১. প্রস্তাবনা
গত ১৫ মার্চ ২০১৫ স্টার প্লাস চ্যানেলে জিমা (এওগঅ) এওয়ার্ড অনুষ্ঠানে একটি বিভাগ দেখলাম ফোক সং। এ বিভাগে একজন শিল্পীকে রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবামের জন্য পুরষ্কৃত করা হল। গত বছরও ফোক বিভাগে রবীন্দ্রসংগীতের জন্য পুরষ্কার দেয়া হয়। আমি এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ দেখিনি। যদিও ভারতসহ আমাদের অঞ্চলে উত্তর–ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বিউপনিবেশকরণের চর্চা একাডেমি থেকে শুরু করে নানান স্তরের জ্ঞানতাত্ত্বিক অনুশীলনে চর্চিত হতে দেখছি। তাহলে প্রশ্ন হল কেন প্রতিরোধ তৈরি হয় না? এর কারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে যে,
১. আমদানি করা বিপ্লবী তত্ত্বের তত্ত্বায়ন ও পরজীবি উদাহরণ সহযোগে আহার এবং
২. কাউন্টার ডিসকোর্স হিসেবে অনুশীলনের অভাব
এর ফলাফল হিসেবে উপনিবেশের জ্ঞানতাত্ত্বিক হেজিমনি আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে যা আজকের ব্রিটিশ–উত্তর ভারতের জাতীয় টেলিভিশনে প্রচারিত জাতীয়ভাবে দেয়া অনুষ্ঠানে পুনরাবৃত্তি করা হয়। কারণ উপনিবেশ একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক বিভাজন–রেখা তৈরি করে ‘নিজ’ এবং ‘অপরে’র দূরত্বসীমা নির্ধারণের মাধ্যমে। ব্রিটিশ কর্তৃক কৃত সকল কর্মই আধুনিক এবং বিজ্ঞানসম্মত। আর ব্রিটিশপূর্ব সবকিছুই প্রাগাধুনিক এবং বর্বরোচিত। আলোকময়তা উত্তর পশ্চিম জ্ঞানতাত্ত্বিক বিভাজন–রেখা সমুন্নত রাখার জন্য এ বাইনারি অপজিশন / বিপরীত জোড়ের প্রকল্পটি সবসময়ই কার্যকর রাখে। ঔপনিবেশিকতা আধুনিক–জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয়ের মানকে নির্ধারণের বেশ কিছু পদ্ধতিগত বিধি–ব্যবস্থা স্থির করে। এ বিধি–ব্যবস্থার পূর্বশর্ত ছিল, একটি বৈশ্বিক মান নির্ধারণ করা। আধুনিকতা এ বৈশ্বিক মানের কেন্দ্রে অবস্থান করে। উন্নয়ন–অগ্রগতি নির্ধারণের প্রধান ভূমিকা পালন করে। মিল ইতিহাস চেতনায় উন্নয়নকে কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। আমরা অপরত্ব নির্মাণের বিপরীত জোড়ের শব্দবন্ধনীর ভেতর নিজেদের স্থাপন করি শিক্ষিত/অশিক্ষিত, অসভ্য/সভ্য, আদিম/আধুনিক, ফাইন আর্টস/ইন্ডিয়ান আর্টস, পল্লি বা লোক/আধুনিক প্রভৃতি। আজকের আধিপত্যবাদী হিন্দী ভাষা সমর্থিত সংস্কৃতির চর্চাকারীগণ নিজেদের আধুনিক হিসেবে সুপেরিয়র ধরে অপরাপর ভাষাগোষ্ঠীর গানকে ফোক হিসেবে চিহ্নিত করছে। যে স্তরে রাগ–রাগিনীর আধিক্য বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে তাকে ক্লাসিক্যাল সংগীত ভুক্ত করে থাকেন ভারতের বর্তমানের কর্তাব্যক্তিগণ। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা জরুরী যে, এ কর্তাব্যক্তিগণ সবাই জন্মসূত্রে বা হিন্দী ভাষা অধ্যূষিত অঞ্চলে বেড়ে ওঠার ভেতর থেকে অন্তর্ভূক্ত হননি। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অধিপতিশীল স্তরে কাজের ভেতর থেকে ‘টিম ইন্ডিয়া’–এ পরিণত হয়েছেন।
অর্থাৎ উপনিবেশ–উত্তর সময়েও উপনিবেশের জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রকল্প সমভাবে সচল। কারণ আজও পর্যন্ত আমরা উপনিবেশের শিক্ষাকাঠামোর মাঝেই রয়ে গেছি। ১৯ শতকের আধুনিকতার সারসত্তাকে সমভাবে অনুসরণ করে চলেছি। তাই বর্তমান সময়কে উপনিবেশ–উত্তর ঔপনিবেশিক অবস্থা হিসেবে আমি চিহ্নিত করছি। এই উত্তর–ঔপনিবেশিক অবস্থাকে নাটকের ক্ষেত্রে আল দীন বলেছেন, ‘পরজীবী নাট্যচর্চা’। পরজীবী অবস্থা প্রাচ্যের দেশগুলোতে সকল ক্ষেত্রে সক্রিয় বিধায় তালাল আসাদ একে আধুনিকতার প্রকল্প হিসেবে উল্লেখ করেছেন। লর্ড কার্জন, উপনিবেশিতদের লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘প্রাচ্যরা রাজ্যের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র’৮। অর্থাৎ একে যত ইচ্ছে যেমন ইচ্ছে রূপদান করা সম্ভব। কারণ প্রাচ্যের জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোটি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ প্রকল্পের অধীনে আধুনিক প্রকল্প জারি করে প্রান্তীয় এজেন্ডা সম্পূর্ণ করা হয়েছে। প্রাচ্যের মানুষ নিজেকে মনে করে ইউরো–কেন্দ্রিক সভ্যতার একটি প্রান্তীয় ব্যাপন হিশেবে। ঔপনিবেশিক শাসক চলে গেছে কিন্তু ব্যবস্থা এমনভাবে পোক্ত করে গেছে যে, আমরা তাদের জন্য এক নিরবচ্ছিন্ন ভোক্তায় পরিণত হয়েছি।
এর একটি সরস উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে বাংলাদেশের প্রভাবশালি ইংরেজি দৈনিক ‘দি ডেইলি স্টার’–এর পৃষ্ঠপোষকতায় ‘হে ফেস্টিভেল’ এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়: ইউল্যাব ও ইংরেজি দৈনিক ‘ঢাকা ট্রিবিউন’–এর পৃষ্ঠপোষকতায় ‘বেঙ্গল লাইটস’। আজকে ঔপনিবেশিক শক্তি চলে গেলেও তাঁর জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্যবাদরে মধ্য থেকে নানা ধরণের ভূঁত আমরা আবার দেখা শুরু করেছি। এসব ভৌতকি রচনাসমূহ স্বভাবতই ইংরেজি সাহিত্যের সরাসরি অনুকরণ সমৃদ্ধ হচ্ছিল। আজকে এসব ভূঁত এখন আর্ন্তুজাতকিতার নামে মাল্টিকাচারালইজমের নামে সক্রিয় হয়ে উঠছে। রবীন্দ্রনাথের কালেও এরকম ইংরেজি পালক লাগানো অভিজাতদের ভীড় লেগেছিল একই কান্নাকাটিতে। তাই তিনি বলেছেন,
ইংরেজ অভিমানী মাতৃভাষাদ্বেষী বাঙালির ছেলেকে আমরা দোষ দিতে চাহি না। ইংরেজির প্রতি এই উৎকট পক্ষপাত স্বাভাবিক। কারণ, ইংরেজি ভাষাটা একে রাজার ঘররে মেয়ে, তাহাতে আবার তিনি আমাদের দ্বিতীয় পক্ষের সংসার, তাঁহার আদর যে অত্যন্ত বেশি হইবে তাহাতে বিচিত্র নাই। তাঁহার যমেন রূপ তেমনি ঐশ্বর্য, আবার তাঁহার সম্পর্কে আমাদের রাজপুত্রদের ঘরেও আমরা কিঞ্চিৎ সম্মান প্রত্যাশা রাখি। আমাদের হতভাগিনী প্রথম পক্ষটি আমাদের দরিদ্র বাংলা ভাষা, পাকশালার কাজ করনে–সে কাজটি নিতান্ত সামান্য নহে, তেমনি আবশ্যক কাজ আর আমাদের আছে কি না সন্দহে, কিন্তু তাঁহাদের আমাদের আপনার বলিয়া পরিচয় দিতে লজ্জা করে। পাছে তাঁহার মলিন বসন লইয়া তিনি আমাদের ধনশালী নবকুটুম্বদের চক্ষে পড়েন এই জন্য তাঁহাকে গোপন করয়িা রাখি; প্রশ্ন করিলে বলি চিনি না।
আর তাইতো রবীঠাকুরের ভাষায় ‘ধনশালী নবকুটুম্বদের’ কাছে ‘বাংলা’ আজও ‘বেঙ্গল’ হিসেবে চর্চিত হচ্ছে। আর এতকথা বলে কি হবে? ‘রবীন্দ্র নাথ টেগোর’ আজও ‘ঠাকুর’ হতে পারলেন না খোদ ইন্ডিয়ানদের কাছে। অথবা বাংলাভাষী ইংরেজি সাহিত্যের আন্তর্জাতিকতাবাদিদের কাছে। এজন্য বেঙ্গল লাইটস ‘বিয়োন্ড আইডেন্টিটি ন্যারেটিভস: ডেফিনেশন অফ নিউওয়ার্ল্ড ফিকশন’ কনফারেন্স–এও সম্মুন্নত রাখলেন একই বিষয়কে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমইয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সাহিত্যের পাঠে বাংলার চেয়ে ইংরেজির গুরুত্বপ্রদানে খুবই উদগ্রবি বোধ করছিলেন। তাঁর মতে,
আমাদরে মধ্যে এমন অনেকে আছেন যাঁহারা বাঙালি ছাত্রদিগকে অধিকতর পরিমানে বাংলা শিখাইবার আবশ্যকতা অনুভব করেন না, এমন–কি সে প্রস্তাবরে প্রতিবাদ করেন। যদি তাঁহাদিগকে স্পষ্ট করিয়া জ্ঞান জিজ্ঞাসা করা যায় যে আমরা যে দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছি সেই দেশের ভাষায় আমাদের নবলদ্ধ জ্ঞান বিস্তার করিবার, আমাদের নবজাত ভাব প্রকাশ করিবার, ক্ষমতা ন্যূনাধিক/পরিমানে আমাদের সকলরেই আয়ত্ত থাকা উচতি কি না, তাঁহার উত্তর দেয়া ‘উচিত’; কিন্তু তাঁহাদের মতে, সেজন্য বিশেষরূপে প্রস্তুত হইবার আবশ্যকতা নাই। তাঁহারা বলেন, ইচ্ছা করিলেই বাঙালির ছেলেমাত্রই বাংলা শিখিতে ও লিখিতে পারে।
এখন কথা হচ্ছে, ইচ্ছা জন্মাবে কিনা? রবীন্দ্রনাথও একই সন্দহে প্রকাশ করেছেন।তিনি যখন এসব কথা বলেছেন তখনও বাংলা আধুনিক সাহিত্যে হাঁটি হাঁটি পা পা করছে। তবে আজকে যখন সাহত্যি একটি র্পূণাঙ্গ রূপের দিকে পৌঁছুতে শুরু করেছে এবং নানা বর্গে বিভাজনও করা যাচ্ছে তখন রবীন্দ্রনাথের কালের ইংরেজ নীতি নির্ধারণি ঔপনিবেশিক শক্তি ছিল। যা কিছু বাংলায় লেখা–লেখি হচ্ছিল তাঁর একটি বড় অংশই ইংরেজি সাহিত্যের সরাসরি অনুকরণ সমৃদ্ধ হচ্ছলি।যা আজও ‘বিয়োন্ড আইডেন্টিটি ন্যারেটিভস’–এর ব্যানারসহ বিভিন্ন বাংলা সাহিত্যের ছত্রছায়ায় ঘটে চলেছে।
২. উপনিবেশের মনোভঙ্গি ও প্রকল্পসমূহ
ঔপনিবেশিকরা আমাদের ইতিহাস, ভাবনা, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে যে–ভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল এবং ইতিহাসবিহীন, পিছিয়ে–পড়া, আদিম, বর্বর, রহস্যময়, অভদ্র সংস্কৃতির মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল এ চিহ্নায়নের ভাষাভঙ্গি কী ছিল তা আমাদের একটু ফিরে দেখা প্রয়োজন। একই সাথে প্রয়োজন কীভাবে আধুনিকতার দোহাই দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প জারি করেছিল যা আজও আমরা অবিকৃত রেখে হেজিমনাইজড জাতি হিসেবে অনুসরণ করে চলেছি।
বাংলায় সাম্রাজ্যবাদকে প্রকট হতে দেখি সেন, মুসলিম এবং খ্রিষ্টান সময়ে। তবে সেন ও মুসলিম সাম্রাজ্যবাদের সাথে খ্রিষ্টান–বেনিয়া সাম্রাজ্যবাদের চরিত্রগত পার্থক্য আছে। খ্রিষ্টান/ব্রিটিশদের কাছ থেকে বাংলা জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসনের স্বীকার হয় পরিকল্পিতভাবে। মিশেল ফুকো জ্ঞানকে ক্ষমতার কেন্দ্রীয় বিষয় হিশেবে উপস্থাপন করেছেন।২ তবে হেগেল ও মার্ক্স দু’জনই ক্ষমতাকে ভেবেছেন ইতিহাসের সাধারণ তত্ত্বের ক্ষেত্রে একটি অন্বেষণ হিসেবে। হেগেলের কাছে এই অন্বেষণ রাষ্ট্র নামক ঈশ্বর এবং মার্ক্সের কাছে শ্রেণিসংগ্রাম পরবর্তী রাষ্ট্রবিহীন অবস্থা।৩ ফুকো জ্ঞাননির্ভর ক্ষমতায়নের যে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের কথা বলেছেন, সে–ভাবেই গঠিত হয়েছিল ভারতীয় সমাজ। উপমহাদেশে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছিল এক ধরণের প্রাচ্যবাদী ডিসকোর্স। এই ডিসকোর্সের কেন্দ্রে ছিল ইংরেজি–নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা। ফুকো বলেছেন, ব্যক্তির আত্মস্বরূপ হচ্ছে ক্ষমতার উপাদান, আধিপত্য বিস্তারের বিষয়। লক্ষণীয়, ঔপনিবেশিক শক্তি শোষণের স্বার্থে ভারতীয়দের এই আত্মস্বরূপকেই নিয়ন্ত্রণ করেছে। সিপাহী বিদ্রোহের পর ইংরেজদের পক্ষ থেকে শুরু হয় এই দখল প্রক্রিয়ার আয়োজন। সু–পরিকল্পিতভাবে প্রচলন ঘটানো হয় পাশ্চাত্যের বিকৃত শিক্ষার, যার বাহন ইংরেজি। জ্ঞানতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রকল্পের প্রথম আঘাতটি করা হয় ইতিহাস–বিহীন জাতি হিশেবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে। অর্থাৎ মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয় যে, তুমি শেকড়বিহীন।
