বি-উপনিবেশিত করা বলতে কী বোঝায়?

অনুবাদ: মনিরুল ইসলাম

অনুবাদকের কথা

আধুনিকতা যেভাবে গোটা দুনিয়ার মুক্তিদায়ী প্রকল্পরূপে হাজির হয়, মিগনোলো তাতে বাদ সেধেছেন। আধুনিকতার তিনি একজন কট্টর সমালোচক। একে তিনি উপনিবেশিকতার অলংকৃতি রূপে বোঝেন। তার চিন্তায়, আধুনিকতা ও উপনিবেশিকতা একে অপরের পরিপূরক। উপনিবেশিকতা ছাড়া যেমন আধুনিকতা সম্ভব নয়, তেমনই আধুনিকতা ব্যতীতও উপনিবেশিকতা অকল্পনীয়। তারা একে অপরের গাঠনিক শর্ত—উপজাত নয়। এইভাবে বোঝার ক্ষেত্রে, মিগনোলোর পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন পেরুর সমাজতাত্ত্বিক আনিবাল কিহানো। উপনিবেশিকতা পরিভাষাটির তিনিই প্রবর্তক। কিহানো একে উপনিবেশবাদ থেকে স্বতন্ত্রভাবে বোঝেন। এই উপনিবেশিকতাই রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত উপনিবেশবাদকে বহাল তবিয়তে বাঁচিয়ে রাখে। উপনিবেশিকতা ক্ষমতার উপনিবেশিকতার সংক্ষিপ্ত রূপ। ক্ষমতার উপনিবেশিকতা ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকাকে নির্দেশ করে। যে মাতৃকার অন্তর্গত আমরা সকলেই। মিগনোলোর মতে, এর কোনো বাহির নেই। এর সঙ্গে মোকাবিলা করতে হলে এর অন্তর্গত থেকেই তা করতে হবে। যে অবস্থানটিকে তিনি প্রান্তীয় বলে পেশ করেন। প্রান্তীয় চিন্তনের লক্ষ্য হলো ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকাকে ছেদ করে বেরিয়ে আসা। মিগনোলো যাকে বলবেন—বিযুক্তকরণ। বিযুক্তকরণের এই করণ নানাভাবে সাধিত হতে পারে। তা সত্ত্বেও এর জ্ঞানতাত্ত্বিক চরিত্রটাই প্রধান হয়ে ওঠে। কিহানো যেমন জোর দিয়েছেন জ্ঞানতাত্ত্বিক পুনর্গঠনের ওপর। মিগনোলো জোরারোপ করেন উপনিবেশিকতা থেকে বিযুক্তকরণকে। একেই তিনি বিউপনিবেশিকতা বলে দাখিল করেন। তার মতে, এই বিউপনিবেশিকতা আর বিউপনিবেশায়ন একই ঘটনা নয়। এর বিস্তারিত আলাপ তিনি তার বইগুলোতে করেছেন।

যে ভূখটাকে আমরা এখন লাতিন আমেরিকা নামে চিনি তাকে দখল করার ঘটনাটি, মিগনোলোদের চিন্তায়, ঐতিহাসিক তাৎপর্যের বিচারে সাধারণ কোনো ঘটনা ছিলো না। উপনিবেশবাদের ধারণা ও ধারাবাহিকতা তা বোঝার জন্য যথেষ্ট নয়। কেননা, এই ঘটনার আগেকার আমলের উপনিবেশবাদ কোনো বিশ্বশক্তির ভিত হিসেবে কাজ করেনি। কিহানোর বিবেচনায়, লাতিন আমেরিকার সমাজ ও সংস্কৃতিকে দখল করার মাধ্যমে নতুন এক বিশ্বব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়। গোটা দুনিয়ার মানুষ, মানুষের দেহ, দেহগত শ্রম, বিপুল সম্পদরাশি, পরিবেশপ্রকৃতি, মানুষেমানুষে পারস্পরিক সম্পর্ক বিন্যাসিত হয় বর্ণবাদী মানদণ্ডে। গড়ে ওঠে বিষয়ীরূপে মানবের ধারণা, তার বিপরীতে সমগ্র এক বিষয়গত প্রকৃতি। এই মানব ধারণার প্রতিভূ হয়ে ওঠে সাদা ইউরোপীয় মানব। বাদবাকি দুনিয়ার মানুষ হয়ে ওঠে ঊনমানব—অর্থাৎ যারা এখনও মানব হওয়ার পথে আছে। ইউরোপীয় মানবের মাঝে গড়ে ওঠে প্রকৃতিকে জয় করার, তাকে পোষ মানানোর, প্রবল বাসনা। পুঁজিবাদী বর্তনীতে যুক্ত হয়ে যায় গোটা দুনিয়ার শ্রম। গোটা দুনিয়ার হয়ে ওঠে একটাই লক্ষ্যপথ। তার নাম আধুনিকতা। গড়ে ওঠে বিষয়ীবিষয় সম্পর্ক নির্ভর বিশেষ কাঠামোর ইউরোপীয় যুক্তি। এবং এই যুক্তিকাঠামোকেই গোটা দুনিয়ার যুক্তিবিদ্যা হিসেবে পেশ করা হয়। সময়কে হাজির করা হয় সরলরৈখিক হিসেবে। ফলে, ইতিহাস ভাগ হয়ে যায় প্রাকআধুনিক, আধুনিক, উত্তরাধুনিক এই ধারায়। প্রাকআধুনিককে সাজানো হয় নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য দ্বারা। তার সাপেক্ষে আধুনিকতা নির্মিতি লাভ করে আলোকায়ন প্রকল্পরূপে। মিগনোলো বর্তমান রচনাটিতে এই প্রসঙ্গগুলো নিয়ে আলাপ করবেন। কিহানোর প্রবন্ধগুলোতে এসব নিয়ে আলোচনা আছে। ফলে, খুব সংক্ষেপে তাদের আলাপ মূলত এই: আমাদের যে বোঝাপড়া ও জগতকে আমরা যে কায়দায় জানাবোঝা করি এবং এই বোঝাবুঝির মধ্য দিয়ে তাকে যেভাবে গড়ে তুলি, আর নিজেরা হয়ে উঠি—তা ঔপনিবেশিক। ঔপনিবেশিক স্থান ও কালে সংঘটিত এক জীবনপ্রক্রিয়ায় আমরা গড়ে উঠি ঔপনিবেশিক পাত্র হিসেবে। এই স্থান ও কালের চরিত্র যতোটা না ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক, তারচেয়ে বেশি জ্ঞানতাত্ত্বিক। আধুনিকতা, সভ্যতা, প্রগতি, উন্নয়ন ইত্যাদি নানা অলংকৃতির দ্বারা এই উপনিবেশিকতা আমাদের মধ্যে কার্যকর থাকে।

সেই ১৫০০ সাল থেকে যে আধুনিক/ ঔপনিবেশিক বিশ্বব্যবস্থা ও কল্পলোক জারি আছে, গত তিরিশ বছর যাবৎ, মিগনোলোর গবেষণা ও পাঠদান তার বোঝাপড়া ও উদ্ঘাটনেই নিয়োজিত। আধুনিক/ ঔপনিবেশিক বিশ্বব্যবস্থা ও কল্পলোক, মিগনোলোর গবেষণায়, পশ্চিমা সভ্যতার ঐতিহাসিক বুনিয়াদ এবং বিশ্বজুড়ে তা ছড়িয়ে দেওয়ার সমার্থক। মিগনোলোর কাজ মূলত চারটি মৌলিক ভিতের ওপর দাঁড়ানো: ) ১৫০০ সালের পূর্বে কোনো বিশ্বব্যবস্থা ছিলো না, আর পশ্চিমা খ্রিস্টীয় (ইউরোপীয়) কল্পলোকে তখনও আমেরিকার একাঙ্গীকরণ ঘটেনি; ) বিশ্বব্যবস্থাই “নতুনত্ব” (নতুন বিশ্ব) ও আধুনিকতার ধারণা গড়ে তুলেছে এবং গ) উপনিবেশিকতা ছাড়া কোনো আধুনিকতা নেই—উপনিবেশিকতা আধুনিকতা থেকে উদ্ভ‚ত নয়, বরং এর গাঠনিক শর্ত; ) আধুনিক/ ঔপনিবেশিক কল্পলোক মানব ও মানবিকতা উদ্ভাবনের ওপর স্থাপিত ও নিয়ন্ত্রিত—যা বর্ণবাদ ও যৌনতন্ত্র এবং সেইসঙ্গে প্রকৃতি উদ্ভাবনেও প্রসঙ্গ বিন্দু হিসেবে কাজ করে। সংক্ষেপে বললে, মিগনোলোর গবেষণা আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতাকে অন্যায় উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণকারী একটি মেশিনরূপে দেখানোতে, এবং আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা থেকে বিযুক্তকরণের বিউপনিবেশিক উপায়ানুসন্ধানে নিবেদিত ছিলো, আর আছেও।

বর্তমান প্রবন্ধটি ক্যাথারিন ওয়ালশের সঙ্গে তার যৌথভাবে লেখা On Decoloniality: Concepts, Analysis, Praxis গ্রন্থটির একটি অধ্যায়। সম্পূর্ণ বইটি দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগটি ক্যাথারিন ই ওয়ালশ লিখেছেন। শিরোনাম—Decoloniality In/As Praxis I । দ্বিতীয় ভাগটি লিখেছেন মিগনোলো। তার শিরোনাম—The Decolonial Option II । দ্বিতীয় ভাগের প্রথম অধ্যায়টির নামই— What Does It Mean to Decolonize? সম্পূর্ণ গ্রন্থের বিচারে যা পঞ্চম অধ্যায়। যেকারণে, বর্তমান প্রবন্ধটির বিভিন্ন অংশে, গ্রন্থটির অপরাপর অধ্যায়গুলোর সঙ্গে সংযোগ তৈরি করার জন্য, লেখককে আমরা প্রথম বন্ধনীর মধ্যে বিভিন্ন নির্দেশনা দিতে দেখবো। সেগুলোকে অক্ষত রাখা হয়েছে। চলমান আলাপটি যে একটি গ্রন্থের একটি অধ্যায় তা জানা থাকলে পাঠকের ক্ষতি তো নেই। যাইহোক, দুয়েকটা প্রসঙ্গে অনুবাদকের পক্ষ থেকে কৈফিয়ত দেওয়ার দরকার আছে। এর প্রথমটি হলো, বড়ো বাক্যগুলোকে বড়োই রেখে দেওয়া। এজন্য কসরত করে ড্যাশ ও কমা ব্যবহার করতে হয়েছে খুব। দুই ড্যাশ ও কমার মাঝের অংশ উহ্য রেখে পড়ার জন্য পাঠকেরা সচরাচর প্রস্তুত থাকেন না। এজন্য তাদের ওপর যথেষ্ট চাপ তৈরি হয়েছে। তাছাড়া, পাঠের ছন্দ যে এতে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে এব্যাপারে অনুবাদকের সন্দেহ নেই। কিন্তু অনুবাদক এক্ষেত্রে অনেকটা নিরূপায়। বাক্যগুলোকে নিজের মতো ভেঙে সাবলীলভাবে পেশ করা যেতো। কিন্তু ঐ যে, স্বর্ণ গলালে স্বর্ণ খোয়া যায়। এই বিশ্বাস অনুবাদককে খুব তাড়িত করেছে। অন্যদিকে, এটি অনুবাদকের একপ্রকার অক্ষমতাই। আরেকটি প্রসঙ্গ হলো, ইংরেজি শব্দগুলোকে তৃতীয় বন্ধনীতে ভরে অনূদিত পাঠে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন যে, বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি। এর উদ্দেশ্য আসলে সৎ। অর্থাৎ, পাঠককে প্রতারিত হতে না দেওয়া। বাক্যকে বোধগম্য করার জন্য কখনও কখনও তৃতীয় বন্ধনীতে কিছু শব্দ ও শব্দবন্ধও যোগ করা হয়েছে। তা অনুবাদকের আরোপিত বলেই সেগুলোকে তৃতীয় বন্ধনীতে রাখা হয়েছে। মূল প্রবন্ধের একদম শেষে সংযোজিত হয়েছে কিছু টীকাও। ইংরেজি ভাষার অনেক শব্দ ও শব্দবন্ধের প্রকাশভঙ্গি ও অর্থ সেই ভাষার ইতিহাস ও সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রের পরম্পরার ওপর নির্ভর করে। এক্ষেত্রে বোঝাবুঝির সামান্য বিচ্যুতির কারণেই অর্থ আমূল বদলে যায়। ভুল পাঠ তৈরি হয়। এরকম ভুলগুলোকে যেন সতর্ক পাঠক ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে পড়েন—এটাই শেষ অনুরোধ। আরেকটি ব্যাপার, বর্তমান অধ্যায়টি কিন্তু মিগনোলোর অনুমতি সাপেক্ষেই অনূদিত হয়েছে। বৈদ্যুতিন বার্তায় অনুবাদককে তিনি এই ব্যাপারে মত দিয়েছেন।

