানপন্থী বৃহৎ পুঁজিমুখি, কর্মসূচির জোর প্রতাপ শুরু হয়। ওয়াশিংটন কনসেনশাস কাঠামোর অধীনে সমন্বিত ও শক্তিশালীভাবে কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির প্রয়োগ শুরু হয়। সেই কাজে বিশ্বব্যাংক ও আই এমএফ প্রভৃতি সংস্থা বাংলাদেশসহ প্রান্তস্থ দেশগুলোর বিভিন্ন খাতে তাদের উপযোগী নীতি ও প্রকল্প প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে।1

ঋণ ও অনুদান নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যেসব নীতি প্রণীত হয় বা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তার বেশিরভাগই কোন নির্বাচিত সংস্থায় আলোচনা করে প্রণীত হয় না। গোপনীয়তা, অস্বচ্ছতা, অপচয় ও দুর্নীতি এসব নীতি ও প্রকল্প প্রণয়ন প্রক্রিয়ার অন্যতম দিক। ৮০, ৯০ ও বর্তমান দশক জুড়ে অন্য প্রান্তস্থ দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও ‘ওয়াশিংটন কনসেনশাস’ এর জোয়ালে ঘাড়টা দিয়ে উন্নয়ন ও সংস্কারের নামে অনেক কর্মসূচি নিয়েছে। এসব কর্মসূচিরই ফলাফল হল আদমজী পাটকল বন্ধসহ পাটখাতে বড় বিপর্যয়, জ্বালানী খাতে জাতীয় সক্ষমতার অবক্ষয় ও বিদেশি মালিকানার সম্প্রসারণ, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে অব্যাহত বাণিজ্যিকীকরণ, নদীনালা খালবিল জলাশয় দখল ও ভরাট করে বিনিয়োগ, আমদানী নির্ভরতা বৃদ্ধি, মিল থেকে (শপিং) মল মুখি অর্থনৈতিক তৎপরতার বিস্তার, চট্টগ্রাম স্টীল মিল, মেশিনটুলস ফ্যাক্টরীসহ বহু শিল্পকারখানা বন্ধ, বহু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান প্রায় বিনামূল্যে বিতরণ, পানির বাণিজ্যিক পণ্যে রূপান্তর, রেলওয়ে সংকোচন, দখল ও লুন্ঠন প্রক্রিয়ায় জনগণের সাধারণ সম্পত্তি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তর, কৃষিখাতে হাইব্রিডসহ বীজসহ কোম্পানি নির্ভরতা বৃদ্ধি, চোরাই টাকার তৎপরতা বৃদ্ধি, কাজ ও মজুরির নিরাপত্তা সংকোচন, বাণিজ্য ঘাটতির ক্রমান্বয় বৃদ্ধি এবং নতুন ধনিক শ্রেণীর জন্ম ও বিকাশ।

উন্নয়ন’ নামের কর্তৃত্ববাদী ও সহিংস এই জাল টিকে থাকে দেশের ভেতর তার সমর্থক গোষ্ঠীর কারণে, যারা এসব তৎপরতার প্রধান সুবিধাভোগী। আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংক ও চেরিল পেয়ার এদের নাম দিয়েছিলেন পঞ্চম বাহিনী, যারা দেশের নাগরিক অথচ বহুজাতিক পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী হিসেবে নিজেদের বিত্ত ও ক্ষমতা নিশ্চিত করে। এদের মধ্যে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী আমলা ছাড়াও থাকে ‘বিশেষজ্ঞ’। দখলদার সেনাবাহিনীর নির্মমতা দেখা যায়, এদেরটা ঢাকা থাকে উন্নযনের মুখোশে।

সন্দেহ নেই, এসবের মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজ অর্থনীতির বিশেষত ঢাকা শহরের জৌলুস অনেক বেড়েছে। টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন ও বিলবোর্ড, বহুতল ভবন, ফ্লাইওভার, শপিংমল, বেসরকারী ব্যয়বহুল জাকজমকপূর্ণ হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অগণিত ব্যক্তিগত দামি গাড়ি, ব্যয়বহুল রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি মিলে প্রচলিত উন্নয়ন ধারণার ভাব তৈরি হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধিও অন্য অনেক দেশের তুলনায় খারাপ হয়নি। কিন্তু এই জৌলুসের নীচে চাপা পড়ে থাকে উচ্ছেদ ও নিপীড়ন, জাতীয় সক্ষমতার বদলে হীনমন্যতার প্রাতিষ্ঠানিকতা, সকলের জন্য সুলভে শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সর্বজনের অধিকার হরণ, দখল ও লুন্ঠন তৎপরতা, টেকসই দারিদ্রের চিত্র, এবং সন্ত্রাসী দখলদারদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।

.

ইউরোপের এডাম স্মিথকে ভুলভাবে ‘অর্থশাস্ত্রের জনক’ বলা হয়, তাঁর প্রধান গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৭৭৬ সালে। কিন্তু অর্থশাস্ত্র বিষয়ক চিন্তা এই বছরই শুরু হয়নি। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র প্রকাশিত হয়েছিল প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের ভারতবর্ষে। এছাড়া দখলপূর্ব আমেরিকায় চিন্তা, দর্শন, বিজ্ঞানচর্চা কী পর্যায়ে তার পুরোটা আমরা এখনো জানি না, তবে যতটুকু অনুসন্ধান সম্ভব হচ্ছে তত বিস্ময়কর তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে। চীনে, প্রথম শতকের দিকে যখন সাম্রাজ্যগুলি আস্তে আস্তে তৈরী হতে থাকে সে সময়, বিজ্ঞানীদার্শনিকবিদ্বজ্জন ধারাবাহিক নিপীড়ন ও হত্যাকান্ডের শিকার হন। এডাম স্মীথকে পুরোধা বিবেচনা করা যায় পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থাকে অনুধাবন এবং তত্ত্বায়ন করবার সূত্রে।

পুঁজিবাদ কী করে সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হলো এবং এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় ইউরোপ কী করে বিশ্ব ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত হলো তার সম্পর্কে বিশ শতকের শুরু থেকেই বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে।2 এই রূপান্তর প্রক্রিয়ার অন্যতম সাক্ষী আমাদের বাঙলা অঞ্চল। ১৭৫৭ সালে যখন বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সিরাজউদ্দৌলার হাত থেকে বাংলার কর্তৃত্ব গ্রহণ করলো তখন তা আপাতদৃষ্টিতে ছিল নেহায়েতই বাণিজ্যিক বিষয়। কিন্তু বৃটিশ পুঁজিবাদের বিকাশ ও তার একচেটিয়া পুঁজিবাদী বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে রূপান্তর প্রক্রিয়ায় এই ঘটনা ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তারের পথে সূত্রপাত হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্ববহ।

একই সময়ে অর্থাৎ আঠারোউনিশ শতকে ইউরোপের চিন্তাজগত রক্তাক্ত কঠিন লড়াইএর মধ্য দিয়ে ঐশী আইনের আধিপত্যকে খারিজ করে প্রাকৃতিক বিধি ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের কাঠামোতে প্রবেশ করে। আমরা এভাবে জানি যে, বিশ্বাসের কাল শেষ করে উনিশ শতকের ‘আলোকময়তার যুগ’ যুক্তির কালএ প্রবেশ করেছে। কিন্তু একই সময় ছিলো একদিকে উপনিবেশকাল অন্যদিকে ইউরোপের অভ্যন্তরে নতুন শ্রেণীবিন্যাস নিয়ে দ্ব›দ্বসংঘাতের কাল।

সন্দেহ নেই, উনিশ শতক জ্ঞানের অনেক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের ঘটনা ঘটেছে। বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, ইতিহাস, প্রত্মতত্ত্বসহ প্রায় সর্বত্র নতুন যে জ্ঞানের সাথে মানুষের পরিচয় ঘটে, তার সঙ্গে পুরনো ঈশ্বর বা তাঁর প্রতিষ্ঠানের সমঝোতা অসম্ভব ছিল। ফ্রয়েড বললেন, ঈশ্বর অবস্থান করেন মানুষের অচেতনে; এটাও বললেন যে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানুষের অপরিণত চেতনা আর অচেতন ইচ্ছাপূরণের আকাঙ্খার মধ্যে। তাঁর ধারণা ছিল বিজ্ঞানের বিকাশের মধ্য দিয়ে মানুষ ‘ঈশ্বর ধাঁধা’ থেকে মুক্ত হবে। মনে করা হল, ঈশ্বর বিদায় নিলেন, মানুষ নিজের পায়ের উপর দাঁড়ালো। নিৎসে সহ অনেকেই ঈশ্বরের মৃত্যু ঘোষণা করলেন।

আধুনিকতা ও পুঁজিবাদের বিকাশের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর অর্থাৎ ধর্মের আধিপত্য দূর হবে বলে ধারণা সৃষ্টি হল। কিন্তু আসল ঘটনা কি তাই? নাকি ঈশ্বরের রূপান্তর ঘটলো এবং নতুনভাবে, ভিন্ন বেশভূষায় তিনি প্রবেশ করলেন? প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বর্বরতা ও তারপর হিটলারের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের উত্থানে আধুনিকতার ভয়াবহ রূপ দেখে ফ্রয়েড জীবনের শেষ পর্যায়ে হতাশার অভিব্যক্তি রেখে লিখলেন সভ্যতা ও তার সৃষ্ট অসন্তোষ নিয়ে। ইহজাগতিকতা, যৌক্তিক ব্যবহার, উপযোগিতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, এসব শব্দাবলীর ভিড়ে এক নতুন ঈশ্বরের আবির্ভাব উপলব্ধি করতে পেরেছেন খুব কম জনই।

It has resolved personal worth into exchange value, and in place of the numberless indefeasible chartered freedoms, has set up that single, unconscionable freedom — Free Trade. In one word, for exploitation, veiled by religious and political illusions, it has substituted naked, shameless, direct, brutal exploitation…The bourgeoisie has stripped of its halo every occupation hitherto honoured and looked up to with reverent awe. It has converted the physician, the lawyer, the priest, the poet, the man of science, into its paid wage labourers.