এ ধাক্কাটা লাগে কোলকাতা–কেন্দ্রিক গজিয়ে–ওঠা নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে। এ শ্রেণিটি ততদিনে কেরানি হওয়ার প্রকল্পের অধীনে ইংরেজি ভাষা শিখে ইতিহাসকে ইংরেজি মানসিকতায় বুঝতে শুরু করেছে। তৎকালীন সাধারণ জনগোষ্ঠীর এ–বিষয় নিয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয় নি, যতটা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে নীল চাষকে কেন্দ্র করে। কারণ তারা ততদিনে বুঝে উঠতেই পারে নি কী ঘটে চলেছে। যেহেতু, বাবুদেরকে বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা ও প্রবন্ধ শুনিয়ে (উনিশ শতকের শুরুর দিকে এশিয়াটিক সোসাইটিকে কেন্দ্র করে ইতিহাস–সংস্কৃতি বিষয়ক যেসব সেমিনার হয়েছে স্যার উইলিয়াম জোন্স প্রমুখদের নেতৃত্বে) ব্রিটিশগণ আলোকময়তার আধুনিকায়নের নানা দিক তুলে ধরতে শুরু করলেন। নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করলেন আধুনিকতার সমরূপ হিশেবে। শুরু করে দিলেন ভারতবাসীর জন্য নানা ধরণের জাতীয় প্রকল্প। ই.বি. ম্যাকাওলের ‘মিনিট অন এডুকেশন’ এ ধরণের প্রকল্পেরই প্রথম ধাপ। ‘মানুষের চৈতন্যকে সব অর্থে করায়ত্ত’ ৪ করে নেবার কূট ভাবনার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে এ শিক্ষা–পরিকল্পনায়। ম্যাকওলে এখানে উল্লেখ করলেন যে, ইংল্যান্ড হলো সভ্যতার একমাত্র জিয়নকাঠি। ‘একজন ভারতীয় রক্ত ও রঙে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, মতামত, আদর্শ ও বুদ্ধিমত্তায় সে ইংরেজ’ ৫। এ–ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন মত প্রদান করলেন, ইংরেজি শিক্ষা ‘হৃদয় মনকে গড়ে তুলছে না, তা সমাজের উপরে চাপাইয়া দেওয়া হইয়াছে। এই শিক্ষা স্বাদেশিকতার বোধে ভারতীয়দের উত্তীর্ণ হতে দেয় না’ ৬। রবীন্দ্রনাথ এই জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসনের প্রতিরোধ করতে চান তার ‘তোতাকাহিনী’ দ্বারা। এই ‘তোতাকাহিনী’ ঔপনিবেশিক শিক্ষা–ব্যবস্থারই এক করুণ মর্মান্তিক উপাখ্যান এবং প্রতিবাদ।
রবীন্দ্রনাথের রূপক–বিদ্রুপ বিদ্রোহের রূপ লাভ করেনি। সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত সচেতন শ্রেণিকে একাট্টা বোধের অধীনে নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়। রাজনৈতিক প্রতিরোধবিহীন ব্যবস্থায় ইংরেজ তাদের আধুনিক শিক্ষা–কাঠামোর অনুমোদন করেন। এ শিক্ষার অধীনে ইউরোপীয় ইতিহাসকে তুলে ধরা হলো। শিক্ষা দিতে শুরু করল যে, ইউরোপীয় ইতিহাস বিজ্ঞানসম্মত বস্তুগত উপাত্তের ওপর নির্ভর করে পদ্ধতিগত উপায়ে লিখিত হয়েছে। ভারতবাসীর এরকম কোনো ইতিহাস নেই। তারা ইতিহাসবিহীন। এভাবে শেকড়বিহীন জাতির শেকড়ের সন্ধানে কোলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় উইলিয়াম জোন্সের নেতৃত্বে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ (১৭৮৪)।
উইলিয়াম জোন্সের৬ (১৭৪৬–৯৪) অনুমান, ভারত ও ইউরোপের ভাষা এবং লোকগাথার একই উৎস ছিল। তিনি মনে করেন, ভারতের অতীতের সাথে গ্রিক প্রত্ন–নিদর্শনের অদ্ভুত মিল রয়েছে। তিনি আরও মনে করেন সূর্য উদিত হয় এবং অস্ত যায় শুধুই তাদের জন্য। তিনি কল্পনা করতে পারেন না যে তাদের দ্বীপের চারপাশে ঢেউ যে প্রবাল এবং মুক্তা ফেলে যায় তা অন্য কোনো বেলাভূমির ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। তার ভাবনায়, প্রাচ্যের সাহিত্য মূলত ইউরোপীয়দের দান এবং জনসাধারণের নবজাগরণে তারা ভূমিকা রাখতে পারে যেমনটি গ্রিক সাহিত্য করেছিল রেনেসাঁকালীন।
ভারতের সাহিত্যের যুগবিভাজন হয় ইতিহাসের যুগবিভাজনের ওপর ভিত্তি করে। জেমস মিল৭ তার ‘হিস্ট্রি অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ (১৮১৭) গ্রন্থে ভারতের ইতিহাসের সময়কে ইউরোপীয় ইতিহাসের আলোকে ‘প্রাচীন’, ‘মধ্য’ ও ‘আধুনিক’ এ তিন পর্বে বিভাজিত করেন। আলোকময়তার ধারক হিসেবে ব্রিটিশ পর্বটিকে আধুনিক সময় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রাচীন পৌরাণিক স্বর্ণ যুগকে প্রাচ্যবাদীরা চিহ্নিত করেছেন স্বেচ্ছাচারিতা ও বর্বরোচিত প্রথা হিসেবে। মিলের মতে, ভারত সভ্যতার প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ে গিয়েছিল এবং একে একমাত্র পশ্চিমের অভিভাবকত্ব নিয়ে ফিরতে হবে। ব্রিটিশপূর্ব ভারতের সাহিত্যকে নিয়ে ভয়াবহ মন্তব্যটি করেন ম্যাক্স মূলার। তার মতে, ভারতের সমগ্র সাহিত্য ব্রিটিশ লাইব্রেরির একটি তাকের বইয়ের সূচিপত্রের সমান।
৩
যদিও শীরনামে ‘বাংলা সাহিত্যের বিউপনিবেশকরণের’ বিষয়টি উচ্চারিত হয়েছে তাই আধুনিকতাবাদী সাহিত্য বিভাজন যা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথাগত হয়েছে যেমন: উপন্যাস, নাটক, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি ভেদ রেখায় ফেলে তুলনামূলকভাবে গত দেড়শত বছরের একটি বিরাট ক্যানভাসকে ভেবে নেয়াটা অন্যায় হবে না। কারণ এভাবেই আমরা সাহিত্য বোঝার হেজিমনিতে নিজেকে প্রযুক্ত করেছি। আর তাইতো আমি শীরনামে ‘বাংলা সাহিত্যকে’ বন্ধনি কমা দিয়ে বেঁধে নিয়েছি। কারণ সেলিম আল দীন এখানেই তার একটি প্রকল্প হাজির করে ‘বাংলা সাহিত্যের’ পশ্চিমা কর্তৃত্ববাদীতাকে প্রথম পাল্টে দেবার কাউন্টার ডিসকোর্স হাজির করেছেন। এ ক্ষেত্রে তার বক্তব্যর দিকে ফিরে তাকানো যেতে পারে –
লেখকের জন্যে স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি তার শিল্পী স্বভাবের মধ্যেই নিহিত থাকে। কেউ গদ্যে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে পারেন, কেউ পদ্যে। কাজেই গদ্য–পদ্যের বিশেষ বিভাজন কেন্দ্রিক গুণাগুণ নির্ণয় অর্থহীন। উপরন্তু পাশ্চাত্য শিল্পরীতিতে গদ্যে ও পদ্যের যে অংশভাগ, আমি তা স্বীকার করি না। কারণ প্রাচ্যের শিল্প–মাধ্যমে শিল্পরীতিতে একটি নিগূঢ় ঐক্যবোধ কাজ করে। যে কারণে সৃষ্টিশীল গদ্য এখানে সব সময়ই কবিতার হাত ধরাধরি করে চলে। বাংলা কাব্যে প্রায় হাজার বছর ধরে পয়ার ছন্দের যে প্রতাপ আমরা প্রত্যক্ষ করি তার মূলেও এই ঐক্য–চেতনা। অর্থাৎ ছন্দ একই সঙ্গে গদ্যের প্রয়োজন মিটিয়ে তবে কবিতা, পয়ারের বিপুল শোষণ ক্ষমতার কারণে বাংলা সাহিত্যে গদ্যের উদ্ভব অনিবার্য হয়ে উঠে নি অথবা বলা যায় গদ্যের সকল সম্ভাবনাকে পয়ার ছন্দ আত্মসাৎ করে সফলভাবে নিজের প্রতাপ অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। পরবর্তীকালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ–কেন্দ্রিক নিরঙ্কুশ গদ্যের উদ্ভব যখন ঘটল দেখা যায় ইতিহাস কিংবা পুরণো কালের গদ্য অথবা সৃষ্টিশীল সর্বত্রই কবিতার সঙ্গে তার একটি গভীর ঐক্যের অভিজ্ঞান বিদ্যমান। রামরাম বসু, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, প্যারীচাঁদ মিত্রের গদ্য নিঃসন্দেহে মধ্যযুগের বাংলা কথকরীতির সমকালীন সংস্করণ যমক অনুপ্রাস, ব্যাজস্তুতি কাব্যালংকার প্রভৃতিতে ঠাসা। হুতোম প্যাঁচার নক্সা, আলালের ঘরের দুলাল প্রভৃতি উপাখ্যান কথকরীতিরই উত্তরসূরি। মধুসূদন কৃষ্ণকুমারী নাটকের ভূমিকায় বলেছিলেন যে, অন্য যে–কোনো ভাষার তুলনায় বঙ্গভূমিতে বাংলা গদ্য অধিকতর গীতল ও সুমিষ্ট। মধুসূদন বাংলা ভাষার স্বভাব–গীতলতাকেই এই কথা দ্বারা নির্দেশ করেছেন। ভাষার স্বভাবের মধ্যে ভাষার সাধারণ চলার পথে শব্দপদবন্ধে গীতলতার এই নৈসর্গিক অবস্থানের কারণে বাংলা গদ্যের সঙ্গে কবিতার ভেদ নির্ণয় কখনও কখনও বহিরঙ্গ আশ্রয়ীমাত্র। তা অন্তর্ধর্মের মূল্যায়ন নয়। বঙ্কিমচন্দ্রের যুগ–দুর্লভ শিল্পভাষা সম্পর্কে এই কথা প্রযোজ্য। রবীন্দ্রনাথের মধ্যেই বাংলা গদ্য এবং পদ্যের দ্বন্দ্ব চূড়ান্তভাবে মীমাংসিত হয়েছে। তাঁর গদ্য কবিতার প্রান্তদেশবর্তী এবং এর আবেদন সর্বকালীন কবি–মনের কাছে পৌঁছে যায়। রবীন্দ্রনাথের গদ্যে কবির কল্পনাশক্তি এক গীতল শব্দের অন্বয়ে সুরের ধারায় ঝংকৃত হয়। বাংলা গদ্য–পদ্যের ভেদটাকে এ ভাষার স্বভাব–সাহিত্যরীতি এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতার আলোকে বিচার করলে দেখা যায় ইউরোপীয় সংজ্ঞাসূত্রের অধীনে তাকে বিভাজন করা যায় না। ন্যায়শাস্ত্রের ভাষা, বিভাগ–দপ্তর বা খবরের কাগজের ভাষা ব্যতিরেকে গদ্যের অস্তিত্ত্ব অন্য কোথাও আছে বলে আমার মনে হয় না।
সেলিম আল দীনের বক্তব্যটির দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কয়েকটি বিষয়। তা হলো,
প্রথমত, পাশ্চাত্য শিল্পরীতির গদ্য/পদ্যের বিভাজনকে অস্বীকার করা।
দ্বিতীয়ত, হাজার বছরের পয়ার ছন্দের ক্ষমতার ওপর আস্থাশীলতা।
তৃতীয়ত, বাংলায় গদ্যচর্চার শুরুর কালেই সৃষ্টিশীল গদ্যে গীতলতাকে স্পষ্ট করা এবং কথকরীতির প্রকাশ খুঁজে পাওয়া।
চতুর্থত, গদ্য/পদ্যের আধুনিক ভেদ তুলে দিয়ে হাজার বছরের সাহিত্যের রীতিতে ফিরে যাবার প্রকল্প জারি করা।
পঞ্চমত, ইউরোপীয় সাহিত্যরীতির সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ।