ইন্টারনেটে খোঁজ করলেই মিগনোলো সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। তাই তার জন্ম, বেড়ে ওঠা ও ডিগ্রি নিয়ে বিস্তারিত লেখা হলো না। সেই সুযোগ এখানে নেইও। তাই তার উল্লেখযোগ্য কিছু গ্রন্থ ও পুরস্কারপদবীর উল্লেখ করা হলো। ডিউক ইউনিরভার্সিটির ওয়েবসাইটে এই তথ্যগুলোই দেওয়া আছে। তার গ্রন্থসমূহ: The Darker Side of the Renaissance: Literacy, Territoriality, and Colonization (1995); Delinking: The Rhetoric of Modernity, the Logic of Coloniality, and the Grammar of Decoloniality (2007); Local Histories/Global Designs: Coloniality, Subaltern Knowledges, and Border Thinking (2000); এবং The Idea of Latin America (2006)। ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় On Decoloniality: Concepts, Analysis, Praxis গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়, এতেই সহলেখক হিসেবে ছিলেন ক্যাথারিন ওয়ালশ (Catherine Walsh)। ২০২১ সালে তার The Politics of Decolonial Investigation গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। গত পনেরো বছরে তার কাজের রাজনৈতিক গুরুত্ব ক্রমেই জনসাধারণের মাঝে নিয়োজিত হয়েছে, যেখানে তিনি শিল্পী, সংরক্ষক (curator), সাংবাদিকদের সঙ্গে কাজ করেছেন, লিখেছেন উপসম্পাদকীয় (op-eds), দিয়েছেন (ইংরেজি ও স্পেনিশ ভাষায়) ভিডিও সাক্ষাৎকার (finterviews) এবং মিদেলবার্গ, ব্রেইমেন, ইউএনসি এবং ডিউকএ সহসংগঠক ও সহশিক্ষক গ্রীষ্মকালীন স্কুল পরিচালনা করেছেন। দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা, এশিয়া ও ইউরোপে অনুষদ ও স্নাতক শিক্ষার্থীবৃন্দের উদ্দেশ্যে তিনি কর্মশালা করিয়েছেন। মিগনোলো The Darker Side of the Renaissance: Literacy, Territoriality and Colonization (1996) গ্রন্থটির জন্য Katherine Singer Kovaks পুরষ্কার (MLA) পেয়েছেন এবং The Idea of Latin America (2006) গ্রন্থটির জন্য ক্যারিবীয় দার্শনিক সংঘের কাছ থেকে পেয়েছেন ফ্রাঞ্জ ফানো পুরস্কার। তার লেখা জার্মান, ইতালীয়, ফরাসি, সুইডিশ, রুমানীয়, স্পেনিশ, পর্তুগিজ, মান্দারিন ও কোরিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি জোহানেসবার্গের উইটস ইউনিভার্সিটির Center for Indian Studies in South Africa (CISA)-র একজন সম্মানসূচক গবেষণা সহযোগী। সম্প্রতি তিনি Dialogue of Civilizations (DOC) কর্মসূচিতে একজন জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে যোগদান করেছেন। তিনি আর্জেন্টিনার বুয়েনেস এইরেসের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Doctor Honoris Causa Degree (2016) University of London-Goldsmith থেকে Honorary Degree (2018) লাভ করেছেন।

মূল লেখা

মানসিক দাসত্ব থেকে তোমাকে মুক্তি দাও

আর কেউ নয় মনকে কেবল আমরাই মুক্ত করতে পারি।

বব মার্লে

পশ্চিমা সংস্কৃতিতে, যেখানে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দেখা দিয়েছে, প্রাত্যহিক জীবনে বাস্তবতা ও বাস্তব বলতে—পর্যবেক্ষক হিসেবে—আমরা যা করি, তা থেকে স্বাধীনভাবে বিরাজমান এক স্বতন্ত্র সত্তার পরিসর বুঝাই। তাছাড়া, বাচনিক ও প্রাযুক্তিক উভয় উপায়েই আমরা করি এবং বলি, যেন আমরা [আগে থেকেই] জানি এহেন স্বাধীন সত্তাসমূহের উল্লেখে আমরা পারঙ্গম। প্রতিদিনকার স্বাভাবিক জীবনাভিজ্ঞতার প্রবাহে বস্তুর এরূপে ধরা দেওয়া, যেন আমাদের তৎপরতা থেকে স্বাধীনভাবে তা আগেভাগেই ছিলো, একে বোধ হয় আরও পোক্ত করে। এছাড়াও, দৈনন্দিন জীবনের চলনসই সঙ্গতির [operational coherence] সুবাদে, বিষয়ের সঙ্গে আমাদের কাজের ফলাফলের সার্থক জ্ঞানমূলক অনুমানের [cognitive prediction] জন্য, আমরা যা করে থাকি, তাও প্রচ্ছন্ন এই দৃষ্টিভঙ্গিটাকেই সমর্থন করে। অভিজ্ঞতার ব্যবহারোপযোগী বিভাজন [operational separation] ও পর্যবেক্ষণের জৈব ব্যাখ্যায় অভিজ্ঞতার যে বিশ্লেষণটিকে গ্রহণ করা হয়, তার ফলাফল পুনরায় বিবেচনার মাধ্যমে এতে আমি বদল আনতে চাই।

উমবের্তো মাতুরানা, বাস্তবতা: বিষয়ের সন্ধানে অথবা জবরদস্তিমূলক তর্কের খোঁজে

আমি এখানে সেখান থেকেই শুরু করেছি গত অধ্যায়ের ঠিক যেখানে ক্যাথারিন তা মূলতবি রেখেছে। [ফলে] দ্বিতীয় ভাগের পুরোটা জুড়েই আমি আসলে যে তর্কটা করবো, যে আমাদের বিউপনিবেশিক মুক্তির জন্য আসলে আমরা প্রত্যেকেই দায়ী, বব মার্লে যেটা তার মুক্তির গানএ পরিষ্কারভাবেই বলেছেন। [তাই] দ্বিতীয় ভাগের গতিপথ জনপ্রিয় গানের দর্শন, বব মার্লে যার গুরু, ও উমবের্তো মাতুরানার বীতশ্রদ্ধ [irreverent] বৈজ্ঞানিক চিন্তার মধ্যস্থলে। মাতুরানার সমান্তরালে আমিও কট্টর বিজ্ঞানসমূহে (মানুষ এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রথাগত বিভাজনে সামান্যপন্থী [nomothetic]) জানা ও বোঝার (মানবিক, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, ও কলা, জ্ঞানতত্ত্বের সত্তাতত্ত্বকে গড়ে তোলা) বিশেষপন্থী [ideographic] পরিসরে অবিদ্যায়তনিক অবস্থান নিই।কারণে, বিউপনিবেশিক চিন্তন ও করণ, ইউরোপীয় রেনেসাঁর সময় থেকে ও ইউরোপীয় আলোকময়তার মধ্য দিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানের সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য জ্ঞানতাত্ত্বিক পূর্বানুমান [epistemic assumptions] থেকে বিযুক্তকরণকে নিশানা করে। পুনর্বিদ্যমানতা [re-existence] বিযুক্তকরণকেই অনুসরণ করে: [আর] আমাদের মনুষ্য জীবনের সমবায়ী অনুশীলনের টেকসই পুনর্জ্ঞাপন প্রয়াসই পুনর্বিদ্যমানতা।

বিউপনিবেশিকতা কোনো বিদ্যায়তনিক জ্ঞানের শাখা নয়, তার মানে অবশ্য এও নয় যে, বিদ্যায়তনে এটি কখনও প্রবর্তিত হতে পারবে না। বিউপনিবেশায়ন থেকে এর বিকাশ ঘটেছে, আর বিউপনিবেশায়ন কোনো পরিচিত শাস্ত্রীয় [disciplinary] প্রবণতা বা নতুন কোনো পদ্ধতিস্বরূপ ছিলো না। বিদ্যায়তনে এটিকে প্রবর্তনের মাধ্যমে (ক্যাথি ও আমি দুজনেই কাজ করি বিদ্যায়তনে; বইটি প্রকাশও করেছে ডিউক ইউনিভার্সিটি প্রেস) আমরা প্রবণতা বদলাবার চেষ্টা করি এবং বিদ্যায়তনে বিউপনিবেশিকতাকে বিবেচনা করি বিদারক [disrupter] হিসেবে। উদাহরণস্বরূপ, বিউপনিবেশিক তৎপরতায় শামিল হওয়ার জন্য তুমি যদি কোনো অনুদান বা ফেলোশিপের আবেদন করো, নিশ্চিত থাকো যে তা তুমি পাবে না। এবং এটিকে বিউপনিবেশিক অধ্যয়ন নামে ঢাকতে গেলে বিউপনিবেশিকতা আধুনিক জ্ঞানতত্ত্বেজিম্মি হয়ে থাকবে। বিউপনিবেশিক অধ্যয়ন বিউপনিবেশিক হতো না—এটি এতোই সরল যে—বিউপনিবেশিক অধ্যয়ন কেন এবং সর্বোপরি কোন রাজনৈতিক, নৈতিক, এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক ছাঁচেই বা এটি প্রবর্তিত হবে? [ঠিক] ক্যাথারিন যেমন প্রথম অধ্যায়েই (যেমনটা আমি বুঝেছি) গুরুত্বারোপ করেছে, কীসের লাগি বিউপনিবেশিক অধ্যয়ন?