— Communist Manifesto, 1848

মানুষের চিন্তাজগতে, সামাজিক ক্ষমতা বিন্যাসে, রাষ্ট্রশক্তির হিংস্রতায় ঈশ্বর ও পুঁজির আপেক্ষিক অবস্থান বিবেচনা গুরুত্বপূর্ণ। কয়েকশো বছর উদীয়মান পুঁজির শক্তির সঙ্গে ঈশ্বরের প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক ক্ষমতার রক্তাক্ত বিরোধ চলে। কিন্তু এই বিরোধ স্থায়ী হয়নি। আপোষরফা হয়: নিয়মে, প্রতিষ্ঠানে, চিন্তায়। তবে আগে ঈশ্বরের বিধিবিধান সামনে ছিল। প্রাক পুঁজিবাদী বিশ্বচিত্রে ঈশ্বরের প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ। পুঁজিবাদী পর্বে মূলধারার ঈশ্বর অবস্থান নিলেন পুঁজির অধীনস্তরূপে। পুঁজি অবতীর্ণ হল নতুন ঈশ্বর রূপে। পুরনো ঈশ্বরের কাজ তাকে অনুসরণ ও তার উপর মায়াবী আচ্ছাদন প্রদান।

মার্কস পুঁজিকে শ্রম হিসেবেই অভিহিত করেছেন, কিন্তু তা মৃত শ্রম, শ্রমের মালিকদের থেকে চুরি করে নেয়া অংশ, যা আবার জীবিত শ্রমের উপরই আধিপত্য বিস্তার করে। পুঁজির আধিপত্য অতএব বর্তমানের উপর অতীত, জীবিতের উপর মৃতের আধিপত্যের একটি শক্তিশালী ধরন। এই পুঁজির স্বাধীন ক্রিয়াকে এডাম স্মীথ প্রমুখ গৌরবান্বিত করেছেন ‘অদৃশ্য হস্ত’ বলে। এই অদৃশ্য হস্তের প্রভাব টের পাওয়া যায়, কিন্তু তাকে ধরাছোঁয়ার উপায় থাকে না মানুষের। ঈশ্বরের ক্ষমতার সাথে এর তফাৎ কী?

.

ঈশ্বরের আধিপত্য নিশ্চিত করার প্রধান উপায় মানুষের ভয়। অজানা, অচেনা জগৎ এবং মৃত্যুউত্তর পর্বের অনিশ্চয়তা এই ভয়ের প্রধান কারণ। অনিশ্চয়তা শুধু জীবন পরবর্তীকাল নয়, যদি জীবনযাপনেরও প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়, তাহলে সার্বক্ষনিক ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা মানুষকে কুঁকড়ে রাখে, অস্থির রাখে। এই ভয়ের একটি প্রতিষেধক হিসেবেই উপস্থিত থাকেন ঈশ্বর। কিন্তু জীবনযাপনের অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা, বিচ্ছিন্নতাজনিত ভয় ও অসহায়ত্ব সৃষ্টি কি প্রাকৃতিক? নিয়তি? তাতো নয়। পুঁজি যখন ঈশ্বরের স্থান দখল করে তখন কি তা মানুষের সকল অনিশ্চয়তার ভয় দূর করতে সক্ষম হয়? না।

নিশ্চিত মৃত্যু নিয়ে মানুষের যতটা ভয় তার থেকে বেশি ভয় মৃত্যুর অনিশ্চয়তা নিয়ে। বাংলাদেশের মানুষ খুব ভালোভাবেই জানেন অকাল মৃত্যুর যন্ত্রণা, এখানে স্বাভাবিক মৃত্যুর কোন গ্যারান্টি নেই। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বের অসংখ্য মানুষ ক্ষুধা, দারিদ্র, চিকিৎসাহীনতা, যুদ্ধ, উচ্ছেদ, সহিংসতা, বর্বর নির্যাতনে মৃত্যুর হুমকির মুখে বসবাস করেন। এটা তো আসলে মৃত্যুর নয়, জীবনেরই সমস্যা।

জীবনকালের অনিশ্চয়তাই পুঁজির অবদান, আবার তার অন্যতম অস্ত্র, অন্যতম ভিত্তি। মৃত্যুর ভয় ও অনিশ্চয়তাও তার শিকারের বাইরে নয়। মানুষের অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তাহীনতার ভয় পুঁজির সংবর্ধন অর্থাৎ মুনাফার নিশ্চিতকরণে অন্যতম অবলম্বন। কেইনস বলেন, বেকারত্ব পুঁজিবাদে স্বীকার করে নিতেই হবে। কিন্তু একই সময়কালের মাইকেল কালেকী বলেন, পুঁজিবাদে চাহিদা যোগান বিবেচনা করলে বেকারত্ব অপরিহার্য নয়, বেকারত্ব তাকে টিকিয়ে রাখতে হয় নিজের আধিপত্য নিশ্চিত করবার জন্য। এই অনিশ্চয়তা সৃষ্টি ও তা বহাল রাখা অতএব পুঁজির রাজনৈতিক অবস্থান ও তার নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখবার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র।

.

রনজিৎ গুহ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের স্বরূপ তুলে ধরতে গিয়ে তা উপস্থিত করেছেন একটি সম্পর্কমডেলছকের মাধ্যমে। তিনি দেখছেন, ঔপনিবেশিক ভারতে উৎপাদন পদ্ধতিতে পুঁজির ভূমিকা ছিল প্রান্তিক, তখন রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ক্ষমতা প্রয়োগ করতো অনেকগুলো অসমতা সর্ম্পকের মধ্যে দিয়ে। এই অসম সম্পর্কের সার হচ্ছে আধিপত্য (dominance) ও অধস্তনতা (subordination), এই দুটো পরষ্পরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। আধিপত্য তৈরি হচ্ছে দুই ভাবে: বলপ্রয়োগ (coercion) এবং সপক্ষে আনার প্রক্রিয়া (persuasion)। আর অধস্তনতার মধ্যে দুটো বিপরীত চিত্র থাকে একটি অনুগত সহযোগিতা (collaboration) এবং অন্যটি প্রতিরোধ (resistance)। রনজিৎ গুহ মার্কসের পুঁজির জৈবিক গঠন সূত্রটি ধার করে তৈরি করছেন আধিপত্য ও অধস্তনতার জৈবিক গঠন। বলছেন, বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থায় এই গঠনের বিভিন্ন বিন্যাসের উপর শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠে।

ঔপনিবেশিক ভারতে পুঁজির অবস্থান প্রান্তিক হলেও পুঁজির আত্মসম্প্রসারণের তাগিদই এই ঔপনিবেশিক শাসনের বিস্তার ঘটিয়েছিল। আমেরিকা দখল, বর্বর গণহত্যা, আফ্রিকায় স্বাধীন মানুষদের দাসে রূপান্তর, ভারতবর্ষসহ এশিয়ার দেশগুলোতে সামর্থ্য অনুযায়ী ইউরোপীয় নানা দেশের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা এই সবই বণিক পুঁজিবাদের পর্বে নিষ্ঠুর আগ্রাসী উন্মাদনার এক একটি অধ্যায়। এই পর্বের মধ্য দিয়েই পুঁজিবাদ ইউরোপে সংহত হয়, শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়, তার সাম্রাজ্যবাদ পর্বে প্রবেশ ঘটে।

লেনিন ‘সাম্রাজ্যবাদ’ সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছিলেন, এটি প্রথমত, পুঁজিবাদের একচেটিয়া স্তর; দ্বিতীয়ত, এই একচেটিয়া স্তরের বিশেষ বৈশিষ্ট হচ্ছে এই ব্যবস্থার শিল্প পুঁজি ও ব্যাংক পুঁজি একীভূত হয় লগ্নী পুঁজি গঠন করে। তৃতীয়ত, এই লগ্নী পুঁজি অনেক বেশি আগ্রাসী হয় তার কেন্দ্রীভবন ও সম্প্রসারণে। এবং চতুর্থত, এই একচেটিয়া পুঁজি বিশ্বকে নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। লেনিনের সাম্রাজ্যবাদ গ্রন্থ রচনার কিছু আগে রোজা লুক্সেমবুর্গ পুঁজির একচেটিয়াকরণ এবং তার সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা নিয়ে যে গ্রন্থ রচনা করেন, সেখানে এই ব্যবস্থা যে অপরিহার্যভাবে সামরিকীকরণের সঙ্গে যুক্ত তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। সেসময় বিশ্বের বেশির ভাগ অঞ্চলে চলছে উপনিবেশকাল।

এই পর্বে উপনিবেশ বিস্তারে ইউরোপের ঈশ্বর খুবই সহায় ছিলেন। পুঁজি যেখানে গেছে তার সাথে ঈশ্বরও গেছেন। ইউরোপীয় ঈশ্বরের সাথে কোথাও কোথাও স্থানীয় ঈশ্বরের সংঘাত হয়েছে, কিন্তু অবশেষে কোথাও বলপ্রয়োগ কোথাও হজম করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে তার নিষ্পত্তি হয়েছে। এই প্রসঙ্গে কেনীয় ঔপন্যাসিক নগুগির কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। তিনি তাঁর পেটালস অব ব্লাড উপন্যাসে (১৯৭৭) বলছেন,

We can imagine the fatal meeting between the native and the alien. The missionary had traversed the seas, the forests, armed with the desire for profit that was his faith and light and the gun that was his protection. He carried the Bible; the soldier carried the gun; the administrator and the settler carried the coin. Christianity, Commerce, Civilization: the Bible, the Coin, the Gun: Holy Trinity.