আল দীন ইউরোপীয় সাহিত্যরীতির সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। তার কাজের দিকে ফিরে তাকালে দেখবো ১৯৭৭ সালের শকুন্তলা নাটকের মাধ্যমে প্রথম তিনি বিষয়ের দিক থেকে নিজ সংস্কৃতিতে ফিরে এসেছেন। তারপর একে একে কিত্তনখোলা, হাতহদাই, চাকা, যৌবতী কন্যার মন, বনপাংশুল, প্রাচ্য প্রভৃতি লেখার মাধ্যমে বিষয়, নিম্নবর্গের ভাষাভঙ্গি এবং আঙ্গিকের দিক থেকে সম্পূর্ণই ফিরে এসেছেন স্বদেশভূমে। গা থেকে খশিয়ে দিয়েছেন উপনিবেশের সকল তকমা। ভেঙে দিয়েছেন গদ্য/পদ্যের অর্থাৎ উপন্যাস, গল্প, নাটক, কবিতা, গানের সকল ভেদরেখা।
একজন স্ব–সচেতন, স্ব–শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে আল দীন প্রতিরোধ তৈরি করতে চেয়েছেন। তিনি পশ্চিমা আধুনিকতার জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রকল্পের পাল্টা কর্মসূচি বিভিন্ন নিরীক্ষার মাধ্যমে ঘোষণা করেছেন এবং প্রয়োগরীতিকেও নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা থিয়েটারের মাধ্যমে উপস্থাপন করে গেছেন।
আলোচনার সুবিধার্থে বর্তমান আলোচনাটিতে তথাকথিত বাংলা সাহিত্যের একটি অংশ মঞ্চ নাটককে কেন্দ্রে রেখে আলোচনা এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হল। কারণ, সেলিম আল দীনের রচনা যেহেতু নাটক হিসেবে মঞ্চায়িত হয়েছে এবং তার লেখায় প্রায়োগিক বিষয়াবলী সক্রিয় ছিল বিধায় বাংলাদেশের মঞ্চ–নাটককে আঙ্গিক বিশ্লেষণের সুবিধার্থে আলোচনাকে কেন্দ্রিভূত করা হল।
৪. বাংলাদশেরে নাট্যর্চচার পূর্বাপর
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ র্পযন্ত নুরুল মোমনেরে সংলাপ নির্ভর নাটক ‘রূপান্তর’, ‘যদি এমন হত’, ‘আলোছায়া’, ‘নয়া খান্দান’ প্রভৃতি আসকার ইবনে শাইখ–এর ‘বিদ্রোহী পদ্মা’, ‘অনুর্বতন’, ‘প্রচ্ছদপট’ প্রভৃতি নাটকরে আঙ্গিক নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা নিরিক্ষা করেন।এ সমইয়ের সবচেয়ে আলোচিত এবং পরাধীন বাংলাদশেরে মানুষের কাছে মুক্তির বারতা নিয়ে সফল ভাবে হাজির হন মুনীর চৌধুরী।তাঁর ‘কবর’ নাটকটি আজও র্পযন্ত সবচেয়ে বেশিবার প্রযোজতি নাটক।এটাকে একটি কালোত্তর্ণি নাট্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।তাঁর অন্যান্য নাটকগুলো হলো, ‘চিঠি’, ‘দণ্ড’, ‘দণ্ডধর’, ‘মানুষ’, ‘মর্মান্তিক’।সাহিত্য মূল্যের এক অনন্য প্রয়াস নিয়ে হাজির হতে দেখি সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহকে তাঁর ‘বহিপীর’, ‘তরঙ্গভঙ্গ’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘উজানে মৃত্যু’। এ এক আধুনকি পশ্চিমা চিন্তাকল্পের বাংলাদেশি উপস্থাপন। আধুনকি মানুষের সঙ্কট এখানে সচল হয়ে ওঠে। বাংলা নাটকে এবস্ট্রাক/বিমূর্ত ধারার নাটক নিয়ে হাজির হন– সাঈদ আহমদে। তিনি রচনা করেন, ‘কালবেলা’, ‘মাইলপোস্ট’, ‘তৃঞ্চা’ প্রভৃতি। এর বাইরে আমরা দেখতে পাই আনিস আহমেদকে ‘মানচিত্র’ এবং ‘এলবাম’ নাটক দুটোর মাধ্যমে। সিকান্দার আবু জাফরকে পাই ‘সরিাজ–উদ–দৌলা’, ‘মহাকবি আলাওল’, ‘মাকড়সা’ ও ‘শকুন্তলা উপাখ্যান’–এ।জিয়া হায়দার–এর ‘শুভ্রা সুন্দর কল্যানী আনন্দ’ প্রতীক নির্ভর নাটক।এসবই হল ১৯৭১–র্পূব বাংলাদেশের মানুষের রচিত নাটক।তবে এ নাটকগুলো ১৯৭১–এর প্রস্তুতি পর্বের জন্য একমাত্র মুনীর চৌধুরী ব্যতিত আমরা আর কোনো নাট্যকারকে খুঁজে পাইনা।
মূলত বাংলাদশেরে নাট্যঐতহ্যি বিবেচিত হতে পারে ১৯৭১ উত্তর যুদ্ধ ফেরত তরুণদের হাত ধরে ১৯৭২-’৭৩–এ যে নাটকরে ধারা শুরু হতে দেখি – তাই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সেলিম আল দীনের ‘জন্ডিস এবং বিবিধ বেলুন’, ‘সংবাদ কার্টুন’, আল–মনসুররে ‘বিদায় মোনালিসা’, ‘হে জনতা আরেকবার’, মামুনুর রশীদের ‘পশ্চিমের সিঁড়ি। এসময়টাকে মামুন এই উদাহরণগুলো ব্যবহার করেই ব্যখ্যা করছেনে এভাবে যে,
এভাবইে শুরু হল। একটা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর এরকমই হয়। হঠাৎ করে সব একসাথে শুরু হয়ে যায়। নিয়মনীতির বালাই থাকেনা।নতুন কিছু করা দরকার, সেটাই আসল কথা।
আর এই নতুনটা শুরু হইয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আশ্রয় করে। এসময়রে নাটক হয়ে উঠল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনঃপুন মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে। সেক্যুলার, অর্থনৈতিক মুক্তির, ভাষার ঐতিয্যের, রবীন্দ্র–নজরুল–জীবানন্দের আবহমান বাংলার চিত্রকল্পের নাটক।এখানে মুনীর চৌধুরী, আসকার ইবনে সাইখ, নুরুল মোমনে, সাঈদ আহমদে ছিটকে পড়ে গেলেন।বাংলাদেশের জাতীয় নাট্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জিবিত হয়ে চেতনায় বাঙালি জাতীয়তাবাদি হয়ে উঠল।
এসব নাটক চেতনায় বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারন করলেও আঙ্গিকেও সে পশ্চিমা রীতিকে অনুসরণ করে। এ সমইয়ের নাট্যকারগণ যেমন, আব্দুল্লাহ আল–মামুন রচনা করেন, ‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘এখন দু:সময়’, সেনাপতি, ‘এখনও ক্রীতদাস’, ‘তোমরাই’, ‘কোকিলারা’ ইত্যাদি, সৈয়দ শামসুল হক–এর ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নুরুলদীনের সারাজীবন’, ‘এখানে এখন’, ‘র্ঈষা’ ইত্যাদি, মমতাজ উদ্দীন আহমেদ–এর ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘এবাররে সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘র্স্পাটাকাস বিষয়ক জটলতা’, ‘হরিণ চিতা চিল’, ‘বিবাহ’, ‘কি চাহ শঙ্খচিল’, ‘রাজা অনুস্বারের পালা’, ‘ফলাফল নিম্নচাপ’ ইত্যাদি , মামুনুর রশীদ–এর ‘ইবলিশ’, ‘গিনিপিগ’, ‘সমতট’, ‘মানুষ’, ‘এখানে নোঙর’, ‘জয়জয়ন্তী’ ইত্যাদি, সেলিম আল দীন–এর ‘জন্ডসি এবং ববিধি বেলুন’, ‘সংবাদ কার্টুন’, ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি, ‘শকুন্তলা’, ‘কীর্তন খোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’। সেলিম আল দ্বীনকে এই কেরামত মঙ্গল পর্যন্ত আটকে দিলাম। তাঁকে উপরোক্ত ধারার ভেতরে চিহ্নিত করতে আগ্রহী।তাঁর বাকী কাজ নিয়ে লেখার পরবর্তি পর্যায়ে বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা করব। পাশ্চাত্য শিল্পভাবনার ওপর দাঁড়িয়ে সেলিম নিজের উপরে উল্লেখিত নাটক নিয়ে বলেছেন,
সন্দেহ করি আমার শুরুর দিকের রচনায় পাশ্চাত্য শিল্পরীতি এমনকি ক্ষেত্র বিশেষ জীবনকে দেখবার ভঙ্গিতে নিতান্ত অনুকৃত।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জিবিত হয়ে আরও বেশ কিছু নাটক উপস্থাপিত হতে দেখি। যেমন এস এম সোলায়মান–এর ইঙ্গিত, ক্ষ্যাপা পাগলের প্যাঁচাল, এই দেশে এই বেশে ইত্যাদি, আবদুল্লাহিল মাহমুদ–এর সাতপুরুষের ঋণ, নানকার পালা এবং মান্নান হীরার পাথর, খলো খলো, আগুন মুখা ইত্যাদি।
এসব নাটকে পরবিশেন রীততিতে বেশ কিছু পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হইয়েছে। তবে তা সবই প্রায় ব্যর্থ হয়ছে। ব্যর্থতার অসংখ্য কারণের একটি হল পশ্চিমা আঙ্গিককে আশ্রয় করে প্রয়াশগুলো চালান হইয়েছে।
এসব নাটকের বাইরে বেশ কিছু রুপান্তর এবং অনুবাদ নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ফ্রাঞ্জ ফানো এ প্রবণতাকে চিহ্নিত করেছেন এভাবে যে,
দেশীয় বুদ্ধিজিবীগণ আসলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি গিলেছে। অবস্থাটা অনকেটা পোষ্য–সন্তানদের মত।মনের মধ্যে নিরাপত্তার ভাবনা দানা না বাঁধা পর্যন্ত পোষ্য–সন্তান যেমন নতুন পারিবারিক কাঠামোকেখুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে, দেশীয় বুদ্ধিজিবীগণও তেমন পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে নিজের করতে চায়।তাঁরা রেবালে, দিদেরো, শেক্সপীয়র এবং এডগার এলেন পো’র সন্ধান পেয়েই সন্তুষ্ট নয়, বুদ্ধিমত্তার দিয়ে তাঁদেরকে তাঁরা যথাসাধ্য আয়ত্তও করতে চেষ্টা কর।
এক্ষেত্রে মলিয়ের নাটককে স্যাটায়ার থেকে ভালগারে উপনীত করেছে। এসব নাটক পরিবেশনকারীগণ স্যাটায়ার ও ভালগাররে মধ্যকার বিভাজন রেখাকে চিনতে পারেন কিনা সেটাই বিস্ময় নিয়ে দেখেছি। আব্দুল্লাহ আল–মামুন খেদভরে মাইকেল মধুসুদন দত্তের বক্তব্যকে ব্যবহার করে একে ‘অলীক কুনাট্যে মজি’ বলে তীরষ্কার করেছেন।
ওপরের সকল নাট্যের চরিত্রকে বিশ্লেষণ করে দেখতে পাই যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অসঙ্গতিকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধেরদ চেতনাকে সাথে নিয়ে নাটক রচিত এবং উপস্থাপিত হয়েছে। এসব নাটক পঞ্চাঙ্ক রীতি অনুসরণে এবং প্রসেনিয়ামের উপজীব্য করে শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্তকে আশ্রয় করে করা হইয়েছে। তবে সৈয়দ শামসুল হক–এর নাটক বাংলাদেশের কাব্য নাট্যের পরিসরকে সমৃদ্ধ করেছে তা অনস্বীকার্য। পশ্চিমা বিবেচনায় তা ক্লাসিকস হিসেবেও চিহ্নিত করা যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় নাট্য আঙ্গিক নির্মাণে তাঁর ভূমিকাটি নিয়ে দীর্ঘ প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়।এ ধরণের প্রয়াস বাংলাদেশের নাটকে নয়া হলওে পৃথিবীর নাটকের ইতিহাসে নয়া বিষয় নয় এবং এ ধারাটি আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে আশ্রয় করে আঙ্গিকগতভাবে এবং কোন কোন নাটকের ক্ষেত্রে চেতনাগত ভাবে দাঁড়িয়েছে কিনা তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। বিষয়টি নিয়ে রচয়িতা হিসেবে তিনি ভেবেছেন কিনা তা সন্দেহাতিত নয়।এটা বলার কারণ হল আব্দুল্লাহ আল–মামুন বেশ খেদের সাথেই বলছেন,
অনেক কাজের কাজি, সব্যসাচী লেখকেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখি, সব কাজ শেষ করে বা কাজের ফাঁকে ফাঁকে নাটক ধরেন।অর্থাৎ নাট্যরচনা তাঁদের প্রাথমিক বা প্রধান কাজ হয় না।অথচ তাঁরা যখন নাটকের চৌহদ্দিতে প্রবেশ করেন, তখন তাঁরা এমন চমক লাগান, এমনভাবে ঝলসে উঠনে যে, পরতাপই হয় এই মর্মে যে আহা তাঁরা কেন শুধুই নাটক লিখলেন না?