অধ্যায়টি গড়ে উঠেছে স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার বিউপনিবেশায়ন ও স্নায়ুযুদ্ধপরবর্তী পর্বের বিউপনিবেশিকতার পার্থক্যের ওপরে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান আর নব্যউদার বৈশ্বিক স্বপ্নের চূড়ান্ত জয়সূচনার একদম কিনারায়, আনিবাল কিহানো উপনিবেশিকতার [মতো] অত্যাবশ্যকীয় এবং ভিত্তিকাঁপানো [এক] ধারণার প্রবর্তন করেছিলেন। [এর] প্রথমটি [বিউপনিবেশায়ন] বাস্তবে পরিণত হলেও, দ্বিতীয়টি [বিউপনিবেশিকতা] সম্ভবত হয়নি। এর পরের প্রশ্ন দাঁড়ালো, বিউপনিবেশিকতার করণীয় খুঁজে বের করা, ইতোমধ্যে যেহেতু এটা অন্তত স্পষ্ট হয়ে গেছে যে রাষ্ট্রটি না হয়েছে বিউপনিবেশিত না গণতন্ত্রী। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান এবং ইরাক আক্রমণ, যা টুইন টাওয়ার ধ্বংসের দ্বারা সত্যায়িত হয়েছিলো (এর পরিকল্পক যেই হোক আর যাই থাকুক তার উদ্দেশ্য), পাঁচশ বছর ধরে জারি থাকা পশ্চিমা মনোজাগতিক ও দৈহিক প্রভুত্বের [hegemony] চক্রের পরিসমাপ্তি টানে। ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার (CMP) পরিচালনা এবং [তার] নিয়ন্ত্রণোদ্দেশ্যে সম্মিলিত পশ্চিমা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন) প্রচেষ্টার মধ্যেই আমরা বসবাস করে চলেছি এই গ্রহে। যে প্রভুত্ব এখন প্রভাব খুইয়েছে।

আনিবাল কিহানোর উপনিবেশিকতার ধারণা মারফত যতটুকু এর স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে এবং আধুনিকতার ধারণায় যতটুকু রূপান্তর তা সাধন করেছে, এই দিকে এগোনোর পথে, খণ্ডটির দ্বিতীয় ভাগ বিউপনিবেশিক চিন্তনের পরিচিতি দেয় ও [তাকে] হালনাগাদ করে। উপনিবেশিকতা—পশ্চিমা আধুনিকতার লুকানো তল—একটি বিউপনিবেশিক ধারণা আর এই কারণেই জীবনযাপনে বিউপনিবেশিক চিন্তন ও করণের নোঙরস্বরূপ [anchor]। বিউপনিবেশিক তৎপরতায় কারা শামিল আছে, আর ইতোমধ্যে কারা [এটি] সম্পন্ন করেছে, এসবের জাতিবিবরণী [ethnographic] প্রতিবেদন হয়ে ওঠা এর উদ্দেশ্য নয়, না এটি নির্দেশ করে বিউপনিবেশিকতা কী বা কেমন তা হওয়া উচিৎ মার্কা সর্বজনীন হয়ে ওঠা ও প্রত্যেকের উপর হুকুমজারি রাখার খায়েশ পোষণ করা আধুনিক কোনো জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রস্তাবনা। এখনও যারা এর সঙ্গে পরিচিত নয়, সেই সকল পাঠকদের জন্য এটি একধরনের পরিচয়সাধন, আর যারা ইতোমধ্যে অবগত, তাদের জন্য আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা/ বিউপনিবেশিকতার ছাঁচে নির্দিষ্ট দর্শন [vision] ও অনুশীলনের হালনাগাদ পাঠ।

দীর্ঘবয়ানকে [macronarrative] খারিজ করা অর্থে, এটি উত্তরাধুনিক ধারণাজাত কোনো পরিচিতি নয়। উল্টা, এটি ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার [matrix] পাঁচশ বছরের দীর্ঘবয়ানের অপরিহার্যতা দাবি করে যা আধুনিক দীর্ঘবয়ান লুকিয়েছে আর উত্তরাধুনিক দর্শন করেছে উপেক্ষা। তুমি যদি আমেরিকীয় ও ক্যারিবীয় দীর্ঘবয়ানসমূহ লক্ষ করো, দেখবে স্থানিক বয়ানসমূহের আছে দুই ধরনের শুরু: পৃথিবীর উৎপত্তি সম্পর্কিত স্মৃতি এবং যারা পৃথিবীর জন্মবৃত্তান্ত বলছে সংশ্লিষ্ট সেই গোত্রের উদ্ভব সম্পর্কিত স্মৃতি (উদাহরণস্বরূপ, পোপোল্ বু, লিইয়েন্ডা দে লোস সোলেস, কূর্মদ্বীপের কাহিনি)। অপরাপর দীর্ঘবয়ানসমূহ হবে পনেরো শতকের শেষাশেষি ও ষোল শতকের প্রথমার্ধের মাঝামাঝি সময়ের স্পেনীয় দখলদারিত্বের। আফ্রিকীয় অভিনিস্ক্রমণ [diaspora] মিডল প্যাসেজের বদলে আমেরিকার মধ্য দিয়ে ছড়াতে শুরু করে।

উত্তরআমেরিকা এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলে অবশ্য পনেরো শতক থেকেই ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত অধিবাসীদের দেখা মিলতে শুরু করে, কিন্তু কারও কারও জন্য সেটা যখন পরিত্রাণ ও সভ্যতার সময়, অন্যদের কাছে এটি ছিলো আধুনিকতার বয়ান—পরিত্রাণ, প্রগতি, উন্নয়ন—দ্বারা সত্যায়িত ঐতিহাসিক অন্যায়ের প্রারম্ভ। এখানে যে পথ অনুসৃত [pursue] হয়েছে, সংক্ষেপে এটিই সেই লক্ষ্যপথ [trajectory] , আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা/ বিউপনিবেশিকতা প্রকল্পটিকে যা ছাঁচে ফেলেছে। অপর পক্ষে, সতেরো শতকের দিকে, তীর্থযাত্রীদের পয়লা দলটির আগমন ও প্রথম বসতি সংস্থাপনের মধ্য দিয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়, আরম্ভ হবে ব্রিটিশ ও ফরাসি বংশোদ্ভূত অধিবাসীদের গল্প।

দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল তার নিজস্ব সহস্রবর্ষব্যাপী [millenarian] স্মৃতি থেকে ও স্পেনীয়, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ফরাসি, বা ব্রিটিশ দখলদারিত্বের মাধ্যমে স্থানিক ইতিহাস থেকে স্বস্ব বিচ্ছেদের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কীভাবে [তাদের] বিবরণটি রচনা করে, আর কীভাবে আমাদের প্রত্যেকেই ঊনিশশো পঁয়তাল্লিশ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে জারি থাকা আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত ও ভুক্তভোগী—আমার পক্ষে, গ্রহজুড়ে তা [সেই অনুসন্ধান] চালিয়ে যাওয়া ও চিহ্নিত করা এই বইয়ের সাধ্যের বাইরে।

বিউপনিবেশায়নের নানা সুরত

গত পাঁচ বছর ধরে বিউপনিবেশায়ন (এবং এর ক্রিয়ারূপ, বিউপনিবেশিত করা) শব্দের ব্যবহার ত্বরিত গতিতে বেড়েই চলেছে; নিঃসন্দেহে, এটা একটা ভালো লক্ষণ। খণ্ডটি বিউপনিবেশিকতা সম্পর্কিত চিন্তার বিশেষ এক ঘরানার [school] পরিচয় তুলে ধরে, এবং সেই প্রকল্পে গৃহীত ক্ষেত্রসমূহকেও নির্দেশ করে; এটি সুনির্দিষ্ট স্থানিক ইতিহাস, স্মৃতি, দেহজ রাজনীতি, এবং ধারণাগত কাঠামো সাপেক্ষে গড়ে ওঠা বিভিন্ন বিউপনিবেশিক লক্ষ্যপথের কোনো বোধগম্য সারাংশ [কিন্তু] নয়। “বিউপনিবেশিত করা বলতে কী বোঝায়?” এই প্রশ্নের উত্তর বিমূর্ত সর্বজনীন কিছু হতে পারে না। এর উত্তর দিতে হবে, বাকি ডব্লিউ এইচ প্রশ্নগুলোর দিকে চেয়ে: কে/ কারা এটি করছে, কোথায়, কেন, এবং কীভাবে?

বিষয়ীত্ব [subjectivities], শিক্ষা, খাদ্যগ্রহণ ও স্বাস্থ্য সংগঠনে পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্ব যেখানে চুঁইয়ে চুঁইয়ে অনুপ্রবেশ করে চিত্তস্ফূর্তিকে [conviviality] ধ্বংস করেছে, [সেখানে] ধারণাগত বিশ্লেষণের [conceptual analysis] ওপর বিদ্যায়তনিকভাবে কাজ করে ও পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্ব [epistemology] থেকে সরে এসে (বিযুক্তকরণ) এবং অবিদ্যায়তনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে (কীভাবে); বিউপনিবেশিক কাজ গোছাতে আধুনিকতার অলংকৃতির [rhetoric] গঠনপ্রক্রিয়া ও রূপান্তর এবং উপনিবেশিকতার যুক্তি বোঝা (কেন); যা দক্ষিণ আমেরিকায় উদ্ভূত হয়ে দুনিয়ার অপরাপর অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিলো (কোথায়); সম্মিলিত কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে (কে/কারা); বইটি অবশ্য সেই প্রশ্নগুলোরই একরকমের উত্তর। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, আমি [সেভাবেই] ব্যাখ্যা করি [ঠিক] যেভাবে আমি বুঝি আর উপনিবেশিকতার বিশ্লেষণ দাঁড় করাই এবং কল্পনা করি বিউপনিবেশিক ময়দান।

ফলে (বি)-উপনিবেশিকতার এক বিশেষ অর্থেরই ব্যাখ্যা দিতে আমি মনস্থ করেছি; যে অর্থটা এটি অর্জন করেছে একটি সমবায়ী প্রকল্পের সদস্যদের কাজে আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা/ বিউপনিবেশিকতা এই তিনটি চাবি শব্দের মাধ্যমে। প্রয়োজনানুসারে বিভিন্ন চাহিদা, অনুমান, ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা অন্যান্য বিউপনিবেশিক প্রকল্পের উল্লেখও আমি করবো। বিউপনিবেশিকতা সম্পর্কে আমার নিজের যে ধারণা, সেই মোতাবেক এর স্বত্বাধিকারী বা বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত কোনো মৌল পরিকল্পনা নেই। আমাদের ক্ষেত্রে (ক্যাথারিন এবং আমি) তো আরও নেই; এবং নিজেকে বিউপনিবেশিকতার পথিকৃৎ ধরে নেয় (অস্পষ্ট কিংবা স্পষ্টভাবে) এমন কোনো বিউপনিবেশিক প্রকল্পকেও আমরা গুরুত্বসহকারে নিবো না। আমরা, এখানে আমরা বলতে আমি মানব প্রজাতিকে বোঝাচ্ছি, এখন সকলেই আছি ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকায়। এর কোনো বাহির নেই, নেই কোনো সুবিধাজনক অবস্থান (নৃতাত্ত্বিক ও লৈঙ্গিক) যেখান থেকে উপনিবেশিকতাকে মোকাবেলা করা যায়। একারণেই, এই প্রস্তাবনায় প্রান্তিক যাপন, চিন্তন ও করণ বিউপনিবেশিক নির্দেশনাস্বরূপ গৃহীত।

আগেই বলেছি, আমরা এখানে বিউপনিবেশিকতার কোনো জাতিবিবরণী বৈশ্বিক প্রতিবেদন দাখিল করছি না। এই গ্রন্থমালা নিজস্ব সুনির্দিষ্ট স্থানীয় ইতিহাসে [সম্পর্কে], এবং নির্দিষ্ট বিউপনিবেশিক প্রকল্পে, স্বীয় নেতৃবৃন্দ কর্তৃক প্রস্তাবিত অপরাপর বিউপনিবেশিক উদ্যোগের জন্যও উন্মুক্ত। কাউকে কিংবা কোনো কিছুকে উপস্থাপন করাটা এই বইয়ের উদ্দেশ্য নয়। আধুনিকতার অভিধানে এবং আধুনিক জ্ঞানতত্ত্বে উপস্থাপনা একটা বাজে শব্দ। কেন? কারণ উপস্থাপন এক গঠিত জগৎ কিংবা বাস্তবতাকে ধরে নেয় যা কোনো না কোনোভাবে উপস্থাপিত আর তারপর দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন গোষ্ঠী কিংবা জনসমষ্টি বিষয়গত ও বাস্তব বলে একটা কিছুর বহুবিধ ব্যাখ্যা হাজির করে থাকে। সেই বিউপনিবেশিককে যদি বিকল্প ধরে তর্ক করা হয়, [আর] এটা এই কারণেই যে জীবন যাপিত হয়ে থাকে বহুবিধ বিকল্পের মধ্যেই, এবং বিকল্পসমূহ জনসমষ্টি ও প্রতিষ্ঠানসমূহের নিজস্ব সংস্কার [assumptions] ও স্বার্থের [interests] দ্বারাই নির্মিত। স্বার্থসমূহ তাদের নিজেদের মধ্যে ও নিজেদের জন্য মন্দ নয়: স্বার্থপরায়ণ হওয়া ও স্ফূর্তি, সম্প্রীতি, সৃষ্টিশীলতা, এবং প্রাচুর্যের পক্ষে কাজ করা এমনই সব আদর্শ এবং স্বার্থ বিউপনিবেশিকতা যাতে উৎসাহ দেয়; তথাপি, সর্তক হতে হবে, রাষ্ট্র, বণিকসংস্থা [corporations] ও অর্থবিত্ত যে পথে নিয়ে যাচ্ছে আর গণমাধ্যম প্রেরণা দিচ্ছে—এটা সেই গতিপথ নয়।

