বাংলাদেশের ‘আদিবাসী চলচ্চিত্রে’ ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীর নিজস্ব শিল্প নির্মাণ কৌশল বিশ্লেষণ।

ভূমিকা

চলচ্চিত্রের সূচনা হয়েছিল চলমান ছবি দিয়ে গল্প বলার চেষ্টা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। শুধু গল্প বলাই যদি একমাত্র লক্ষ এবং উদ্দেশ্য হতো তাহলে হয়তো চলচ্চিত্র ‘শিল্প’ হয়ে উঠতে পারত না। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ গল্প শুনে এসেছে, লিখে এসেছে, পড়ে এসেছে। তাই শুধু গল্প বলা কিংবা গল্প শোনা চলচ্চিত্রের উদ্দেশ্যের মধ্যে যদি সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে চলচ্চিত্র ‘শিল্প’ হিসেবে স্বীকৃতি পেতো কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। তেমনি সাধারণ মানুষের পক্ষে চলচ্চিত্রকে তুমুলভাবে গ্রহণ করার প্রবণতাও সৃষ্টি হতো না। চলচ্চিত্রশিল্প গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে মূল উপাদান বা কৌশল ছিল শট, ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল, ক্যামেরা মুভমেন্ট, গল্প, গল্প বলার ধরন, গল্পের বিষয়বস্তু এবং সার্বিকভাবে মানবজীবন সংশ্লিষ্ট ঘটনা। এ সকল উপাদানই হচ্ছে ‘চলচ্চিত্র’ মাধ্যমটির শিল্প নির্মাণ কৌশল। কালের বিবর্তনে চলচ্চিত্র শিল্পের বিষয়, আঙ্গিক, পরিবেশনারীতি, প্রযুক্তি, জনসংস্কৃতির উপাদান নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে উপস্থাপিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ‘বৃহত্তর জনগোষ্ঠী’র পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় আদিবাসীর সাংস্কৃতিক উপাদান অনুসন্ধান এবং তা চলচ্চিত্রশিল্পে উপস্থাপনের প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে নবীনতম শিল্প মাধ্যমটি বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠছে। কখনো কখনো মূল ধরার চলচ্চিত্রে আদিবাসীর প্রসঙ্গ যেমন এসেছে চলচ্চিত্রকে বর্ণিল করে তোলার নিমিত্তে, আবার তেমন কখনো আদিবাসীর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির ভুল ব্যাখ্যা বা উপস্থাপন ও প্রত্যক্ষ করা যায়। বিশ্ব চলচ্চিত্রের অগ্রযাত্রায় চলচ্চিত্রে আদিবাসী-উপস্থাপন নব-সংস্করণ নয়। পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণ কৌশল আত্তীকরণপূর্বক আদিবাসীর মানুষ এখন তাদের নিজেদের সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্য, লোকাচার, কৃত্যমূলক পরিবেশনা, জীবন সংগ্রাম, অর্থনৈতিক উপায়-উপকরণ, রাজনৈতিক মতবাদ ও মতাদর্শ ইত্যাদি চলচ্চিত্র মাধ্যমে নিজস্ব আঙ্গিকে উপস্থাপনের প্রয়াস পাচ্ছে। এমত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা বাঙালি জনগোষ্ঠী কর্তৃক নির্মিত চলচ্চিত্রে আদিবাসী উপস্থাপনের বিপরীতে আদিবাসী পরিচালক কর্তৃক নির্মিত চলচ্চিত্রে আদিবাসী উপস্থাপন কৌশলের প্রবণতা নির্ণয় বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যপূর্ণ বিবেচিত হয়। যা এই অধ্যায়ে যৌক্তিক আলোচনার মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়েছে। বক্ষ্যমাণ অধ্যায়ে নির্বাচিত দুইটি চলচ্চিত্রে (মর ঠেংগাড়ি বা My Bicycle এবং “Kalpona”….Not Imagination) মূলত বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীর জীবনসংগ্রাম, রাজনৈতিক মতাদর্শ, তাদের সংস্কৃতি, গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনাচরণ, ভাষা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, অর্থনৈতিক উপায়-উপকরণ প্রভৃতি উঠে এসেছে। বিশেষ করে আদিবাসীর বৈশিষ্ট্যসহ চাকমা জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনযাপন প্রণালী নির্বাচিত চলচ্চিত্রদ্বয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে।

চলচ্চিত্র পর্যালোচনা

চলচ্চিত্র শিল্প বরাবরই ছিল উন্মুক্ত। নতুন প্রযুক্তির পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি আত্তীকরণের ক্ষমতা চলচ্চিত্র শিল্পের রয়েছে। তাই বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্র শিল্পের নেতৃত্বে থাকা তুলনামূলক ‘বৃহত্তর জনগোষ্ঠী’ চেয়েছে নতুন সংস্কৃতির উপাদান অনুসন্ধানে আদিবাসীর সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ চলচ্চিত্রে নিজস্ব আঙ্গিক ও কৌশলে উপস্থাপন করতে। বাংলাদেশেও এই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে বিভিন্ন সময়। বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশে নির্মিত বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্র (ফার্স্ট সিনেমা), শিল্পমান নির্ভর চলচ্চিত্র বা আর্টফিল্ম (সেকেন্ড সিনেমা) এবং রাজনৈতিক ধারার চলচ্চিত্রেও (থার্ড সিনেমা) এই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। এখানে উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশে নির্মিত চলচ্চিত্রে ‘আদিবাসী’ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে এমন কয়েকটি চলচ্চিত্রের ‘আদিবাসী’ উপস্থাপন কৌশল মূল্যায়নপূর্বক নাতিদীর্ঘ পরিসরে উপস্থাপন করা প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করছি।

মেঘের অনেক রং (১৯৭৬)

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র মেঘের অনেক রং -এ উঠে এসেছে আদিবাসী প্রসঙ্গ। এখানে আদিবাসী প্রসঙ্গ উঠে এসেছে যথাক্রমে –

– আদিবাসী চরিত্রের উপস্থিতির মাধ্যমে: মাথিন এই চলচ্চিত্রে আদিবাসীর প্রতিনিধিত্বকারী চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।

– দৃশ্যায়নের মাধ্যমে: চলচ্চিত্রের ৮ মিনিট ২২ সেকেন্ডে পাহাড়ি জুম ক্ষেতে ফসল সংগ্রহের দৃশ্য এবং চলচ্চিত্রের ১৪ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড থেকে দৃশ্যে মারমা বা রাখাইন জনগোষ্ঠীর উৎসব ‘সাংগ্রাই’ উঠে এসেছে।

– মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী নারীর অবদান উপস্থাপনার মাধ্যমে: মাথিনকে একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে (যুদ্ধের ময়দানে সেবাদানকে বিবেচনায় নিয়ে) দেখা যায়।

– আদিবাসী ভাষা ও সংগীত উপস্থাপনের মাধ্যমে: চলচ্চিত্রের ৩৪ মিনিট ৩০ সেকেন্ড থেকে ৩৪ মিনিট ৪০ সেকেন্ড পর্যন্ত দৃশ্যে আদিবাসী ভাষার (রাখাইন ভাষার) সংলাপ প্রত্যক্ষ করা যায়।

– বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আদিবাসীর অবস্থান ও অধিকারের প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে: মাথিন যখন বলছে, “লাইফ উইদাউট মিশন তো মৃত্যুর সমান। তাইতো এই মুক্তিযুদ্ধ ডক্টর” তখন বাঙালি ডাক্তার ওমর বলে ওঠে “এই মুক্তিযুদ্ধ কি আপনারও?” পরবর্তী সংলাপে মাথিন বলে, “I belong to this land, জানি আপনারা আমাকে বাঙালি বলে স্বীকার করতে চান না” এর উত্তরে ডাক্তার ওমর বলেন – “আমি ও কথা মিন করিনি”। কিন্তু তিনি আসলে কি মিন করেছেন সেটা পরবর্তী কোন সংলাপে উঠে আসেনি। ফলে বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যায়।

চলচ্চিত্রের এই সংলাপ প্রসঙ্গে সমালোচক কবিতা চাকমা তাঁর “Sovereign: Over Representation: Indigenous Cinema in the Chittagong Hill tracts of Bangladesh” (ডালিয়া চাকমা কর্তৃক ভাষান্তরিত) প্রবন্ধে একে ‘বাঙালি কর্তৃত্ববাদ (Hegemony)’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

আধিয়ার (২০০৩)

আধিয়ার চলচ্চিত্রে আদিবাসী উপস্থাপিত হয়েছে যেভাবে সেগুলো হলো-

– সংলাপের মধ্যে আদিবাসী সম্পর্কে তথ্য উপস্থানের মাধ্যমে: আধিয়ার চলচ্চিত্রে তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে স¤পৃক্ত সাঁওতাল এবং রাজবংশীদের কথা উঠে এসেছে চলচ্চিত্রের ১ঘন্টা ৫১ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে, ১ঘন্টা ৫৭মিনিট ৩৫ সেকেন্ডে। আর চলচ্চিত্রের পর্দায় আদিবাসী জনজীবন কিংবা সংস্কৃতির উপাদান পরিচালক দেখিয়েছেন ১ঘন্টা ৪৯ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড থেকে একটি দৃশ্যে।

– সরাসরি কোরাস দৃশ্যে আদিবাসী উপস্থাপনের মাধ্যমে: আধিয়ার চলচ্চিত্রের ১ ঘন্টা ৫৭ মিনিট ৩৫ সেকেন্ডে ধান কাটার দৃশ্যে আদিবাসী কৃষকদের দেখা যায় তীর-ধনুক নিয়ে ধানক্ষেত পাহারা দিতে, কিছু আদিবাসীর শ্রমিককে ধান কাটতে।

– প্রতিরোধ ও সম্মুখ যুদ্ধে আদিবাসী উপস্থাপনের মাধ্যমে: চলচ্চিত্রের ২ ঘন্টা ৪ মিনিট ৯ সেকেন্ড থেকে ২ ঘন্টা ৪ মিনিট ২০ সেকেন্ড পর্যন্ত দৃশ্যে অত্যাচারী জমিদারের পাইক-বরকন্দাজদের উপর বাঙালি এবং আদিবাসী কৃষকদের তীর ধনুক, লাঠি, বল্লম নিয়ে আক্রমণ করতে দেখা যায়। জমিদার বাড়ির দিকে ছুটে যাওয়া আদিবাসী যোদ্ধাদের দেখা যায় তীর ধনুক, বল্লম হাতে আক্রমণ করতে।

– আদিবাসীর ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্যগীত পরিবেশনের মাধ্যমে: ১ ঘন্টা ৫৫ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড থেকে ১ ঘন্টা ৫৮ মিনিট ১০ সেকেন্ড পর্যন্ত দৃশ্যে আদিবাসী নৃত্যগীত উপস্থাপন করেছেন পরিচালক। চলচ্চিত্রে এই নৃত্যগীত পরিবেশনকারী দলকে ‘সাঁওতাল’ হিসেবে চলচ্চিত্রে উল্লেখ করলেও মাঠপর্যায়ে সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে প্রকৃত পরিচয়ে তারা কুঁড়ুখ ভাষার ওরাওঁ জনগোষ্ঠী।

গবেষণাকালে মাঠপর্যায়ে ক্ষেত্র সমীক্ষণের অংশ হিসেবে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার ওরাওঁ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি এবং সংগীতশিল্পী ভারতী কুজুরের সাক্ষাৎকার পাওয়া যায়। যিনি আধিয়ার চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত আদিবাসী সংগীতের কোরাস শিল্পীদের মধ্যে একজন। অর্থাৎ এই চলচ্চিত্রে সংগীতে যে কজন শিল্পীর কন্ঠ রয়েছে তিনি তাঁদের মধ্যে একজন। তিনি নিশ্চিত করে বলেন “এটি কুঁড়ুখ ভাষার ঝুমুর আঙ্গিকের গান এবং ওরাওঁ জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী ঝুমুর নৃত্য।” কিন্তু চলচ্চিত্রে তাদের উপস্থিতিকে সাঁওতাল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যা একটি জনগোষ্ঠীর ভাষা সংস্কৃতি সম্পর্কে ভুল উপস্থাপন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

নাচোলের রানী (২০০৬)

নাচোল বিদ্রোহ বা চাঁপাইনবাবগঞ্জ তথা বরেন্দ্রভূমিতে সংঘটিত তেভাগা আন্দোলনের বিষয় নিয়ে নির্মিত নাচোলের রানী চলচ্চিত্রটিতে ‘আদিবাসী’ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে ৩ ভাবে।

– বর্ণনা বা সংলাপে আদিবাসী সম্পর্কিত তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে: চলচ্চিত্রের আজহার ও রমেন মিত্রের কথোপকথনের দৃশ্যে (১৩ মিনিট ১৬ সে. – ১৩ মিনিট ৩০ সে. পর্যন্ত) উঠে এসেছে মাতলা মাঝি ও সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর প্রসঙ্গ। নাচোল বিদ্রোহের সাঁওতাল কৃষক প্রসঙ্গে আলোচনা উঠে এসেছে ৩৮ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডে। এভাবেই আলোচনা প্রসঙ্গে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন স্থানে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।

– বাঙালি অভিনয় শিল্পী কর্তৃক সাঁওতাল বা ‘আদিবাসীর মানুষ’ চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে: চলচ্চিত্রটিতে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রসমূহ উপস্থাপন করা হয়েছে বাঙালি অভিনয়শিল্পী দিয়ে। মুখে কালো মেকাপ বা মেক-ওভার করে, ভাষাগত কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সাঁওতাল চরিত্রসমূহ উপস্থাপন করেছেন পরিচালক। বিশেষ করে মাতলা মাঝি, হরেক, পারু এবং সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর অন্যান্য প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্রসমূহ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে পরিচালক বাঙালি অভিনয়শিল্পী ব্যবহার করেছেন।

– সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর কোরাস অংশগ্রহণের মাধ্যমে: নাচোলের রানী চলচ্চিত্রে বিভিন্ন কোরাস দৃশ্যে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায়। ইউটিউবে প্রাপ্ত চলচ্চিত্রটির ৩টি খণ্ডের মধ্যে প্রথম খণ্ডে (৩৯ মিনিট ০৩ সেকেন্ড থেকে ৪০ মিনিট ০১ সেকেন্ড পর্যন্ত) সাধারণ কৃষকদের উদ্দেশে রমেন মিত্রের দেওয়া এক কৃষক সমাবেশের দৃশ্যের মধ্যে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড আদিবাসীর বৈশিষ্ট সম্পন্ন সাঁওতাল জনগোষ্ঠীকে দেখা যায়। এছাড়াও চলচ্চিত্রের দ্বিতীয় খণ্ডে যথাক্রমে ৩ মি. ৪১ সে. থেকে ৪ মি. ১৯ সে.; ১১ মি. ০৯ সে. থেকে ১১ মি. ২৭সে.; ২০ মি. ৪৬ সে. থেকে ২১ মি. ৪০সে.; ২১ মি.৪১ সে. থেকে ২৪ মি. ৫ সে. এর নাচগানের দৃশ্যে, ৩০মি. ৩০ সে. থেকে ৩৯মি. ২ সে. পর্যন্ত পুলিশের সাথে সংঘর্ষ এবং পুলিশকে হত্যার দৃশ্যে, ৩৯মি. ২ সে. থেকে ৪০মি.৩২ সেকেন্ড পর্যন্ত পুলিশ হত্যাকাণ্ডের পর বাড়ির আঙ্গিনায় পরামর্শ-সভার দৃশ্যে, পুলিশ বাহিনী ও সাঁওতাল এবং বাঙালি কৃষকদের সঙ্গে যুদ্ধের দৃশ্যে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায়।

ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটিতে ব্যাকগ্রাউন্ড বা আবহ নির্মাণের স্থান হিসেবে বরেন্দ্র অঞ্চল বেছে নেয়া হলেও চরিত্র নির্মাণে প্রকৃত প্রোটো-অস্ট্রালয়েড নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কোন অভিনয় শিল্পীকে নেয়া হয়নি। ফলে একটি জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য চলচ্চিত্রের পর্দায় উপেক্ষিত থেকেছে। বাঙালি অভিনয়শিল্পী কর্তৃক সাঁওতাল চরিত্রে অভিনয়, চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ায় পরিচালককে স্বস্তি দিলেও ঐতিহাসিক মূল্য বিচারে এবং চলচ্চিত্রের নৃতাত্ত্বিক সৌন্দর্য অনুসন্ধানে এই কৌশল অবলম্বন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া অসঙ্গত নয়।

উল্লিখিত তিনটি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে আদিবাসী উপস্থাপনের কৌশল প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায় যে তিনটি প্রবণতা বা বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা যায়, আর তা হল –

– বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আদিবাসী উপস্থাপনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর প্রতি বাঙালির কর্তৃত্ববাদী মনোভাব প্রকাশিত হয়;

– একটি জনগোষ্ঠীর নৃত্য-গীত তথা ভাষা ও সংস্কৃতিকে অপর একটি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বলে দেশের সকল জনগোষ্ঠীর সামনে ভুল তথ্যসমেত উপস্থাপন;

এবং

– আদিবাসী চরিত্রে বাঙালি অভিনয়শিল্পী উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রকৃত আদিবাসীর নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করার প্রবণতা প্রতীয়মান হয়।

চিহ্নিত এই তিনটি প্রবণতা বাংলাদেশের অন্যান্য চলচ্চিত্রে যেখানে আদিবাসী প্রসঙ্গ কোন না কোন ভাবে উঠে এসেছে সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়। ফলে বলা যায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আদিবাসী প্রসঙ্গ কখনোই যথাযথ নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখে সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি।

বাংলাদেশের যে চলচ্চিত্রসমূহ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আদিবাসী উপস্থাপনের তিনটি প্রবণতা চিহ্নিত করা গেছে, তার প্রত্যেকটির পরিচালক ছিলেন বাঙালি। বাঙালি বা ‘ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা’ জনগোষ্ঠী কর্তৃক নির্মিত চলচ্চিত্রের মধ্যে আদিবাসী উপস্থাপন কৌশলের মৌলপ্রবণতাসমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে আদিবাসীর পরিচালক কর্তৃক নির্মিত ও অভিনীত চলচ্চিত্রের গুণগত ও সার্বিক পার্থক্য এবং ব্যবধি নির্ণয় করার নিমিত্তে। যার গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রবন্ধের শেষাংশে যথাযথভাবে প্রতীয়মান হবে।

আদিবাসী প্রসঙ্গে

প্রবন্ধের এই অংশে বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ‘আদিবাসী’ সম্পর্কিত আলোচনা উপস্থাপন যৌক্তিক বিবেচিত হয়। ‘আদিবাসী’ বলতে সাধারণার্থে মানব গোষ্ঠীকে বোঝালেও নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে আদিবাসী বলতে শুধু মানব গোষ্ঠী নয় বরং বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানব গোষ্ঠীকে বোঝায়। বাংলায় বহুল ব্যবহৃত আদিবাসী শব্দটি ইংরেজি Ethnic Group বা Ethnic People থেকে গৃহীত হয়েছে। সামাজিক নৃবিজ্ঞানী Denton and Massey তাঁদের Race Relation and Population Diversity গ্রন্থে আদিবাসী সম্পর্কে বলেন –

“Group of people who see themselves and are seen by the other, as having hereditary training that sets them apart.” কোথাও কোথাও আদিবাসীকে ‘আদিবাসী’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।

আদিবাসী বা “আদিবাসী হলেন তারাই, যাদের আর্থসামাজিক অবস্থা দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় কম অগ্রসর এবং যাদের জীবনধারা সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিচালিত হয়, তাদের নিজস্ব প্রথা ও ঐতিহ্য অনুসারে, তাদের নিজের অথবা বিশেষ কোন আইন বা নিয়ম দ্বারা। একটি স্বাধীন দেশের অন্তর্ভুক্ত মানব সম্প্রদায় যারা বর্তমান রাষ্ট্রসীমা নির্ধারিত হওয়ার পূর্ব থেকে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছেন; যাদের নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য রয়েছে- একটি জনগোষ্ঠী হিসেবে তারা সে দেশে বসবাস করেন, অথচ সে দেশের জাতীয় কার্যাবলী পরিচালনাকে নিয়ন্ত্রণ করেনা, তারাই হচ্ছে আদিবাসী” বা আদিবাসী।

প্রদত্ত সংজ্ঞায় স্পষ্টত নির্ধারিত হয় যে আদিবাসী হলেন তারাই,

– যারা একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাস করে;

– ‘বৃহত্তর জনগোষ্ঠী’ অপেক্ষা তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনাচরণ পৃথক;

– গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনাচরণে অভ্যস্ত,

– অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর;

– একই সাংস্কৃতিক ও বংশগতির ধারার অধিকারী; প্রভৃতি।

সেই বিবেচনায় চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, ভিল, মুণ্ডা অর্থাৎ বাঙালি ব্যতীত ভিন্ন ভাষার অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে এই প্রবন্ধে চিহ্নিত করা হয়েছে।

চলচ্চিত্রের বিকাশমান পর্যায়ে আদিবাসী সংস্কৃতি চলচ্চিত্রায়িত হতে শুরু করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। সামাজিক নৃবিজ্ঞানের একটি শাখা হলো ‘ভিজ্যুয়াল অ্যানথ্রোপলজি’। যেখানে কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণ চিহ্নিত হয়। যার একটি হলো নৃতাত্ত্বিক গবেষণার ভিডিও, চলচ্চিত্র, ফটোগ্রাফি এবং ভিডিও ব্যবহারের মাধ্যমে আদিবাসী সম্পর্কে যথাযথ ও মানবিক পর্যবেক্ষণ। ‘ভিজ্যুয়াল অ্যানথ্রোপলজি’র মধ্যে বিশেষভাবে বিবেচিত হয় চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের মধ্যে আবার যে বৈশিষ্ট্যগুলো প্রবলভাবে ক্রিয়াশীল থাকা প্রয়োজন সেগুলো হলো –

– জনজাতি বা প্রজাতি হিসেবে মানুষকে সেখানে কীভাবে উপস্থাপন করা হয় বা হয়েছে এবং কিভাবে তাদের জীবনের সঙ্গে তা সম্পর্কিত;

– কোন বিশেষ জনজাতি বা সমাজ অথবা সভ্যতার নিজস্ব গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি;

এবং

– একটি জনজাতি বা সাংস্কৃতিকভাবে স্বতন্ত্র জাতিসত্তাকে চলচ্চিত্রের পর্দায় উপস্থাপন করা হয় উক্ত জনজাতির জীবনাচরণ ও তাদের জীবনের প্রেক্ষাপটে এবং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে। যা ‘ভিজ্যুয়াল অ্যানথ্রোপলজি’র নৈতিক বিবেচ্য বিষয়।১০

ভিজ্যুয়াল অ্যানথ্রোপলজি বলতে বুঝায় নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণাকালে কিংবা আদিবাসীর জীবন-সম্পর্কিত বাস্তবঘনিষ্ঠ তথ্যাদি ভিডিওগ্রাফির মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খ উপস্থাপন করা। যেখানে কোন কৃত্রিমতা বা আদিবাসী সম্পর্কিত ভুল তথ্য থাকবে না। যা পরবর্তীকালে আদিবাসী সম্পর্কিত সঠিক তথ্য প্রদান করতে পারে। আদিবাসী-চলচ্চিত্র নির্মাণে ভিজ্যুয়াল অ্যানথ্রোপলজি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ।

Visual anthropology is either the use of visual media as a research method or its study as a research topic. Whether they consider themselves visual anthropologists or not, most anthropologists take photos of the people and places they encounter in their fieldwork. Visual anthropologists go further, using photography and film to document important events for fine-grained future analysis. As moments frozen in time, photographs allow for analytical contemplation and shared consideration. Film can be slowed down or sped up to focus on certain aspects of individual action or group dynamics that might otherwise go unnoticed. Images may be magnified to reveal minute details. Both film and photography allow for images to be placed side by side for comparison. ১১

গবেষকগণের প্রদত্ত সংজ্ঞার আলোকে আদিবাসী চলচ্চিত্র নির্মাণে ভিজ্যুয়াল অ্যানথ্রোপলজির গুরুত্বকে সংক্ষেপে তিনটি কারণে চিহ্নিত করার প্রয়াস পাওয়া যায় সেগুলো হলো-

– বিশেষ কোন জনগোষ্ঠী বা আদিবাসী সম্পর্কে গভীর ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে:

ভিজ্যুয়াল অ্যানথ্রোপলজি আদিবাসীর সাংস্কৃতিক অনুশীলন, বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে গভীর গবেষণা এবং বোঝার সাথে জড়িত। এর মাধ্যমে, চলচ্চিত্র নির্মাতারা আদিবাসী সম্পর্কে গভীর ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পারে, যা সঠিকভাবে আদিবাসীর জীবনচিত্র তুলে ধরতে সাহায্য করে।

– আদিবাসী সম্পর্কে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত বা স্টেরিওটাইপ ধারণা এড়াতে সাহায্য করে:

মূলধারার মিডিয়াতে (বিশেষত চলচ্চিত্রে) আদিবাসী সম্পর্কে প্রচার কতিপয় ধাঁধাঁযুক্ত বদ্ধমূল ভুল ধারণা দ্বারা প্রভাবিত। যা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর নিকট নেতিবাচক ধারণাকে শক্তিশালী করতে পারে এবং ভুল বর্ণনার দিকে নিয়ে যেতে পারে। ভিজ্যুয়াল অ্যানথ্রোপলজি আদিবাসী সংস্কৃতির সূক্ষ্ম উপলব্ধি প্রদান করে, যা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সাধারণ স্টেরিওটাইপ বা বদ্ধমূল ধারণা এড়াতে ও আদিবাসী সম্পর্কে আরও সঠিক এবং সম্মানজনক চিত্র উপস্থাপন করতে সাহায্য করে।

– আদিবাসীর ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিক সংরক্ষণের প্রচার করে:

আদিবাসী চলচ্চিত্র যেহেতু এক বা একাধিক নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ, বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য কিংবা সংগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে, তাই মাঠপর্যায়ে সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভিজ্যুয়াল অ্যানথ্রোপলজি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যা পরবর্তীকালে চলচ্চিত্র মাধ্যমে যথাযথভাবে উপস্থাপিত হলে সর্বসাধারণের সামনে আদিবাসীর ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও সংগ্রামের রূপচিত্র সংরক্ষণ ও প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ফলে আদিবাসী চলচ্চিত্র নির্মাণে ভিজ্যুয়াল অ্যানথ্রোপলজি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে চিহ্নিত হয়।

প্রসঙ্গ– ‘ফোর্থ সিনেমা’

চলচ্চিত্র শিল্প মাধ্যমটি ক্রমাগত জনপ্রিয় এবং সহজপ্রাপ্য হয়ে ওঠার নিরিখে সর্বসাধারণের চলচ্চিত্র নির্মাণের সহজগম্যতা তৈরি হয়েছে। ‘ক্ষমতাসীন জনগোষ্ঠী’-এর বাইরে অন্যান্য সকল জনগোষ্ঠীর নিকট প্রায় সমান্তরাল চলচ্চিত্র নির্মাণকৌশল পৌঁছে যাওয়ায় আদিবাসীর মানুষও তাদের নিজেদের সংস্কৃতি, ভাবনা ও বক্তব্য তাদের শিল্পকৌশলের আলোকে চলচ্চিত্রে উপস্থাপন শুরু করে। যা পরবর্তীকালে ‘ফোর্থ সিনেমা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। মাওরি চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং তাত্ত্বিক বেরি বার্কলে (Barry Barcla,, ১৯৪৪-২০০৮) হলেন ফোর্থ সিনেমা তত্ত্বের প্রবক্তা। তিনি আদিবাসী বা আদিবাসী সমূহের জগতকে ‘ফোর্থ ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।১২ তিনি ২০০৩ সালে অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অনুষ্ঠানে ‘আদিবাসী জীবন ও সংস্কৃতি’-নির্ভর চলচ্চিত্রকে বিশ্ববাসীর সামনে ফোর্থ সিনেমা হিসাবে উপস্থাপন করেন। পূর্ব থেকে প্রচলিত প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সিনেমার প্রেক্ষিতে ফোর্থ সিনেমাকে স্বতন্ত্র হিসেবে আখ্যা দানকালে তিনি উল্লেখ করেন যে, “The phrase Fourth Cinema comes as a late addition to the First-Second-Third Cinema framework with which you will be familiar, First Cinema Being American cinema; Second Cinema Art House cinema; and Third Cinema the cinema of the so-called Third World.”১৩