৫
ঔপনিবেশিক জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসনকে আমরা ‘আফ্রিকা’ পাঠের মাধ্যমে আমরা সহজেই জানতে পারি। আফ্রিকার এক অঞ্চল পরিচিতি পায় ফ্রাঙ্কোফোন অঞ্চল হিসেবে এবং অপর অঞ্চল পরিচিতি পায় অ্যাংলোফোন অঞ্চল হিসেবে। ফ্রান্স ও ব্রিটিশরা যুগপৎ ৭০ বছরের উপনিবেশের অধীনে ক্যামেরুন, নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকীয়দের ভুলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে তাঁদের বর্ণমালাকে। ওলে সেয়িঙ্কা, নগুগিদের আমরা দেখতে পাই বিজাতীয় ভাষায় চর্চা করতে। অবশ্য নগুগি নিজ ভাষায় প্রত্যাবর্তন করেন সম্পূর্ণ প্রতিরোধীর চেহারায়। অনেকে এক্ষেত্রে বলে থাকেন, আফ্রিকার ভাষা–সংস্কৃতির প্রতিরোধের ক্ষমতা কম থাকায় তা হারিয়ে গেছে। আর বাঙালির ভাষা–সংস্কৃতির প্রতিরোধের ক্ষমতা বেশি বিধায় ২০০ বছরের আগ্রাসনের পরেও তা টিকে আছে। এখানে উল্লেখ্য যে, উত্তর–ঔপনিবেশিক সমাজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝতে হবে উপনিবেশ কতটা সফল হতে পেরেছে।
এসব কারণে উত্তর–উপনিবেশিকতাবাদকে আমি উত্তর–ঔপনিবেশক পরিস্থিতি হিসেবে দেখতে আগ্রহী। এক্ষেত্রে শর্মিলা সেনের৯ বক্তব্যর সাথে একমত হয়ে আমিও বলতে চাই, উত্তর–উপনিবেশ হলো একটি পরিস্থিতি। যখন পশ্চিমা শাসন সরাসরি প্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে না কিন্তু নিয়ন্ত্রণের সকল ব্যবস্থা এমনভাবে সম্পন্ন হয়েছে যে সে এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে চাবি দেয়া পুতুলের মতো নিয়ন্ত্রিত। ‘ইজম’ বা ‘বাদ’ হলো কোনো বিশেষ কর্মসূচি বা মতবাদ, যেমন : মার্ক্সবাদ, নারীবাদ প্রভৃতি।
উত্তর–ঔপনিবেশিকতাকে উত্তর–ঔপনিবেশিকতাবাদ হিশেবে বেশিরভাগ তাত্ত্বিকগণের উল্লেখ করার বড় কারণ হলো এর ঔপনিবেশিকতার একটি সমালোচনামূলক অবস্থান আছে, যা ঔপনিবেশিক নৃতাত্ত্বিক গবেষণাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে। ১৯৩০ সালে সমগ্র বিশ্বের ৮৪.৬ শতাংশ জমিই ছিল কোনো না কোনো বর্তমান বা প্রাক্তন উপনিবেশের অন্তর্গত। এ থেকেই বোঝা যায় উপনিবেশবাদ আমাদের পৃথিবীর ভৌগোলিক বা ঐতিহাসিক মানচিত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রক্রিয়া। উপনিবেশিত মানুষদের সংস্কৃতি বোঝার মাধ্যমে তাদেরকে কীভাবে আরও নির্বিঘ্নে শাসন–শোষণ করা যায়।এজন্য কোন পদ্ধতি যুক্তিযুক্ত তা জানতে এ সকল এলাকায় ব্যাপকভাবেই নৃতাত্ত্বিক গবেষণা পরিচালিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে, উপনিবেশ–উত্তর সময়ে এ সকল নৃতাত্ত্বিক গবেষণা বিস্তর সমালোচনার সম্মুখীন হয়। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় নৃতাত্ত্বিক চিন্তক ছাড়াও উপনিবেশিত অঞ্চলসমূহের অনেক চিন্তক উপনিবেশবাদের ব্যাপক সমালোচনা করেন। ব্যাপক ভিত্তিতে এই সমালোচনাগুলো উত্তর–আধুনিকতাবাদ–কেন্দ্রিক হলেও এদের মধ্যেই উত্তর–ঔপনিবেশিকতাবাদী চিন্তকগণ অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ উত্তর–ঔপনিবেশিকতাবাদ কথাটা যখন বলা হয় তখন ‘উত্তর’ কথাটি কেবল ঔপনিবেশিকতা পরবর্তী সময়কে নির্দেশ করে না, বরং ঐসব চিন্তা ও প্রতিক্রিয়াকে নির্দেশ করে বা ঔপনিবেশিক চিন্তাগুলোকে চাপিয়ে দেয়ার যে অন্যায় চেষ্টা, তার মুখোমুখি দাঁড় করায়।
উত্তর–ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষা বর্ণমালা হারায় নি বলে স্বস্তির ঢেঁকুর তুলে লাভ নেই। ভাষার ভেতরে আত্মীকৃত করতে হয়েছে পাশ্চাত্যের শব্দ, গঠন–কৌশল, বিরামচিহ্ন প্রভৃতিকে। গদ্য লেখার কৌশল করতে হয়েছে আয়ত্ত। পালাগান, জারি–সারি, যাত্রাপালাকে গ্রাম্য সংস্কৃতির অধীন করে পারফর্মিং আর্টের অন্যতম অংশীদার ‘ড্রামা’ কে ‘নাটক’ নামে পশ্চিম থেকে আগত লেবেদেফের হাত ধরে আমাদের শিখতে হয়েছে। লেবেদেফ বাংলা নাটকের জনকে পরিণত হয়ে পড়েন। ইউরোপকেন্দ্রিক প্রসেনিয়াম থিয়েটারের অধীনে দু’একটা ময়মনসিংহ গীতিকার চর্চা করে নিজের মূলধারার সাংস্কৃতিক চর্চাকে উপস্থাপন করছি ‘এক্সপেরিমেন্টাল ড্রামা’ (!) বলে।
নাটকের ক্ষেত্রে এ পরজীবী প্রকল্পের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য ১৯৮০ সালের নবগঠিত গ্রাম থিয়েটারের ঘোষণাপত্রে সেলিম আল দীন এর বি–উপনিবেশিতকরণ প্রকল্পের প্রথম ভাষ্য ঘোষিত হয় :
বাংলাদেশের মঞ্চে…আমরা আমাদের নিজেদের জীবন, পরিম–ল ও লড়াই–এর চিত্র তুলে ধরতে চাই। গ্রাম থিয়েটার মেরুদ–হীন আপোসকামী নাট্যচর্চার বিরুদ্ধে প্রাণবন্ত ও প্রাণদায়ী নাট্যচর্চাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।…গ্রাম থিয়েটার আধুনিক নাট্যকলার সঙ্গে বাংলাদেশের নিজস্ব নাট্য–আঙ্গিকের সমন্বয় সাধনে বদ্ধপরিকর।১০
‘কিত্তনখোলা’ নাটকের মাধ্যমে এ প্রতিরোধী প্রকল্পের শুরু। এ বিষয়টি খোলাসা করবার পূর্বে খোদ উত্তর–ঔপনিবেশিকতা নিয়ে আরো একটু বক্তব্য উপস্থাপন জরুরি।
সাহিত্য সমালোচনায় উত্তর–ঔপনিবেশিকতাবাদ প্রত্যয়টি ব্যবহৃত হয়ে আসছে এডওয়ার্ড সাইদের ‘ওরিয়েন্টালিজম’, তালাল আসাদের ‘কলোনিয়াল এনকাউন্টার’ এবং উত্তর–কাঠামোবাদী তত্ত্বের নানাবিধ ধারা প্রবাহিত সেই সব র্যাডিক্যাল কাজ বোঝাতে, যেগুলোর অ–ইউরোপীয় সমাজের ঔপনিবেশিক রেপ্রিজেন্টেশনের চলমানতার বিষয়ে অধিক আগ্রহী। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক অঞ্চলের যে সমস্ত চিন্তক, যাঁরা নিজেরা ঔপনিবেশিক শাসন দ্বারা নানাভাবেই নির্যাতিত, নিপীড়িত হয়েছিলেন, তাঁদের পক্ষ থেকে ঔপনিবেশিকতাবাদের সমালোচনামূলক ধারা তৈরি হয়েছিল। উদাহরণ হিশেবে বলা যায়, ‘তালাল আসাদ’–এর কথা যিনি লিবিয়ার অধিবাসী ছিলেন এবং এটি ছিল ইতালীয় উপনিবেশ। যিনি নিজে ঔপনিবেশিক শাসকদের নানা বিষয়গুলোকে কাছ থেকে দেখতে পেরেছিলেন, এমনকি ভুক্তভোগিও ছিলেন। মূলত উত্তর–ঔপনিবেশিকতা হলো উপনিবেশবাদের বিশাল ইতিহাসকে বোঝার পদ্ধতি ও তত্ত্বের একটি সমালোচনামূলক ধারা।
আর বি–উপনিবেশীকরণ হলো উত্তর–ঔপনিবেশিক সমালোচনাসমূহকে সাথে নিয়ে প্রতিরোধের কর্মপদ্ধতি তৈরি করা। কেনিয়ার সাহিত্যিক নগুগি ওয়া থিয়েঙ্গা মনের বি–উনিবেশীকরণের যে ধারণা তত্ত্বায়িত করেছেন তার মূলকথা হলো ইউরো–কেন্দ্রিক আবর্তন–পথ থেকে সরে এসে দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সৌরম–লে প্রবেশ। সে ক্ষেত্রে দেশী মতাদর্শ–সংস্কৃতি–বাস্তবতা–স্থানীয়জ্ঞান–কিংবদন্তি–সময়চেতনা–মিথ–ইতিহাসবোধকে পুনর্জাগরিত–পুনরাবিষ্কৃত করার প্রেক্ষিতে দেশীয় ভাষায় অভিব্যক্তি প্রকাশ হয়ে দাঁড়ায় উত্তর–ঔপনিবেশিক আধিপত্য প্রতিরোধের অন্যতম পদক্ষেপ।
নাটক যেহেতু সমন্বিত ও প্রায়োগিক শিল্পকর্ম, সেহেতু নাটকে দেশীয় সংস্কৃতি, নৃত্য, কিংবদন্তি এবং ইতিহাসবোধের সর্বোচ্চ প্রয়োগ সম্ভব, যা সাহিত্যের অন্যকোনো শাখায় সম্ভব নয়। নাইজেরিয়ান নাট্যকার ওলা রেটিমি মনে করেন আফ্রিকায় উত্তর–ঔপনিবেশিকতাকে প্রতিরোধের জন্য নাটকের ফর্মগুলো ইউরোপ থেকে আমদানি করা নয়। আফ্রিকার বিপ্লবী সাহিত্যিক নগুগি ও নোবেল বিজয়ী নাট্যকার ওলে সেইঙ্কার নাটক পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, তাঁরা কতটা সফলভাবে ঔপনিবেশিক জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসনকে প্রতিরোধের হাতিয়ার হিশেবে নিজস্ব সংস্কৃতির উপাদানগুলোকে নাটকে প্রয়োগ করেছেন।