তা সত্ত্বেও, সেই তিন চাবিশব্দ (আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা/ বিউপনিবেশিকতা), আর সেই “/’’ [স্ল্যাশ] যা একইসঙ্গে তাদের যুক্ত ও বিযুক্ত করে, আন্দোলনসমূহের—যা জনসাধারণের জীবনযাপনে ধারণাটিকে দৃঢ়ভাবে রোপণ করে—দ্বারা গড়ে ওঠা [articulated] আসলে একটাই যৌগিক ধারণা। প্রত্যেকটি চাবিশব্দ কিংবা ধারণা একে অপর থেকে বিযুক্ত, একইসঙ্গে তার পূর্বোক্তটির সঙ্গে যুক্ত। বিউপনিবেশিকতা আপাতভাবে তিনটি ধারণার একটি মাত্র, কিন্তু এটিই সেই ধারণা উপনিবেশিকতাকে যা আধুনিকতার অন্ধকার পিঠ হিসেবে দৃষ্টিগোচর করেছিলো।

আনিবাল কিহানোর যথার্থ অভিব্যক্তি মারফত [বললে], সেই ত্রয়ী একটি বিষমজাতীয় ঐতিহাসিকনৈর্মিতিক [historical-structural] পর্ব [node]। এটি ১৯৬০ ও ১৯৭০এর দশকে ব্যাপকভাবে আলোচিত জ্ঞাপক/ জ্ঞাপিত [signifier/ signified], নির্দেশক/ নির্দেশিত [sign/ reference] (বিশ্লেষণী দর্শনে) এবং মিশেল ফুকো কর্তৃক সমালোচিত শব্দ/ চিন্তা দ্বৈত বর্জন করে (বিযুক্ত হয়)। ত্রয়ীটি জ্ঞাপনকে [এক] ভিন্ন ভিতের ওপর দাঁড় করায়: বিউপনিবেশিক ভিত।

ফলে, বিউপনিবেশিকতার তর্কটি, এখানে যেভাবে করা হয়েছে, তার গড়ে ওঠার প্রেক্ষিত আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতার বোঝাপড়া ব্যতীত বোধগম্য হবে না। আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা না থাকলে, বিউপনিবেশিকতার দরকারই পড়তো না, কারণ তখন আর বিউপনিবেশিত করার থাকতো না কিছু। তত্ত্বসমূহ, বিশ্বতত্ত্বের [cosmologies] মতো, সমগ্রতাকে [totality] লক্ষ্য বানায়, কিন্তু এমন নয় যে তাদের সমগ্রতাবাদী [totalitarian] হতে হবে। তার মানে, বিউপনিবেশিকতায় শামিল হতে অপরাপর লক্ষ্যপথের [trajectories] জন্যও জায়গা রয়েছে। এখানে “বিউপনিবেশিত করার কিছু নেই” বলতে আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতার ধারণাগত কাঠামোর বাহির নির্দেশ করে। অতএব, উপনিবেশিকতা যদি আধুনিকতার শর্ত হয়ে থাকে, তাহলে উপনিবেশিকতা ব্যতীত আধুনিকতা সম্ভব নয়; আর আধুনিকতা ছাড়াও কোনো প্রকার উপনিবেশিকতা থাকবে না। তাই, উপনিবেশিকতাকে শেষ করতে হলে আধুনিকতার গালগপ্পকেও [fictions] শেষ করা জরুরি। আধুনিকতার দীর্ঘবয়ানে প্রোথিত [laid out] মূলনীতি, অনুমান, এবং আস্থাসমূহের ধারণপূর্বক তা থেকে উপনিবেশিকতাকে তুমি বাদ দিতে পারবে না। আধুনিকতাকে ছাড়াই চিন্তা করা, এর গালগপ্প থেকে বিযুক্ত হওয়া, [তাই] একটি অগ্রগণ্য বিউপনিবেশিক চ্যালেঞ্জ।

আধুনিকতার চিন্তা (উদ্ধৃতির জন্য দেখুন: আধুনিকতা না কোনো সত্তা [entity], না সত্তাতাত্ত্বিক [ontological] কোনো ঐতিহাসিক পর্যায়, বরং আত্মপরিষেবিত [self-serving] এক সেট গপ্পো [narratives]) হালে পানি পায় বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। আরও দুটি অধিকতর স্পর্শগ্রাহ্য [concrete] জ্ঞাপক আধুনিকায়ন ও উন্নয়নের এটি ছিলো বিমূর্ত সহচর। আধুনিকতাকে গড়ে তোলা হয়েছিলো তার নিজেরই কল্পলোক [imaginary] আকারে, আর আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন ছিলো সেই দুনিয়ার ইঞ্জিনস্বরূপ। [যেকারণে] আধুনিকতা এমন এক দিগন্তকেই [horizon] উন্মোচন [signify] করতে এসেছিলো, যে দিগন্তের পানে আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন [ইতোমধ্যেই] আমাদের সকলকেই, অর্থাৎ, গোটা গ্রহটাকেই ধাবিত করে যাচ্ছিলো।

বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে “আধুনিকতার” ধারণাটি (এবং সেই শতকের শেষ দিককার উত্তরাধুনিকতা) জীবন ও ইতিহাসের বহু আগেই উদ্ভাবিত [devised] এক দিগন্তেরই নবরূপায়ণ ঘটায়। এর আগেকার রূপসমূহের ছিলো অন্য নাম: রেনেসাঁ, প্রগতি, এবং সভ্যকরণ অভিযান [civilizing mission]। সেই ক্যাচটুয়েন্টি টু ছিলো [একটা] ভান যে, আধুনিকতা [যেন] সেই বয়ানসমূহের অতিক্রমী [একটা] কিছু, যা শব্দটিকে এবং যে কল্পলোকের হাতছানি শব্দটি দেয় তাকে উদ্ভাবন করেছে। বিউপনিবেশিকভাবে বললে—এটা একটা কল্পকাহিনি—কুশীলব, প্রতিষ্ঠান, এবং ভাষাসমূহের এক নির্মিতি, যা জ্ঞান ও যুদ্ধের মাধ্যমে তাদেরকেই প্রাধিকার দেয়, যারা সামরিক ও আর্থিকভাবে সেই কল্পলোকেরই রচয়িতা ও রক্ষক।

বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের আরেক মৌল ও নয়া ধারণা ছিলো উন্নয়ন [development], যা প্রগতি [progress] ও সভ্যকরণ অভিযানের প্রতিস্থাপন ঘটিয়েছিলো। উন্নয়ন প্রতিস্থাপিত করেছিলো প্রগতিকে, আর আধুনিকায়ন করেছিলো সভ্যকরণ অভিযানকে। সুতরাং, আধুনিকতার তর্কমূলক অলংকৃতিটাকে পুরোনো এক দিগন্তেরই পুনর্বর্ণনের [redescription] দ্বারা আরও তরতাজা করা হয়েছিলো। এই পুরোনো দিগন্তটা ছিলো রেনেসাঁ, একদম এর ঐতিহাসিক ভিত্তি। প্রথমদিকে আধুনিকতা একটি পরিচিত শব্দ না হলেও, বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আধুনিকতা যা বোঝাতে চাইতো তা [সেই অর্থ] পূর্ববর্তী শতকগুলোতেই প্রোথিত [embedded] ছিলো। এটি প্রোথিত ছিলো ষোল শতকের ফ্রান্সের “প্রাচীন এবং আধুনিক” এর সুপরিচিত বাহাসে। ষোল শতকে আধুনিক বলতে বোঝানো হতো “অধুনা সময়”। নিজেদের যারা আধুনিক মনে করতো প্রাচীন ছিলো তাদেরই বানানো এক বিভাজন।

পরে, এটি হয়ে ওঠেছিলো একটি নিন্দাসূচক পরিভাষা: প্রাচীনেরা হয়ে ওঠেছিলো বর্তমানের আলোক দর্শনে অক্ষম, পিছিয়ে পড়া, পশ্চাৎপদ ও রক্ষণশীল জনসমষ্টি। কিন্তু, “অধুনা সময়”কে, গুরুত্বসহকারে, কেবলই সাম্প্রতিক সময়, [বিশেষ করে] ইউরোপের সাম্প্রতিক সময় হিসেবে বোঝা হয়েছিলো (এটি জাপানের কিংবা আফ্রিকার কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার বর্তমান হওয়া সম্ভব ছিলো না, [কারণ] সেখানকার জনসমষ্টির অন্য চাহিদা [exigencies] ছিলো), যা উত্তরোত্তর স্থানের কেন্দ্র হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছিলো। এই ভাবনা [আরও] সংহত [consolidated] হয়েছিলো হেগেলের ইতিহাসের দর্শন বিষয়ক বক্তৃতায়, যেখানে তিনি সর্বজনীন ইতিহাসের কালানুক্রমিক [chronological] ও আরোহী ক্রমোন্মোচনের [ascending unfolding] পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছিলেন, যা—তার লেখালেখির কালে—জার্মানিতে এসে পৌঁছেছিলো। হেগেলের কাছে জার্মানি ছিলো স্থান/ ভূগোলবিদ্যার কেন্দ্র, সময়/ ইতিহাসের বর্তমান।

আধুনিকতার চিন্তা তৎকালীন স্বঘোষিত রেনেসাঁসীয় এবং আধুনিকদের প্রারম্ভিক দার্শনিক প্রণোদনা ও ভঙ্গিকেই একুশ শতকে প্রলম্বিত ও প্রসারিত করেছিলো। উন্নয়নের আরেক মাত্রা এসে তখনই হাজির হয়েছিলো, আধুনিকতা যখন নয়াউদারনৈতিক বিশ্বায়ন কর্তৃক আত্মস্থ এবং অধীনস্ত [subsumed] হয়ে ওঠেছিলো। নয়াউদারবাদ এবং ওয়াশিংটন ঐকমত্য [Washington Consensus] উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের মধ্যেকার আপোসের স্থানচ্যুতি ঘটিয়েছিলো, আর তাকে বদলে দিয়েছিলো উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন দ্বারা, যা প্রগতি, আধুনিকতা, সভ্যতা ও উন্নয়নের [মতো] উদারনৈতিক দ্যোতনাসমূহেরও স্থানচ্যুতি ও অন্তর্ভুক্তি [subsumed] ঘটায়।

উপনিবেশিকতা প্রসঙ্গে, ক্ষমতার উপনিবেশিকতা, এবং ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকা (CMP)

ঐতিহাসিক উন্মোচনের পূর্বে ধারণাগত গড়নটাকে [conceptual frame] বিশ্লেষণ করে আস্তেধীরেই এগোনো যাক। উপনিবেশিকতা একটি বিউপনিবেশিক ধারণা। আধুনিকতার ঢেকে রাখা পৃষ্ঠের উন্মোচনই এর মূল উপজীব্য। উপনিবেশিকতা—এর দ্বারা—আধুনিকতাজাত মাত্রা [dimension] হিসেবে নয়, হাজির হয় তার [আধুনিকতার] গাঠনিক শর্ত আকারে। ফলে, এই বইয়ে যেমন দেখানো হয়েছে, আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা সম্পর্কিত প্রারম্ভিক তাত্ত্বিক ধারণাটি যৌথ বিউপনিবেশিক কর্মকাণ্ডেরই ভিত্তি হয়ে ওঠেছিলো। উপরন্তু, উপনিবেশিকতা ও আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতার ধারণাসমূহ তৃতীয় বিশ্বেই দানা বেঁধেছিলো। এরচে ভালো, এই সকল ধারণা উদ্ভূত হয়েছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বংসের কালানুক্রমিক মুহূর্তে আর, এর দ্বারা, সেই ভাবাদর্শটি বিশ্বকে বিভাজিত করেছিলো প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়ে। একারণে, উপনিবেশিকতা ও আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা তৃতীয় বিশ্বের দক্ষিণ দুনিয়াতে কাল্পনিক পরিবৃত্তিসাধনে [mutation] নির্দেশকস্বরূপ।