বেরি বার্কলে প্রদত্ত ফোর্থ সিনেমার সংজ্ঞার আলোকে স্টুয়ার্ট মুরে (Stuart Murray, জন্ম ১৯৬৭) তার Images of Dignity: Barry Barclay and Fourth Cinema গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে,

It is the conception of Fourth World ‘world views and value systems’, to use Tuhiwai Smith’s words, and an idea of their legitimacy and worth in a contemporary era dominated by beliefs and practices often antithetical to Indigenous peoples, that drove a figure like Barclay in the making of his films. Central to such concerns is the vexed and contested notion of Fourth World ‘difference’ and the view that the lived experiences of Indigenous lives encompass social, cultural and individual acts that differ widely from those of their non-Indigenous counterparts[…]While he writes that there is a ‘temptation to analyse Fourth Cinema’ in terms of ‘surface features: the rituals, the language, the posturing, the décor, the use of elders, the presence of children, attitudes to land, the rituals of a spirit world’, he also notes that ‘in Fourth Cinema, at its best, something else is being asserted which is not easy to access’. This ‘something else’ is, fundamentally, what Barclay thinks of as a ‘reworking’ of the ‘ancient core values’ of Indigenous cultures. ১৪

‘ফোর্থ সিনেমা’ বা ইন্ডিজেনাস ফিল্ম বা আদিবাসী চলচ্চিত্র বলতে বুঝায় “Fourth cinema is used to describe legitimate films that are made by indigenous people, using their concepts, words, settings, and other features that are used to distinctly define them.”১৫

বেরি বার্কলে প্রদত্ত সংজ্ঞা বা তত্ত্ব এবং স্টুয়ার্ট মুরে ও অন্যান্য গবেষকগণ প্রদত্ত বিশ্লষণের আলোকে বলা যায় যে, ফোর্থ সিনেমা বা চলচ্চিত্র হল সেই চলচ্চিত্র যেখানে,

– চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হবে আদিবাসী বা আদিবাসীর জনসংস্কৃতি ও তাদের জীবন-সংগ্রাম;

– চলচ্চিত্র পরিচালনা এবং অভিনয় করবেন আদিবাসী বা আদিবাসীর মানুষ;

– উক্ত চলচ্চিত্রটি হবে আদিবাসীর নিজস্ব ভাষায় (ক্যামেরার ভাষা কিংবা মৌখিক ভাষায়);

– ‘বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর’ মূল ধারার চলচ্চিত্রে সাংস্কৃতিক লক্ষ্য আকাঙ্ক্ষার সাথে এই ধারার চলচ্চিত্র হবে সাংঘর্ষিক বা স্বতন্ত্র;

– বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য (ফার্স্ট সিনেমার বৈশিষ্ট্য) প্রধান না হয়ে বরং আদিবাসীর নিজস্ব বক্তব্য প্রধান হয়ে উঠবে;

– থার্ড সিনেমার (রাজনৈতিক চলচ্চিত্র) সঙ্গে এই ধারার চলচ্চিত্রের কিছুটা সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হবে।

তাত্ত্বিকদের মতামতের প্রেক্ষিতে চিহ্নিত বৈশিষ্ট্যসমূহের আলোকে নির্বাচিত চলচ্চিত্রদ্বয়কে (মর ঠেংগাড়ি ও “Kalpona”… Not Imagination) ‘বাংলাদেশের ফোর্থ সিনেমা’ বা ‘বাংলাদেশের আদিবাসী চলচ্চিত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কারণ নির্বাচিত চলচ্চিত্রদ্বয়

– বাংলাদেশে নির্মিত চলচ্চিত্র;

– উক্ত চলচ্চিত্রদ্বয় নির্মাণ করেছেন দুইটি ভিন্ন আদিবাসীর (রাখাইন ও ত্রিপুরা) চলচ্চিত্র নির্মাতা;

– নির্বাচিত চলচ্চিত্রদ্বয়ে অভিনয় করেছেন সংশ্লিষ্ট আদিবাসীর মানুষ;

– উক্ত চলচ্চিদ্বয়ের বিষয়বস্তু আদিবাসী জীবন সংগ্রাম ও রাজনৈতিক চিন্তা চেতনাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে;

– উক্ত চলচ্চিত্রদ্বয় বাণিজ্যিকভাবে নির্মিত হয়নি;

– নির্বাচিত চলচ্চিত্রদ্বয় ফার্স্ট সিনেমার বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে যেমন নির্মিত হয়নি বা বড় কোন থিয়েটার হলে মুক্তি পায়নি, তেমনি উক্ত চলচ্চিত্রদ্বয় সেকেন্ড সিনেমা বা আর্ট ফিল্ম ধারার চলচ্চিত্রও নয়;

– উক্ত চলচ্চিত্রদ্বয় উপস্থাপিত বক্তব্য বাংলাদেশের মূল ধারার জনগোষ্ঠীর বক্তব্যের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়;

– নির্বাচিত চলচ্চিত্রদ্বয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য উঠে এসেছে যা থার্ড সিনেমা ধারার (রাজনৈতিক চলচ্চিত্র) সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ;

ফলে বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে গবেষণার জন্য নির্বাচিত চলচ্চিত্রদ্বয়কে বাংলাদেশের ফোর্থ সিনেমা বা আদিবাসী চলচ্চিত্র হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

আদিবাসী সংস্কৃতি প্রচলিত ধারার পরিচিত সংস্কৃতি বলয়ের বাইরে বৈচিত্র্যময়, বর্ণিল এবং বহুমাত্রিক সংস্কৃতি হিসেবে এই প্রবন্ধে গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে আদিবাসীর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চেতনালব্ধ ‘আদিবাসী চলচ্চিত্র’ নির্মাণ প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের ‘আদিবাসী চলচ্চিত্রে’ ‘আদিবাসী’ কোন কোন কৌশল অবলম্বন পূর্বক উপস্থাপিত হয়েছে বা আদিবাসী সংস্কৃতি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে যে কৌশলের প্রয়োগ ঘটেছে তা চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ এই প্রবন্ধের গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করা হয়েছে।

নির্বাচিত চলচ্চিত্রদ্বয় বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের ‘আদিবাসী চলচ্চিত্র’ প্রসঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে সমকালীন সময়ে দুইটি আদিবাসী চলচ্চিত্র মর ঠেংগাড়ি (২০১৫) ও “Kalpona”… Not Imagination (২০১৬) প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। এই গবেষণা প্রবন্ধে মর ঠেংগাড়ি ও “Kalpona”… Not Imagination চলচ্চিত্রদ্বয় কেন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক সে বিষয়ে আলোচনা উপস্থাপনের পূর্বে দুইটি বিষয়ে ধারণা প্রদান করা প্রয়োজন। অর্থাৎ বাংলাদেশে নির্মিত চলচ্চিত্রে আদিবাসী এবং তাদের জীবনযাপন বা জনসংস্কৃতি এই গবেষণার আলোচ্য বিষয়। সেই বিবেচনায় এই চলচ্চিত্রদ্বয় (মর ঠেংগাড়ি ও “Kalpona”… Not Imagination) গবেষণার উপাত্ত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। যেখানে দেখানো হয়েছে যে নির্বাচিত চলচ্চিত্রদ্বয়ে ‘বাংলাদেশের আদিবাসী চলচ্চিত্র’ হয়ে ওঠার সকল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিধায় মর ঠেংগাড়ি ও “Kalpona”… Not Imagination চলচ্চিত্রদ্বয় এই গবেষণার উপাত্ত হিসাবে নির্বাচন যৌক্তিক এবং বিশ্ব-চলচ্চিত্র ও দেশীয় চলচ্চিত্র সংস্কৃতির নতুন পাঠ নির্মাণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং প্রয়োজনীয়। নিম্নে পর্যায়ক্রমে ‘মর ঠেংগাড়ি’ ও “Kalpona”… Not Imagination চলচ্চিত্রে আদিবাসী উপস্থাপনকৌশল বিশ্লেষণপূর্বক উপস্থাপন হলো-

মর ঠেংগাড়ি (২০১৫)

একজন চাকমা যুবকের জীবন সংগ্রাম ও পাহাড়ি জীবন বাস্তবতার চলচ্চিত্র মর ঠেংগাড়ি বা আমার বাইসাইকেল (২০১৫)। আদিবাসী যুবক কমল চাকমা। সে শহরে কাজ করত, কিন্তু একদিন তার চাকরি চলে যায়। তখন সে প্রায় নিঃস্ব হয়ে একটি সাইকেল নিয়ে তার পাহাড়ের জন্মভূমিতে ফিরে আসে। বাড়িতে ফিরে আসার পর কমলের ছেলে তার বাবাকে ফিরে পেয়ে খুশি হয়। তবে কমলের কাছে সঞ্চয় বলতে একটি বাইসাইকেল ছাড়া কিছুই ছিল না। পরিবারে অনেক অভাব-অনটন। কিন্তু কমল নতুন চাকরির জন্য আর শহরে ফিরে যেতে চায় না। সে জীবন নির্বাহ করার জন্য এই বাইসাইকেল দিয়েই কাজ শুরু করে। সে সাইকেল দিয়ে বিভিন্ন পণ্য এবং মানুষকে নিয়ে যাতায়াত শুরু করে। এভাবেই সে তার পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে। কিন্তু একদিন এক দুর্ঘটনা ঘটে। সেই দুর্ঘটনায় তার সাইকেল থেকে একজন আরোহী পড়ে গিয়ে আহত হয়। পরে কারবারির নেতৃত্বে বিচারে কমলের ১০০ টাকা জরিমানা করা হয় এবং তিনি কেবল পণ্য বহন করতে পারবেন, মানুষ আর বহন করতে পারবেন না এমন সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। সবই ঠিকঠাক চলছিল। এর একদিন পর কিছু লোক তার কাছে চাঁদা দাবি করলে কমল তা দিতে অস্বীকার করে। এক রাতে ঘুম থেকে উঠে কমল দেখে তার সাইকেলটি ঘরের সামনে নেই। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে বাড়ির পাশে নিচু স্থানে ভাঙ্গা অবস্থায় বাইসাইকেল পড়ে থাকতে দেখে। এরপর সেই সাইকেল নিয়ে শহরের দিকে রওনা দেয় ঠিক করার জন্য। এমন সময় যাত্রাপথে কমল দেখতে পায় বিপরীত দিক থেকে আসা নৌকাগুলোতে নতুন বাইসাইকেল, টেলিভিশন সেট এবং একটি মোটরসাইকেল তাদের পাহাড়ি গ্রামের দিকে আসছে। এখানে চলচ্চিত্রটি সমাপ্ত হয়।

চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেছেন – কমল মণি চাকমা (কমল চরিত্রে), ইন্দিরা চাকমা (দেবী চরিত্রে), উ চিং হ্লা রাখাইন (দেবু চরিত্রে), বিনয় কান্তি চাকমা (কারবারি চরিত্রে), জয় শান্তি চাকমা (নেবু চরিত্রে) সুভাস চাকমা (নৌকা চালক চরিত্রে), আনন্দ চাকমা, সোহাগ চাকমা, মিন্টু চাকমা, জীবন চাকমা প্রমুখ। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন অং রাখাইন।

চিত্র – মর ঠেংগাড়ি (My Bicycle) চলচ্চিত্রের পোষ্টার।

মর ঠেংগাড়ি চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু প্রেক্ষিত ভেদে ভিন্নভাবে আলোচনার সুযোগ থাকলেও এই গবেষণা শিরোনামের সাথে সঙ্গতি রেখে বলা যায় – পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসী জীবন ও সংগ্রাম এই চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু। পূর্ণাঙ্গ আদিবাসী চলচ্চিত্র বলতে যা বোঝায় তা এই চলচ্চিত্রের মধ্যে বিদ্যমান। পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী জীবন, ধর্ম, ভাষা, অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থা, বাসস্থান, পরিবেশ, সংগ্রাম তথা সার্বিক আদিবাসী জনসংস্কৃতি এই চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে। আদিবাসী জনসংস্কৃতির সার্বিক চিত্র প্রতিনিধিত্বমূলক ভাবে এই চলচ্চিত্রে উঠলেও গবেষণার সুবিধার জন্য পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত চাকমা জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতি এই চলচ্চিত্রের কিভাবে উঠে এসেছে তা সুনির্দিষ্টভাবে উক্ত জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের আলোকে আলোচনা অধিকতর যৌক্তিক বলে বিবেচিত হয়।

মর ঠেংগাড়ি চলচ্চিত্রে একটি দরিদ্র চাকমা পরিবারের সংগ্রাম দেখানো হয়েছে। যে পরিবারের প্রধান কমল নামের একজন যুবক। যার পূর্বপুরুষের বসতভিটা কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ঐতিহাসিক বিবেচনায় ১৯৬০ এর দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে তৈরি হওয়া কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামের ৪০ ভাগ কৃষি জমি পানির নিচে তলিয়ে যায়। পাহাড়ের ভাঁজেভাঁজে সমতল ভূমিতে বসবাসরত লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে।১৬ উদ্বাস্তু জনসংখ্যার বৃহত্তর একটি অংশ দেশের সীমানা পাড়ি দিয়ে অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করে। আর যারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত বা মিয়ানমারে যায়নি তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ের উপরে আশ্রয় নেয়। নতুন করে ঘর বেঁধে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। সে রকমই একটি পরিবারের সদস্য কমল। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ-এর কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষগুলোর দুঃখ-কষ্টের অন্যতম কারণ কাপ্তাই লেক। চলচ্চিত্রের শুরুতে স্টাবলিশমেন্ট শটের মাধ্যমে কাপ্তাই লেক দেখানো হয়েছে। কাপ্তাই লেকের বিশালতা ও সৌন্দর্যের পাশাপাশি এর তলদেশে থাকা অতীত ইতিহাস খুঁড়ে বের করে দর্শককে তা দেখানোর প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে। নান্দনিক চলচ্চিত্র কৌশল হিসেবে দেখা যায় কাপ্তাই লেকের বুকে জলকে দ্বিখণ্ডিত করে সামনে এগিয়ে আসছে নৌকার অগ্রভাগ। এরপর চলচ্চিত্রের প্রথম সংলাপের আলোচ্য বিষয় হিসেবে উঠে আসে কাপ্তাই লেকের তলদেশে কোথায় কার বাড়ি ছিল, কেমন ছিলো তাদের জীবন ব্যবস্থা ইত্যাদি প্রসঙ্গ। পূর্ববর্তী কাপ্তাই লেকের বিশালতা দেখা গেলেও এই বিশালত্বের নিচে লুকিয়ে আছে ঐতিহাসিক দুঃখ-ঘোর-ক্লান্ত বাস্তুচ্যুত হওয়ার ইতিহাস। চলচ্চিত্রটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বাস্তুচ্যুত হওয়ার ইতিহাস থেকে শুরু হয়ে বর্তমান সময়কে স্পর্শ করে গেছে।