ঠিক যে কারণে নগুগি কিংবা ওলে সেইঙ্কাকে আফ্রিকান উত্তর–ঔপনিবেশিক জ্ঞানতত্ত্বের প্রতিরোধের উদ্দিষ্ট নাট্য–ঐতিহ্যের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, একই কারণে উত্তর–উপনিবেশ জাতি–রাষ্ট্র বাংলাদেশের নাট্যকার সেলিম আল দীনকে বাংলা নাটকের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। বর্ননাত্মক নাট্যরীতিতে দেশজ সংস্কৃতির উপাদানের সফল প্রয়োগ করে বাংলা নাট্যরীতিকে দাঁড় করিয়েছেন ইউরোপীয় নাট্যরীতির মুখোমুখি।
বাংলা নাটকের বি–উপনিবেশীকরণ প্রকল্পে আল দীনের নাম বিশেষভাবে বলার কারণ একটাই—আর তা হলো : লেবেদেফের হাত ধরে বাংলা নাটকের ইউরোপকেন্দ্রিক যে পরিচিতি নির্মিত হয়েছিল দেশের মূল নাট্যধারা থেকে বিযুক্ত হওয়ার মাধ্যমে, সেখানে আল দীন প্রথম বাংলার মূল নাট্য–ঐতিহ্যেকে গ্রাম্যতার খোলসমুক্ত করেন ‘ফোক ড্রামা’কে ‘বাংলা ড্রামা’ হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমে এবং গা থেকে ‘ফোক’–এর পরগাছাটিকে সাহিত্যগুণের মাধ্যমে ছাড়িয়ে দিয়ে। তিনি একই সাথে নাটকের ‘আঙ্গিক’/ফর্ম নিয়ে পশ্চিমারীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করেন। নাটকে উড়–নি, লাঠি প্রভৃতি ব্যবহারের মাধ্যমে দূরে ঠেলে দেন প্রপস ও সেটের প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে। পদ্য ও গদ্যের সংমিশ্রণে বর্ণনারীতিকে প্রসেনিয়ামের মূল ধারণা থেকে বের করে এনে দাঁড় করান পালাগান ও যাত্রাগানের আঙ্গিকে। তুলে আনেন বাংলা পরিবেশন সাহিত্যের আদি শিল্পতত্ত্ব দ্বৈতাদ্বৈতবাদকে।
আল দীনকে আমরা দেখি এক দীর্ঘ পথ–যাত্রা অতিক্রম করতে। অরুণ সেন১১ আল দীনের নাট্টাভিযানকে চারটি পর্বে বিভাজিত করেছেন। তা হলো : ক. প্রস্তুতি ও নিরীক্ষা পর্ব, খ. প্রথম পর্ব : কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাত হদাই, গ. দ্বিতীয় পর্ব : চাকা, যৈবতী কন্যার মন, হরগজ, ঘ. তৃতীয় পর্ব: বনপাংশুল, প্রাচ্য। আমি অরুণ সেনের বিভাজনের সাথে একমত। আল দীন অনিকেত অন্বেষণ (১৯৭২) নাট্যের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেন। এরপর একে একে লিখে যান নীল শয়তান, তাহিতি ইত্যাদি, সর্প বিষয়ক গল্প, জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা, সঙবাদ কার্টুন, মুনতাসীর, করিম বাওয়ালির শত্রু অথবা মূল মুখ দেখা, আতর আলীদের নীলাভ পাট প্রভৃতি। সেন (২০০০ : ৯৫) আল দীনের এ প্রস্তুতিকালীন পর্বে পশ্চিমা রীতিকে খুঁজে পান স্পষ্টভাবে। তিনি বলেন,
রিয়েলিজম বা ন্যাচারালিজমকে বর্জন করার যে প্রয়াসগুলো সফল হয়েছিল ইউরোপীয় নাটকে, তাদের গ্রহণ করার সময়ও তিনি ছিলেন অভিনবত্বেরই সন্ধানী। ‘থিয়েটার অব দি অ্যাবসার্ড’ চরিত্রের পারম্পর্য এবং রূপাবয়ব বা সংলাপের যুক্তিশৃঙ্খলাকে ভেঙে ফেলার, বাস্তবের মায়াকে লঙ্ঘন করার যে–যে আয়োজন করেছে, নাটককে উদ্ভট পরিসমাপ্তির দিকে নিয়ে গেছে, তার নানাবিধ লক্ষণকে তিনি ব্যবহার করেছেন।১২
তবে সেন একইসাথে এ কথাও স্বীকার করেছেন যে, বৈদেশিক প্রভাব থাকলেও কিন্তু সেগুলো একটি আরেকটির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তবে বিষয়ের দিক থেকে আল দীন কালিদাসের লেখনী থেকে সরে গিয়ে এক নতুন শকুন্তলাকে উপহার দেন। একে বিষয়গত এবং চরিত্রের সনাতনী সংকট চিত্রণের বি–উপনিবেশীকরণের প্রথম পদক্ষেপ হিশেবে দেখা যেতে পারে।
বি–উপনিবেশীকরণের আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ হিশেবে আমি চিহ্নিত করতে চাই ‘কিত্তনখোলা’ নাটককে। নাট্যের পশ্চিমা আঙ্গিক থেকে প্রথম তিনি নিজেকে সরিয়ে এনে দাঁড় করান বাংলার চিরায়ত বর্ণনাত্মক ভঙ্গিতে। এখানে আঞ্চলিক ভাষার ভঙ্গি এবং নিম্নবর্গের ব্যবহৃত শব্দমালা। এসব শব্দ ও বাক্য ভদ্র মধ্যবিত্তের কানে বড় আড় ঠেকে। আল দীন ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ এর মধ্যে বর্ণনাত্মক ধারায় লিখে ফেলেন কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাত হদাই। তিনি বাঙালি–নাট্যাঙ্গিকের অনুসরণে, কবিতা গান নাচ ও সংলাপের সমন্বয়ে কথকের মাধ্যমে পরিবেশন করেন তার বি–উপনিবেশীকরণের প্রথম কর্মসূচি। অরুণ সেনের মতে, “…সেলিম আল দীন তাঁর নিজের জমিতে প্রতিষ্ঠিত হলেন”১৩। লেবেদেফ পূর্বজদের সাথে বাংলা নাট্যের যে ছেদ ঘটিয়েছিলেন তা সেলিম আল দীন আবার জুড়ে দিলেন।
পাশ্চাত্যের জ্ঞানতাত্ত্বিক ঘুণে পোকা সহজেই উবে যায় না তার প্রমাণও আল দীন রাখলেন তাঁর উল্লেখিত ত্রয়ী নাট্যের গঠন প্রকাশের ক্ষেত্রে। তিনি একে ঘোষণা করলেন, ‘এপিক রিয়েলিজম’ হিসেবে। আধুনিক ও ধ্রুপদী নাট্যের অংশীদার হতে গিয়ে পাশ্চাত্যরীতিতে মহাকাব্যের মাপকাঠিকে ব্যবহার করতে চাইলেন নিজ কাব্যের তত্ত্ববিচারে। অর্থাৎ আল দীনের বি–উপনিবেশীকরণের নিরীক্ষার শুরুটা আধুনিক সাহিত্যতত্ত্বের তুলনামূলক বিচারের অধীনে বিশ্লেষণের দোষে দুষ্ট হলো।
তবে একইভাবে আল দীন আরেকটি তত্ত্ব যা তার সাহিত্যের প্রধানতম ভিত্তি তাকে আমাদের সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরলেন। তিনি কাউন্টার ডিসকোর্স হিসেবে তাঁর নাট্যের তত্ত্বায়নও করলেন নিজেই। তিনি এই তত্ত্বকে বললেন ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদী’। ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদ’ হল সেলিমের শিল্পভুবনে অন্যতম উদ্ভাবন। তিনি বাংলাদেশের ভূমিপুত্রদের সংস্কৃতির কাছে ফিরে গিয়ে দেখেন ধর্মীয় কৃত্যর সাথে শিল্প কৌশল একাঙ্গতি হইয়েছে এখানে বিস্তৃত পরিসরে। রবীন্দ্রনাথও বাংলা জাতীয় সাহিত্যের খোঁজে ধর্মকে সম্মিলনের কেন্দ্রে চিহ্নিত করেরছেন। সেলিম শ্রী চৈতন্য এবং সূফীবাদী ধর্মদর্শন থেকে দ্বৈতদ্বৈতবাদী শিল্পসত্ত্বকে গ্রহণ এই শিল্পভাবনাকে নিজের রচনার ভেতর থেকে একটি সেক্যুলার চরিত্র নির্ধারণ । বৈষ্ণব ধর্ম এবং সূফী মতবাদ অনুযায়ী মানুষ যখন ঈশ্বরের দিকে ধাবিত হয় অথবা ঈশ্বর যখন তাঁর সৃষ্টির সাথে মিলে যায় তখন কিন্তু স্রষ্টা এবং সৃষ্টির ভেতর কোনো ভেদরেখা থাকে না। সৃষ্টি এবং স্রষ্টার এই অভেদাত্মক রূপটি দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বের সূত্র বলে পরিচিত। দ্বৈতাদ্বৈতবাদ প্রত্যয়টি শিল্প মতাদর্শ হিসেবে সেলিম প্রথম প্রয়োগ করেন। সেলিমের মতে,
এই শিল্পতত্ত্বে একেব মধ্যে বহু এবং বহুর একের মধ্যে লীওন হবার দৃষ্টান্ত রূপে মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্য থেকে প্রভূত দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা যায়।ধরা যাক– পাঁচালি, এ একই সঙ্গে নাট্য, নৃত্য, গীত, কৃত্য, কাহিনী, উপাখ্যান, রাগরাগিনীর বিচিত্র সঞ্চয় তাঁর এক দেহে যেন নিখিলের সমস্ত বৈচিত্র এক অবিভাজ্য স্বর্ণ–সঙ্কেতে জ্বলজ্বল করে ।
সেলিম শিল্পের বহুত্বকে একাঙ্গীকৃত করে একের ভেতর সাঙ্গিকৃত করেছেন। এক্ষেত্রে সেলিমের অবস্থান পরিষ্কার,
আমাদের নাটক লিখিয়েদের উচিত নাটকের সঙ্গে অন্যান্য শল্পি মাধ্যমরে দ্বৈতাদ্বৈত সর্ম্পকটি বুঝে নেয়া। আঙ্গিকচেতনা সঙ্কীর্ণ হলে এ মাধ্যমে মানুষ ভাস্কর্যের আনন্দ আর সংগীতের দ্যোতনা পাবে না।
তিনি ১৯ শতকপূর্ব বাংলা সাহিত্যে এ লক্ষণগুলো চিহ্নিত করলেন। উদাহরণ হিশেবে বললেন,
এ একই সঙ্গে নাট্য, নৃত্য, গীত, কৃত্য, কথা, কাহিনী, রাগরাগিণীর বিচিত্র সঞ্চয়, তার এক দেহ যেন নিখিলের সমস্ত বৈচিত্র্য, এক অবিভাজ্য স্বর্ণ–সঙ্কেতে জ্বলজ্বল করে।১৪
তিনি দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যচিন্তার একটি পাটাতন নির্মাণের প্রস্তাব করলেন এবং প্রয়োগ হিশেবে চাকা, যৌবতী কন্যার মন, বনপাংশুল, প্রাচ্য প্রভৃতিকে হাজির করলেন। বি–উপনিবেশীকরণের এ–ধরণের প্রস্তাবনা এখন পর্যন্ত রবীন্দ্র–উত্তর সাহিত্যে আমরা আর–কাউকে হাজির করতে দেখি কী?