এভাবে, আমাদের পরিপ্রেক্ষিত [perspective] এখানে স্নায়ুযুদ্ধ এবং তৃতীয় বিশ্বের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতানির্ভর, যেখানে আধুনিকতা ও আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতার বিউপনিবেশিক ধারণাসমূহ প্রোথিত আছে। আমাদের (ক্যাথারিন ও আমার) ক্ষেত্রে প্রথম বিশ্বের যাপিত অভিজ্ঞতা কেবল অপরিহার্যই নয়, একইসঙ্গে প্রাসঙ্গিক হলেও, আমাদের কাজ [তবু] প্রথম বিশ্বের সংখ্যালঘুর স্মৃতি ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক নয়। ক্যাথারিন ও আমার সংকর (ভূমিকাংশ পড়–ন) অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে, গ্লোরিয়া আনসালদুয়ার [Gloria Anzaldúa] বিবৃতিটি আমাদের আলোচনার জন্য এক নির্দেশকস্বরূপ: “যুক্তরাষ্ট্রমেক্সিকো সীমান্তটি এক অরক্ষিত ক্ষত যেখানে তৃতীয় বিশ্ব প্রথমের সঙ্গে ঘঁষা খায় আর রক্ত ঝরায়। এবং মামড়ি [scab] পড়ার আগে আবার তার রক্তক্ষরণ হয়, দুটো বিশ্বের প্রাণরুধির তৃতীয় একটি দেশ—প্রান্তীয় এক সংস্কৃতি—গঠনের জন্যই একত্রিত হয় ।” সীমান্ত সর্বত্রই আর তারা কেবল ভৌগোলিক নয়; তারা বর্ণগত আর লৈঙ্গিক, জ্ঞানমূলক আর সত্তাতাত্ত্বিক [ontological], ধর্মীয় এবং নন্দনতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক ও জাতীয়। সীমান্তগুলো আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতার অভ্যন্তরীণ সড়ক এবং আন্তর্জাতিক আইন ও বৈশ্বিক সরলরৈখিক চিন্তার ফসল।

উপনিবেশিকতা যদি বিউপনিবেশিক ধারণা হয়, এটি অবশ্যই বিউপনিবেশিক চিন্তার ফলাফল হবে। পুনরুক্তিটি [tautology] এখানে উপনিবেশিকতাকে (ঠিক যে অর্থে কিহানো একে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন) জোরের সঙ্গে শাস্ত্রাতিক্রমী [transdisciplinary] ধারণা বলে নির্দেশ করে: এটি সুনির্দিষ্ট কোনো শাস্ত্রীয় কিংবা আন্তঃশাস্ত্রীয় [interdisciplinary] আলাপ থেকে উদ্ভূত হয়নি, বরং ষাটের দশক থেকে আশির দশকের শেষ নাগাদ দক্ষিণ আমেরিকার যাপিত অভিজ্ঞতা থেকে ওঠে আসা। যদিও নেতৃস্থানীয় বিউপনিবেশিক ভাবুক আনিবাল কিহানো একজন প্রশিক্ষিত সমাজতাত্ত্বিক ও বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দক্ষিণ আমেরিকায় জারি থাকা নির্ভরশীলতা তত্ত্ব, ইউরোকেন্দ্রিকতা এবং আধুনিকতা সম্পর্কিত আলাপে নিবেদিত অংশগ্রাহী ছিলেন, সেগুলো ছিলো শাস্ত্রীয় সংস্রবের বাইরের: সেগুলো কোনো শাস্ত্রকে হালনাগাদ করা কিংবা উৎকর্ষবিধানের উপকরণ ছিলো না, বরং তা প্রোথিত ছিলো জীবনানুশীলন ও মুক্তির উদ্যোগে। কিহানোর চিন্তায় সমাজবিজ্ঞানের ছাঁচটিকে অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু উপনিবেশিকতার ধারণাটিকে যা সামনে এনেছে তা সমাজবিজ্ঞানের উৎকর্ষসাধনের কোনো প্রচেষ্টা ছিলো না, ছিলো ইতিহাসের ঢেকে রাখা পৃষ্ঠের উন্মোচনের প্রয়াস, সমাজবিজ্ঞান যেখানে সংসৃষ্ট ছিলো আর আছেও।১১

উপনিবেশিকতা, ফলে, ইউরোপীয় বিবেচ্য—এর অর্থনীতি, সংবেদনা ও ইতিহাস—মূল্যায়নের জন্য ইউরোপে উদ্ভূত কোনো ধারণা নয়, বরং তিনটি বিশ্বের বিভাজন ধ্বসে যাওয়ার কালে, উপনিবেশিকতার স্থানীয় ইতিহাসের তাগাদা থেকে, তৃতীয় বিশ্বে গড়ে তোলা এক ধারণা। ইউরোপীয় বিবেচ্য ছিলো আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা ও বিশ্বায়ন—আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা ও বিশ্বায়নের ঢেকে রাখা পৃষ্ঠ—উপনিবেশিকতা নয়।

উপনিবেশিকতার ধারণাটি একইসঙ্গে দুটি লক্ষ্যপথ [trajectories] উন্মুক্ত করেছিলো: একদিকে, আধুনিকতার অন্ধকার পৃষ্ঠে এটি আলো ফেলেছিলো; অন্যদিকে, বিউপনিবেশায়নকে এটি রূপান্তরিত করেছিলো বিউপনিবেশিকতায় ও বিউপনিবেশিক চিন্তায়। এর মানে দাঁড়ায়, স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার বিউপনিবেশায়ন, কূটোপায়ে [paradoxically], আধুনিক চিন্তার শর্ত ও সংবেদনশীলতায়ই গ্রথিত ছিলো: আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতার গাঠনিক মূলনীতির চেয়ে উপকরণ বদলানোকেই এটি নিশানা করেছিলো। বিউপনিবেশায়ন নির্দিষ্ট কিসিমের উপনিবেশায়নে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিলো; উপনিবেশিকতার সার্বিক যুক্তি তখন পর্যন্ত আওতাবহির্ভূতই রয়ে গিয়েছিলো। উপনিবেশিকতা বিউপনিবেশিক চিন্তার ফলাফল, আর বিউপনিবেশিক চিন্তা উপনিবেশিকতার ধারণার মাধ্যমেই অস্তিত্ব লাভ করেছিলো। এসকল কারণেই, উপনিবেশিকতা ইতোমধ্যেই একটি বিউপনিবেশিক ধারণা: বিউপনিবেশিকভাবে চিন্তা করাটা উপনিবেশিকতাকে দেখা সম্ভব করেছিলো, আর উপনিবেশিকতার দেখন [seeing] বাস্তবায়িত করেছিলো বিউপনিবেশিক চিন্তাকে। গল্পটার একটি দিকের (আধুনিকতা) বদলে দুটো দিকই, আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা, দেখনের [seeing] ব্যঞ্জনার্থ অনেক। পুনরায় বললে: দুটো দিকের একটির (উপনিবেশিকতা) উন্মোচন ঘটলেই জীবনযাপনের লুকানো মাত্রাগুলো—জনসমষ্টির অসন্তুষ্টি ও ক্ষোভের কারণ—ফাঁস হয়ে যায়; অন্যদিকে, অপরটি (আধুনিকতা) হলো সম্ভাব্য সব ভালো জিনিসের কাহিনিকথন; উদাহরণস্বরূপ, সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলোর ধনসম্পদের বিনিয়োজিত অংশ অপরের মঙ্গলের জন্যই।১২

সমীকরণটির এই দ্বিতীয় দিকের বাইরে “অন্যভাবে চিন্তন ও করণ”এর অভিব্যক্তির উত্থান ঘটে। কেন? আধুনিকতা যা অস্বীকার করেছিলো সেই অভিজ্ঞতা থেকে ভাববার তাগাদাই এর কারণ, আর এর দ্বারা এটাই প্রমাণ করা যে, আধুনিকতা সবসময়ই তার, কাহিনিকারদের কল্যাণ ও স্বার্থের নিশ্চয়তা [warranty] প্রদানকারী বিজ্ঞান, রাজনীতি ও অর্থনীতির নামে আত্মস্বীকৃত, কাহিনিকারদের কল্পলোক ও অভিলাষসমূহের [desires] সঙ্গে যা খাপ খায় না, তাকে গোপন ও দমন করার মাধ্যমে গল্পটার আদ্ধেক [মাত্র]। এর মৌলিক ব্যঞ্জনাটা এই যে, উপনিবেশিকতাকে এমন কোনো ধারণা বা সত্তায় পর্যবসিত করা যায় না, নির্দিষ্ট কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা কিংবা ইস্যু তদন্ত করার জন্য, যাকে বিদ্যমান সমাজবিজ্ঞান কিংবা মানবিক বিদ্যায় প্রয়োগ বা অধ্যয়ন করা যায়। খোদ উপনিবেশিকতা “প্রয়োগযোগ্য” নয় [ঠিকই], কিন্তু, সর্বদা বিউপনিবেশিক চিন্তাকে [এটি] ইতোমধ্যেই আবশ্যক করে তোলে, আর বর্জন করে সমাজবিজ্ঞান কিংবা মানবিকবিদ্যার শাস্ত্রীয় [যতো] প্রবিধান। দায়টা অনেক বেশি। [যেকারণে] উপনিবেশিকতাকে “অন্তর্ভুক্ত” করার মাধ্যমে শাস্ত্রটির হালনাগাদকরণের চাইতেও, এটি নির্দেশ করে আলাপের শর্তাবলিরই (অনুমান, মূলনীতি ও বিধিবিধান) বদল ও শাস্ত্রসমূহের পরিহার।

বিদ্যমান যেকোনো শাস্ত্রেরই যে শব্দভাণ্ডার, যে শব্দগুলো তদন্তের ক্ষেত্র নির্দেশ করে থাকে কিংবা ক্ষেত্রটাকে বোঝানোর জন্য যেসকল ধারণা তুমি ব্যবহার করো, তার দুটি বাগর্থিক [semantic] মাত্রা থাকে। প্রথমেই দেখতে পাবে, যেসকল শব্দ/ ধারণা তুমি ব্যবহার করে চলেছো তার অধিকাংশই ইউরোপীয় আধুনিক/ সাম্রাজ্যিক ও স্থানীয় ভাষার এবং সেগুলো গ্রিক ও ল্যাটিন থেকে আহরিত। দ্বিতীয়ত, যেসকল শব্দ/ ধারণা তুমি তোমার শাস্ত্রে এবং এমনকি প্রাত্যহিক আলাপে ব্যবহার করছো, দেখবে, তার অধিকাংশই, যদি সব নাহয়ে থাকে, ষোল ও সতেরো শতকের দিককার ইউরোপে অনূদিত ও পুনর্নিরূপিত [redefined]

ঘটনা হলো, সমকালে বিদ্যমান সভ্য ভাষাসমূহের কোনোটারই (মান্দারিন, হিন্দি, উর্দু, ফারসি, আরবি, রুশ, এইসব), যেকোনো একটি শাস্ত্রের গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে, প্রাসঙ্গিক নাহওয়াটা [এটাই] নিশ্চিৎ করে যে, ইউরোকেন্দ্রিক জ্ঞান স্বীয় কর্তৃত্ব খাটানোর সঙ্গে সঙ্গে অপরাপর জানাবোঝার অনুশীলন এবং জ্ঞান ও বিশ্বাসব্যবস্থার শব্দভাণ্ডারকেও (এবং যুক্তিবিদ্যা) অযোগ্য সাব্যস্ত করে। ট্রিভিয়াম এবং কোয়াড্রিভিয়াম, রেনেসাঁসীয় বিজ্ঞান ও বিদ্যাবত্তার [scholarship], এবং পরবর্তীকালে, আলোকময় [যুগের] বিজ্ঞান, দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানসমূহের—যার সবগুলোই নিজেদের ধারণাগত শব্দভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলো গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষার ওপর—কাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে, প্রতিটি অইউরোপীয় এবং অপশ্চিমা সভ্যতার ভাষাসমূহের জ্ঞান ও বোঝাপড়ার সমবিদ্যমান কাঠামোকে [coexisting frames] বাতিল করার ক্ষেত্রে, একত্রে কাজ করেছিলো।১৩

বাইরের একজন মূল্যায়নকারীর অনুরোধে, এখানে আমি আরও কিছু মন্তব্য যোগ করতে চাই: ক্ষমতার উপনিবেশিকতায় কিহানো আসলে ক্ষমতা বলতে কী বোঝাতে চায়?