পরবর্তী সময়ে আর্নেস্ট ম্যান্ডেল পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থাকে স্থায়ী যুদ্ধ অর্থনীতি হিসেবে সূত্রায়িত করেন।3 আন্তনিও গ্রামসি মতাদর্শের আধিপত্য বিষয়টির উপর গুরুত্ব দেন, যে আধিপত্য পুঁজির শাসন ও শৃঙ্খলের প্রতি জনসম্মতি উৎপাদন করে। এই আধিপত্য কীভাবে কাজ করে তার উপর দীর্ঘদিন ধরে এখনও বিস্তৃত কাজ করছেন নোয়াম চমস্কি। তাই এখন আমরা দেখি শিল্প পুঁজি ব্যাংক পুঁজির সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় মিডিয়া, শিক্ষা, সংস্কৃতি জগৎ কীভাবে কেন্দ্রীভূত হয় পুঁজির শৃঙ্খলে। বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে এই শৃঙ্খলে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে তাদের উপযোগী নাটবল্টু ধরণের মানুষ উৎপাদন করে তার প্রামাণ্য বিবরণও দেয়া সম্ভব।

.

বাংলা অঞ্চলে ব্রিটিশ রাজের শাসনের আবহে, পৃষ্ঠপোষকতায়, প্রশ্রয়ে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠে। সমাজের ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর মধ্যে মুসলিম এলিট শাসকেরা তখন ক্ষমতাচ্যুত, বিপর্যস্ত; হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ধর্ম রক্ষাসমাজ রক্ষাজাত রক্ষায় খুব সক্রিয়; আর উদীয়মান মধ্যবিত্তের একটি অংশ কেউ ধর্মান্ধতার শৃঙ্খল পশ্চাদপদতা থেকে মুক্তির জন্য কেউ উন্নয়নের জন্য ইংরেজ শাসনের উপরই ভরসা করে আছে। এই কারণে গণবিদ্রোহের বিপরীতে তাদের অবস্থান ইংরেজ শাসকদের পক্ষেই। এর কিছু নমুনা উনিশ শতকের হাতে গোনা কয়েকটি পত্রপত্রিকায় পাওয়া যায়। বিনয় ঘোষ তাঁর ৫ খণ্ডের সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্রে সেগুলো সংকলিত করেছেন।

ইউরোপীয় পুঁজি ও ভারতীয় ঈশ্বরের সংঘাতও আমরা দেখি। রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা রদ, ঈশ্বরচন্দ্রের বিধবা বিবাহ ইত্যাদি কর্মসূচিতে ভারতের ঈশ্বর ক্রদ্ধ হন, কিন্তু ধাপে ধাপে আপোষও সংগঠিত হয়। একচেটিয়া বিশ্বপুঁজি ও ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী ঈশ্বরের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের বিকশিত রূপ আমরা পাই ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’র উদ্যোক্তা বিজেপি ও শিবসেনার মধ্যে। ২০০০ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নর্মদা বাঁধের পক্ষে রায় দেবার পর এই বাঁধ উদ্বোধন করতে গিয়ে আদভানী বলেন ভারতের তিনটি সাফল্যের কথা: পারমাণবিক বিস্ফোরণ, কারগিল যুদ্ধ এবং মানুষের প্রতিবাদের মুখে পুঁজির আগ্রহে বাঁধ নির্মাণ। আদভানী উল্লেখ করেন যারা এই বাঁধ নির্মাণে বিরোধিতা করছে দুবছর আগে তারাই পারমাণবিক পরীক্ষার বিরোধিতা করেছিল। ঠিকই, তাঁরা আবার যুদ্ধেরও বিরোধী। এই বিরোধিতাকারীদের একজন অরুন্ধতি রায় আদভানীর বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখান, কীভাবে ভারতে করপোরেট (বা পুঁজিবাদী) বিশ্বায়ন, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদ একাকার হয়ে গেছে।4 এই ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশীয় রণকৌশলে প্রধান শক্তি। দেশি বিদেশি দখলদার ও লুটেরাদের থাবায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশ এই অক্ষের অন্যতম শিকার বস্তু।

.

ল্যাটিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ঔপনিবেশিক আধিপত্য শুরু হয় উনিশ শতকেই। ১৮৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন উইলিয়াম ম্যাকিনলি। পুরনো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর জায়গা তখন ক্রমে দখল নিয়ে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অগ্রসর হচ্ছে। ফিলিপাইন এর আগে ছিল স্পেনএর উপনিবেশ। এই উপনিবেশ নিয়ে তখন বহুমুখী লড়াই। ফিলিপাইনের মানুষ চাইছে মুক্তি, স্পেন তার শাসন ধরে রাখতে চায়, ফ্রান্স জার্মানীও এর দখল নিতে মরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র তখন নবীন এবং ক্রমশ: ক্ষমতা বিস্তারে মনোযোগী বিশ্বশক্তি। কেন যুক্তরাষ্ট্র এই দখলে আগ্রহী? এর প্রেসিডেন্ট ফিলিপাইন দখল করবার কারণ বলছেন এভাবে5:

রাতের পর রাত মধ্যরাত পর্যন্ত আমি হোয়াইট হাউসের মেঝেতে হেঁটেছি। আর ভদ্রমহোদয়েরা, আপনাদের কাছে বলতে আমার লজ্জা নেই যে, একাধিক রাতে আমি হাঁটু গেড়ে বসে আলোর জন্য এবং পথনির্দেশ পাবার জন্য সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি। এবং অবশেষে একদিন গভীর রাতে এটা এল, আমি জানিনা কি করে এল, কিন্তু এল: () আমরা স্পেনএর কাছে ফিলিপাইন ফেরত দিতে পারি না একারণে যে, এটা খুব কাপুরুষোচিত আর অসম্মানজনক হবে; () আমরা এই প্রাচ্যে দ্বীপপুঞ্জ আমাদের প্রতিদ্ব›দ্বী ফ্রান্স বা জার্মানীর হাতে যেতে দিতে পারি না কারণ তা খুব বাজে ব্যবসা হবে, আমাদের স্বার্থহানিকর হবে; () আমরা এই অঞ্চল এখানকার মানুষের হাতেও ছেড়ে দিতে পারি না কারণ তারা স্বশাসনে অনুপযুক্ত, কিছুদিনের মধ্যেই তারা বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে স্পেনএর সময়কালের চাইতেও খারাপ অবস্থার সৃষ্টি করবে। কাজেই () তাদের সবাইকে নিয়ে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমাদের সামনে; ফিলিপিনোদের শিক্ষিত করা, তাদের সভ্য এবং খ্রীস্টান করা এবং ঈশ্বরের অনুগ্রহে তাদের জন্য সর্বোত্তম ব্যবস্থা করা যার জন্য খ্রীষ্ট মারা গেছেনসেটাই আমাদের একমাত্র করণীয়।

সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, দখল ও লুন্ঠনে এভাবেই বরাবর কোন না কোন ‘ঈশ্বর’ আদেশ দিয়ে গেছেন, দখলদারদের সাথে থেকেছেন।

বিশ শতকের শুরু থেকে এশিয়াতেও তার উপর্যুপরি চেষ্টা ছিল দখল বিস্তারের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এইপথে তার সকল বাধা দূরীভূত হয়, কেননা তার ইউরোপীয় প্রতিদ্ব›দ্বীরা ততদিনে সকলেই বিপর্যস্ত, ক্ষতবিক্ষত এবং নিজেদের রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং বিশ্বপুঁজির রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র তখন পুঁজিবাদী বিশ্বে একক ও অদ্বিতীয়। পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে যখন প্রতিষ্ঠিত হয় ততদিনে শুধু যে এই অঞ্চল থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়েছে তাই নয়, বিশ্ব মানচিত্রেই ঔপনিবেশিক প্রভু হিসেবে ব্রিটিশ রাজের যে সবচাইতে ক্ষমতাধর অবস্থান ছিল সেই পর্বেরও অবসান ঘটে। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্র ইউরোপ থেকে আটলান্টিক পার হয়ে উত্তর আমেরিকায় স্থিত হয়। সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার নতুন পর্বে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব নিশ্চিত হয় পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করে লক্ষ মানুষ হত্যার পর। এরপর তার ইতিহাস হত্যা ও লুন্ঠনের।