মিল, জোন্সদের হাত ধরে জ্ঞানতাত্ত্বিক চিন্তার অধীনে উন্নয়নমূলক–শ্রেণিবিভাজিত–বিবর্তনবাদী–ইউরো–কেন্দ্রিক যে কাঠামো আমরা ম্যাকাওলের শিক্ষা–পরিকল্পনার অধীনে গ্রহণ করেছিলাম তা আজও চর্চা করে যাচ্ছি। এ–ক্ষেত্রে আল দীনের একটি বক্তব্যের দিকে ফিরে তাকাই :
…দেখতে পাই আধুনিক পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান সাধনার পথে শ্রেণীকরণের প্রবল তাগিদ। সেই রুচি শিল্পসম্ভোগের স্পৃহায় নিত্যই উৎপাদন করে চলছে নব নব আঙ্গিক। আমরা সেই নৌকাতে সেই পালেই নিজের নাম লিখে চলেছি। সেই চলাটাকে অসম্মান করতাম না যদি না দেখতাম, নিজেদের গুনটানা বিশাল সাম্পান ডুবিয়ে দিয়ে উল্টা করতালি আদায় করতে চাই। অথচ একথা সাহস করে বলবার সময় এসেছে যে, শ্রেণীকৃত পাশ্চাত্য শিল্পরীতিসমূহ তার পদ্য, গদ্যচেতনা, ছোটগল্প, নাটক, উপন্যাস মাত্র দু’শ কি আড়াইশ বছরে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে এসেছে। আজ সেগুলোর সংজ্ঞা–সীমানা আঁকড়ে ধরে যতইনা শিল্পরচনার প্রয়াস করি, ব্যর্থ হতে বাধ্য।১৫
বিবর্তনবাদী চিন্তাকাঠামো সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে তাঁর মেটান্যারেটিভস–এর জন্য। মেটান্যারেটিভ/মহাবয়ান–এর কেন্দ্র হিশেবে আবির্ভূত হয়েছে ইউরো–কেন্দ্রিকতা। আল দীন সবসময়ই এই ইউরো–কেন্দ্রিকতাকে অস্বীকার করেছেন। সংস্কৃতির বিশ্বায়নকে তিনি মেনে নেন নি। উন্নয়ন ডিসকোর্স নির্ভর ইউরো–কেন্দ্রিক সভ্যতার বিকাশকে তিনি গ্রহণ করেন নি। এ কারণেই তিনি জ্ঞানের তত্ত্বীয় বি–উপনিবেশীকরণ–এর কর্মসূচি হিশেবে দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বকে হাজির করেছেন। এ বিষয়টি তাঁর বক্তব্যের আলোকেই আমরা বুঝতে পারি, তা হলো :
‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদী’ শিল্পতত্ত্বের ক্ষেত্রে আমি এ কথা নিত্যই মনে রাখছি যে, বিশ্বনন্দনতত্ত্ব বা শিল্পসূত্রের সমকালীন ক্ষেত্রে এমন কোনো সংজ্ঞা সৃষ্টি সম্ভব নয় যা সর্বব্যাপী ও সর্বত্রগামী। এ কথাও সত্য যে, সর্বকালের জন্য প্রযুক্ত, অবশ্য পালনীয় শিল্পসিদ্ধির চূড়ান্ত নিশ্চয়তা দানকারী কোনো শিল্পতত্ত্ব জগৎ–সংসারে নেই। সঙ্গে আরও এক পঙ্ক্তি যুক্ত হলো একথা বলার জন্য যে, শিল্পতত্ত্বের শাখা–মুকুল যতই ঊর্ধ্বগামী হোক, এর মূলটা দেশকাল, ভূগোল ও জনপদেই নিবদ্ধ।১৬
এখানে আরেকটি প্রশ্ন উঠতে পারে যে, মধুসূদন, রবীন্দ্র–অন্তঃপ্রাণ আল দীন দেশকালের সীমা নির্ধারণে সংস্কৃত ধারাকে কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন কী? আমার এ লেখায় আমি শকুন্তলাকে বিষয়ের দিক থেকে বি–উপনিবেশীকরণের প্রক্রিয়া হিশেবে উপস্থাপন করেছি, যা আরো সংশয় তৈরি করতে পারে। পূর্বেই বলেছি, আল দীন উপনিবেশের জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্যকে অস্বীকার করার জন্য একটি লম্বা জার্নি করেছেন। এ জার্নিকে তিনি উল্লেখ করেছে নিুরূপভাবে :
আশি–নব্বুইয়ের ঠিক মধ্যভাগে, বাঙলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের আলো অন্ধকারে একদা বেরিয়ে পড়ি। সিদ্ধাচার্যদের কৃত্যগৃহ থেকে নাটুয়াবেশী গোর্খনাথের মাদল–নৃত্য দেখে চলে যাই, জয়দেবের প্রিয় পতœী পদ্মাবতীর নাট্যের আসরে। বহুদূর যেতে যেতে, শঙ্খ কাঁসর আর ঢোল–করতালের মিলিত ক্রেঙ্কারে খুব একজন অতি গৌরবর্ণ, উদ্দ—নৃত্যে বিভোল কান্তিময়ী পুরুষকে দেখতে পাই। কান্তিময়ী পুরুষ, কেননা তিনি একই সঙ্গে কৃষ্ণাবতার ও রাধারূপিণীও বটেন।১৭
এই কান্তিময়ী পুরুষ চৈতন্যের কাছ থেকে তিনি প্রথম পরিচিত হন ‘অচিন্ত্য দ্বৈতাদ্বৈতবাদ’ তত্ত্বেরকৃষ্ণের স্বাঙ্গীকৃত এই নিখিল, বাঙালির শিল্পরীতি ও সংস্কৃতি–চেতনার এক নৈসর্গিক ফসল। আল দীন এ শিল্পতত্ত্বের প্রতিরোধী ও প্রভাব–বলয়কে বর্ণনা করেন ঠিক এভাবে :
বাঙলায় সহস্র বছর ধরে বাইরের বিশেষ কোনো ধর্ম বা ধর্মাচারণ এবং শিল্পতত্ত্ব সহজে প্রবেশাধিকার পায় নি। নাথবাদ কিংবা অচিন্ত্যদ্বৈতাদ্বৈতবাদের প্রবল প্রভাবের কারণে বাইরের শিল্পতত্ত্ব অন্তত ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত আমাদের শিল্পস্বাতন্ত্র্যকে হরণ করতে পারে নি।১৮
এ বক্তব্য থেকে এটা প্রমানিত হয় যে, বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে জ্ঞানতাত্ত্বিক কেন্দ্রিকতা তৈরি হয়েছে আল দীন তা অস্বীকার করেছেন। বিশ্বকেন্দ্রিকতা ভেঙে দেয়ার সাথে সাথে স্থানীয় আধিপত্যবাদকে রুখে দিয়ে শিল্পের এক বহুত্বের স্বর খুঁজে পেয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের নিজস্ব স্বরকে তিনি বাংলার জল আবহাওয়ায় বেড়ে–ওঠা পালাগান, কবিগান সহ সকল প্রক্রিয়ার ভেতরে খুঁজে পেয়েছেন এবং তাত্ত্বিক কাঠামোকেও চিহ্নিত করেছেন। অনেকে এ তাত্ত্বিক কাঠামোর দুর্বলতা খুঁজে পেতে পারেন। তবে দুর্বলতা খোঁজার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া অনুসরণ জরুরি। এ প্রক্রিয়াগত সমালোচনা শেষ পর্যন্ত বাংলা নাট্যের স্বরকে আরো ভিত্তি প্রদান করবে। কারণ উপনিবেশীকরণ প্রকল্পকে রুখে দিতে চাইলে আজকের উত্তর–ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় কাউন্টার ডিসকোর্স জরুরি। আল দীনের বড় সার্থকতা তিনি বি–উপনিবেশীকরণের কর্মসূচির তাত্ত্বিক কাঠামোকে আমাদের সামনে হাজির করেছেন। একইসাথে সংস্কৃত তত্ত্বের হেজিমনিকেও প্রতিরুদ্ধ করেছেন। আল দীন তাঁর চিন্তাকে হাজির করেন নিরূপভাবে, তা হলো :
আমি বর্তমান এই বিশ্বাসে বদ্ধমূল যে প্রাক–বুদ্ধকাল, চর্যাপদ ও উত্তরকাল থেকে উনিশ শতকের প্রারম্ভ পর্যন্ত বাঙলা গান, নাট্যপালা, উপাখ্যান, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, এমন কি এদেশে প্রচলিত নানা ধর্মদর্শনের মধ্যে একটি পারস্পরিক সাধারণীকৃত নন্দনতাত্ত্বিক ঐক্য অনুধাবন করা যায়। তাতে একথা প্রমাণিত হতে পারে যে, এদেশের প্রাচীন ও মধ্যযুগের নানান শিল্পমাধ্যমে সমাজ–সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীগত শিল্পরুচি ও সৌন্দর্যবিচারের একটি সাধারণ সূত্র ছিল। বাঙালির নন্দনতাত্ত্বিক চিন্তার সূত্রবদ্ধ কোনো গ্রন্থ মেলে না এ যেমন সত্য, তেমনি মেলে না বলেই যে একালেও অনাবিষ্কৃত থাকবে, তা উচিত হয় না। এই আলোচনার রশ্মি ধরে বলা যায়, নানা মাধ্যমে ধর্মতত্ত্ব বা মুক্ত মানব–রসের স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণায় প্রাচীন ও মধ্যযুগে জীবন জগতের যে অলঙ্করণরীতি ও শৈলী তা সংস্কৃত নন্দনতত্ত্বের আশ্রয়ী নয়। কিন্তু সহস্র বছর ধরে গড়ে ওঠা আমাদের শিল্প–সৌন্দর্য বিচাররীতির ক্ষেত্রে উনিশ শতক থেকে সংস্কৃত ও পাশ্চাত্য নন্দনতত্ত্বের প্রভাব হয়ে ওঠে নিরঙ্কুশ। ক্রমে কুড়ি শতকে এসে পাশ্চাত্য প্রভাব অপ্রতিরোধ্য বলেই স্বীকৃত ও চর্চিত হয়ে আসছে। এর ফলে সহস্র বছরের শিল্পকর্মের যে দেশজ ধারাবাহিকতা আমরা দেখি, তার বিচারের ক্ষেত্রে একটি অনপনেয় সঙ্কটের সৃজন হল। সহস্র বছর ধরে যে সব রচনা আমাদের জাতির চিত্তজয়ী বলে কালজয়ী হয়ে উঠেছিল। এ্যারিষ্টটল, হোরেস, লনজাইনসের নন্দনতত্ত্বের বিচারে সেগুলো অকিঞ্চিৎকর ঠেকে। আমাদের পালা নাটকগুলো নাটকই নয়, কাব্য। বিশাল মঙ্গলকাব্য আট দিবস ধরে পরিবেশিত হত, তা নিতান্ত পুচ্ছপল্লবিত রচনা। আমাদের শিল্পরুচির ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে এই মধ্যখ–ন নাটকের কতদূর ক্ষতি করেছে সে বিচারের ভার ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দিলেও মর্মের অন্তরে এক বিষমচ্ছেদের কষ্ট পাই।১৯
আল দীন একে একে কথানাট্যের অধীনে লিখে চলেন চাকা, যৌবতী কন্যার মন, বনপাংশুল, প্রাচ্য, স্বর্ণবোয়াল, হরগজ, নিমজ্জন, ধাবমান। পশ্চিমা রীতিকে নাট্য রচনায়, অভিনয়ে, সময়ের দৈর্ঘ্যে তিনি অস্বীকার করেন সম্পূর্ণভাবে। বনপাংশুল ও প্রাচ্য সাহিত্যে বাংলার পাঁচালিরীতির সফল প্রয়োগ ঘটান। এ পদ্ধতিকে ঙৎধঃঁৎব২০ হিশেবে উল্লেখ করেছেন উগান্ডার লেখক পিউ জিরিমি—তার মতে, বি–উপনিবেশীকরণ প্রকল্পের জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতি বিশেষ। ঙৎধঃঁৎব মূলত : ঙৎধষরঃু + ষরঃধৎধঃঁৎব। আল দীনও একই পথে হেঁটেছেন কিচ্ছা, হাস্তর প্রভৃতি ব্যবহারের মাধ্যমে। এ এক ভিন্ন নাট্যরীতি যা পশ্চিমা নাটক থেকে সম্পূর্ন ভিন্ন। এ রীতি একান্তই বাংলা নাটকের নিজস্ব স্বর।
আল দীনের ‘চাকা’ রচনা থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল রচনাকে আমি নাটক না বলে সাহিত্য বলতে আগ্রহী। এ প্রবন্ধের শুরুতেই আল দীনের বক্তব্যকে আমি যে প্রথম চারটি ভাগে বিভাজিত করেছি, সেই ভাগ গুলিতে দেখতে পাই পশ্চিমা নাট্য রচনার সকল ব্যাকরনিক সীমা ভেঙে ফেলার ইচ্ছা। তিনি শুধুমাত্র ইচ্ছা প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হন নি। তার রচনার দিকে তাকালে দেখতে পাবো গদ্য ও পদ্যের সংমিশ্রণ। গদ্যও রচিত হচ্ছে কাব্যময়তার সকল গুণাগুণ নিয়ে। এক্ষেত্রে যৈবতী কন্যার মন রচনার পরী–পর্ব থেকে খানিকটা পড়া যেতে পারে :