নৌকায় যেতে যেতে কমল যখন পানিতে হাত ডুবিয়ে জল নাড়াচাড়া করতে থাকে তখন ক্লোজ শটে কমলের হাত, জল এবং নৌকার পার্শ দেখা যায়। সাধারণত এরকম স্বচ্ছ জলধারা দেখে যেকোনো পরিণত ব্যক্তির ভেতরেও শিশু মন জেগে উঠবে, ইচ্ছা করবে তাতে হাত দিয়ে পানি নাড়াচাড়া করতে। এটি মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা শৈশব চেতনার বহিঃপ্রকাশ। এর মাধ্যমেই কমলের মনে উদয় হয় জলের নিচে তলিয়ে যাওয়া তার পূর্বপুরুষের বসতভিটার কথা। ক্লোজ শট থেকে মাস্টার শট বা কম্পোজিট শটের মাধ্যমে কাপ্তাই লেকের জল দিয়ে কমলের মুখ ধৌত করা দেখানো হয়। চোখে মুখে পানি দিয়েই কমল আবার বিস্তৃত জলরাশির দিকে তাকায়। যেন সে তার চোখে মুখে লেগে থাকা শহুরে ধূলিকণা ও নাগরিক স্মৃতিচিহ্ন ধুয়ে ফেলে। ‘শহুরে নাগরিক মানুষে’র খোলস ছেড়ে হয়ে ওঠে কাপ্তাই লেকের জলে অতীত-হারানো বন-প্রকৃতিঘনিষ্ট এক পাহাড়ি মানুষ। তারপর ফিরে যায় তার অতীতে। কমলের অতীত ইতিহাস স্মৃতিতে হানা দেয়। সে স্মৃতিকাতর হয়ে নৌকার মাঝিকে প্রশ্ন করে,

কমল – “আচ্ছা দাদা তোমার মনে আছে কি এখানে আমার দাদা দাদির বাড়ি ছিল। ঐদিকে কবরস্থান ছিল, মনে আছে ?”

পরিচালক যেন দর্শককে অতীত ইতিহাসের কবর খুঁড়ে দেখাতে চাচ্ছেন বাস্তবতার ভয়াবহতা। দর্শককে নিয়ে প্রবেশ করছেন গল্পের ছলে নিজেদের ঐতিহ্যময় সমৃদ্ধ এক অতীতে। প্রশ্ন-উত্তরে গল্প বলার ছলে ইতিহাস উপস্থাপনের কৌশল প্রয়োগ এই দৃশ্যে উঠে আসে। কমলের কথা শেষ হলে নৌকার মাঝি তাকে যেন আরেকটু যাচাই করে আরো অতীত কথা স্মরণ করিয়ে দিতে প্রশ্ন করছে

নৌকা চালক- “তোমার আর কিছু মনে নেই? ” কমলের সব স্মরণে আছে। তাই সে বলে,

কমল – “হ্যাঁ আমার মনে আছে, রাজবাড়িটা ঐদিকে ছিল, আর ওদিকে কিছু ঝাড় জঙ্গল ছিল।”

কথোপকথনের মধ্য দিয়ে দর্শককে খানিকটা ইতিহাস সচেতন করে দিয়ে চলচ্চিত্র দেখার জন্য প্রস্তুত করে দিলেন পরিচালক। অর্থাৎ এই চলচ্চিত্রের জন্য কিছুটা ইতিহাস সচেতন হওয়া প্রয়োজন। জানা থাকা দরকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবন সংগ্রাম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে। নতুবা এই চলচ্চিত্র অনেকের কাছে ভুল সংবাদের কারণ হতে পারে। কথা শেষ করে কমল আবার ফিরে তাকায় বিস্তৃত জলরাশির দিকে। লং-শটে কাপ্তাই লেকের উপর ভাসমান এই নৌকায় দু’জন মানুষ এবং একটি বাইসাইকেল দেখা যায়। শট-কাট করে সাইকেলের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে আমরা দেখি কমল আবার প্রশান্ত-এক্সপ্রেশন নিয়ে নৌকা থেকে উঠে সাইকেলের দিকে এগিয়ে আসছে। পরম যত্নে সাইকেলের শরীরে হাত বুলিয়ে দেয়। সাইকেলের বেলে হাত বুলিয়ে দেয়ার সময় এক্সট্রিম ক্লোজ শটে সেটা দেখানো হয়। সাইকেল যে পরবর্তী অংশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে যাচ্ছে, তার বার্তা পাওয়া যায়। সাইকেলের বেল বেজে ওঠে এবং দৃশ্যের সমাপ্তি হয়। অর্থাৎ ঘাটে পৌঁছে গেছি আমরা। এতক্ষণ ধরে চলচ্চিত্রের যে প্রাক্কথন বা ভূমিকা উপস্থাপন করলেন পরিচালক, এখন সেটা সমাপ্ত হলো। এবার আমাদের বর্তমান সময়ে নামতে হবে নতুন আরেক গল্প শোনার জন্য।

চিত্র: মর ঠেংগাড়ি (My Bicycle) চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যের স্থিরচিত্র।

অং রাখাইন নির্মিত মর ঠেংগাড়ি চলচ্চিত্রে আদিবাসী জীবন ও সংস্কৃতি উঠে এসেছে। উঠে এসেছে চাকমা জনজীবন ও তাদের সর্বপ্রাণবাদী বৌদ্ধ ধর্মীয় কৃত্য, মদ জগরা, চাকমা জনগোষ্ঠীর গান, তাদের পোশাক, বিচার ব্যবস্থা, পাহাড়ি অঞ্চলের প্রতিবেশ প্রভৃতি। পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসী জনজীবনের যে সকল উপাদান মর ঠেংগাড়ি চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে তা সংক্ষিপ্তাকারে নিম্নে উপস্থাপন করা হলো –

  • আদিবাসী সদস্য হিসেবে চলচ্চিত্রে নৃগষ্ঠীর অভিনয়শিল্পী;
  • আদিবাসী ভাষা;
  • আদিবাসী ধর্ম ও সর্বপ্রাণবাদী কৃত্য;
  • আদিবাসী কৃষি উৎপাদন ও আর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থা;
  • আদিবাসী সমাজব্যবস্থা;
  • পারিপার্শ্বিক ভূরাজনৈতিক প্রতিবেশ;
  • মদ জগরা ও দাবা দ্রব্য;

চিহ্নিত বিষয় বৈশিষ্ট্যগুলো নিচে বিশ্লেষণ করা হলো-

  • আদিবাসী সদস্য হিসেবে চলচ্চিত্রে নৃগষ্ঠীর অভিনয়শিল্পী

মর ঠেংগাড়ি চলচ্চিত্র যেহেতু চাকমা জনগোষ্ঠীর জীবন সংগ্রাম নিয়ে নির্মিত তাই এখানে চাকমা জনগোষ্ঠীর মানুষের উপস্থিতি স্বাভাবিক। চলচ্চিত্রে উপস্থাপিত সকল চরিত্রই আদিবাসীর প্রতিনিধি। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এখানে কোন বাঙালি অভিনয় শিল্পী দিয়ে অভিনয় করানো হয়নি। চলচ্চিত্রের পর্দায় উপস্থিত প্রতিটি শিল্পীই মঙ্গোলীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। চাকমা জনগোষ্ঠীর জীবন সংগ্রাম নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হলেও দু’একটি চরিত্রে অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষ অভিনয় করেছন। যেমন দেবু চরিত্রে অভিনয়কারী শিশু শিল্পী উ চিং হ্লা রাখাইন জনগোষ্ঠীর মানুষ, আ চিং মারমা নামের আরেকজন মারমা জনগোষ্ঠীর শিল্পীও এখানে অভিনয় করেছেন। তবে তারাও মঙ্গোলীয় নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হওয়ায় দর্শকের দৃষ্টিতে চাকমা এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীর অভিনয়শিল্পীকে পৃথক করা সম্ভব নয়। ফলে বাংলাদেশে নির্মিত অপরাপর চলচ্চিত্রে যেখানে আদিবাসী চরিত্রে বাঙালি অভিনয় শিল্পী কর্তৃক অভিনয় উপস্থাপন করতে দেখা যায়, যা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু, তা এই চলচ্চিত্রে পরিলক্ষিত হয়নি। এ কারণে এই চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশে নির্মিত অপরাপর আদিবাসী সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্র থেকে স্বতন্ত্র এবং মৌলিক।

  • আদিবাসী ভাষা

মর ঠেংগাড়ি চলচ্চিত্রে পূর্ণাঙ্গভাবেই চাকমা ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশের অন্যান্য আদিবাসী সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্রের তুলনায় এই চলচ্চিত্র অনেক বেশি বাস্তব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে চাকমা জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা ব্যবহারের কারণে। এমনকি শিশু শিল্পী উ চিং হ্লা রাখাইনকেও চাকমা ভাষায় এই চলচ্চিত্রে কথা বলতে দেখা যায়।

  • আদিবাসী ধর্ম ও সর্বপ্রাণবাদী কৃত্য

চাকমা জনগোষ্ঠী বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। পাশাপাশি তারা সর্বপ্রাণবাদী সংস্কৃতি ও কৃত্য পালন করে থাকে। চলচ্চিত্রে দেখা যায় কমল সাইকেল নিয়ে যাত্রী পরিবহনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর উক্ত পরিসেবার মঙ্গল কামনার্থে বাড়িতে বৌদ্ধ ভিক্ষু ডেকে পূজার আয়োজন করে (২৫ মি. ০৮ সে. – ২৬ মি. ৫০সে.)। তখন বৌদ্ধ ভিক্ষুর উচ্চারিত মন্ত্র এবং সম্মুখে থাকা কৃত্যের নৈবেদ্য স্বরূপ নারকেল, কলা, আগরবাতি, গোলাপজল, আমের জুস, প্রভৃতি উপকরণ দেখা যায়। যা সর্বপ্রাণবাদী কৃত্যের অংশ বলেই গবেষকগণ মনে করেন।১৭ এছাড়াও চলচ্চিত্রে ৪৭ মি.২০ সে. – ৪৭ মি.৫৬ সে. পর্যন্ত দৃশ্যে কার্বারী কাকা ও কমলের কথোপকথনের দৃশ্যে উঠে আসে বিজু উৎসবের প্রসঙ্গ। যেখানে কার্বারী কাকা বিজু উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে কমলকে কিছু অর্থ দান করতে বলেন। বিজু চাকমা জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর সামাজিক ও কৃত্যমূলক অনুষ্ঠান। পুরাতন বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে বরণ উপলক্ষে চাকমা সমাজের মানুষ একত্র হয়ে সামাজিক ও ধর্মীয় কৃত্যমূলক অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। সেখানে উক্ত সমাজের সকলে নিজের সামর্থ্যানুযায়ী অংশগ্রহণ করে। চাকমা সমাজের ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবের বিষয়টিও চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে।

চিত্র: মর ঠেংগাড়ি (My Bicycle) চলচ্চিত্রে কৃত্যমূলক প্রার্থনার একটি দৃশ্যের স্থিরচিত্র।
  • আদিবাসী কৃষি উৎপাদন ও আর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থা

পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়কেন্দ্রিক জীবন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত জনগোষ্ঠীর আর্থনৈতিক জীবন পরিচালিত হয় পাহাড়কে কেন্দ্র করে। বিশেষ করে পাহাড়ি জুম কৃষি উৎপাদন ও সাধারণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পেশা এখানকার মানুষের আর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থার প্রধান অনুষঙ্গ। বর্তমান সময়ে পার্বত্য অঞ্চলের অনেক জনগোষ্ঠীর মানুষ উচ্চশিক্ষা গ্রহণপূর্বক দেশ-বিদেশে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। কিন্তু এখনো পার্বত্য অঞ্চলের একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা পাহাড়ি কৃষি-উৎপাদন ও স্থানীয় ব্যবসাকেন্দ্রিক। চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয়, কমল শহরে চাকরি করার সময় ৬ মাস বেতন পায়নি। এই সময় বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারেনি। কিন্তু তার স্ত্রী দেবী এই ছয় মাস পাহাড়ি কৃষি ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরে তার পরিবার রক্ষা করেছে। এমনকি চলচ্চিত্রে আমরা দেখতে পাই কমল বাড়িতে ফিরে আসার পরে যখন তার আয়-রোজগারের কোন ব্যবস্থা নেই, তখন দেবী পাহাড়ি জুম ফসল সংগ্রহ করে এনে সংসারে সকলের খাবারের ব্যবস্থা করে। চলচ্চিত্রের ২১ মি.২৫ সে.- ২১ মি.৩০ সেকেন্ড পর্যন্ত দৃশ্যে কমল তার ছেলে দেবুকে বাড়ি ফিরে এসে জিজ্ঞেস করে,

কমল – দেবু তোমার মা কোথায় গেছে

দেবু – জুমে গেছে

এরপর দেবীকে আমরা দেখতে পাই ঝুড়িতে শাকসবজি নিয়ে বাড়িতে আসতে। এবং আয়-রোজগারবিহীন এই বৈরী সময়ে পরিবারের খাবার আসছে পাহাড়ের জুম ভূমি থেকে। অর্থাৎ প্রচণ্ড প্রতিক‚ল পরিস্থিতির মধ্যেও পাহাড় এই জনগোষ্ঠীকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এমনকি চলচ্চিত্রে দৃশ্যমান অধিকাংশ পেশাজীবী মানুষের পেশাই কৃষি সংশ্লিষ্ট। চলচ্চিত্রে উপস্থাপিত জনগোষ্ঠীর কেউ কেউ তাদের উৎপাদিত কলা, আনারস, বা অন্যান্য কৃষি পণ্য নিয়ে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে যায়। অর্থাৎ তারা কৃষি সংশ্লিষ্ট ফসল নিয়ে ব্যবসায় জড়িত। পাশাপাশি বাজারে ছোট ছোট দোকান বা ব্যবসায়ী শ্রেণিও রয়েছে। সেখানে নতুন পেশাজীবী হিসেবে কমল পরিবহন সেবা নিয়ে উপস্থিত হয়। পাহাড়ি জনজীবনে কৃষি-উৎপাদন ও স্থানীয়-ব্যবসা প্রধান অর্থ উপার্জনকারী মাধ্যম তা এই চলচ্চিত্রে উপস্থাপিত হয়েছে। একই সাথে নতুন পেশাজীবী শ্রেণির উদ্ভবের সম্ভাবনার ইঙ্গিতও পাওয়া যায় চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে যখন নতুন বাই সাইকেল, মোটর বাইক পাহাড়ি জনপদে প্রবেশ করে।