বিপ্লব উত্তর চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনামসহ পূর্ব এশিয়ায় বিপ্লবী পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রীয় আঞ্চলিক কৌশলে পাকিস্তান ছিল অন্যতম অবলম্বন। যুক্তরাষ্ট্রের বশ্য রাষ্ট্র হিসেবেই পাকিস্তানের বিকাশ, তার সামরিক শাসন, ভাঙন এবং অবশেষে তার ঘাড় ব্যবহার করে আফগানিস্তানে ধ্বংসযজ্ঞ। একাধিক ঈশ্বর এই প্রক্রিয়ায় নানাভাবে ব্যবহৃত হয়েছেন। মুখ্য ভূমিকা ছিল মার্কিনকেন্দ্রিক পুঁজির। একসময় মার্কিনী পকেটেই জন্ম নিয়েছে আল কায়েদা ও তালেবান, বর্তমানে এই দুটি নাম যুদ্ধ অর্থনীতি আর সাম্রাজ্যের বিস্তারে মার্কিনীদের প্রধান অবলম্বন ও অজুহাত। এই প্রক্রিয়ায় ফুলে ফেপে উঠছে সামরিক আর নিরাপত্তা ব্যবসা, সংকটজর্জরিত মার্কিনী নেতৃত্ব নতুন জীবন লাভের সুযোগ পেয়েছে কিন্তু ফ্যাসিবাদী আবহাওয়া বিশ্বে দমবন্ধ অবস্থার তৈরি করেছে। সাম্প্রদায়িকতা আর বর্ণবাদের লুকানো সব উপাদান পাখা খুলে উড়তে শুরু করেছে পশ্চিমা বিশ্বে। এগুলো আকস্মিক নয়, এই ধারাতেই এই সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে।

সাম্রাজ্যবাদের পর্বে পুঁজিবাদের প্রবেশের কিছুকাল পরে উপনিবেশগুলো ক্রমে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন সত্তা গঠন করলো। সূচনা হলো সাম্রাজ্যবাদের প্রবেশ করলো আরেক পর্বের। আগে তাদের যে ভূমিকা পালন করতো বন্দুক ও গুলি সেই ভূমিকা পালনে প্রতিষ্ঠিত হল বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ। উত্তর উপনিবেশ বেশিরভাগ দেশের পরিচালনা ব্যবস্থার মূল সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্রেই বাঁধা থাকলো। নানা প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নতুন বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্র ও প্রান্ত পরষ্পরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেল। এক নতুন অখন্ড জৈবিক সম্পর্ক। ঈশ্বর ভিন্ন ভিন্ন বা খন্ড খন্ড বিভক্ত হলেও পুঁজি অখন্ড এবং বৈশ্বিক।

ক্রমে নিরাকার সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আর নিরাকার সর্বশক্তিমান পুঁজির একাকারপ্রাপ্তির চেহারা এখনও অনেকের কাছে পরিষ্কার নয়। হিটলার তার বর্বরতার উপর প্রলেপ দিয়েছেন এই বলে যে, তার এই সব কাজই আসলে ঈশ্বরের কাজ। গোয়েবলস বলেছিলেন, তিনি আসলে নিমিত্ত মাত্র, তাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছেন আসলে ঈশ্বর। ২০০৪ সালে এসে বুশ বলেছেন, ‘ঈশ্বর আমাকে বলেছেন আলকায়েদার উপর আক্রমণ চালাতে আমি চালিয়েছি; এরপর তিনি আঘাত করতে বলেছেন সাদ্দামকে আমি তাও করেছি।’ যুক্তরাষ্ট্রের এটর্নী জেনারেল এশক্রফট বলেছেন ‘যুক্তরাষ্ট্রের একজনই রাজা, তিনি যীশুখ্রীষ্ট।’ এই যীশুখ্রীষ্টের রাজ্যের অন্যতম বন্ধু ইসলাম ধর্মের কেন্দ্র সৌদী আরব। ইরান সৌদী আরবকে আক্রমণ করবে এই যুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র তার কাছে বিক্রি করেছে ৯০০ কোটি ডলারের মারণাস্ত্র। যীশুর এক গালে চড় খেলে আরেক গাল পেতে দেবার বাণী অনেক আগেই পরিত্যক্ত। ‘খ্রীষ্টের রাজ্য’ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে এখন সবচাইতে বড় সন্ত্রাসী শক্তি।

সেই বুশএশক্রফট এখন রাজ্যছাড়া। সর্বশক্তিমান পুঁজির যথেচ্ছাচার তৎপরতায় ব্যবস্থার কাঠামোগত সংকট উলঙ্গ হয়ে ধ্বস নেমেছিল খোদ যুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্বব্যাপী। ব্যবস্থা রক্ষায় বর্তমান ওবামা প্রশাসন বেইলআউটসহ নানা পথে অগ্রসর হয়েছেন, নিয়ন্ত্রণহীন পুঁজিকে পথে আনতে চেষ্টা করেছেন।

.

দুনিয়ায় এখনও ঈশ্বর শক্তিশালী। নানাধর্মের নানা ঈশ্বরের সংঘাতও কম নয়। ঈশ্বরের শান্তির বাণী মুখে নিয়ে দেশের পর দেশে মানুষের জীবন ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত করার কোন কমতি নেই। কিন্তু ঈশ্বর শক্তিশালী হলেও দুনিয়া চলে পুঁজির নিয়মে। নিরাকার পুঁজির সাকার রূপ বহুজাতিক সংস্থা, তার সাক্ষাৎ প্রতিনিধি বিশ্বব্যাংক আইএমএফ, বলপ্রয়োগের জন্য সিআইএ পেন্টাগন আর সব খুনি বাহিনী, মোলায়েম প্রলেপের জন্য এনজিও। এগুলো এখন দানবের মতো সর্বত্র বিরাজমান, নদীনালা বিল সমুদ্র বন মাটি বায়ু পশু পাখি আকাশসহ মানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্র গ্রাস করেছে। গ্লোবালাইজেশনের এই বিশ্বে মানুষ ক্রমান্বয়ে পুঁজির ক্রিয়ায় বিচ্ছিন্ন হচ্ছে নিজের থেকে, নিজের শ্রম ও মেধা থেকে, পরস্পরের থেকে, নিজবসত থেকে, নিজভূমি থেকে। আবার সম্পর্কিত হচ্ছে পুঁজির নিয়মে, তার নির্দেশনায়।

বর্তমানকালে এসব ঘটনা যেহেতু ঘটে গণতন্ত্র, জনগণের কল্যাণ, দারিদ্র বিমোচন এবং ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতি’র নামে সেহেতু এই সময়ে সম্মতি উৎপাদন আগের যেকোন সময়ের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ। রাজারাজড়ার কালে ক্ষমতাবানরা যে দূরত্বে থাকতো, এখন সে তুলনায় তারা অনেক নিকটে এবং দৃশ্যমান। এই নিকট যে ইলেকট্রনিক মায়ায় বন্দী তা সহজে চোখে পড়ে না। প্রতিদিন ক্ষমতাবানদের বাণী ও চিত্র মানুষ শোনে ও দেখে। আর তাদের কথা ও সুর যাতে নিজের কথা ও সুর হিসেবে মানুষ ভাবতে শেখে সেজন্য থাকে বিশাল আয়োজন—শিক্ষা, সংস্কৃতি, এনজিও আর গণমাধ্যমের হুলস্থুল সমাবেশ। বস্তুত আমরা এখন বাস করি বিজ্ঞাপনের রাজ্যে। আমরা বেতার, টিভি, সংবাদপত্র, ইন্টারনেট, দেয়াল পোস্টার, বিলবোর্ড, ফ্যাশন শো, স্পনসরড নাটকচলচ্চিত্রগানের আসর, খেলা, চিত্রাংকন, শিক্ষামেলার মধ্যে দিয়ে দিনরাত্রি অতিক্রম করি; আসলে আমরা দেখি আর আত্মস্থ করি বিজ্ঞাপন। রবীন্দ্রনাথ, লালন, নজরুল, করিম শাহসহ নারীপুরুষ, শিশু বৃদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধ, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সবই এখন বিজ্ঞাপনের বাহন। বহু মেধাবী শিল্পী, চলচ্চিত্রকার, কবিরা তাঁদের প্রতিভার শ্রেষ্ঠ অংশটুকু ইজারা দিয়েছেন বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাছে, কোন না কোন পণ্যে ধন্য হবার জন্য মানুষকে প্ররোচিত করবার কাজে তা ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে, দেশে দেশে, সারা বিশ্বে এই বিজ্ঞাপনের মধ্যেই গড়ে উঠে এক বৈশ্বিক ভাষা, স্বাদ, আকাঙ্খা, প্রেস্টিজ বোধ।