পরীর পায়ের নখে সাদা চন্দনের প্রলেপ। উন্মাদ জমিদার অন্ধকার ঘরে গা শুঁকতে থাকে—হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে—তোমার পায়ের নখে এত চাঁদ কেন? আমি চুমু খাবো পায়ে। শিউরে ওঠে বিন্দু। বিন্দু না পরী।২১
পাঠকের কাছে চাকা, যৌবতী কন্যার মন, হরগজ, স্বর্ণবোয়ালকে মনে হবে উপন্যাস পড়ছে। অসম্ভব মনে হবে এর মঞ্চে উপস্থাপনকে এবং সম্পূর্ণ রচনাটি মঞ্চে উপস্থাপনে দশ থেকে বার ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। এ–কাজটি রবীন্দ্রনাথকে আমরা করতে দেখি তার নাটক, নৃত্যনাট্য ও শেষ দিকের উপন্যাসের ক্ষেত্রে। তারাশঙ্করকে দেখি কবি রচনার মাধ্যমে এ–প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হতে। আল দীন রবীন্দ্রনাথের এ প্রতিরোধী অবস্থাকে একটি তত্ত্বগত এবং প্রায়োগিক রূপদানে সক্ষম হয়েছেন।
রবীন্দ্র–অন্তঃপ্রাণ আল দীন রবীন্দ্রনাথের মতোই আন্তর্জাতিকতাবাদের দিকে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন। স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেও আমরা তার লেখনীকে মহাকাব্যিক প্রয়াসের দিকে এগিয়ে যেতে দেখি। ধর্ম, স্থানীয় মিথ, বিষয়–চরিত্র–সময়ের ব্যাপ্তিতে আল দীন তার প্রয়াসকে অব্যাহত রাখেন।
আল দীনের নাটকের প্রয়োগ নিয়ে কিছু প্রশ্ন প্রায়ই শুনতে পাই। তা হলো, নাটকের পরিবেশন পালা নাট্যের আদলে হলেও তা মধ্যবিত্তের থিয়েটার ফ্যান্টাসির নির্দিষ্ট সময়কে মেনে উপস্থাপিত হয়। এ নাট্যের রচনার ব্যাপ্তি কয়েক দিবসব্যাপী হলেও তা পশ্চিমা প্রসেনিয়ামকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে দেয় না। দৃশ্যের দ্বিমাত্রিক অবস্থানকে ভেঙে বহুমাত্রিক করলেও প্রসেনিয়ামের বাইরের কাঠামোকে সে ভাঙে নি কোথাও। চরিত্রের সংকট আধুনিক মধ্যবিত্তের সংকটকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। কখনও কখনও কালিন্দীর বা পরীর মনোগত দ্বৈততা ছাড়িয়ে যায় তার শ্রেণিকে। চাকা নাটকের গাড়োয়ানের চিন্তায় উঁকি দিয়ে যায় রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অসংগতির আধুনিক মধ্যবিত্তীয় বিশ্লেষণ। গাড়োয়ানকে রাজনৈতিক সচেতনতার পদ্ধতিগত বিশ্লেষকে পরিণত করে—যা বড়ই কানে ঠেকে অনেকের। এক্ষেত্রে আমি বলতে চাই যে, উত্তর–ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে পিউরিটান হবার সুযোগ আছে কি–না। সংস্কৃতির মিশ্রণকে আমাদের মেনে নিতে হবে। এর ভেতরকার পশ্চিমা প্রভাবগুলো এবং স্থানীয় সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো চিহ্নিত করতে হবে। স্থানীয় সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর নিজস্ব পরিসর ও উপযোগিতা নির্ধারণ করতে হবে। উপনিবেশকের সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর তুলনায় স্থানীয় সংস্কৃতির ওপর গুরুত্বারোপ অধিক করতে হবে। অর্থাৎ কেবল আলাদা পরিচয় নির্মাণ করলেই চলবে না, বরং হাইব্রিড আইডেনটিটিকে স্বীকার করে নিয়ে প্রাক–ঔপনিবেশিক উপাদানগুলোকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনের পথ নির্মাণ করতে হবে। হোমিভাবা তার হাইব্রিডিটির আলোচনায় এ বিষয়টিকে গুরুত্ব প্রদান করেছেন। এডওয়ার্ড সাইদের মতে, সালমান রুশদি মিডনাইট চিলড্রেনসে এ–কাজটিই করেছেন। আর আল দীন তার কথানাট্যে এ–কাজটি করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে।
৬
জাতীয়তাবাদী চিন্তাই উস্কে দিয়ে থাকে বি–উপনিবেশায়নের কর্মসূচিকে। একটি সাধারণীকৃত আকাঙ্ক্ষাই প্রাক–ঔপনিবেশিক সময়ের ঐক্যের নির্ণায়ক। মানুষ তার সংস্কৃতির একটি পরিচয় নির্ধারণ করে এবং তা তুলে ধরতে চায় সমগ্র মানুষের মাঝে। শুরু হয় জ্ঞানতাত্ত্বিক সংকটের লড়াই। এ সংকট থেকে উত্তরণের কর্মকৌশল নির্ধারণ করার জন্যই সে বি–উপনিবেশীকরণ–প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। ফ্রাঞ্জ ফানো তার এক গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায় অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক অধ্যায়—এখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, স্থানীয় বুদ্ধিজীবীটি তার প্রকৃত পরিচয়কে স্মরণ করে এবং তাকে আত্তীকৃত করার প্রচেষ্টাসমূহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। সাইদ, কাবরাল, নগুগিদের কাজেও জাতীয় চরিত্র নিরূপণের কৌশল স্পষ্ট। জাতীয়তাবাদী অবস্থানের সাথে উপনিবেশের বিরোধিতা সম্পৃক্ত। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও আমরা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎসভার বার্ষিক অধিবেশনে পড়া বাংলা জাতীয় সাহিত্য প্রবন্ধে সর্বজাতি জাতীয় সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা এবং কৌশল তুলে ধরতে দেখি। তাহল, বঙ্গসাহিত্যের উন্নতি ও ব্যপ্তি–সহকারে কেবল যে সমস্ত বাঙালির হৃদয় অন্তরতম যোগে বদ্ধ হইবে তাহা নহে, একসময় ভারতবর্ষের অন্যান্য জাতিকেও বঙ্গসাহিত্য আপন জ্ঞানান্নবিতরণের অতিথিশালায়, আপন ভাবামৃতের অবারিত সদাব্রতে আকর্ষণ করিয়া আনিবে তাহার লক্ষণ এখণ হইতেই অল্পে অল্পে পরিস্ফুট হইয়া উঠিতেছে।
বাংলাদেশে বাঙালি ‘জ্ঞানান্নবিতরণে’ কিংবা ‘আপন ভাবামৃতের অবারিত সদাব্রতে’ আকর্ষণ করতে বাঙালির উদ্যমের শেষ নেই; কিন্তু অপরের ভাবমৃতের সন্ধানে বাঙালি ভীষণ নিরুদ্যম। ফলে ‘জাতীয় সাহিত্য’ বলতে কেবলই এক জাতির সাহিত্যের মুখচ্ছদ মনে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ‘জাতীয় সাহিত্যে’ মূলত খুঁজতে চেয়েছেন ‘সম্মিলিত জাতীয় হৃদয়’; জাতীয় সাহিত্যের জন্য সম্মিলন একটি জরুরী কৌশল। ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতায় পরিবর্ধিত লেখকদের অগ্রগতির তিনটি স্তরকে চিহ্নিত করেছেন ফ্রাঞ্জ ফানো।
প্রথম স্তরে দখলদার ইউরোপীয় সংস্কৃতির আত্মস্থীকরণ,
দ্বিতীয় স্তরে জাতীয় আদি সত্তা–অন্বেষণের তাগিদ,
তৃতীয় স্তরে জনগণসম্পৃক্ত জাতীয় সাহিত্য; জাতীয় সাহিত্যকে তিনি মনে করেন লড়াইয়ের সাহিত্য, বিপ্লবী সাহিত্য।
তবে কখনও কখনও এ জাতীয়তাবাদী অবস্থান প্রবলরূপ ধারণ করে থাকে। জাতীয়তাবাদের প্রাবল্য উত্তর–ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে অপরাপর জাতিসত্ত্বার জন্য এক নয়া ঔপনিবেশিক শক্তিতে পরিণত হয়। আমরা যদি স্বাধিনতা–উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্যের দিকে ফিরে তাকাই তবে দেখব প্রবল বাঙালির একটি সাহিত্য নির্মীত হয়েছে যেখানে একটি কল্পিত বাঙালিকে নির্মাণ করে বাংলাদেশ নামক বর্তমান ভুখ–ের একক মালিকানা উদযাপনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আল দীনও কি জাতীয়তাবাদের একই চোড়াগলি পথে হেঁটেছেন নাকি তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবিত পথকে বাস্তবে রূপদানের চেষ্টা করেছেন তা এখন বিবেচনার বিষয়। কারণ বিউপনিবেশকরণ প্রকল্প মোটা দাগে দুটো দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে।
১. ঐতিহ্য নির্ভরতা: অর্থাৎ উপনিবেশ পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরে যাবার চেষ্টা করে একটি দোষমুক্ত ভার্জিন প্রকৃয়াকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা।
২. আধুনিকতাকে প্রশ্নাতিতভাবে নেতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা।
৩. সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের অনুশীলন করা। এবং
৪. নিজেই অপরাপর জাতিসমূহের জন্য একটি নয়া উপনিবেশ স্থাপন করা।
৭
সেলিম আলদীনের বাংলা সাহিত্যের বিউপনিবেশকরণ প্রকল্প হল ‘কথানাট্য’ : সর্বজাতি জাতীয় সাহিত্যের রূপরেখা প্রণয়ন
প্রথমেই একটি বিষয় পরিষ্কার করে নেয়া জরুরী যে, কথানাট্যকে কথকতার সাথে গুলিয়ে ফেললে খুবই ভুল হবে। কারণ ‘কথকতা’ হল একধরনরে হাবভাব–ভঙ্গমিা ও গীত অথবা সুর সংযোগে কোনো কাহিনী পরিবেশন।যিনি কথকতার আশ্রয়ে কাব্য–পুরাণাদি পরিবেশন করেন তিনি কথক। বাঙলায় কথকতা মহাভারতরে ধারায় আগত–পরে ‘চৈতন্যভগবত’ চৈতন্যমঙ্গল’ প্রভৃতি কাহিনী কথকতার ধারায় রচিত।সেলিমের কথানাট্য কথকতার থেকে একেবারেই ভিন্ন। তিনি নিজেই ‘কথানাট্য’ এর ব্যাখা হাজির করেছেন এভাবে যে, “কথানাট্য : বাঙলা পাঁচালি ও কথকতার ধারায় রচিত সমকালীন নাটক।তবে একে কথকতার পরিবেশনরীতি অনুসৃত হয় না।কথানাট্যের আঙ্গিকে বর্নণা ও সংলাপ অদ্বৈতরূপে।পাশ্চাত্য রীতিতে নাটক মাত্রই সংলাপভিত্তিক এবং সেখানেবর্নণার কোনো অবকাশ রচিত হয় না।কিন্তু মধ্যযুগের বাঙলা পাঁচালি ও কথকতার পরিবেশনায় দেখা যায়–এতে বর্ণনা–গীত–নৃত্য–সংলাপ অভূতর্পূব ঐক্যে গ্রনহিত।কথানাট্যে এই নিয়মটাকেই অনুসরণ করতে দেখা যায়। চাকা প্রভৃতি নাট্য গদ্যে রচিত–তাতে দৃশ্যভাগ নেই–সংলাপও অবিমিশ্র নয়। মনে হয় সমগ্র কথার নৈপথ্যে এক জন বর্ণনাকারী (কথক বা পাঁচালি গায়কের মত বিদ্যমান)। তিনি বলেছেন–ব্যাখ্যা করছেন এবং অন্য চরিত্রের হাবভাবও প্রদর্শন করছেন। আবার চরিত্রাভিনেতাগণ স্ব–স্ব চরিত্রের ব্যাখ্যার সংঙ্গে স্বীয় সংলাপের বহির্ভূত অন্য চরিত্রের মনস্তত্ত্ব–নাট্যে বর্ণতি নিসর্গের আবহ–ঘটনা ও পরিবেশ বর্ণনায় অবতীর্ণ হচ্ছেন ।এ নিঃসন্দেহে বাঙলা কথকতা পাঁচালির ধারার আধুনিক সংস্করণ।”