  • আদিবাসী সমাজ ব্যবস্থা

যৌথ সমাজকাঠামোয় অভ্যস্ত চাকমা জনগোষ্ঠীর মানুষ গ্রামকে বলে ‘আদাম’। আর গ্রামের প্রধানকে বলে ‘কার্বারী’। কার্বারী গ্রামের লোকদের দ্বারা নির্বাচিত হয়। গ্রামের ছোটখাটো বিবাদ বা সমস্যা নিষ্পত্তি করে থাকেন একজন কার্বারী। এছাড়াও চাকমাদের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন কার্বারী।১৮ চাকমা সমাজের নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধি ‘কার্বারী’ পদবীর একটি চরিত্র এই চলচ্চিত্রে দেখা যায়। যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিনয় কান্তি চাকমা। চলচ্চিত্রে দেখা যায় কমলের সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে একজন আহত হলে কার্বারীর কাছে তার বিচার দাবি করে। তখন কার্বারী পাড়ার মানুষদেরকে সঙ্গে নিয়ে বসে সামাজিক প্রথা অনুযায়ী বিচার করে অর্থাৎ চাকমা সমাজে কার্বারীর যে দায়িত্ব এবং ক্ষমতা রয়েছে তা এই চলচ্চিত্রে দৃশ্যমান হয়। পাশাপাশি বিজু উৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠান আয়োজনের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় কার্বারী চরিত্রের মধ্যে। তিনি কমলের সঙ্গে দেখা করে বিজু উৎসব আয়োজনে তার অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করেন। সেই উৎসব উপলক্ষে তাকে সামান্য কিছু দান করে অংশগ্রহণ করতে বলেন। পাশাপাশি কমল যখন শহর থেকে ফিরে আসে, তখন কমল কি করবে, না-করবে এসব নিয়ে তাকে পরামর্শ দেয়। অর্থাৎ পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত চাকমা জনগোষ্ঠীর সমাজবদ্ধ জীবনযাপন এবং পরস্পরের কাছাকাছি অবস্থান, তাদের সমাজকাঠামোয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পরামর্শ তাদের সামষ্টিক জীবনাচরণের বহিঃপ্রকাশ। যা এই চলচ্চিত্রে পরিচালক তুলে ধরেছেন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ অর্থপূর্ণভাবে।

  • পারিপার্শ্বিক ভূরাজনৈতিক প্রতিবেশ

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূরাজনৈতিক প্রতিবেশ বাংলা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ভিন্ন। প্রায় সময়ই দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক চাঁদাবাজির ঘটনা উঠে আসে। এই বিষয়টিকে পরিচালক চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করেছেন। কমল যখন আর্থিক দুরবস্থা দূর করার জন্য তার সাইকেলে যাত্রী এবং পরবর্তীকালে পণ্য পরিবহন শুরু করে তখন তার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালোর দিকে যেতে শুরু করে। এমন সময় তার পথ রোধ করে দাঁড়ায় একদল পাহাড়ি যুবক। তাদের পরিচয় চলচ্চিত্রে সুস্পষ্ট না করা হলেও এটা বোঝা যায় যে এরা কারা। তারা কমলের কাছে কিছু টাকা দাবি করে। কমল সে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরদিন ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে কমল দেখে ঘরের সঙ্গে রাখা তার বাইসাইকেলটি নেই। পরে বাড়ির পাশে খাদে ভাঙ্গা অবস্থায় সাইকেলটি খুঁজে পায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন সুন্দর, তেমনি সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশের ভিতরে অসুন্দর রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করে। যা এই চলচ্চিত্রে পরিচালক কৌশলী হাতে উপস্থাপন করেছেন।

চিত্র: মর ঠেংগাড়ি (My Bicycle) চলচ্চিত্রে মা-ছেলের ভীত-সন্ত্রস্ত মুখ।

আরো অনেক জটিল শ্বাসরুদ্ধকর ভূরাজনৈতিক প্রতিবেশের চিত্র স্বল্প সময়ের জন্য উপস্থাপন করেছেন পরিচালক। যা দর্শনে যেকোন সচেতন দর্শকের মনে নতুন ভাবনা ও প্রশ্নের উদয় হবে। ভাবনা-চিন্তার উদ্রেককারী এমন ভূরাজনৈতিক প্রতিবেশ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অথচ সংক্ষিপ্ত পরিসরে পরিচালক ‘ফোর্থ সিনেমা কনসেপ্টে’র এই চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করেছেন।

  • মদ, জগরা ও দাবা দ্রব্য

মদ জগরা চাকমা সমাজে সুপরিচিত পানীয়। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষে তারা এগুলো বাড়িতে তৈরি এবং পান করে থাকে। অতিরিক্ত মদ জগরা পান চাকমা তথা পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত নৃগোষ্ঠীর আর্থনৈতিক অবনতির জন্য দায়ী বলে অনেকে ধারণা করেন।১৯ চলচ্চিত্রে দুইটি দৃশ্যে মদ্যপানের বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে। কমলের বাইসাইকেলের চাকা নষ্ট হলে সেটা নিয়ে সে যখন বাজারে যাচ্ছিল ঠিক করার জন্য তখন (৪০ মি.২৮সে.- ৪১ মি.১৩ সে. পর্যন্ত) দু’জনকে দেখা যায় মাতাল হয়ে পড়ে থাকতে। মাতাল অবস্থায় তারা বিভিন্ন কথা বলতে থাকে। দ্বিতীয় আরেকটি দৃশ্য দেখা যায় (৪৮মি.৩৭ সে.-৫০মি.৪০ সে.) কমল সাইকেল নিয়ে যাওয়ার পথে তিনজন মদ্যপানরত যুবক তাকে বসতে বলে তাদের আসরে। কমল যুক্ত হয় এবং আনন্দ বিনোদনের সঙ্গে মদ পান করে থাকে। মদ পান আদিবাসীর আনন্দ বিনোদনের অংশ। যা এই চলচ্চিত্রে দেখা গেছে।

পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত চাকমাসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মানুষ দাবা বা বাঁশের তৈরি বিশেষ ধরনের ধূমপান করার যন্ত্র নিজেরাই তৈরি ও ব্যবহার করে থাকে। অবসর সময়কালে কিংবা কাজের ফাঁকে তারা দাবা বা হুকায় দম নেয়। তামাক জাতীয় দ্রব্য এর মধ্যে দিয়ে আগুন ধরিয়ে তার ধোঁয়া গ্রহণ করে। এটা নাগরিক সমাজের প্রচলিত সিগারেট বা বিড়ির একটি সনাতন অথবা আদিবাসী সংস্করণ বলা যায়। চাকমা জনজীবনের সঙ্গে দাবা বা হুকা গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। এটা তাদের জনসংস্কৃতির অংশ। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন স্থানে একাধিক কোরাস চরিত্রকে এবং কমলের আয়-রোজগার বৃদ্ধি পাওয়ার পরে ঘরে বসে অবসর যাপনের সময় এই হুকা বা দাবায় টান দিতে দেখা যায়। যা চাকমা জনজীবনকে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরতে অন্যতম উপাদান হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।

মর ঠেংগাড়ি চলচ্চিত্রটি একজন আদিবাসী পরিচালক কর্তৃক নির্মিত, আদিবাসী জীবন সংগ্রাম ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের চলচ্চিত্রিক শিল্পভাবনার নান্দনিক প্রকাশ। এখানে একটি জনগোষ্ঠীর সার্বিক জীবন সংস্কৃতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ যেমন উঠে এসেছে, তেমনি উঠে এসেছে তাদের প্রাত্যহিক জীবনে ছোট ছোট আশা আকাঙ্ক্ষা, পরিশ্রম, সমস্যা, সংকট ও বাস্তবানুগ জীবন ব্যবস্থা। সার্বিক বিবেচনায় এই চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের ‘আদিবাসী চলচ্চিত্রে’ ‘আদিবাসী’ উপস্থাপন পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে নতুন ভাবনা ও শিল্পিত প্রয়োগের নান্দনিক বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

Kalpona”….. Not Imagination (২০১৬)

স্বাধীন-ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতা সান্তুয়া ত্রিপুরা পরিচালিত “Kalpona”….. Not Imagination চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য রচনা করেছেন কবিতা চাকমা ও সান্তুয়া ত্রিপুরা। চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেছেন জয়তু দেওয়ান, পদ্মিনী চাকমা, মীর রিফাত উস সালেহীন এবং শেখ সজীব ইসলাম।

চলচ্চিত্রটিতে দেখা যায় যে, ঢাকার নাগরিক সমাজে বসবাসরত চাকমা জনগোষ্ঠীর একজন শিক্ষার্থীর দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যায়। স্বপ্নের মধ্যে সে দেখতে পায় উন্মত্ত কুকুরের হিং¯্র শব্দ সিঁড়ি বেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। স্বপ্নে এই দৃশ্য দেখে তার ঘুম ভেঙে যায়। সে যখন ঢাকার রাস্তায় হাঁটে কালো পোশাকের কেউ একজন তাকে অনুসরণ করতে থাকে। একাধিকবার এমন ঘটনা সে দেখে। লাইব্রেরিতে যায়, বইপত্র নেয়, পড়ে এবং ভাবে। ভাবতে থাকে তার নিজের পার্বত্য অঞ্চলের দুরবস্থা সম্পর্কে। চলচ্চিত্রের আরেকটি চরিত্রে দেখা যায় একজন চাকমা নারীকে। সে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে নিজের মনের ভাব ব্যক্ত করতে থাকে। ছেলেটি পার্বত্য চট্টগ্রামে তার গ্রামের বাড়িতে যায়। সেখানেও যেন তাকে তাড়া করে ফেরে অদৃশ্য সেই শত্রু। যার আগমনের শব্দ হায়না বা কুকুরের মত। পাহাড়ী গ্রাম-পাড়া ঘুরে সে পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে আত্ম উপলব্ধি করতে পারে। তারপর আবার শহরে ফিরে আসে। তার বইপত্র গুছিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে সংগ্রামী চেতনা বুকে ধারণ করে।

বাংলাদেশে নির্মিত বিকল্পধারার এই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটিতে শুধু ‘আদিবাসী উপস্থাপন’ নয় বরং এই চলচ্চিত্রটি একজন আদিবাসী নির্মাতা কর্তৃক নির্মিত। যার চিত্রনাট্য রচনা করেছেন চাকমা জনগোষ্ঠীর মানুষ। যেখানে অভিনয় করেছেন উক্ত জনগোষ্ঠীর অভিনয়শিল্পী এবং যে চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু আবর্তিত হয়েছে পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী জীবন, সংগ্রাম ও মানবাধিকারের বিষয় নিয়ে ।

চিত্র: “Kalpona”….. Not Imagination চলচ্চিত্রের স্টাবলিশম্যান্ট শটের একটি স্থিরচিত্র।

Kalpona”….. Not Imagination চলচ্চিত্রটি শুরু হয়েছে একটি স্টাবলিশমেন্ট শট দিয়ে। যেখানে ভাসমান মেঘরাশির নিচে কাপ্তাই হ্রদ। হ্রদ ও আকাশের স্থির একটা শটে কেবল মেঘ ভেসে যাচ্ছে আর ব্যাকগ্রাউণ্ডে ভেসে আসছে কুকুরের চিৎকার। দুইবার কুকুরের চিৎকারের মাধ্যমে এই দৃশ্য সমাপ্ত হয়। এই একটি মাত্র দৃশ্য যেখানে কুকুরের শব্দ দিয়ে পরিচালক যে অর্থ তৈরি করার চেষ্টা করেছেন তা সচেতন দর্শকের কাছে কৌত‚ হলোদ্দীপনা তৈরি করবে। পরের দৃশ্য শুরু হয় একটা পুরাতন পাকা বাড়ির ঘরের ছাদ থেকে। সেখান থেকে ক্যামেরা নেমে এসে বিছানায় ঘুমন্ত রামনকে (জয়তু দেওয়ান) দেখায়। ঘুমন্ত মুখে দুশ্চিন্তার বলিরেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক্যামেরা কাট করে যে ভবনে সে ঘুমিয়ে রয়েছে সেই ভবনটিকে কাত হয়ে যেতে দেখায়। এক্সপ্রেশনিস্ট ধারার এই ক্যামেরা এঙ্গেলের মাধ্যমে চরিত্রের অবচেতন মনে জমে থাকা বিভিন্ন ট্রমা ও নিপীড়নের অবদমিত যন্ত্রণাকে তুলেধরার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। অর্থৎ অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে সে ঘুমাচ্ছে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সময় ব্যাকগ্রাউন্ডে কুকুরের তাড়া করার শব্দ। ক্ষীপ্র কুকুরের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা সামনের দিকে এগুতে থাকে। শট কাট করেই আবার ঘুমন্ত মুখ, মুখে চিন্তার বলিরেখা দেখা যায়। কাট টু কাট শটের মাধ্যমে এবার দেখা যায় দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে কেউ একজন তার ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা যে কোন মানুষের পা, তা স্পষ্টভাবে বুঝায় না। কারণ এখানে কোন মানুষের পা দেখা যায় না। তবে ক্যামেরার সাদাকালো চিত্রণের সাথে এভাবে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা এবং ব্যাকগ্রাউণ্ডে ক্ষিপ্র কুকুরের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ ভয়ানক এক পরিস্থিতির পূর্বাভাস দেয়। স্বাধীন ধারার স্বল্পদৈর্ঘ্য এই চলচ্চিত্রটিতে কোন সংলাপ ব্যবহৃত না হলেও ছিল ব্যাকগ্রাউণ্ডে ধারাবর্ণনা। এই ধারাবর্ণনার সূত্রধরে এর বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ যৌক্তিক।