এদের দৃষ্টিতে তারুণ্যের উদ্দামতা কিসে? অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নয়, জীবনদানে নয়, স্বাধীন জ্ঞানচর্চা মননে শ্রমনিষ্ঠ হওয়ায় নয়, সৃজনশীলতার নৈপুণ্যে নয়, প্রতিবাদী মিছিলে নয়, বোনের কিংবা বন্ধুর অপমানের প্রতিবাদ করতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নেওয়াতে নয়; তীব্র গরমে বা বর্ষায় বা শীতে দেহের সকল পেশী ও স্নায়ুর কর্মক্ষমতার অতিরিক্ত চাপ দিয়ে চাষবাস, ফসল ফলানো, নদী বা অশান্ত সমুদ্রে মাছ ধরা, বা কারখানায় পণ্য উৎপাদন, বা মানব পরিবহণ তাতেও নয়। তবে কীসে? এইকালের অহি তৈরি হয় বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে—তারুণ্যের উদ্দামতা তৈরি হয় কোকাকোলা পেপসি বা অন্যকোন বিষাক্ত পানীয় পানে, মোবাইলে অনর্গল কথা বললে, নির্ধারিত ফ্যাশন অনুসরণে, গাড়ি বাড়ির নেশায় উন্মত্ত হলে, দখল করা ফসলের জমি জলাশয় বন দখল করে বানানো এপার্টমেন্ট কিনলে, পুঁজির সেবায় সৃজনশীলতা ঢেলে দিলে, কোম্পানির সেবায় চৌকস হলেশুধু কেনা আর বেচা, বেচা আর কেনাতে, ভোগেই জীবনের সার্থকতা চিহ্নিত, প্রচারিত। তরুণের জীবনীশক্তি পাল্লা দিতে ব্যর্থ হয় বাজারের চাহিদার সাথে, ছিনতাই সন্ত্রাসে আগ্রহীদের সংখ্যা বাড়ে। তারুণ্যের কৃত্রিম জোশ আনতে কিংবা পরাজয় ভুলতে ভর করে ইয়াবা কিংবা অন্যকোন নেশায়। ভয়ংকর পুঁজি চাঙ্গা হয়।

আমাদের খেলার মাঠ, আকাশ, বৃক্ষরাজি দখল করে ভূমিদস্যুরা। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা একাংশ রাস্তায় কিংবা ভযংকর কোন কর্মক্ষেত্রে শৈশব ঢেলে দেয়। আর স্বচ্ছল অংশ? তারা ঘরের টিভি বা কম্পিউটরে অখাদ্যকে খাদ্য, মিথ্যাকে সত্য, বিষকে মধু হিসেবে শেখে, ভাবতে শেখে।

বিজ্ঞাপন হিসেবে পরিচিত নানা উপায়ের বাইরে জ্ঞানচর্চা, শিক্ষা ও সাংবাদিকতার জগতও এখন আরেক রকম বিজ্ঞাপনের বাহন। সারা দুনিয়াতেই বহুজাতিক সংস্থার এখন পণ্যের মান উন্নয়ন, নিরাপদ কর্ম পরিবেশ, প্রযুক্তি বিকাশে যত অর্থ ব্যয় হয় তার চাইতে বেশি ব্যয় হয় পিআর বা পাবলিক রিলেশনস তৎপরতায়। এর সহজ অর্থ বিষময় প্রকল্প পাশ বা পণ্য বাজার তৈরিতে সরকারী নীতি ও জনমত পক্ষে আনা। পুঁজির জাল, বিদ্যাচর্চা দখলের মধ্য দিয়ে তৈরি করে নাটবল্টু, তাদের নাম বা পরিচয় হতে পারে ‘কর্পোরেট সেনাবাহিনী’। যে বাহিনীর সদস্যদের ক্যারিয়ার সাফল্য নির্ভর করে আনুগত্য, পুঁজির ফুলে ফেঁপে উঠায় দক্ষ ভূমিকা পালন, কোম্পানির স্বার্থকে স্বপ্নে জাগরণে নিজের স্বার্থ বলে ভাবতে শেখা, আর কর্পোরেট মস্তিষ্কের ছাঁচে নিজের মস্তিষ্ক তথা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কে ক্ষমতার চাইতেও বেশি সচল রাখার উপর। কর্পোরেট সেনাবাহিনী বলতে শুধু সিইও থেকে নিম্নবেতনের কর্মী পর্যন্ত বোঝায় না। আনুষ্ঠানিক কর্মচারি না হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমলা, মন্ত্রী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, এনজিও কর্মকর্তা যে কনসালট্যান্ট, মিডিয়া পার্টনার আর লবিস্টদের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন, বিশ্বব্যাপীই যা বিস্তৃত, সেটাও এই কর্পোরেট সেনাবাহিনীর অংশ।

বর্তমানকালের সর্বশক্তিমান ঈশ্বর একচেটিয়া বিশ্ব পুঁজির শাসন নিশ্চিত করায় অস্ত্র বহনকারী সেনাবাহিনীর পাশে এই সুশীল সেনাবাহিনীও সদা সক্রিয়। এই বাহিনীই অর্থাৎ কনসালট্যান্ট, মিডিয়া পার্টনার, আর লবিস্টরাই বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্র, অর্থনীতি আর মানুষের জীবনযাপনের প্রধান নীতি নির্ধারক। মানুষ ভোট দিয়ে সরকার বানায়। আর সেই সরকার পরিচালিত হয় সর্বশক্তিমানের এইসব প্রতিনিধিদের দিয়ে, যাদের জনগণ চেনে না, সচরাচর দেখেও না। এদের দেখা যায় মন্ত্রণালয়, দূতাবাস বা বিভিন্ন সংস্থার অফিসে। সন্ধ্যার পর নিয়মিত নানা গোপন বা প্রকাশ্য আনাগোনা বা পার্টিতে এদের প্রীতি সমাবেশ ঘটে।

সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ বাঙালী মুসলমানদের রাষ্ট্র। কিন্তু সর্বশক্তিমানের বিধান অনুযায়ী এটি পুঁজির বৈশ্বিক ব্যবস্থায় প্রান্তিক একটি অঞ্চল। লুন্ঠন ও দখলের ভাগ বসানো আর নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ছাড়া সরকার এবং তার নানা বাহিনীর আর কোন ভূমিকা খুঁজে পাওয়া কঠিন। ভূমি আর ভূমির নীচের সম্পদও ক্রমান্বয়ে এসব বহুজাতিক পুঁজির দখলে নেবার চেষ্টায় প্রাণান্ত করছে কর্পোরেট সেনাবাহিনী। জনগণ এসব খুব কমই অবহিত, তাদের নির্বাচিত সংসদও কিছু জানে না। দৃশ্যমান এইসব নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান সবই যেন মায়া। আছে এবং নাই। আসল সিদ্ধান্ত ‘তার’, সবই ‘তার’ ইচ্ছা যেন।

কিন্তু মানুষ শযতানের প্ররোচনায় কেন ভুলবে? যাতে ভোলে সেজন্য বিস্তৃত আয়োজন আছে। একশো টাকা লুন্ঠনের জন্য অন্তত দুইটাকা বরাদ্দ আছে কর্পোরেট সেনাবাহিনীর অংশ কর্পোরেট ‘সুশীল সমাজ’, কনসালট্যান্ট, মিডিয়া পার্টনার, লবিস্টদের জন্য। সংসদ বা মন্ত্রীসভা এই আয়োজনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক চলে, কখনও চলে ক্রসফায়ার, কখনও জারী করে দুর্বৃত্তদের জন্য দায়মুক্তি অধ্যাদেশ।

সেইকারণে বিশেষজ্ঞ পরিচয়ে কনসালট্যান্ট বা লবিস্টরা যখন তাদের ‘এমবেডেড’ মিডিয়ার মাধ্যমে ধ্বংসকে উন্নয়ন হিসেবে মানুষের সামনে উপস্থিত করে, তথাকথিত স্টাডি রিপোর্টে সত্যকে মিথ্যা দ্বারা ঢাকে, অবিরাম সংলাপে দারিদ্র বিমোচনকে দারিদ্র সৃষ্টির বন্দোবস্ত দ্বারা পরিচালিত করে, তখন তা বিজ্ঞাপনেরই আরেকটি রূপ নেয়। উদ্দেশ্য অভিন্ন: ‘সম্মতি উৎপাদন’।

.