সেলিম আল দীন প্রথমে বর্ণনাত্বক বিষয়টির তত্ত্বায়ন করলেন এবং তা চাকা নাটকে তুলে ধরলেন। তারপর যৌবতী কন্যার মন, হরগজ রচনাটিতে দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বের সাথে বর্ণনাত্মক নাট্যের সম্মিলন ঘটালেন। নাটকের আঙ্গীক সম্পূর্ণ রূপে আদিকল্পের স্থানান্তর হল।নাটক প্রসেনিয়াম–এ থাকল কিন্তু সে রচনা ও প্রয়োগে ফিরিয়ে আনল বাংলাদেশের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহি রীতিকে তবে অনুপুঙ্খভাবে নয়। এখানে বর্তমানের শিক্ষিত শহুরে জনগোষ্ঠীর উপযোগী করে এক নয়া প্রদর্শনী।এটা সেলিম–ইউসুফের র্বতমান সমইয়ের স্বাধিনতা উত্তর বাংলাদেশের একটি স্বতন্ত্র ধারা নির্মাণ করল।একে ঐতিহ্য আশ্রিত দ্বৈতাদ্বৈতবাদী বর্ণনাত্মক নাট্য ।এটা কথানাট্যের এক নয়া পরিবেশনা হাজির করা হল।সেলিম এটাকে কথানাট্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
আব্দুল্লাহ আল–মামুন ‘বাংলাদেশে নাটক রচনা : ধারা ও বিবর্তণ’ প্রবন্ধে বাংলাদেশের জাতীয় নাট্য ঐতিহ্য নির্মিত হয়েছে কিনা তাঁর খোঁজ–খবর করেছেন।সেখানে তিনি সেলিম আল দীনরে কাজেই একমাত্র সেই ধারা খুঁজে পেয়েছেন।সমগ্র আলোচনাটিতে কেবল মাত্র সেলিম প্রসঙ্গে আলোচনাতেই তিনি মন্তব্য করেছেন যে,
সেলিম আল দীনরে নাট্যরচনায় লোকজ ঐতিহ্যের নিরন্তর অনুসন্ধান এবং যথাযথ প্রয়োগ আমাদের নাট্য ঐতিহ্য নির্মাণে আমাদের অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছে ।
সেলিমের ঐতিহ্য চেতনার নিরিন্তর অন্বেষণকে সৈয়দ শামসুল হক দেখেন এভাবে যে,
সেলিম অনবরত সন্ধান করে চলেন প্রকাশের নতুনতর মার্গ; নতুন, কিন্তু বাঙলা ভাষার সৃষ্টিবুদ্ধি এবং হাজার বছরের ধারাবাহিকতার অন্তর্গত অবশ্যই।বাঙলায় তিনি লেখেন কারণ বাংলার মানুষের অস্তিত্ব এবং জগৎ–বোধ, যাপতি জীবনের স্বপ্ন ও যন্ত্রণা তাঁর বিষয়–অপচি তা বিশ্বের সকল মানুষেরই মানচিত্র হয়ে ওঠে বটে।
সলেমিরে কাজ যে একটি র্পযায়ে উপনীত হয়ছেে তা আমরা দবেশে রায়রে সমাপনি মন্তব্যে দখেতে পাই,
সেলিম আমাদের তেমন এক স্রষ্টা যাঁকে গ্রহণ করতে আমাদের নতুন নন্দনতত্ত্ব তৈরি করতে হবে ।
যদিও সেলিমের রচনা বিশেষ করে চাঁকা থেকে শুরু করে পরবর্তি রচনাসমূহকে তিনি নিজেও নাটক হিসেবে উপস্থাপন করেন নি। যেহেতু ঢাকা থিয়েটার একে নাটক হিসেবে মঞ্চে উপস্থাপন করেছে তাই জাতীয় নাট্য আঙ্গিকপর্বে একে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছি। দেবেশ রায় এক্ষেত্রে বেশ সরল এক মতামত হাজির করেছেন,
আমি নিশ্চিয়ই সেলিমের কাজের সাফল্য, ‘বাংলা নাটককে বিশ্বমানে উন্নীত করা’–এই ভাষায় ধরতে চাই না। আমার তো কিছুই জানা নেই–কাকে বাংলা বলে, কাকে নাটক বলে, কাকে বিশ্বমান বলে।” এ–বিষয়ে আমাদের জ্ঞানের বহর কীরকম তা আমাদের থিয়েটারের বোল–বোলাওয়রে ভুল ইতহিাস তৈরির গল্প করতে গিয়ে আমি বলেছি।
আমি এই মুহুর্তে এর বেশি বলতে চাইছি না যে সেলিম একটি পদ্ধতি আন্দাজ করে তাঁর যন্ত্রপাতির ক্ষমতা সবে শানাতে শুরু করেছিলেন। সেই যন্ত্রপাতি ব্যবহারে লাগবে কী না–তাঁর নিষ্পত্তি সে করে যেতে পারেন নি।
সেলিমের এটা ব্যর্থতা নয়। এটাই সেলিমের কল্পনা ও কাজরে সামর্থনের প্রমাণ যে সে তাঁর নাটকগুলিকে নাটকও বলেন নি।সেগুলিকে নাটক বলেছি আমরা, অন্য কোনো শব্দের অভাবে। সেলিমও আরো নানা শব্দ বলেছেন।
সেলিমের এই নাটকগুলিকে যে নাটক বলেই ডাকতে চাইছি আমরা, তাঁর কারণ প্রযোজক–পরিচালক নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু এগুলোর জন্য সেরকম একটা পাঠ তৈরি করেছেন।
বাংলাদেশের সর্বজাতি জাতীয় নাট্য আঙ্গিক নির্মাণের প্রকল্প সেলিম–ইউসুফ দ্বৈরথ থিয়েটার চর্চার গোঁড়া থেকেই। আর এক্ষেত্রে তাঁরা ঝাঁপ দেন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর নানা সাংস্কৃতিক তৎপড়তার ভেতরে। একাজটি তাঁরা নিভৃত গিবেষকের মত করে যেতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা এসব সাংস্কৃতিক তৎপড়তার স্থানীয় চর্চাকে বেগবান করবার লক্ষ্যে এক আন্দোলন গড়ে তোলেন সমগ্র বাংলাদেশে। এর নাম ‘গ্রামথিয়েটার আন্দোলন’। ৯০–এর দশকের গোঁড়ার দিকে এ আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। একে উপজীব্য করে বাংলাদেশের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত চষে বেড়াতে শুরু করেন সেলিম–ইউসুফ। তাঁদের কাছে দীনেশ চন্দ্রের সেই বাংলাদেশ একে একে খুলে যেতে শুরু করে। সেলিম নাটক রচনার প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে আসতে শুরু করেন ‘চাকা’ রচনার ভেতর থেকে। তিনি তাঁর রচনাকে বেগবান করবার জন্য দীর্ঘ গবেষণার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং পিএইচডির অভিসন্দর্ভ রচনা করেন ‘মধ্যযুগরে বাংলা নাট্য’–এর ওপর। সৃষ্টিশীল লেখক যখন তাঁর সৃষ্টির পুষ্টি খুঁজতে গভীর গবষেণায় অভিনিবেশ করেন তখন তিনি কয়লার খনির ভেতরে সোনার ফলনতো পাবেনই। সেলিমও দেখা পেলেন বাংলাদেশের হাজার বছর বয়সি নাট্য আঙ্গিকের।
সেলিম কথানাট্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে এক সংর্কীণ পথ থেকে বের করে ভৌগোলকি সীমারখোয় স্থাপন করলেন। জাতীয়তাবাদকে একমাত্র ভাষা কেন্দ্রিকতা থেকে একটি বহুত্ববাদি ‘কল্পিত’ জাতীয় চেতনা নির্মাণে নিজেকে ব্যপৃত করলেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার সাংস্কৃতিক কৌশলকে নিজের রচনাতে অর্ন্তভূক্ত করলেন। বনপাংশুল এর এক অনন্য উদাহরণ।এটা আরও মূর্ত হয়ে উঠল ইউসুফ যখন এই রচনা মঞ্চে অনুবাদ করলেন।এখানে গীত থেকে শুরু করে বাদ্যযন্ত্র ও বিভিন্ন প্রপসরে সংমিশ্রণ সংস্কৃতির বহুত্বকে একীকরণ/একাঙ্গীকরণ করলেন।এ এক বাংলাদেশের অন্য নাট্য।ঢাকা থিয়েটার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে স্থাপন করল।রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে হয়ত ‘ধর্ম’কেন্দ্রিক জাতীয় ঐক্য নাট্যের মাধ্যমে যে প্রতিস্থাপিত হতে পারে তা অবলোকন করতে পারতেন।বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার আদিকল্পের স্থানান্তররে এক নয়া রাজনীতি।
পরবর্তীতে ঊষাউৎসব, স্বপ্নরমণীগণ–এ ভাষার একাঙ্গিকরণ করা হয় যা কথানাট্যের আরেকটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ যেখানে অপরাপর জাতিসত্ত্বার ভাষা ও গীত–নৃত্যের কৌশলকে অদ্বৈত করার নিরীক্ষা করা হয়েছে। বনপাংশুলে’ সর্বপ্রাণবাদী দর্শনকে ব্যবহার করা হয়েছে মান্দি জনগোষ্ঠীর নিজের দর্শন ।এই সর্বপ্রাণবাদকে সেলিম ‘ধাবমান’ ও ‘পুত্র’ রচনাতে একীকরণের নিরীক্ষা করেছেন যেখানে মানুষ পুত্র ও গরু পুত্র এবং গাছ ও গাছে ফাঁস নেয়া পুত্রের সর্ম্পককে একীকরণ করে অদ্বৈত করা হয়েছে।
সেলিম কথানাট্যের দ্বৈতাদ্বৈতবাদী বর্ণনাত্মক পাঁচালি বাংলাদেশের ভৌগোলক সীমারেখার অন্তর্ভূক্ত নানামুখী সংস্কৃতি এবং দর্শনকে একীকরণ/একাঙ্গীকরণ করনে। একীকরণ/একাঙ্গীকরণ/ফউিশন ছিল সেলিমের শিল্পতত্ত্বের ক্ষেত্রে শেষ অবস্থান। এখানে তিনি,
১. শিল্পসৃষ্টির কৌশল, রচয়িতার ভাব ও উপকরণগত সংশ্লেষণ পর্যবেক্ষণ,
২. ভিন্ন এমনকি বিপরীত স্বভাবের উপাদানের একীভূত রূপ সৃষ্টি কৌশল বিচার এবং
৩. উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর একীভূত উপাদানরূপে নর্ঞথক হয়ে উঠেছে কিনা তা দেখা।
এই তত্ত্বকে নিয়ে সেলিম উৎসাহীত ছিলেন সংস্কৃতিরবহুত্বকে অদ্বৈত করতে। পাশাপাশি সমগ্র বিশ্বের ক্লাশিকস ও শিল্প প্রবণতাকে তিনি একীভূত করতে চেয়েছেন।ফউিশনের ভেতর ঘটে যাওয়া গ্রহীতা/রিসিভার এবং দাতা/ডোনার–এর শ্রেণিগত ভিন্নতা নিয়ে নানা ধরণের বাহাসে উপনীত হওয়া যেতে পারে। অধিপাত্যশীল সংস্কৃতি হিসেবে বাঙালির অধিপত্য সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হবে কিনা বা এর প্রবণতা নিয়েও বাহাসে উপনীত হবার অবকাশ রয়ে যায়। তবে এ তত্ত্বের ভেতরে তাঁকালে দেখবো যে, একীকরণও মূলত অদ্বতৈ করতে চায় সবকছিুকে কারণ এটা দ্বতৈ নয় বহুত্ত্বকে একীকরণ করে। এ জন্য সলেমি কথানাট্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির ঐক্য স্থাপন করেছেন এবং একটি ‘কল্পিত’ জাতীয় সংস্কৃতির প্রস্তাবনা হাজির করেছেন। ১৯৭১–উত্তর বাংলাদেশে জাতীয় চেতনার বিকাশ জরুরি বলে যা আজ আমাদের সামনে উপস্থিত। এই বাংলাদেশ তাঁর দেশের সংস্কৃতির বহুত্ত্বকে স্বীকার করতে সংকীত এবং আদিবাসী প্রশ্নে নানা টালবাহানায় উপনীত। অথচ সেলিম–ইউসুফের প্রস্তাবিত ‘কথানাট্যে’ সংস্কৃতির অদ্বৈতদ্বৈতা এক নয়া বাঙালি জাতীসত্ত্বার কথকথাকে শুধুমাত্র ভাষা কেন্দ্রিক নয় পাশাপাশি ভৌগোলিক সীমারখোয় বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার ‘কল্পনা’ নির্মাণ করবে।