চলচ্চিত্রটির দুটি পর্যায় সাদাকালো এবং রঙিন। শহরের জীবন যাপন, কর্মব্যস্ততা তথা নাগরিক বৈচিত্র্যময় কংক্রিটের নগর সাদাকালো দেখিয়েছেন পরিচালক। অপরদিকে প্রকৃতির নিকটবর্তী পাহাড়, মেঘ, ঝরনা ও পাহাড়ি মানুষ এবং জনজীবনকে উজ্জ্বল, রঙিন করে চলচ্চিত্রের পর্দায় উপস্থাপনের মাধ্যমে পরিচালক ভিন্ন এক বার্তা দিতে চেয়েছেন। শহরের জীবন যাপনে ব্যস্ততা রয়েছে, কংক্রিটের বিশালত্ব রয়েছে, কিন্তু তাতে জীবন্ত প্রাণ নেই। বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের জনজীবন এই কর্মব্যস্ত কংক্রিটের নগরে এসে প্রাণহীন হয়ে ওঠে। সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে চলচ্চিত্রটির পরিচালক জানান, নিষ্প্রাণ এবং অপরের দুঃখ অনুধাবনে ব্যর্থ এই নাগরিক সমাজকে বোঝাতে তিনি সাদাকালো নগর দেখিয়েছেন। অপরদিকে প্রকৃতি ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর পার্বত্য অঞ্চলের জীবনযাত্রা, ঘরবসতি, মানুষ এবং তাদের সংস্কৃতি উপস্থাপনের সময় তাকে উজ্জ্বল এবং রঙিন করে দেখিয়েছেন। প্রাণ এবং প্রকৃতির মেলবন্ধনে প্রকৃতপক্ষে মানুষ তথা সভ্যতা বেঁচে থাকে। সেই সভ্য জীবনকে সুন্দর ও রঙিন করে উপস্থাপন কল্পে পরিচালকের নান্দনিক এই শিল্প ভাবনা চলচ্চিত্রে অনুসৃত হয়ে থাকতে পারে। মূলধারার গণমাধ্যম বা চলচ্চিত্র মাধ্যমে শহরকে (ঢাকা) যেভাবে দেখতে কিংবা দেখাতে অভ্যস্ত এর বিপরীতে গিয়ে একজন পাহাড়ে বড় হওয়া নাগরিক শহরকে যেভাবে দেখেন বা অনুভব করেন সেই দেখার এবং অনুভবের অনুভূতি চলচ্চিত্রে কালার কনট্রাস্ট এর মাধ্যমে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। এর মাধ্যমেই মূল ধারার চলচ্চিত্র বা মেইনস্ট্রিম মিডিয়া এবং সিনেমার সাথে ফোর্থ সিনেমার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এই কালার কন্ট্রাস্টের মাধ্যমে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং সচেতন রাজনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যমে “Kalpona”….. Not Imagination চলচ্চিত্রটি ফোর্থ সিনেমার বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। কারণ আদিবাসীর প্রতি মূল ধারার জনগণের যে দৃষ্টিভঙ্গি তার বিপরীতে মূল ধারার নাগরিক জীবনের প্রতি আদিবাসী সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা এই চলচ্চিত্রে প্রকাশ হয়েছে। “Kalpona”….. Not Imagination চলচ্চিত্রে আদিবাসী সংস্কৃতি এবং জীবন সংগ্রাম যে যে উপাদানের আলোকে উপস্থাপিত হয়েছে সেগুলো হলো-

  • আদিবাসী চরিত্রের উপস্থিতি;
  • আদিবাসী রাজনৈতিক সংগ্রাম ও চেতনাগত অবস্থান;
  • আদিবাসীর বাসস্থান ও ভৌগলিক অবস্থা;
  • আদিবাসী সংস্কৃতি ও পোশাক;

চিহ্নিত বিষয়-বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে বিশ্লেষণ করা হবে আদিবাসী নৃতত্ত্ব, আদিবাসী জনসংস্কৃতি এবং আদিবাসী রাজনৈতিক চেতনা ও অবস্থানের আলোকে।

  • আদিবাসী চরিত্রের উপস্থিতি

আদিবাসীদের মধ্যে চাকমা জনগোষ্ঠী জনসংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম। পার্বত্য অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক নেতৃত্ব, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এমনকি শিক্ষা-সংস্কৃতিতে তাদের নেতৃত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। পার্বত্য জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক নেতৃত্বের এক ঐতিহাসিক চরিত্র কল্পনা চাকমা। কল্পনা চাকমা অপহরণকে কেন্দ্র করে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে একজন চাকমা যুবক ও চাকমা নারী প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। রামন চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়তু দেওয়ান এবং কল্পনা চামকা চরিত্রে অভিনয় করেছেন পদ্মিনী চাকমা। এছাড়াও এই চলচ্চিত্রের শেষ দিকে (০৯মি. ৩৩ সে.- ১০মি. পর্যন্ত দৃশ্য) পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন আদিবাসীর প্রতিনিধিদের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায়। এর মধ্যে ৫ জন আদিবাসী শিশু (২ জন বৌদ্ধভিক্ষুসহ), আদিবাসী নারী (চাকমা, মারমা, উসুয়ে), জুম চাষি প্রভৃতি পেশা ও কর্মব্যস্ত আদিবাসীর উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায়। যেহেতু আদিবাসী জীবন ও রাজনৈতিক মতাদর্শকে কেন্দ্র করে এই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে সেহেতু এখানে আদিবাসী চরিত্রের উপস্থিতি স্বাভাবিক। পাশাপাশি নাগরিক জীবন এবং নাগরিক জীবনের প্রেক্ষিতে আদিবাসী জীবন উপস্থাপনের ক্ষেত্রে এই চলচ্চিত্রে আদিবাসীর অধিক উপস্থিতি যৌক্তিক ও নান্দনিক। এমনকি বাণিজ্যিক ধারার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে যেখানে আদিবাসী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বাঙালি অভিনয়শিল্পী কর্তৃক অভিনয় উপস্থাপনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় তার বিপরীতে শিল্পমান নির্ভর ও বক্তব্যমূখ্য এই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে পূর্ণাঙ্গ ভাবেই আদিবাসী সংস্কৃতি, জীবন সংগ্রাম ও রাজনৈতিক চেতনাগত অবস্থান স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।

  • আদিবাসী রাজনৈতিক সংগ্রাম ও চেতনাগত অবস্থান

পাহাড়ি নারীদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করতো কল্পনা চাকমা। তাকে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা আজ সর্বজনজ্ঞাত। যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও চেতনা পাহাড়ে বসবাসরত জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন কল্পনা চাকমা, তা ব্যাহত হয় কল্পনা চাকমা অপহরণের মাধ্যমে। তবে তা থেমে যায়নি, বন্ধ হয়ে যায়নি চিরদিনের মত। সময়ের বিবর্তনে এখন তারা অনেকেই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছে। শহর ও নাগরিক জীবনে পদচারণা করে শিখে নিয়েছে রাজনৈতিক কূটকৌশল ও চিন্তাধারার মূল সূত্র আবিষ্কারের কৌশলপূর্ণ পদ্ধতি। তারা এখন তাদের সংগ্রামী চেতনার কথা, রাজনৈতিক বক্তব্য চালচ্চিত্রিক শিল্পকৌশলে নান্দনিক ভাবে প্রকাশ করতে পারে। শিল্পের বহুমাত্রিক প্রকাশভঙ্গির কৌশল এখন তারা আয়ত্ত করেছে। শিল্পের পথ ধরে তারা তাদের বক্তব্য পৌঁছে দিচ্ছে দেশ ও বিদেশের মানুষের কাছে। সচেতন রাজনৈতিক চিন্তার শিল্পিত বহিঃপ্রকাশ “Kalpona”….. Not Imagination স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি। চলচ্চিত্রটিতে সাবটাইটেল ও ভয়েস ওভার ব্যবহার করা হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। মূলত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উপস্থাপনের নিমিত্তে ইংরেজি ভাষার প্রয়োগ।২০ চলচ্চিত্রের মূল বক্তব্য কল্পনা চাকমা বিষয়ে হলেও এর আরো অনেক শাখা বক্তব্য রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে কেন তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, কেন তারা তাদের অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হয় কিংবা কেন তাদের সংগ্রাম করা উচিত, কেন মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া উচিত তাদের প্রতি অন্যায় নিপীড়নের সঠিক ইতিহাস। তারা এই ভূখণ্ডে বসবাস করেও যেন স্বাধীন দেশের পূর্ণাঙ্গ নাগরিকের অধিকার পাচ্ছে না। তারা দমবন্ধকরা সামরিক আস্তানার মধ্যে বেড়ে উঠছে। অথচ বাংলাদেশের মানুষ কখনোই দীর্ঘকাল সামরিক শাসন মেনে নেয়নি। পাকিস্তান আমলের সামরিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই স্বাধীন দেশেই তাদেরকে বছরের পর বছর যেন সামরিক শাসনের অধীনে থাকতে হচ্ছে। এটা তাদের শৈশব-কৈশোরের নির্মল আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছে। যা তারা ফিরে পেতে চায়, তাদের পূর্বপুরুষের বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত বসতভিটা সেটলার কর্তৃক দখল হয়েছে, পাহাড়ে ক্রমাগত নির্যাতন-নিপীড়ন হয়, ভূমি থেকে উৎখাত করা হয় ভূমিপুত্রদের, এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। সেই প্রতিবাদী চেতনা প্রকাশিত হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। তাই আমরা শুনতে পাই “What will happen to the future? and where is it truth, the truth of Victory, the truth of society and your ideology.”

এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মানুষকে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করা এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে উৎসাহী করতে উদ্বুদ্ধ করবে।

Someone chasing me like I am a dog. Who am I actually? Why there are so many states of ideology? Dear there is no Red flag, not even a red balloon that I want to play with them. I want to smile with them. Dear is this the one state where people disappear? Oh dear! Where is my existence? Do I have a fear? this night is it really a Nightmare? Am I screaming from the box? Dare what is happening on the other side of the world? fire, blood shade. let the people know is it really a nightmare or reality.

উল্লিখিত ভয়েস ওভারের সাথে পর্দায় ভেসে ওঠা দৃশ্যকল্প এবং শ্রবণে আঘাত করা শব্দমালা আমাদেরকে ক্রমাগত শ্বাসরুদ্ধকর বদ্ধ পরিবেশে নিয়ে যায়। যেখানে দমবন্ধ হয়ে আসবে রক্তমাংসের মানুষের। পাহাড়ের প্রকৃত পরিস্থিতির নান্দনিক উপস্থাপনকল্পে বিপ্লবী কবিতার ভাষা, সাদাকালোর চলমান চিত্রমালা এবং দুশ্চিন্তা উদ্রেককারী ভয়ার্ত সাউন্ড ইফেক্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রকাশ করে। রাজনৈতিক বক্তব্য উপস্থাপনের অন্যতম দৃষ্টান্ত – “Where are all these revolutions? Oh dear! Why did not resist? Why shall I not racist?”

পাহাড়ের রাজনৈতিক অবস্থা এবং নির্যাতন নিপীড়নের চিত্র চলচ্চিত্রের ভাষায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা এই চলচ্চিত্রের নান্দনিক অভিপ্রায়।

  • আদিবাসীর বাসস্থান ও ভৌগলিক অবস্থা

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে কংক্রিটের নগর এবং সবুজঘেরা পাহাড়ি জনপদের ব্যবধি নির্ণয় করতে পরিচালক চলচ্চিত্রটিকে যথাক্রমে সাদাকালো অংশ এবং রঙিন অংশে উপস্থাপন করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা পাহাড়ি অঞ্চল এবং তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রাণ-প্রকৃতিতে পরিপূর্ণ। সেই প্রাণৈশ্বর্য সম্পন্ন নিরাভরণ প্রকৃতি, প্রতিবেশ ও ভৌগোলিক অবস্থান এবং তাদের নিজেদের বসতবাড়ির দৃশ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে রঙিন কালারটোন ব্যবহার পরিচালকের নিজস্ব নন্দন ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। নান্দনিক বাস্তবানুগ চলচ্চিত্রিক পরিবেশ বিনির্মাণে পরিচালক রঙিন কালারটোনের পাশাপাশি পাহাড়ি আদিবাসী জনজীবনের ভৌগোলিক অবস্থা ও বাসস্থান উপস্থাপন করেছেন। কৃত্রিম স্টুডিও-নির্ভর সেট নয় বরং প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ ও আদিবাসী বাসস্থানের দৃশ্য তিনি ধারণ করেছেন সরাসরি। “Kalpona”… Not Imagination চলচ্চিত্রে ০:৫:০৬-০:৫:৫০ সেকেন্ড পর্যন্ত বিশাল পাহাড় এবং পাহাড়ের চ‚ড়া দেখা যায়। যে পাহাড়ের ভাঁজেভাঁজে বসবাস করে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষ। পাহাড়ের সঙ্গে তাদের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। এই দৃশ্যে মনে হয় কল্পনা চাকমা পাহাড়ের মতো বিশাল ও উন্নত এক ব্যক্তিত্ব। যিনি সমবেত মানুষ তথা পাহাড়ের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছেন। কল্পনা চাকমার চোখ দিয়ে যখন ছোট ছোট অসংখ্য পাহাড়-টিলা দেখা যায় তখন ক্যামেরা এঙ্গেলের কারণে মনে হয় তিনি দৃষ্টিগ্রাহ্য সকল পাহাড়ের চাইতেও বিশাল। তিনি এই পাহাড়কে নেতৃত্ব দেন। সমবেত পাহাড়ের উদ্দেশ্যে তিনি দাঁড়িয়ে কিছু বলতে চান। কিন্তু চলচ্চিত্রিক দৃশ্যকল্প বিনির্মাণে পরিচালকের যে নান্দনিক ভাবনাই থাকুক না কেন এর বাইরেও পাহাড়ি ভৌগোলিক প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রত্যক্ষ করা যায়। চলচ্চিত্রটির ২য় পর্যায়ে অর্থাৎ ০৬মি.০২সে. – ০৯মি. ০২ সে. এর দৃশ্যে পাহাড়ে বসবাসরত আদিবাসীর ঘর-বসতির দৃশ্য উঠে এসেছে। এখানে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে নির্মিত উঁচু ঘর দেখা যায়। দেখা যায় পাহাড়ের সাথে মেঘের মিশ্রণ। মেঘ পাহাড়ের পার¯পরিক মিশ্রণটি পাহাড়ি জনজীবনে কৃষি উৎপাদনে অত্যন্ত সহায়ক। চলচ্চিত্রটির ০৯মি.৩৩সে. – ০৯মি. ৫৯ সেকেন্ড পর্যন্ত দৃশ্যে পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষ এবং তাদের কর্ম তৎপরতার পাশাপাশি তাদের আবাস গৃহ উঠে এসেছে। এখানে তাদের সংস্কৃতির কিছু অংশ দৃশ্যমান হয়।