পুঁজিবাদের যে অর্থশাস্ত্র এখন বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করে আছে, তা ভাববাদী দর্শনের ওপর ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে। এজন্য অনেক ক্ষেত্রে তার কট্টর বা মৌলবাদী চেহারাও সৃষ্টি হয়। এই অর্থশাস্ত্র খুবই উদ্দেশ্যমূলকভাবে, সুনির্দিষ্ট শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করতেই একটা নিয়তিবাদের মধ্যে মানুষকে আটকে রাখার চেষ্টা করে। এই অর্থশাস্ত্র মানুষকে শেখাতে চেষ্টা করে, যা কিছু ঘটছে চারিদিকে, এটা এমন একটা শক্তি দ্বারা ঘটছে, তা এক অদৃশ্য শক্তি, সর্বশক্তিমান, সেটা হলোবাজার। এর ওপর কারও হাত নেই, কিছুু করার নেই, কিছু করতে গেলেই অনিষ্ট হবে, মেনে নিতে হবে সবকিছু। ‘ইনভিজিবল হ্যান্ড’, এডাম স্মিথ বলেছেন। এই অদৃশ্য শক্তিতে মানুষের ভ’মিকা শূণ্য। আমরা যদি নিষ্ক্রিয় থাকার পরামর্শ উপেক্ষা করে বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করি তাহলে আমরা এই অদৃশ্য শক্তির পেছনে পাবো পুঁজি। হ্যাঁ, পুঁজি তার গতি অনুযায়ী কাজ করছে। একটা নিরাকার শক্তি হিসেবে আমরা ঈশ্বরের কথাও ভাবি, কিন্তু অর্থনীতিতে আমরা নিরাকার শাসক যদি খুঁজতে যাই, সেটা হচ্ছে এই পুঁজি। যে নিরাকারভাবে শাসন করছে এবং কতিপয়ের স্বার্থে মানুষের পৃথিবী বিপর্যস্ত করছে। বর্তমান বিশ্বের সবচাইতে সচল ঈশ্বর হলো এই পুঁজি।

যে অর্থশাস্ত্র আমাদের শেখানো হয়, সেই অর্থশাস্ত্র মুখে স্বীকার না করলেও, একটি নির্দিষ্ট দর্শন দ্বারাই পরিচালিত হয়। এই অর্থশাস্ত্রের দর্শন অনুযায়ী, এই পুঁজিবাদ, যাকে ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতি’ নামে সাধারণত অভিহিত করা হয় সেটাই শেষ কথা। এই বিশ্বাস অনুযায়ী, মানুষের মধ্যকার ব্যক্তি স্বার্থের উন্মাদনা, মানুষের মধ্যে হিং¯্র প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ, সংঘাত, ধ্বংস কিংবা মানুষের মধ্যেকার মানবিক সম্পর্কগুলোর ক্ষয় ইত্যাদি অবধারিত। এই ব্যাপারে মানুষের করার কিছু নাই। এর মধ্যেই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। এটাই হচ্ছে মানুষের নিয়তি। অতএব, এটাই হচ্ছে ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’।

এই নিয়তিবাদিতার ওপর ভর করে ক্ষমতাবানরা দাঁড়ায় আর নিজেদের সম্পর্কে দাবি করতে থাকে, তাদের সকল বক্তব্যই বস্তুনিষ্ঠ এবং বৈজ্ঞানিক। তারা আমাদের বোঝাতে চায় যে, এটাই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। বৈজ্ঞানিক ভাবে তারা ধ্বংসাতœক অমানবিক কিংবা নিয়তিবাদী হতে শেখায়! আমরা যদি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম পরিচালক বিশ্বব্যাংক কিংবা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার সর্দার মার্কিন প্রশাসনের লেখাকথাবার্তা খেয়াল করি, তাহলে দেখবো, তারা এই কাজই করে নানা বাগাড়ম্বরের আড়ালে। আমাদের দেশে তাদের সুরে সুর মেলানো ‘বিশেষজ্ঞ’ কনসালট্যান্টরাও বর্তমান যে বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে আমরা বসবাস করি, তাকেই মহিমান্বিত করবার চেষ্টায় সর্বতোভাবে নিয়োজিত।

সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’র যে যন্তরমন্তর ঘর, সেটা ইতিহাসের সব পর্বেই পাওয়া যায়। যন্তর মন্তর ঘরে প্রবেশ করিয়ে দার্শনিক, জ্ঞানী বা বিজ্ঞানী, লেখক কবি শিল্পীকে রাজদরবারের অনুগত বানানোর চেষ্টা, ইতিহাসের সমস্ত পর্বে, সমস্ত রাষ্ট্র ক্ষমতার পর্বেই আমরা দেখি। এটা সামন্তবাদী ব্যবস্থা পর্যন্ত, রাজতন্ত্র পর্যন্ত যতো স্পষ্ট ছিলো, যতো প্রত্যক্ষ ও বলপ্রয়োগের ব্যাপার ছিলো, পুঁজিবাদের মধ্যে ততোটা নয়। পুঁজিবাদের মধ্যে যাকে আমাদের মুক্ত মনে হয়, স্বাধীন বিজ্ঞানী বা দার্শনিক মনে হয়, তারা আর কোন রাজদরবারের সাথে নাই, সরকারেরও বিরোধিতা করছে হয়তো, কিন্তু খেয়াল করলে সেই লেখক বিজ্ঞানী দার্শনিকের পরাধীন ভূমিকাটাই আমরা দেখতে পাই। পুঁজিবাদের শাসনের ধরন রাজদরবার বা রাষ্ট্রক্ষমতার মতো সবসময় প্রত্যক্ষ জোরজুলুম দিয়ে চলে না, কারণ পুঁজির শাসন হচ্ছে নিরাকার। সাকার কিছু প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এখনকার শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়, কিন্তু মূল শাসনটা হচ্ছে নিরাকার পুঁজির। সুতরাং পুঁজি যখন শাসন করে, পুঁজির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা শৃঙ্খলিত যে থাকে সে আপাতঃদৃষ্টিতে কোন রাজদরবারের অংশীদার নাও হতে পারে, কিন্তু তার যে ভূমিকা, সে ভূমিকা কোন না কোন ভাবে পুঁজির কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে পর্যায়ে আমরা বসবাস করি, তাতে পৃথিবীর সাতশো কোটি মানুষের কারও কোন ধরনের খাদ্যহীন, বস্ত্রহীন কিংবা শিক্ষাহীন বা চিকিৎসাহীন থাকার কথা নয়। কারণ বিজ্ঞানের প্রযুক্তির যে অগ্রগতি হয়েছে, তার যে সম্ভাবনা এবং দক্ষতা তৈরী হয়েছে, সেটা ব্যবহার করলে প্রায় বিনা পয়সায়, মানুষের খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, আশ্রয়, বস্ত্র, যোগাযোগসহ সব চাহিদা মেটানো সম্ভব। এখনও পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ বিদ্যুতের সুফল পায়নি। খুব কম খরচে, পরিবেশ সম্মতভাবে এই সমস্যা সমাধানের বহু পথ আছে। কিন্তু পুঁজির মুনাফার নিশ্চয়তা দিতে গিয়ে এসব পথ ও সম্ভাবনা কার্যকর হয় না। মুনাফা নিশ্চিত রাখতে গিয়ে অনেক আবিষ্কারও গায়েব করে দেয়া হয়। কৃত্রিম সংকট, ঘাটতি প্রকৃতপক্ষে পুঁজির মুনাফার ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য। উল্টো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে মানুষের বিরুদ্ধে যতোরকম নিপীড়ন, আধিপত্য ও বৈষম্য বিস্তারের কাজে। বর্তমানে খুবই প্রবল ক্ষমতাধর শক্তিকে এক কথায় বলা যায়, ‘মিলিটারী ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স’। বিভিন্ন ধরনের মিলিটারী হার্ডওয়্যার, মানবপ্রকৃতিধ্বংসী সামরিক আয়োজন আর তার সহযোগী বিজ্ঞান সমাজবিজ্ঞান মিডিয়া তৎপরতা। ইরাক মানববিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করেছে এই অজুহাতে সেখানে ধ্বংসযজ্ঞ করলো যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এর চাইতে বহু বহু গুণ বিধ্বংসী অস্ত্রশস্ত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উৎপাদন করছে। বিশ্বে সমরাস্ত্র গবেষণা এবং সমরাস্ত্র সংক্রান্ত যা কিছু রয়েছে তার কেন্দ্রে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

বাণিজ্যিক শিক্ষা ও চিকিৎসার এই জাল সারা বিশ্বে ব্যাপক আকার নিয়েছে। বাণিজ্যিক চিকিৎসার সাথে যুক্ত ইনস্যুরেন্স ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীর বাণিজ্য, যুক্ত চিকিৎসা বিজ্ঞান ফার্মেসী রসায়ন জীববিদ্যা গবেষণা। ওষূধ কোম্পানি এমন কোন গবেষণা করার জন্য অর্থ বরাদ্দ দেবে না যেটা তার ওষুধের ব্যবসা সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধক। দীর্ঘমেয়াদী মুনাফার জন্য হুমকি হতে পারে এরকম কোন ওষুধ বাজারে আসুক সেটাও তারা চাইবেনা। এমন ওষুধই তারা বাজারজাত করবে যেখানে তার মুনাফা সর্বোচচ হবে।

পাশাপাশি আমরা যদি কৃষিক্ষেত্রে তাকাই সেখানে দেখবো গবেষণার মূল লক্ষ্য বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য ও মুনাফা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় কনসালটেন্সি, জেনেটিক কোডিং ইত্যাদি। এসবই কিন্তু বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তার সাথে যোগ হয় দেশে দেশে তাদের উপযোগী কৃষি নীতি, পানিনীতির জাল তৈরি। যদি খেয়াল করি সবুজ বিপ্লব এর অভিজ্ঞতা, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির বীজের সাথে ঢুকছে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, যান্ত্রিক সেচ ইত্যাদি। শুধু আমাদের দেশে নয় সারা বিশ্বের অনেক দেশে। সার, কীটনাশক, এবং গভীর নলকূপ সারাবিশ্বেই মাটি, পানি এবং কৃষি ব্যবস্থার মধ্যেকার প্রতিবেশগত ভারসাম্য বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। বহুমাত্রিক ক্ষতি আমাদের ওপর বোঝা হয়ে ওঠেছে।