উপনিবেশিকতা ও ক্ষমতার উপনিবেশিকতা হলো “patrón colonial de poderÓ”-এর [ক্ষমতার ঔপনিবেশিক নকশা] সংক্ষেপ, আমি যার অনুবাদ করেছি “colonial matrix of power” [ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকা]Matrix, এসেছে আদি ফরাসি matrice শব্দ থেকে, যার অর্থ “জরায়ু”। শতাব্দী ধরে উদ্ভূত অপরাপর শব্দগুলোও জীবনের পুনরুৎপত্তি ও যা থেকে কিছু [একটা] জন্মায় সেই রকম কোনো সারবস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এর অর্থের আরও প্রসারণ ঘটেছিলো। এখানে patrón-এর অনুবাদে—কোনো সত্তা গঠনকারী (মানসিক ও কায়িক, The Matrix সিনেমাটার মতো) কাঠামোগত সম্পর্ক ও প্রবাহের—একটা সেটকে আমি গুরুত্ব দিয়েছি। সিনেমাটিতে মেশিননির্মিত এক সাইবারজগৎ মানুষের বিশ্বাস তৈরি করে যে, উৎপাদিত এই ইন্দ্রজালটিই তাদের আস্থাযোগ্য বাস্তবতা। কী ঘটছে, প্রধান চরিত্র, নিয়ো তা বুঝে ফেলে, এবং মানবদেহসমূহ যেখানে বাঁচে সেই কল্পজগৎ [fantasies] নির্মাণকারী কম্পিউটার প্রোগ্রামটিকে—বাস্তবতার ইন্দ্রজালসৃষ্টিকারী মেশিনটির রসদ হিসেবে যা মানবদেহের শক্তি ও তাপ ব্যবহার করে—ধ্বংস করতে চাওয়ার মাধ্যমে [সে] বিদ্রোহ করে। ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার সঙ্গে সাদৃশ্যটির [analogy] একএক মিল। ব্যতিক্রমটি হলো বাস্তবতার ইন্দ্রজালটির উৎপাদক, সিনেমাটিতে, কোনো মানুষ নয়—মানবসৃষ্ট এক মেশিন। ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার ক্ষেত্রে ইন্দ্রজালটির (আধুনিকতা) রচয়িতারা—মানবদেহগত (শ্রম) শক্তির পাশাপাশি জীবমণ্ডল (জল, জমি ও অক্সিজেন) ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড (সূর্য ও চাঁদের আলো) থেকেও শক্তি গ্রহণ করে—ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকারই অন্তর্গত মানুষ, কিন্তু তারা মনে করে কিংবা মনে করাতে চায় যে, ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার বাহিরের দৃষ্টান্তও আছে, যেখান থেকে তাকে অবলোকন করা সম্ভব। সেটা ছিলো খ্রিস্টীয় খোদা আর তার পর্যবেক্ষক ইহজাগতিক বৈজ্ঞানিক/ দার্শনিক মানুষের দৃষ্টান্ত। বিউপনিবেশিকভাবে বললে, আসলে কোনো বাহিরটাহির নেই, ফলে, বিউপনিবেশিক চিন্তা খোদার আধুনিক (কিংবা উত্তরাধুনিক) সংস্করণ কিংবা বৈজ্ঞানিক/ দার্শনিক পর্যবেক্ষক হওয়ার দাবি করে না।

মানব সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্র একটি অংশ কর্তৃক নির্মিত সেই মাতৃকাটি (ঔপনিবেশিক) বৃহত্তর অংশের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ক্ষমতাই সেই ঔপনিবেশিক মাতৃকার উদাহরণ যার দ্বারা মানব সম্প্রদায়ের সকলেই শাসিত হয়ে থাকে, আর অবশ্যই শাসনটি তার কারিগর ও দারোয়ানদেরও [এতে] অন্তর্ভুক্ত করে নেয়: শাসক শাসিত হয়ে থাকে তার আপন আকাক্সক্ষা ও বিধির প্রতি বাধ্যবাধকতার দ্বারা। বিউপনিবেশিকতা ঔপনিবেশিক মাতৃকার আনুগত্যকামী কৌশলটিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে এর অন্তর্গত থেকেই ক্ষমতার চর্চা করা। এই ধরনের কৌশল জ্ঞানগত বিধায়, বিউপনিবেশিক মুক্তি সূচিত করে জ্ঞানগত অবাধ্যতা। একজন আধুনিক নায়কের (নিয়ো) মানসিকতায় আধুনিকতা/ মাতৃকার ইন্দ্রজাল সম্পর্কিত সতর্কতা আর নেই, কিন্তু ক্রমবর্ধমান গ্রহীয় রাজনৈতিক সমাজ তাদের/ আমাদের করতলে লুফে নিচ্ছে তাদের/ আমাদের নিয়তি। বিউপনিবেশিকতাকে—পশ্চিমা আধুনিকতার ব্যক্তিতান্ত্রিক কল্পলোকের প্রাধিকারপ্রাপ্ত চরিত্র—কোনো নায়ক কর্তৃক প্রবর্তিত বলে ভাবা যাবে না। The Matrixএর (সিনেমাটিতে) নিয়োর মতো, বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা বিউপনিবেশিক গ্রহীয় শক্তিসমূহ, বর্তমানে, আমাদের বিচিত্র স্থানীয় ইতিহাসে আন্তঃসম্পর্কিত হয়ে উঠছে। বিউপনিবেশিক বিশ্লেষক ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার গঠন ও রূপান্তর বুঝতে চান, [যেন] “বর্তমানকে ব্যক্ত করতেই অতীতের পাঠ”, রেনেসাঁর আচ্ছাদিত পৃষ্ঠগ্রন্থের ভূমিকায় যেমন বিশ্লেষিত হয়েছে।১৪ বিযুক্ত হওয়ার জন্য জানা চাই কোত্থেকে এবং কীভাবে বিযুক্ত হতে হবে। ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার অন্তর্গত থেকে সেটা একধরনের ক্ষমতারই সংগ্রাম।

ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই, আর না আছে অতীত। আমরা সকলে, এই গ্রহে, অতীতের বোঝা ও ভবিষ্যতের আশা বহনকারী স্থির ও অনিয়মিত এক বর্তমানের মধ্যে বসবাস করছি। [আর] বিশ্বজনীন কল্পকাহিনির আবাসভূমি উত্তরআটলান্টিকে কেবল নয়, বর্তমানে আমরা মানবসত্তা গ্রহের সর্বত্র সকলে যা করে বেড়াচ্ছি তাই হবে ভবিষ্যৎ। বিউপনিবেশিকতা বর্তমানে জারি থাকা বহু বিকল্পের একটি। কিছু বিকল্প চায় কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ করতে, পুনর্পশ্চিমাকরণের [rewesternization] ক্ষেত্রে কী করা উচিৎ ও কী করতে পারতো, আর পুনর্পশ্চিমাকরণের একতরফা শাসন ঠেকাতে বিপশ্চিমাকরণের [dewesternization] কী করা উচিৎ ও করতে হবে, [এসব নিয়ে] বিভিন্ন আদর্শের মধ্যে দ্ব›দ্ব ও পার্থক্য বিদ্যমান। দুটি বিকল্পই রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত: ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা নিয়ে উভয়ই তারা সাম্প্রতিক বিবাদটির বাস্তবায়ন ঘটায়। বিউপনিবেশিকতা রাষ্ট্রচালিত প্রকল্প নয়, তা হতেও পারে না। সেগুলো ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকা থেকে বিযুক্ত হওয়ার তাগাদা থেকে স্থানীয় ইতিহাসে[র পাটাতনে] নিজেরা নিজেরাই সংঘবদ্ধ জনগণের প্রকল্প। উপরন্তু, মুক্তিকামী বাহিনিগুলোর মধ্যেও বিভিন্ন বিকল্প হাজির আছে, আর এসব বাহিনি এখন দুনিয়া জুড়ে বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু এখানে আমি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছি, সেই অর্থে, তাদের সবগুলোই [আবার] বিউপনিবেশিক নয়। অবশ্য তা তাদের হতেও হবে না। বিউপনিবেশিকতা, এখানে যেভাবে ব্যক্ত হয়েছে, পুনরায় বলা যাক, বন্ধনীমুক্ত সত্যের দাবি করে না। বিপরীতক্রমে, এটি উন্মোচিত করে যে, বন্ধনীযুক্ত সত্য ছাড়া বন্ধনীমুক্ত আধুনিক/ ঔপনিবেশিক সত্য কর্তৃক সৃষ্ট সমস্যাগুলোর [আদতে] কোনো সমাধান নেই। বিউপনিবেশিকতা, এখানে যেমন বলা হয়েছে, বহু বিকল্পের একটি মাত্র। প্রত্যেকটি বিকল্পেরই (নিয়ন্ত্রণকামী কিংবা মুক্তিকামী) তার নিজস্ব কিছু করণীয় থাকে। করণীয়সমূহ বিশ্বজনীন নয়। কোথায় এবং কী কারণে [কোন] করণীয় এসে হাজির ও প্রবর্তিত হবে, তা [আসলে] সংশ্লিষ্ট বিকল্পগুলোরই মুখাপেক্ষী। ষষ্ঠ ও সপ্তম অধ্যায়ে এই সমস্যাগুলোয় আমি ফিরবো। উপনিবেশবাদ ও উপনিবেশিকতা এবং বিউপনিবেশায়ন ও বিউপনিবেশিকতার মধ্যেকার ফারাকগুলো আরও তলিয়ে দেখা যাক।

উপনিবেশিকতা উপনিবেশবাদের সমার্থক নয়

উপনিবেশিকতাকে উপনিবেশবাদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। এই গ্রন্থে, বিউপনিবেশিকতাকে আমরা যেভাবে আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা/ বিউপনিবেশিকতা ধারণা ত্রয়ীর অন্তর্গত রূপে হাজির করেছি, তাতে এই দুইয়ের পার্থক্য বুঝতে পারাটা খুবই জরুরি।

উপনিবেশবাদএর বিশ্লেষণ দিয়েই শুরু করা যাক। উপনিবেশবাদ শব্দটি সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য আসলে পাওয়া যায় না। ব্যুৎপত্তিসংক্রান্ত অন্তর্জালিক অভিধানটি আমাদের জানায় যে, শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিলো ১৮৮৬ সালে, এবং অর্থ নির্দেশ করতো “ঔপনিবেশিক শাসনের পদ্ধতি।”১৫ এক্ষেত্রে দর্শনশাস্ত্রীয় স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়াটি বরং [Stanford Encyclopedia of Philosophy] বেশি উদার। উপনিবেশবাদকে এটি নিম্নোক্তরূপে প্রণয়ন করে:

উপনিবেশবাদ কর্তৃত্ব কায়েমের চর্চা, যা একদল লোক কর্তৃক অপর দলকে পরাভূত করার সঙ্গে সম্পর্কিত। উপনিবেশবাদের সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে জটিলতাসমূহের একটি হলো, এটিকে সাম্রাজ্যবাদ থেকে আলাদা করাটা কঠিন। হরহামেশা শব্দ দুটি একে অপরের সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উপনিবেশবাদের মতো, সাম্রাজ্যবাদও আশ্রিত অঞ্চলের ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। পরিভাষা দুটির বুৎপত্তি অবশ্য, কীভাবে তারা পৃথক, সেই ইঙ্গিতও প্রদান করে।

কলোনি [colony] পরিভাষাটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ colonus থেকে, যার অর্থ কৃষিজীবী। এই উৎস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, উপনিবেশবাদের চর্চা সাধারণত নতুন কোনো অঞ্চলে জনগোষ্ঠী প্রেরণের সঙ্গেই সম্পর্কিত ছিলো, যেখানে আগমনকারীরা স্থায়ীভাবে বসবাস করতো ঠিকই, কিন্তু মাতৃভূমির প্রতিও তারা রাজনৈতিক আনুগত্য বজায় রাখতো। অপরপক্ষে, ইম্পেরিয়ালিজম [imperialism] এসেছে ল্যাটিন পরিভাষা imperium থেকে, [যার] অর্থ হুকুম করা। এভাবে সাম্রাজ্যবাদ পরিভাষাটি এক দেশ কর্তৃক আরেক দেশের ওপর ক্ষমতানুশীলনের প্রতি নজর কাড়ে— হোক তা বসতি স্থাপন, সার্বভৌমত্ব, কিংবা নিয়ন্ত্রণের পরোক্ষ কোনো কৌশলের মাধ্যমে।১৬

দুটি কারণে উদ্ধৃত সংজ্ঞাগুলো আমার আলোচনায় [বেশ] প্রাসঙ্গিক। প্রথমত, এগুলো খুব তথ্যপূর্ণ। দ্বিতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটা হলো, লেখক যে জটিলতাটার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন—তা। সাম্রাজ্যবাদকে লেখক প্রায় সেভাবেই সংজ্ঞায়িত করেছেন—ব্যুৎপত্তি অভিধানটি যেভাবে উপনিবেশবাদকে সংজ্ঞায়িত করেছে। এখানে সমস্যা যেটা দাঁড়ালো, অন্তর্ভুক্তিটা রচিত হয়েছিলো একটি ঐতিহাসিক, শাস্ত্রীয় পরিপ্রেক্ষিত থেকে এই অনুমান নিয়ে যে, প্রতিটি শব্দ পৃথক প্রপঞ্চের [phenomenon] সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ—এমনকি, লেখক যদিও মেনেই নিয়েছেন যে, কখনও কখনও এদের একটিকে অপরটি থেকে আলাদা করা [সত্যিই] মুশকিল। কেমন হবে যদি অন্যভাবে—বিউপনিবেশিকভাবে—সাম্রাজ্যবাদ/ উপনিবেশবাদ লেখা হয় ও উপনিবেশবাদ ছাড়া কোনো সাম্রাজ্যবাদ নেই এবং উপনিবেশবাদকে সাম্রাজ্যবাদের গঠনগত শর্ত ঘোষণা করার মাধ্যমে উপনিবেশবাদকে সাম্রাজ্যবাদের পরিপূরক হিসেবে ভাবা হয়? বিউপনিবেশিক চিন্তনে এটা একটা ছোট্টো অনুশীলন [মাত্র], আধুনিক/ পশ্চিমা জ্ঞানতাত্ত্বিক অনুমান [assumptions] থেকে বিযুক্তকরণ; কিংবা চাইলে ইউরোকেন্দ্রিকতাও বলতে পারো।

আধুনিকতা ও বিশ্বতন্ত্র

এখন তাহলে আধুনিকতা পরিভাষাটিকে বিশ্লেষণ করা যাক। আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা একটি বিউপনিবেশিক ধারণা, কিন্তু আধুনিকতা নয়। উপনিবেশিকতা দেখায় যে, আধুনিকতার সকল প্রকার বয়ান ও উদ্যাপন আসলে গল্পটার অর্ধেক। ইয়ুর্গেন হেবারমাসের ভাষায়, আধুনিকতা একটি অসমাপ্ত প্রকল্প। এবং আজকাল আমরা তা দেখি মধ্যপ্রাচ্য দখল, রাশিয়ার বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ও নিজের মতো করে “উন্নয়ন করা”র মতো শেরেকি [heresy] কর্মকাণ্ড থেকে চীনকে “সংযত রাখা”র প্রচেষ্টায়; দৃষ্টান্তগুলোর সবই পুনর্পশ্চিমায়নের পর্যায়ে থাকা আধুনিকতার অসমাপ্ত প্রকল্প।

আধুনিকতার জন্মই যেহেতু সময়ের একরৈখিকতায়, বিশ্বজনীন সময় ও ইতিহাস, ধারণাটির জন্য তাই এর ঐতিহাসিক পূর্বমুহূর্ত—প্রাকআধুনিক—অপরিহার্য এবং এটি গড়ে তুলেছে এর পরবর্তী পর্যালোচনামূলক ধাপ: উত্তরাধুনিক। বিউপনিবেশিকভাবে বললে, জাগতিক সহাবস্থান [coexistence] এবং যাপন ও চিন্তনকে উদ্দীপিত করতে—যা নাপ্রাকআধুনিক নাউত্তরাধুনিক—অনাধুনিক ধারণাটি জরুরি। অনাধুনিক একটি নমনীয় ধারণা—সবসময় উল্লিখিত হয় না—কিন্তু অনুন্নতদের, বর্তমানে, অসভ্য জনগোষ্ঠী হিসেবে উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে পূর্বানুমিত ও জরুরি: আধুনিক কিংবা উত্তরাধুনিক হওয়ার জন্য যাকে [নিজের] ঘাটতি পূরণ করে নিতে হয়। অনাধুনিককে পুরোভাগে নিয়ে আসায় আধুনিকতার পরিত্রাণমূলক [salvific] ও আলঙ্কারিক (প্ররোচনা) বয়ান বুঝতে সুবিধা হয়, যা পালাক্রমে অনাধুনিকদের শাসন করারও বৈধতা এনে দেয়, আর বিশ্বজনীন “ইতিহাস” উন্মোচনের আধুনিক (এবং সাম্রাজ্যিক) প্রকল্পে ও আধুনিকতার অসমাপ্ত প্রকল্পে তাদের বোঝাস্বরূপ প্রতিপন্ন করে। তবে, বিউপনিবেশিকভাবে, বিশ্বজনীন ইতিহাসের উন্মোচন রূপে আধুনিকতার নির্মাণকে এমনভাবে মঞ্চস্থ করা হয় যেন এটি ছিলো বাহিরের সংস্পর্শবিহীন, আর ইতিহাসের অগ্রযাত্রাকে পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে [গৃহীত] কর্মোদ্যোগ ও প্রণীত সিদ্ধান্তসমূহের বৈধতাদানকারী বয়ান থেকেও স্বাধীন কোনো স্বতন্ত্র সত্তা, কিংবা ঐতিহাসিক পর্ব, যখন বিউপনিবেশিকভাবে বললে, এটি [দাঁড়ায়] আধুনিকতার মতো খুবই আধুনিক একটি ধারণা কর্তৃক নির্মিত এক ইন্দ্রজাল ([এই] বাড়তিটুকুও আবশ্যক: আধুনিকতা একটি আধুনিক ধারণা)। প্রায়ই ইঙ্গিত করা হয় এবং দোষী সাব্যস্ত করা হয় যে, আজটেকরা নাকি সূর্যকে অব্যাহত রাখতে মানুষ বলি দিতো। সভ্যতার অগ্রযাত্রা ঠিক রাখতে পশ্চিমা আধুনিকতার যা কিছু [বলি দেওয়া] দরকার তাই বলি দেয় (আর এটা স্বীকৃতও)। শব্দটির পরিণতি (এবং এটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বয়ান) মানবতার [ধারণার] উৎস থেকে, এর আধুনিক (এবং উত্তরাধুনিক) সময় ও রূপের দিকে ছড়িয়ে পড়া, ইতিহাসের এক সত্তাতত্ত্বের [ontology] উদ্ভাবনে গিয়ে ঠেকে। সম্প্রতি সংজ্ঞায়িত নয়া জমানা, দ্য অ্যানথ্রোপোসিন, মানবপ্রজাতির একপাক্ষিক বিশ্বজনীন “ইতিহাসের” বৈজ্ঞানিক কাহিনিকল্প ব্যতীত আর কিছু নয়। ফলে, আধুনিকতার ধারণা ঘিরে গড়ে ওঠা কল্পলোক থেকেই তা উদ্ভূত।

পশ্চিমা সভ্যতার আত্মা রূপায়ণকারী হিসেবে ঠিক কোন সময় থেকে আধুনিকতা শব্দটি পরিচিতি লাভ করে তা স্পষ্ট নয়, যদিও এর ভাব ও অনুভবের গোঁড়া রেনেসাঁ ও নতুনত্বের ধারণার মাঝে খুঁজে পাওয়া যায়। এর প্রথম ব্যবহারের কৃতিত্ব দেওয়া হয় শার্ল বোদলেয়ারকে—বিশেষভাবে, তার ১৮৬৪ সালের “আধুনিক জীবনের চিত্রকর” প্রবন্ধটিকে। নিশ্চিতভাবেই বোদলেয়ার কেবল তার ইউরোপীয় অভিজ্ঞতার আলোকেই [তা] লিখেছেন। প্রবন্ধটির চতুর্থ অংশে, শিরোনাম “আধুনিকতা”, বোদলেয়ার তার গদ্যে এমন এক প্রতিকৃতির স্বভাবকে ধরতে চেয়েছেন, যাকে ঠিক একজন আর্টিস্ট [শিল্পী], কিংবা একজন ড্যান্ডি [ফুলবাবু], কিংবা একজন ফ্ল্যানোর [ভবঘুরে] বলা যায় না, কারণ তার সংবেদনশীলতা এই বর্গগুলোকেও ছাপিয়ে যায়। বোদলেয়ার প্রস্তাব করেন যে, এই অতি আধুনিক মানুষগুলোকে বলা যায় “জীবনের প্রেমিক” এবং তার সম্পর্কে লিখেন:

আর তাই, হাঁটা কিংবা গতিবৃদ্ধি তার, সে চলে আপন পথে, নিয়ত অন্বেষণে; কীসের অন্বেষণে? আমরা হয়তো অবশেষে আশ্বস্থ হতে পারি যে, এই মানুষটা, যেমন আমি তাকে নিয়ে বলেছি, এই নিঃসঙ্গ মর [mortal] জন্মসূত্রেই এক জাগ্রত কল্পনাপ্রতিভার সঙ্গে গাঁথা, সদা বিচরণশীল মানুষের বিশাল মরুতে, ডাহা [pure] কোনো অলসের চেয়ে আছে তার মহত্তর এক সংকল্প, অধিকতর এক সর্বজনীন লক্ষ্য, এছাড়াও [আছে] পরিপার্শ্বের ক্ষণস্থায়ী আনন্দ। সে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই অসংজ্ঞায়িত কিছু, যুৎসই একটি পরিভাষার অভাবে প্রশ্নের ধারণাটিকে ব্যক্ত করতে আমরা যাকে বলতে পারি ‘‘আধুনিকতা’’। যে কাব্য ভরা আছে তার ঐতিহাসিক খামে, তার কেতা [fashion] থেকে নির্যাস সংগ্রহ, ক্ষণিক থেকে পরমকে পাতিত করাই তার লক্ষ্য।