  • আদিবাসী সংস্কৃতি ও পোশাক

চলচ্চিত্রটির কয়েক জায়গায় পাহাড়ি জনসংস্কৃতির অন্যতম উপাদান তাদের নিজস্ব পোশাক উঠে এসেছে। উঠে এসেছে তাদের কৃষিকর্মের সাথে যুক্ত বিভিন্ন উপকরণ সামগ্রী। এমনকি অলংকার সমৃদ্ধ একজন উসুই (ত্রিপুরা) পৌঢ়া নারীকে দেখা যায় চলচ্চিত্রে। তার গলায় ব্যবহৃত অলংকার দেখে সহজেই আদিবাসী ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিহিত আদিবাসী নারী বলে প্রতিয়মান হবে। পাশাপাশি পিনন-হাদি পরিহিত আদিবাসী নারীকে দেখা যায়। স্বল্পদৈর্ঘ্য এই চলচ্চিত্রের ০৯ মি.৩৩ সে.- ০৯মি. ৫৯ সেকেন্ড পর্যন্ত দৃশ্যে বিভিন্ন আদিবাসীর মানুষকে দেখানোর জন্য পরিচালক স্ট্যাটিক শটে শ্যালো ডেপথ অফ ফিল্ড এবং ডিপ ডেপথ অফ ফিল্ডের সমন্বয়ে নান্দনিক ও অর্থপূর্ণ দৃশ্য ধারণ করেছেন। এই দৃশ্যেই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বেশি আদিবাসী জীবন চিত্র উঠে এসেছে। যা দেখে অপেক্ষায় থাকা মুক্তিকামী অসহায় মানুষের অসহায়ত্ব প্রকাশ পায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীর জীবন ও সংস্কৃতি বিস্তৃভাবে উঠে না আসলেও, এই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে যে বক্তব্য উপস্থাপনের প্রচেষ্টা পরিচালক গ্রহণ করেছেন, তার মাধ্যমে আদিবাসী জীবন সংস্কৃতি, চিন্তাকল্প, রাজনৈতিক চেতনাবোধ ও অধিকার আদয়ের সংগ্রামী চিত্র উঠে এসেছে।

চিত্র: “Kalpona”….. Not Imagination চলচ্চিত্রে একজন উসুই (ত্রিপুরা) নারী।

এই চলচ্চিত্রটি পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা কল্পনা চাকমা অপহরণের বিষয়কে ঘিরে আবর্তিত। প্রাপ্ত তথ্যমতে কল্পনা চাকমা হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক স¤পাদক ছিলেন। ১৯৯৬ সালের ১১ জুন মধ্যরাতে তার বাড়ি থেকে পরিবারের সদস্যদের সামনে তাকে অপহরণ করা হয় বলে জানা যায়।২১ বহুবছর কেটে গেলেও এখনো তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেই সময় এই অপহরণ বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কল্পনা চাকমার অপহরণ, বিচার না পাওয়া এবং পাহাড়ে সার্বিক রাষ্ট্রনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলে সেখানে বসবাসরত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রতি অমানবিক ও বিমাতাসুলভ আচরণ তাদেরকে আন্দোলন সংগ্রামের পথ বেছে নিতে বাধ্য করে। এখনো সেই অপহরণের তদন্ত কাজ শেষ হয়নি, শুরু হয়নি বিচারিক প্রক্রিয়া।২২ পাশাপাশি প্রতিটি তরুণ-তরুণীর পেছনে ধাওয়া করে এক অজানা আতঙ্ক। সেই আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তারা কেন হবে না সংগ্রামী, কেন ফিরে যাবে না মাটির কাছে, মানুষের কাছে। কারণ পাহাড়ের প্রতিটি মানুষ স্বাধীন রাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ নাগরিকের সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে চায়। তাদের সেই স্বাধীনতার সুখ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম প্রয়োজন। এমনই যৌক্তিকতা ও ক্ষুরধার বক্তব্য রাজনৈতিক কবিতার ছন্দে প্রকাশের নিমিত্তে এবং সচেতন রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরার প্রয়াসে ফোর্থ সিনেমা ধারায় নির্মিত হয়েছে এই চলচ্চিত্র।

বাংলাদেশের ‘আদিবাসী চলচ্চিত্রে’ ‘আদিবাসী’ উপস্থাপন কৌশল বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের ‘আদিবাসী চলচ্চিত্রে’ ‘আদিবাসী’ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে যে প্রবণতা বা কৌশল চিহ্নিত করা যায় সেগুলো হলো –

  • আদিবাসী জনসংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট গল্পে আদিবাসী অভিনয়শিল্পী এবং তাদের বহুমাত্রিক সংস্কৃতির উপাদানসমূহ প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের ‘আদিবাসী চলচ্চিত্রে’ ‘আদিবাসী’ উপস্থাপন;
  • আদিবাসী জনজীবন সম্পর্কিত ঘটনাসমূহ ব্যবহার পূর্বক বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের ‘আদিবাসী চলচ্চিত্রে’ ‘আদিবাসী’ উপস্থাপন;
  • বাংলাদেশের ‘আদিবাসী চলচ্চিত্রে’ ‘আদিবাসী’ উপস্থাপন কৌশল হিসেবে চলচ্চিত্রিক শিল্পকৌশল বা চলচ্চিত্রের নন্দনভাষা ও চিহ্নবিজ্ঞানের প্রয়োগ;

নির্বাচিত বাংলাদেশের আদিবাসী চলচ্চিত্রদ্বয়ে আদিবাসী উপস্থাপনের ক্ষেত্রে উল্লিখিত কৌশল বা প্রবণতাসমূহ মোটা দাগে চিহ্নিত করা যায়। আলোচ্য প্রবন্ধে উল্লিখিত কৌশলসমূহ বিশ্লেষণপূর্বক একটি সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। এমতাবস্থায় উল্লিখিত কৌশলসমূহ বিশ্লেষণ প্রাসঙ্গিক।

  • আদিবাসী জনসংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট গল্পে আদিবাসী অভিনয়শিল্পী এবং তাদের বহুমাত্রিক সংস্কৃতির উপাদানসমূহ প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের ‘আদিবাসী চলচ্চিত্রে’ ‘আদিবাসী’ উপস্থাপন

পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্র) চাইতে স্বাধীন ধারার স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতাগণের ‘আদিবাসী চলচ্চিত্রে’ ‘আদিবাসী’ জনসংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট গল্প বা কাহিনি অধিক মাত্রায় উঠে এসেছে।২৩ বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাগণ তাদের চলচ্চিত্রে পাহাড়ে বসবাসরত আদিবাসীদের জনজীবন, সংগ্রাম, সংকট, চিন্তা-চেতনা, ইতিহাস, আন্দোলন ইত্যাদি বহুমাত্রিক বিষয় তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। আদিবাসীর প্রকৃতি কেন্দ্রিক যাপিত জীবন ও বেড়ে ওঠার সতেজ স্মৃতি তাদের মননে। যার প্রতিফলন দেখা যায় তাদের চলচ্চিত্রে। এ প্রসঙ্গে মর ঠেংগাড়ি (২০১৫), “Kalpona”….. Not Imagination (২০১৬) চলচ্চিত্রের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা যায়। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও জনসংস্কৃতির প্রতি তাদের চিন্তাকল্প উঠে এসেছে এসব চলচ্চিত্রে। তাই সেখানে আরোপিত বা কৃত্রিম কোন সংস্কৃতি বিনির্মাণের প্রয়োজন হয় না। বরং চলচ্চিত্রে শিল্পমান বজায় রেখে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও বক্তব্য উপস্থাপন সেখানে প্রধান্য পায়। যেখানে আদিবাসীর জীবন চিত্র এবং তাদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, ভাষা শৈলী, পোশাক ইত্যাদি উপস্থাপিত হয়েছে উক্ত জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের আলোকে। যা বাংলাদেশের বৃহত্তর চলচ্চিত্র শিল্প পরিসরে সাংস্কৃতিক বহুমাত্রিকতা আনায়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেবে বলে ধারণা করা যায়।

  • বাংলাদেশের ‘আদিবাসী চলচ্চিত্রে’ ‘আদিবাসী’ উপস্থাপনে চলচ্চিত্রের নন্দনভাষা ও চিহ্নবিজ্ঞানের প্রয়োগ কৌশল

সাম্প্রতিক সময়ে স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাগণ তাদের স্বল্পদৈর্ঘ্য এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য ‘আদিবাসী চলচ্চিত্রে’ ‘আদিবাসী’ জনজীবনের গল্প উপস্থাপনের ক্ষেত্রে নান্দনিক ও চলচ্চিত্রিক শিল্প কৌশল ও চিহ্নবিজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। যা ‘আদিবাসী চলচ্চিত্র’ নির্মাণের উল্লেখযোগ্য শিল্পকৌশল হিসিবে বিবেচিত। নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সদস্য কর্তৃক রচিত, অভিনিত এবং পরিচালিত চলচ্চিত্রসমূহকে আদিবাসী চলচ্চিত্র অভিধায় চিহ্নিত করা যায়। আদিবাসী চলচ্চিত্রসমূহে তাদের নিজস্ব অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র ক্যামেরা এঙ্গেল, বিষয় ও বিষয়ী নির্বাচন এবং শিল্পকৌশল প্রত্যক্ষ করা যায়।

সর্বপ্রাণবাদী বিশ্বাসের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিশ্বাসের অনুষঙ্গে গৃহীত চিহ্ন বা প্রতীকসমূহ তাদের চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে। উদাহরণ হিসেবে এখনে “Kalpona”….. Not Imagination” চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত কিছু চলচ্চিত্রিক শিল্পকৌশল এবং চিহ্ন বা প্রতীকের উল্লেখ প্রাসঙ্গিক। “Kalpona”….. Not Imagination” চলচ্চিত্রে প্রতীক হিসেবে উঠে এসেছে যে বিষয়গুলো তা হলো – কালার, প্রাণী, ক্যামেরা এঙ্গেল ও ক্যামেরা মুভমেন্ট, বই, স্বাধীনতা স্তম্ভ ও শিখা চিরন্তন, পোস্টার, দেয়াল লিখন এবং গাণিতিক চিহ্ন

* কালার –

চলচ্চিত্রটিতে সাদাকালো এবং রঙিন এই দুটি পৃথক বা কনট্রাস্ট কালার ব্যবহার করা হয়েছে। নাগরিক কোলাহল পূর্ণ ইট-কাঠ-পাথরের নিষ্প্রাণ শহর বুঝাতে ঢাকার বিপরীতে প্রাণপ্রাচুর্য ও শিকড়ের নিকটতম অংশ যেখানে অনেক আলো বাতাস এবং নিজের অস্তিত্ব পরিপূর্ণভাবে প্রকাশিত হয় এবং স্থানের সৌন্দর্য তুলে ধরতে পরিচালক এই চলচ্চিত্রে বিপরীতধর্মী কালার টোন ব্যবহার করেছেন।

* প্রাণী –

Kalpona”….. Not Imagination চলচ্চিত্রটিতে হায়েনার বা হিংস্র জানোয়ারের প্রতীক হিসেবে রাগান্বিত বা ক্ষিপ্র কুকুরের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ব্যবহার করেছেন। পাশাপাশি একটি অসহায়, নিরপরাধ ক্ষুদ্র প্রাণ বোঝাতে কিংবা অদৃশ্য কোন অনুসরণকারী হায়েনার সামনে একটি ক্ষুদ্র প্রাণ বোঝাতে বিড়ালের প্রতীকী ব্যবহার করেছেন পরিচালক।

* ক্যামেরা এঙ্গেল ও ক্যামেরা মুভমেন্ট –

Kalpona”….. Not Imagination চলচ্চিত্রটিকে ফোর্থ সিনেমার ধারায় নির্মিত আদিবাসী চলচ্চিত্র বলে পূর্বেই চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি এই চলচ্চিত্রে বিভিন্ন সময়ে এক্সপ্রেশনিস্ট ক্যামেরা এঙ্গেল প্রত্যক্ষ করা যায়।

* বই –

যৌক্তিকভাবে প্রতীক বা চিহ্নবিজ্ঞানের অংশ হিসাবে “Kalpona”….. Not Imagination স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে একাধিক বই ব্যবহৃত হয়েছে। বইগুলোর মধ্যে রয়েছে – প্রিয় চে, কাকে বলে ইতিহাস, গ্যাটে থেকে ডাবিøউটিও এবং কল্পনা চাকমার ডায়েরী। উল্লিখিত বইসমূহের ব্যবহার চলচ্চিত্রে উপস্থাপিত রাজনৈতিক বক্তব্যের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক এবং অর্থপূর্ণ বলেই প্রতীয়মান হয়েছে।

* স্বাধীনতা স্তম্ভ ও শিখা চিরন্তন –

স্বাধীন বাংলাদেশ এবং সেই দেশের নাগরিক হিসেবে পাহাড়ে বসবাসরত আদিবাসীদের সাথে ঘটে চলা আচরণের বাস্তবতা প্রকাশের জন্যে প্রতীক হিসেবে স্বাধীনতা স্তম্ভ এবং শিখা চিরন্তন চলচ্চিত্রের একাধিক শটে, ভিন্ন ভিন্ন ক্যামেরা এঙ্গেলের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন পরিচালক।

* পোস্টার, দেয়াল লিখন এবং গাণিতিক চিহ্ন –

Kalpona”….. Not Imagination চলচ্চিত্রে প্রতীক হিসেবে দেয়ালে পোস্টার দেয়াল লিখন এবং গাণিতিক সংখ্যা ব্যবহার করতে দেখা গেছে। পোস্টারের মধ্যে কল্পনা চাকমা সম্পর্কিত লেখা, চে গুয়েভারার ছবি, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার পোস্টার দেখতে পাওয়া যায়। উক্ত পোস্টারগুলো স্বাভাবিকভাবেই বিপ্লবী চেতনা এবং রাজনৈতিক অবস্থানকে চিহ্নিত করে।