প্রচলিত মুনাফানির্ভর বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে একটা ধর ধর মার মার কাট কাট দৃষ্টিভঙ্গী আছে। কৃষি উন্নয়ন করতে পানি মাটি মানুষের যাইহোক, বীজসহ প্যাকেজ নিতে হবে, অসুখ হলে বিপুল পরিমাণ ওষুধ খেতে হবে, অস্ত্রোপ্রচার করতে হবে, ফলাফল যাই হোক না কেন। রক্ত থেকে শুরু করে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবসা এখন খুবই লাভজনক ব্যবসা। যার প্রধান শিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্বের নারীশিশু। মাদক বাণিজ্যের মতোই নারীশিশু পাচার বর্তমান বিশ্বে একটি অন্যতম অর্থনৈতিক তৎপরতা। এর মধ্যে একটা অংশ পতিতাবৃত্তিতে, অন্য একটি অংশ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবসায় ব্যবহৃত হয়।

আগেও বলেছি, এই যে কৃষি, চিকিৎসা, প্রকৃতি সমস্ত ক্ষেত্রে পুঁজির আগ্রাসী দাপট তাকে বৈধতা দেয় মিডিয়া, গবেষক; আর পুঁজির পক্ষে দর্শন ও চিন্তার আধিপত্য। এরা বলে যে, খাদ্য সংকট সমাধানের এছাড়া আর কোন পথ নেই। আমাদের এখানে যে বিভিন্ন জাতের ধান ছিল, সেগুলোর যে উৎপাদন ক্ষমতা ছিলো, সেই উৎপাদন ক্ষমতা সেই জাতগুলো বহাল রেখে বাড়ানো যায় কিনা এ বিষয়ে গবেষণা হয়েছে খুবই কম। প্রয়োজনীয় গবেষণা হলে আমাদের বীজের বৈচিত্রময় জাতগুলোর উৎপাদনশীলতা বহুগুণ বৃদ্ধি করা যেতো। কোন খরচবৃদ্ধি না করে, মাটি, পানি, পরিবেশ কোন কিছু নষ্ট না করেও উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব ছিল।

অর্থাৎ যে জ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক বলা হচ্ছে, সেটা মানুষের জন্য কী ফলাফল আনবে তা নির্ভর করছে তার পেছনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মতাদর্শিক শক্তির ওপর। বাংলাদেশে এবং পৃথিবীব্যাপী বিজ্ঞানের যে ভূমিকা/ব্যবহার এখন দেখা যাচ্ছে তা প্রধানত মানুষ ও প্রকৃতি বিনাশী পুঁজির অধীনস্ত, তার দর্শন দ্বারা পুষ্ট। ফলে মানুষের ক্ষমতা, মানুষের জ্ঞান, বিজ্ঞানটাই আমাদের বিরুদ্ধে বিধ্বংসী রূপে হাজির হয়। যে টেলিভিশন মানুষে মানুষে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হতে পারতো সেটা আজ আমাদেরকে ক্রমান্নয়ে বিচ্ছিন্ন এবং স্বার্থপর, উম্মাদ, হিংস্র, অশ্লীল, বিধ্বংসী করে তুলছে। এমনকি শিশুকাল থেকেই সন্ত্রাসপ্রেমী, ভোগে আসক্ত করবার চেষ্টা চলে। আচ্ছন্ন মাবাবাই শিশুকে খেলনা হিসেবে বন্দুক কিনে দেয়, ক্ষতিকর খাদ্য, পানীয় ইত্যাদি হয়ে ওঠে জীবনের লক্ষ্য। ভোগবাদিতা আর নিয়তিবাদিতা হয়ে ওঠে জীবনের প্রধান পরিচয়।

সর্বশেষ প্রযুক্তি ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বের সকল অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যোগাযোগের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা চিকিৎসায় ভারসাম্য আনার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা অভূতপূর্ব। কিন্তু আমরা দেখতে পাই ফটকাবাজারী ব্যবসা, প্রতারণা, অপরাধ, যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের পক্ষে জনমত তৈরি, পর্ণোগ্রাফি ইত্যাদি কাজেই এই প্রযুক্তির ব্যবহার সবচেয়ে বেশী। এর মধ্যে আরও ভয়াবহ হচ্ছে শিশু পর্ণগ্রাফি, ধর্ষণ সাইট। বাজার অর্থনীতি অনুযায়ী ব্যক্তি স্বার্থ চূড়ান্তকরণ বা ব্যক্তি স্বার্থ ব্যবহার করার যে সমস্ত তত্ত্ব ধারণা চিন্তা অর্থের জন্য উন্মাদনা তৈরি করেছে এটা তারই একটি খন্ড চিত্র।

.

আমাদের চারপাশের জগৎ, আমাদের আত্মসত্তা, অনেকটাই আমাদের জানার বাইরে। মানুষের জানার সীমা সম্প্রসারিত হয়েছে, আগের চাইতে জানার পরিধি এখন অনেক বেশি। কিন্তু অজানার সীমাই আমাদের অজানা, এমনকি নিজসত্তার ভেতর বাহিরও। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ যেমন আমাদের জানার সম্ভাবনা সম্প্রসারিত করেছে, তেমনি তা জ্ঞানের উপর জানার উপর কতিপয়ের নিয়ন্ত্রণ জারীর বিদ্যমান ব্যবস্থায় অসহায়ত্বও বাড়িয়ে দিয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের। সেই জানাঅজানার আধারকে অধিকতর দুর্জ্ঞেয় করে তোলায় পুঁজির বিশেষ আগ্রহ। জানা ও অজানার জগতকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে পুঁজির পক্ষে নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ জীবিতের চেতন ও অচেতন যথেষ্ট মাত্রায় মুচড়ে দেবার ক্ষমতা নিশ্চিত করা ছাড়া জীবিতের উপর মৃত তার কর্তৃত্ব আরোপ করতে পারে না। ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতি’র নামে কতিপয়ের শৃঙ্খলে আবদ্ধ শাসনব্যবস্থাই পুঁজির আরাধ্য। মুনাফার উন্মাদনায় পুঁজির মালিকেরাও অনিশ্চিত পথে পা বাড়ায়। আরও মুনাফার প্রাপ্তি, অনিশ্চয়তা, প্রতিযোগিতার নির্মমতা সবই মালিককেও সর্বদা অস্থির রাখে। তার জন্যেও অপরিহার্য হয়ে উঠে ঐশী সর্বশক্তিমানের সমর্থন।

কিন্তু মানুষ কেন মেনে নেয় এই শৃঙ্খল? এই প্রশ্নের সাথে এই প্রশ্নও করা যায় যে, মানুষ কেন হাজার বছর মেনে নিয়েছে কতিপয় প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব, কিংবা মেনে নিয়েছে নিষ্ঠুর সাম্রাজ্যের শাসন যখন শাসকেরা বলেছে এটাই ঈশ্বরের নির্দেশ? শুধুই কি বলপ্রয়োগ? বলপ্রয়োগ অবশ্যই ছিল। কিন্তু তার চাইতেও ক্ষমতাধর ছিল মানুষের চেতন ও অচেতনকে দখল করা। সংক্ষেপে যার নাম ‘সম্মতি উৎপাদন’। তবে এটাও ঠিক এবং এটাই আমাদের সাহস যোগায় যে, ইতিহাসের কোনো কোনো বাঁকে বলপ্রয়োগ বা সম্মতি আদায় কোনটিই কাজ করেনি। তখন ভেঙে পড়েছে পুরনো বিন্যাস, ভেঙে পড়েছেন পুরনো ঈশ্বরও। কিন্তু যতদিন তা হয়নি ততদিন সম্মতি উৎপাদনে ঈশ্বর খুব শক্তিশালী অবলম্বন ছিলেন। বর্তমানে সেই অবলম্বন আগের মতো কার্যকর নয়। এখন পুঁজির মধ্য দিয়ে আবির্ভূত নতুন ঈশ্বর মানুষকে দখল করে আরও নতুন নতুন উপায়ে। এসব উপায়ের মধ্যে আছে এমন সব প্রযুক্তি বা মাধ্যম যেগুলো মানুষই আবিষ্কার করেছিল ঈশ্বরের কথিত বিধি বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।

নিজের জ্ঞানের সীমা সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সাথে মানুষের সংঘাত হল, মানুষ তার ভাব, সৃজনশীলতা আর প্রশ্নের শক্তি নিয়ে ঈশ্বরের দাপট অতিক্রম করলো। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ দ্রুততর হল। তার মধ্যে আজ আমরা এমন পর্যায়ে যখন মানুষের ক্রম আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক বিকাশ হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সকল মানুষের কাছে এখন পৌঁছে যাওয়া সম্ভব শারীরিক যোগাযোগ ব্যতিরেকেই। মহাবিশ্বেরও অনেককিছু মানুষের জানার মধ্যে। তথ্য প্রযুক্তিসহ আরও বহুক্ষেত্রে মানুষের নানা আবিষ্কারের পরিস্থিতি এমন যে, বিশ্বের সকল জাতি ধর্ম ভাষা ও অঞ্চলের মানুষদের পরষ্পর যোগাযোগ, সংহতি এবং ঐক্য এখন বস্তুগতভাবেই সম্ভব। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব তা থেকে অনেক দূরে। পুঁজির উপনিবেশ এখন সারাবিশ্ব।

১০.