চিত্র: “Kalpona”….. Not Imagination চলচ্চিত্রে প্রতীক হিসেবে দেয়ালে পোস্টার।

পাশাপাশি ০২মি.৪৪সে. – ৩ মি. পর্যন্ত দৃশ্যে দরজার উপর ২২৪০ লেখা দেখা যায়। ফ্রেমে এই সংখ্যাটিই ফোকাস পয়েন্ট হওয়াতে চোখ এড়ানো যায় না। গবেষণা চলাকালীন এই চলচ্চিত্রের পরিচালক জনাব সন্তুয়া ত্রিপুরার সঙ্গে মুক্ত সাক্ষাৎকার পর্বে ‘২২৪০’ গাণিতিক সংখ্যাটি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে বলেন – এর একটি গূঢ় অর্থ রয়েছে, তবে তা এখনি প্রকাশ করবেন না বলে তিনি জানান। এছাড়াও সাদা দেয়ালে ANNIHILATE এবং THESE DEMONS শব্দদুটি বিশেষ অর্থপূর্ণ যা এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বলেই মনে হয়েছে।

চিত্র: “Kalpona”…. Not Imagination চলচ্চিত্রে দেয়াল লিখনের মাধ্যমে ননন্দভাষা তৈরির চিত্র।

মর ঠেংগাড়ি চলচ্চিত্রের ৫৪ মি. ২০সে. – ৫৪ মি. ৩৮ সেকেন্ড পর্যন্ত দৃশ্যে একটি এক্সট্রিম ক্লোজ শট দেখানো হয় যেখানে একটি প্লাস্টিকের খেলনা বাঁশি সামরিক বুটের তলায় পিষ্ট হয়। এই পিষ্ট হওয়ার শটের মধ্য দিয়ে অনেক না বলা বক্তব্য উঠে এসেছে। উঠে এসেছে পাহাড়ের আদি বাসিন্দাদের প্রতি বিভিন্ন সময়ে ঘটে চলা প্রশাসনিক বা রাষ্ট্রীয় বিমাতাসুলভ আচরণের চিত্র। অর্থপূর্ণ এবং নান্দনিক এই দৃশ্যের মধ্য দিয়ে আদিবাসী জনজীবনের সংগ্রাম, অত্যাচার-নিপীড়ন ও দুর্বিষহ যন্ত্রণার চিত্র পরিচালক উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন। আদিবাসী চলচ্চিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শাসক কর্তৃক নিপীড়িত হবার চিত্র তাদের নিজস্ব ভাষা ও ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা। যা এই দৃশ্যের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

পাশাপাশি পরের শটে দেখাযায়, সেই ভাঙ্গা প্লাস্টিকের বাঁশি ডিজল্ভ হয়ে কমলের ভাঙ্গা সাইকেলে মিলিয়ে যাচ্ছে। যার মাধ্যমে পিতা পুত্রের কষ্ট একাকার হয়ে ওঠে। এভাবেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বা বাংলাদেশের আদিবাসী চলচ্চিত্রে আদিবাসীর সমস্যা ও বক্তব্য উপস্থাপনকল্পে নান্দনিক কৌশল প্রয়োগ করতে দেখা যায়।

চিত্র: মর ঠেংগাড়ি (My Bicycle) চলচ্চিত্রে চিহ্ন বা প্রতীক ও শটের নান্দনিক ব্যবহার।

যার মাধ্যমে আদিবাসীর প্রতি ঘটে চলা নির্দয় আচরণের তথ্য অন্যান্য জনগোষ্ঠীর কাছে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন পরিচালকগণ।

চিত্র: মর ঠেংগাড়ি চলচ্চিত্রে প্রতীক ও সম্পাদনার নান্দনিক ব্যবহার।

“বাংলাদেশের ‘আদিবাসী চলচ্চিত্রে’ ‘আদিবাসী’ উপস্থাপন কৌশল বিশ্লেষণ” শীর্ষক আলোচনার মাধ্যমে এদেশে বাঙালি পরিচালক কর্তৃক নির্মিত চলচ্চিত্রে কিভাবে আদিবাসী উপস্থাপিত হয়েছে, অপরদিকে ‘ফোর্থ সিনেমা’ বা ‘আদিবাসী চলচ্চিত্রে’ আদিবাসী কিভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, তার একটি তুলনামূলক চিত্র উঠে এসেছে। যেখানে আদিবাসী চলচ্চিত্রে আদিবাসী উপস্থাপনায় আদিবাসীর জীবন সংগ্রাম ও সংস্কৃতির চিত্র যথাযথভাবে ফুটে উঠেছে। এই গবেষণায় আরো প্রতীয়মান হয়েছে যে, সম্পর্কিত সময়ে বাংলাদেশের ‘আদিবাসী চলচ্চিত্র’সমূহে তাদের গল্প বা কাহিনি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে নান্দনিক চলচ্চিত্রিক শিল্পকৌশল নিজস্ব আঙ্গিকের উপস্থাপন শুরু হয়েছে। যা বাংলাদেশের আদিবাসী চলচ্চিত্রের নিজস্ব চলচ্চিত্রিক শিল্পকৌশল হিসেবে চিহ্নিত হয়।

উপসংহার

ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা জনগোষ্ঠীর পরিচালকগণ কর্তৃক নির্মিত চলচ্চিত্রে আদিবাসী উপস্থাপনের বিপরীতে চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে আসছে ‘আদিবাসী চলচ্চিত্র’। এটা সত্য যে ‘ফোর্থ সিনেমা’র অগ্রগতি এবং বৃদ্ধি হলো সিনেমার উত্তরাধিকারের অন্তর্গত সাম্রাজ্যিক প্রেরণার প্রতিরোধ। প্রকৃতপক্ষে, এটি দেশীয় চলচ্চিত্রের নতুন আঙ্গিক ও পরিচয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বৃহত্তর সংস্কৃতি এবং চলচ্চিত্রের স্বার্থেই বাংলাদেশে নির্মিত ‘আদিবাসী চলচ্চিত্র’সমূহকে প্রচারের সুযোগ উন্মুক্ত করে দেয়া প্রয়োজন। এর ফলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প যেমন বহুমাত্রিকতা ও বৈচিত্র্য অর্জন করবে, তেমনি আদিবাসী সম্পর্কে জনমানুষের মধ্যে ইতিবাচক ও মানবিক ধারণা সৃষ্টি হবে। যা মানবিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন, আদিবাসীর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে ‘ক্ষমতা বলয়ের’ বাইরে থেকে নিজেদের চলচ্চিত্র নির্মাণের যে প্রচেষ্টা আদিবাসীর পরিচালকগণ অব্যাহত রেখেছেন, তার মাধ্যমে একদিন তারা তাদের উপেক্ষিত সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে জীবন্ত করে তুলতে পারবেন। একইভাবে রাষ্ট্রনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। এর মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা শাসকগণের কাছে পৌঁছানোর হাতিয়ার হিসেবে চলচ্চিত্রকে সাবলীলভাবে ব্যবহার করতে পারবেন। যার ফলে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের অংশগ্রহণের পথ সুগম হবে।

প্রবন্ধের শেষাংশে এসে এই প্রতীতি জন্মায় যে, বাংলাদেশের আদিবাসী চলচ্চিত্র তুলনামূলক নবীন আঙ্গিকের চলচ্চিত্র প্রচেষ্টা হলেও এখানে আদিবাসীর জীবন সংগ্রাম ও সংস্কৃতি উপস্থাপনকল্পে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। আদিবাসী চলচ্চিত্র নির্মাণে পরিচালকদের নিজস্ব শিল্পকৌশলের প্রয়োগ আদিবাসীসমূহের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ যেমন ব্যবহৃত হয়েছে তেমনি সম্পর্কিত সময়ে তাদের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও মতাদর্শ তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে উপস্থাপন করেছেন পরিচালকগণ। যা বাংলাদেশের আদিবাসী চলচ্চিত্রের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। বাঙালি পরিচালক কর্তৃক নির্মিত চলচ্চিত্রে আদিবাসী উপস্থাপন কৌশলের বিপরীতে আদিবাসী পরিচালক কর্তৃক নির্মিত চলচ্চিত্রে ‘আদিবাসী উপস্থাপন কৌশল’ স্বতন্ত্র এবং নিজস্ব নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ। ফলে বলা যায় বাংলাদেশের ফোর্থ সিনেমা বা ‘আদিবাসী চলচ্চিত্রে’ ‘আদিবাসী’ উপস্থাপিত হয়েছে যথাযথ চলচ্চিত্রিক শিল্পকৌশল ও নিজস্ব নন্দন শিল্পশৌকর্যের আলোকে। যা বাংলাদেশের মূল ধারার অন্যান্য চলচ্চিত্র থেকে আদিবাসী চলচ্চিত্রকে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

তথ্যনির্দেশ

১। মেঘের অনেক রং চলচ্চিত্রের ইউটিউব লিংক –
https://www.youtube.com/watch?v=btLTSFMb-RY (accessed on the 27th June 2022)

২। কবিতা চাকমা, উপস্থাপনায় সার্বভৌমত্ব: বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী চলচ্চিত্র, ২০০২, রাষ্ট্রচিন্তা (ভ্লগ)। অনুবাদ – ডালিয়া চাকমা। httpst//rashtrochinta.net/blogpost/ / (accessed on the 2 Feb 2022)

৩। আধিয়ার চলচ্চিত্রের ইউটিউব লিংক –
https://www.youtube.com/watch?v=Hjhc4C56x10&t=7155s (accessed on the 27th June 2022)

৪। ভারতী কুজুর (৫৬), (আদিবাসী কণ্ঠশিল্পী) এর সাক্ষাৎকার (০৪-০৩-২০২২, মিঠাপুকুর, রংপুর) থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে।

৫। নাচোলের রানী চলচ্চিত্রের ইউটিউব লিংক –
https://www.youtube.com/watch?v=REU3gEyipqc (accessed on the 27th June 2022)

৬। মৎ প্রণীত, ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আদিবাসী : বহুমাত্রিক সংস্কৃতির উপস্থাপন কৌশোল বিশ্লেষণ’ শীর্ষক গবেষণ ফেলোশিপ, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ২০২১-২০২২ অর্থবছর, ৩য় অধ্যায় দ্রষ্টব্য, পৃ. ১২১

৭। Nancy A and Douglas S. Massey Denton, (1998). Race Relation and Population Diversity, Lecture in the Cabrini College 40th Anniversary series The changing Face of America, Cabrini College, Radnor, PA, October 23

৮। মেসবাহ কামাল ও অন্যান্য (সম্পাদনা), আদিবাসী জনগোষ্ঠী, ‘ভূমিকা’, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ সংস্কৃতি সমীক্ষা মালা, ৫ম খণ্ড, ঢাকা, ডিসেম্বর ২০০৭, পৃ. XIV

৯। Jenny Chio, Visual anthropology, In The Open Encyclopedia of Anthropology, edited by Felix Stein. Facsimile of the first edition in The Cambridge Encyclopedia of Anthropology, University of Southern California, Initially published 26 Jul 2021 https://www.anthroencyclopedia.com/entry/visual-anthropology, (accessed on the 9th April 2023)

১০। K. Kris Hirst, An Introduction to Visual Anthropology: Images and What They Tell Us About People; https://www.thoughtco.com/visual-anthropology-introduction-4153066 (accessed on the 10th April 2023)

১১। Jennifer Hasty, David G. Lewis, & Marjorie M. Snipes, Visual Anthropology and Ethnographic Film, Social Sciences Library.
https://socialsci.libretexts.org/Bookshelves/ (accessed on the 10th April 2023).

১২। Stuart Murray, Images of Dignity: Barry Barclay and Fourth Cinema, Academia, Published 2008
https://www.academia.edu/
, (accessed on the 08th April 2023)

১৩। Barry Barclay, CELEBRATING FOURTH CINEMA, Printed in Illusions Magazine, NZ: July 2003,
https://www.academia.edu/ (accessed on the 8th April 2023)

১৪। Stuart Murray, Images of Dignity: Barry Barclay and Fourth Cinema, Academia, Published 2008
https://www.academia.edu/5249443/Images_of_Dignity_Barry_Barclay_and_Fourth_Cinema , (accessed on the 8th April 2023)

১৫। Christina Milligan, Sites of exuberance: BarryBarclay and Fourth Cinema, Ten years on, International Journal of Media & Cultural PoliticsVolume 11 Number 3, https://www.researchgate.net/publication/283684531_Sites_of_exuberance_Barry_Barclay_and_Fourth_Cinema_ten_years_on (accessed on the 27th June 2022)

১৬। প্রশান্ত ত্রিপুরা, বহুজাতির বাংলাদেশ: স্বরূপ অন্বেষণ ও অস্বীকৃতির ইতিহাস, সংবেদ প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ৪৩

১৭। আফসার আহমদ, বাংলাদেশের আদিবাসী নাট্য, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ১১

১৮। মেজবাহ কামাল ও অন্যান্য (সম্পাদনা), আদিবাসী জনগোষ্ঠ : বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা, ৫ম খণ্ড, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, পৃ. ৬২

১৯। বঙ্কিম চন্দ্র চাকমা, চাকমা সমাজ ও সংস্কৃতি, উপজাতীয় সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট (ক্ষুদ্র আদিবাসী কালচারাল ইন্সটিটিউট), রাঙ্গামাটি, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ৯০

২০। সান্তুয়া ত্রিপুরা, “Kalpona”….. Not Imagination (চলচ্চিত্র)’ এর সাক্ষাৎকার (০৫-০৪-২০২২, ঢাকা) থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে।

২১। কল্পনা চাকমা অপহরণ ও বিচার কার্যক্রম সম্পর্কিত তথ্য,

https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A6%A8%E0%A6%BE_%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%AE%E0%A6%BE_%E0%A6%85%E0%A6%AA%E0%A6%B9%E0%A6%B0%E0%A6%A3 (accessed on the 10th April 2023)

২২। মৎ প্রণীত, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আদিবাসী: বহুমাত্রিক সংস্কৃতির উপস্থাপন কৌশোল বিশ্লেষণ, শীর্ষক গবেষণ ফেলোশিপ, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ (২০২১-২০২২ অর্থবছর), ঢাকা, চতুর্থ অধ্যায় দ্রষ্টব্য, পৃ. ১৮৪

 

  • লেখাটি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে একচল্লিশ তম সংখ্যায়, জুন ২০২৩-এ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
Scroll to Top