বিশ্বের সকল অঞ্চল একরকম নয়, কোথাও মানুষ বেশি কোথাও কম, কোথাও খাদ্য উৎপাদন বেশি কোথাও কম, কোথাও তেল গ্যাস কয়লাসহ খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য আছে, কোথাও তা একেবারেই নেই, কোথাও সুপেয় পানির প্রাচুর্য আছে কোথাও তা দুর্লভ, অবস্থানগত তারতম্যের কারণে ফসলের বৈচিত্র আছে, কোথাও জমির অভাব কোথাও জমি অব্যবহৃত পড়ে আছে। এরকম বিশ্বকে আমরা অসম বলতে পারি, বৈচিত্রময়ও বলতে পারি। বিশ্বের বৈচিত্রময় স্থানিক বৈশিষ্ট্য বৈচিত্রময় সুযোগ, সংস্কৃতি, সক্ষমতা তৈরি করে।

যদি এই বৈচিত্রময় কিংবা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়, যদি যেখানে যা উদ্বৃত্ত আছে তা ঘাটতি এলাকায় ঠিকমতো যেতে পারে, যদি জ্ঞান দক্ষতা সংস্কৃতির পারস্পরিক যোগসূত্র তৈরী হয়, যদি বৈচিত্রময় বিশ্ব বৈষম্যময় বিশ্ব হিসেবে টিকে থাকার রাজনৈতিকঅর্থনৈতিক বিধিব্যবস্থার অবসান ঘটে তাহলে বিশ্বের মানুষ সমৃদ্ধ সভ্যতার স্বাদ পেতে পারে। মানুষেরা মানুষ হিসেবে আলাদা বেঁচে থাকতে পারে না, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার শর্ত পূরণ করতে হলে প্রকৃতি, প্রাণবৈচিত্র, পশুপাখিবনবৃক্ষপানিবাতাস জগতও অনুকূল থাকতে হবে। পুঁজি শুধু মানুষকে দখল করেনি, তা বিপর্যস্ত করেছে অসংখ্য প্রাণের সমাবেশ প্রকৃতিকে।

মানুষের সভ্যতা সম্ভব, সম্ভব মানুষের ইতিহাসে প্রবেশ। কিন্তু মৃতের আধিপত্য, পুঁজি কিংবা ঈশ্বরের ভৌতিক ক্ষমতা যখন মানুষের সকল ক্ষমতাকে তার নিজের ক্ষমতা হিসেবে কেন্দ্রীভূত করে রাখে তখন সম্পদ, দক্ষতা, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব দরিদ্র, বঞ্চিত, নিগৃহীত, সম্পদহীন, ক্লিষ্ট মানুষের দ্বারা চিহ্নিত হয়। প্রযুক্তি শৃঙ্খলিত। বিজ্ঞান বন্দী। মিডিয়া কেন্দ্রীভূত, পুঁজির নাটবল্টু উৎপাদন উপযোগী করে শিক্ষা বিন্যস্ত। পুঁজির ভৌতিক ক্ষমতা দ্বারা সম্মতি উৎপাদনের সংস্কৃতি নির্মাণের অবিরাম অপচেষ্টা জোরদার।

পুঁজির একাধিপত্যের এই উন্নয়ন দর্শনের সাথে লড়াই না করে উপনিবেশীকরণ থেকে মুক্তির বা জীবনের ভয়ংকর চেহারা থেকে বাঁচার পথ নাই। মানুষের হাতে যে ক্ষমতা এসেছে সেই ক্ষমতাকে সামষ্টিক স্বার্থে কাজে লাগানোটাই আমাদের বাঁচার এবং সবাইকে নিয়ে বিকশিত জীবনে বাঁচার একমাত্র পথ। মতাদর্শিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং একই সাথে নিজের ক্ষমতা সম্পর্কিত চেতনাকে বিকশিত করা হলো এই সামষ্টিক ভূমিকার অন্যতম অংশ।

একজন মুক্তদৃষ্টির মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব যে, দুনিয়া সব ‘তার’ ইচ্ছায় চলে না। নিপীড়ক ক্ষমতার সঙ্গে চিন্তা ও প্রত্যক্ষ সংঘাতে নতুন ক্ষমতার উদ্ভব হয়। জীবন্ত মানুষ জীবন্ত হয়, আচ্ছাদন সরিয়ে সত্যকে দেখে; নিজের উপলব্ধি আর শক্তি দিয়ে ক্ষমতার উপর পাল্টা দখল নেয়। বিশ্বব্যাপী মানুষ বারবার লড়াইয়ে ফিরে আসে নিজের সম্পদ ও জীবন নিজের কাছে ফিরিয়ে আনতে। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে যখন মানুষ দাঁড়ায় তখন সে বিদ্যমান আধিপত্য অস্বীকার করছে, তার তখন মুক্তদশা, তার সৃষ্টিশীল ক্ষমতারই বিকাশ ঘটে তখন। নিজের সত্তার বিউপনিবেশীকরণ সমষ্টির মুক্তির পথ নির্মাণ করে। নিজে মুক্ত হয়ে বিকশিত করে সামষ্টিক মুক্তির সম্ভাবনা।

এই বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত আমার কয়েকটি বই:

বিশ্ব পুঁজিবাদ ও বাংলাদেশের অনুন্নয়ন, করিম প্রকাশনী। ঢাকা, ১৯৮৩। ২য় সংস্করণ: সংহতি প্রকাশন, ২০০৭।
বাংলাদেশের উন্নয়ন সংকট এবং এনজিও মডেল, প্রচিন্তা প্রকাশনী। ঢাকা, ১৯৮৮, ২য় সংস্করণ, ২০০০।
ক্রান্তিকালীন বিশ্ব অর্থনীতি ও উন্নয়ন সাম্রাজ্য, বস্তু প্রকাশন। ঢাকা, ১৯৯২। ২য় সংস্করণ: মীরা প্রকাশনী, ২০০১।
পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ ও অনুন্নত বিশ্ব, সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯৩। শ্রাবণ, ২০০৬।
নারী, পুরুষ ও সমাজ, সন্দেশ। ঢাকা, ১৯৯৭। ২য় সংস্করণ: ২০০৫। ৩য় সংস্করণ: সংহতি প্রকাশন, ২০১২।
বাংলাদেশের অর্থনীতির চালচিত্র, শ্রাবণ প্রকাশনী। ঢাকা, ২০০০।
আতঙ্কের সমাজ সন্ত্রাসের অর্থনীতি, মীরা প্রকাশন। ঢাকা, ২০০১।
বিশ্বায়নের বৈপরীত্য: শ্রাবণ, ২০০৩ (২য় সংস্করণ)। শ্রাবণ, ২০০৭।
বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিমুখ, শ্রাবণ প্রকাশনী। ঢাকা, ২০০৫।
উন্নয়নের রাজনীতি, সূচীপত্র। ঢাকা, ২০০৬।
কোথায় যাচ্ছে বাংলাদেশ?, সংহতি। ঢাকা, ২০০৮
অরক্ষিত মানুষ অরক্ষিত দেশ, এডর্ণ। ঢাকা, ২০০৯
Development or Destruction, Essays on Global Hegemony, Corporate Grabbing and Bangladesh, Srabon, 2007
পুঁজির অন্তর্গত প্রবণতা: মানুষ, সম্পদ, প্রকৃতি, সংহতি প্রকাশন। ঢাকা ২০১০।
ঈশ্বর পুঁজি ও মানুষ, মাওলা ব্রাদার্স। ঢাকা, ২০১৪।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতপ্রশ্ন, নবরাগ প্রকাশনী। ২০১৫।
আমরা ৯৯%, মানুষজন প্রকাশনী। ২০১৫

  1. এসব সংস্থার নেতৃত্বে তথাকথিত বিদেশি সাহায্যের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে দারিদ্র্য দূর ও উন্নয়নের নামে কীভাবে দখল ও লুন্ঠনের বিভিন্ন নীতি ও প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে তার কিছু প্রামাণ্য বিবরণ পাওয়া যাবে গত একদশকে প্রকাশিত জন পারকিনস এর কনফেশনস অব ইকনমিক হিটম্যান (২০০৪)দ্য সিক্রেট হিস্ট্রি অব দ্য আমেরিকান এম্পায়ার (২০০৭) এবং নাওমী ক্লেইন এর শক ডক্ট্রিন: দ্য রাইজ অব ডিসাস্টার ক্যাপিটালিজম (২০০৮) গ্রন্থগুলোতে।[]
  2. বিশ শতকের শুরুতেই এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পথনির্দেশক কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। J A Hobson: Imperialism A Study, 1902; Hilferding: Finance Capital, 1908; Rosa Luxemburg: Accumulation of Capital, 1913; Lenin: Imperialism The highest stage of Capitalism, 1916.[]
  3. এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য পাঠক আমার পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ…দেখতে পারেন।[]
  4. A Film with Arundhati, 2006[]
  5. এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট-এর ভাষ্য উদ্ধৃতি করেছেন উইলিয়াম ব্লুম তাঁর কিলিং হোপ (২০০৩) এ। এই বিষয়ে আরও আলোচনা আছে আমার কোথায় যাচ্ছে বাংলাদেশ গ্রন্থে। কিলিং হোপ গ্রন্থে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী তৎপরতার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যাবে।[]
Scroll to Top