কিছু কিছু বিন্দুতে, আধুনিকতা কল্পিত হয়েছে ঐতিহ্যের সঙ্গে তফাতহীনভাবে [contradistinction]। আধুনিকতা ও ঐতিহ্য আধুনিক দুটি ধারণা, দুটি সত্তাতত্ত্বনয়, একটি আধুনিক আর অপরটি প্রাকআধুনিক। আধুনিকতাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে [সব] বানানো কথা [fictional narratives] দিয়ে, আধুনিকতা স্বয়ং যেখানে [এর] প্রধান চরিত্র, শব্দটি একটি ঐতিহাসিক পর্ব এবং আর্থসামাজিক সংগঠনের পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট বিষয়ী ও বিষয়ীত্ব [subjectivities] নিরূপণকারী একপ্রস্থ মানদণ্ডকে নামাঙ্কিত করে। বানানো কথাই [fiction] হয়ে ওঠে বাস্তব। এসকল কথায়, ঐতিহ্য ব্যাখ্যাত হয়েছে আধুনিকতার অভ্যাগমে পুরোগামী এক পর্ব হিসেবে। এসব বয়ানে, উপনিবেশিকতা সর্বদাই অনুপস্থিত, আর তাই “ঐতিহ্য” উপনিবেশিকতার লুকানো যুক্তিটাকেই বাস্তবায়িত করে, [ঠিক] যেভাবে আধুনিকতার অলংকৃতি [rhetoric] কাজ করে।

এই সকল নির্মিতি [constructions] যখন বিউপনিবেশিকভাবে বিশ্লেষিত হয় (যা জ্ঞান ও বিষয়ীত্বের [subjectivities] বিউপনিবেশায়নের একটি উপায়)—অর্থাৎ, আধুনিকতাকে উপনিবেশিকতার যুক্তি দিয়ে দেখন—ঐতিহ্য তার সমস্ত স্পষ্টতা নিয়ে আধুনিকতার চিন্তা ও কল্পলোক [imaginary] নির্মাণপ্রক্রিয়ায় উদ্ভাবিত এক পরিভাষা হিসেবে হাজির হয়। অপরপক্ষে, এটি যখন বিশ্বাস করানো গেলো যে, এটি ঐতিহাসিক পর্বে পরিগঠিত ও জীবনযাপনের কল্যাণকর (আধুনিক) উপায়, আধুনিকতা সদাই [এমনভাবে] অলংকৃত হয়েছে যেন তা ছিলো বিশ্বজনীন, আর তাই বিশ্বজুড়ে এর প্রসার ঘটাতে হবে: এটা ধরে নেওয়া হয়েছিলো যে, গ্রহের বাদবাকি অংশও আধুনিকতার পথে অনুরূপ ঐতিহাসিক ক্রমোন্মোচন প্রক্রিয়ার অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় শামিল, আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি ইউরোপের অনুরূপ পর্যায়ের মধ্য দিয়েই যাবে। পশ্চিম ইউরোপ আর সাম্প্রতিক কালের যুক্তরাষ্ট্র ছিলো গ্রহের বাদবাকি অংশের গন্তব্যস্থল। [অর্থাৎ] একই উপায়ে সংগঠিত হবে সমাজ, আর বিষয়ী ও বিষয়ীত্ব সকলই হবে ইউরোপীয় অনুকৃতি। নিঃসন্দেহে উদ্ভট কাহিনি, কিন্তুএখনও তা আমাদের অধিকার করে রেখেছে। উপনিবেশিকতার পরিসমাপ্তি ঘটেনি; এটি সর্বত্রই বিরাজমান।১৮

কারো কাছে, ইউরোপীয় আলোকায়নই [enlightenment] আধুনিকতার উৎসস্থল। অন্যদের কাছে, ইউরোপীয় রেনেসাঁ [renaissance] থেকেই এর উৎপত্তি। খোদ রেনেসাঁ সময়ের প্রেক্ষিতে পরিবর্তন নির্দেশক একটি ধারণা ও ভাবনা—হয় সেটি, নয় পুনর্জন্ম ও অগ্রসরমানতা। উভয়ই আমাদের আধুনিক/ ঔপনিবেশিক বিশ্বব্যবস্থার আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, আর এর দুটি মৌলধারণা: আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা। সৃষ্টিজগতের জন্ম থেকে লয়, শেষ বিচারের দিন ও চূড়ান্ত পরিত্রাণের [লক্ষ্যে] সম্মুখাভিমুখী যাত্রা ছিলো ইতোমধ্যেই এক খ্রিস্টীয় উদ্দেশ্যবাদ [teleology]। পুনর্জন্ম যদিও খ্রিস্টীয় বিশ্বতত্ত্বে [cosmology] গড়ে ওঠেনি। এটি ছিলো একটি জায়মান ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী [orientation] থেকে উদ্ভূত এক ভাবনা, আরও তিন শতক পরে, ইউরোপীয় আলোকায়নে যা পরিণতি লাভ করবে। রেনেসাঁর পার্থিব প্রবণতাসমূহের মধ্যে এটি ছিলোই—প্রগতির ভাবনা যাকে [আরও] পরিণত করে। এভাবেই, প্রগতির ভাবনা, আজকাল আমরা যেমন বুঝি, পশ্চিমা শব্দভাণ্ডারে প্রবেশ করেছিলো প্রথমবারের মতো: “চোদ্দো শতকের শেষাশেষি, প্রাচীন ফরাসি progres থেকে (আধুনিক ফরাসি progrès), ‘চলমানতা, সম্মুখপানে পদচারণা,’ ল্যাটিন progressus থেকে ‘সম্মুখ যাত্রা’, progrediএর পুরাঘটিত অতীত থেকে। ইংরেজিতে এর প্রাথমিক ব্যবহার ছিলো বিশেষত ‘রয়্যালটির বিনিময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত যাত্রা’। এর ‘সমৃদ্ধি, উন্নয়ন ও উচ্চ পর্যায়ের দিকে অগ্রসরমানতা’র আলঙ্কারিক [figurative] অর্থটির চল হয় আনুমানিক ষোলো শতক থেকে।”১৯

রঙ্গমঞ্চে উত্তরাধুনিকতার প্রবেশ ঘটে আধুনিক কল্পলোকের বহুবিধ অনুমানের সমালোচনাস্বরূপ, দীর্ঘবয়ানের চাহিদা সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। উত্তরাধুনিক আধুনিকতার সমালোচনা করে, তবে, তার উৎপত্তি [কিন্তু] চিন কিংবা নামিবিয়া, উজবেকিস্তান কিংবা বলিভিয়া নয়। আধুনিকতা শব্দটি যেখানে প্রথম আবির্ভূত হয়েছিলো, ঠিক যা হওয়ার কথা, তার উদ্ভবও ঘটেছিলো অনুরূপ জায়গায়: ফ্রান্সে। কিন্তু উত্তরাধুনিকতা কেবল উত্তর আটলান্টিকের আধুনিকতার প্রতি সমালোচনামূলক অবস্থানই নির্দেশ করেনি, আর করেও না। জঁফ্রাঁসোয়া লিওতারের উত্তরাধুনিকতার ধারণা ও ফ্রেডরিক জেমসনের চূড়ান্ত পুঁজিবাদের যুক্তি সম্পর্কিত তত্ত্বানুসারে, এটি দাবি করে যে, আমাদের সকলেই, “আমরা,” এই গ্রহে উত্তরাধুনিক সময়ে বাস করছি। অন্যভাবে বললে, ইতিহাস বিষয়ক পশ্চিমের নির্দিষ্ট সত্তাতত্ত্ব [ontology] অনবরতই এর বিশ্বজনীনতার দাবি জানায়। [এর] সাম্প্রতিক পরিণতিসমূহের একটি হলো অধিমানবএর [posthuman] বিশ্বজনীনতা, যা ধরেই নেয় যে গ্রহের সকলেই অধিমানব যেখানে, বাস্তবতা হলো, আধুনিকতা জনংসখ্যার অধিকাংশকেই অবনমনের দ্বারা ঊনমানব [quasi-human] করে রেখেছে (সপ্তম অধ্যায় দেখুন)

বিউপনিবেশায়ন পরবর্তী বিউপনিবেশিকতা প্রসঙ্গে

তর্কটি বিউপনিবেশায়ন ও বিউপনিবেশিকতার অর্থ সম্পর্কিত বিচারবিশ্লেষণ পর্যন্ত গড়িয়েছিলো। বিউপনিবেশায়ন যেসময়ে বিউপনিবেশিকতায় পরিবৃত্তি [mutation] লাভ করে, অনুরূপ সময়েই উপনিবেশিকতার ধারণায়ন [conceptualization] ও বিশ্লেষণ—চিন্তনের, আর তাই যাপনের, করণের ও আস্বাদনেরও [sensing] এক বিউপনিবেশিক উপায়—অস্তিত্ব লাভ করেছিলো । নিষ্করণও [undoing] একটা কিছুর করণ; বিযুক্তকরণ [delinking] ধরে নেয় আর কিছুর সঙ্গে পুনর্যোজন [relinking]। ফলে, বিউপনিবেশিকতা হলো নিষ্করণ ও পুনর্করণ [redoing]; এটি যাপন [praxis]। নিষ্করণের পরেই আসে পুনর্করণ: পুনরস্তিত্ব [re-existence], প্রথম ভাগের প্রথম অধ্যায়ে ওয়ালশ [ক্যাথারিন] যেমন আলোচনা করেছেন। আমার মতে বিউপনিবেশিকতার লক্ষ্য হলো বিযুক্তকরণ, কীসের জন্য বিযুক্তকরণ? জ্ঞানতাত্ত্বিক পুনর্গঠন (কিহানো [Quijano]), পুনরস্তিমানতায় [re-existing] (কেবল প্রতিরোধ নয়, অ্যাদলফো আলবান আচিন্তে [Adolfo Albán Achinte]) নিযুক্ত হওয়া, আধুনিকতার নকশা ও কামনার এবং জাতির অতীত নিয়ে জাতীয়তাবাদীদের ফয়সালায় [selection] জিম্মি হওয়ার চেয়ে জীবনের যে রকমটাকে আমরা রক্ষা করতে চাই—তাতে নিয়োজিত হওয়া; কানাডায় আদিবাসীদের চাহিদা ও ধারণার পুনর্জাগরণ (লিন সিম্পসন [Leanne Simpson]); এবং সবশেষে কিন্তু [গুরুত্ববিবেচনায়] তুচ্ছ নয়—আর পরিসর আলাদা হলেও, বিযুক্তকরণের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি একই—সাংস্কৃতিক বিপশ্চিমায়ন [dewesternization] ও রাজনৈতিক পুনরাবির্ভাব [re-emergence], শারজাহ দ্বিবার্ষিকে [Sharjah Biennial] যেমন গ্রথিত হয়েছে (ইউকো হাসেগাঁওয়া [Yuko Hasegawa])। দশম অধ্যায়ে এসব আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি।২০

রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নেওয়া” নয় বরং জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বিষয়ীগত পুনর্নিমাণে আত্মনিয়োগই ছিলো এর লক্ষ্য (ষষ্ঠ অধ্যায়ে দেখুন)। কিহানো তার ভিত্তিস্থাপনকারী প্রবন্ধটিতে বিউপনিবেশায়ন শব্দটি ব্যবহার করলেও, স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে শব্দটা যে অর্থ নির্দেশ করতো, তার আলোচনা তা বদলে দেয়। অন্তর্জালিক ব্যুৎপত্তি অভিধান নির্দেশ করে যে, পরিভাষাটির রাজনীতিক অর্থ ১৮৫৩ সালের, আর ব্যাখ্যা দেয় যে, আগে এটি ছিলো এক চিকিৎশাস্ত্রীয় পরিভাষা। এই সম্পর্কে আর কিছু বলা হয় না, কিন্তু [ঠিকই] কেউ কল্পনা করে নিতে পারে যে, এটি পড়ষড়হএর সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলো। তুমি যখন গুগল করবে “decolonization, definition”, সবার আগে তুমি খুঁজে পাবে এই Wikipedia I Britannica.com: “বিউপনিবেশায়ন [decolonization] (US) বা বিউপনিবেশায়ন [decolonisation] (UK) হলো উপনিবেশের বিনাশ, যেখানে একটি রাষ্ট্র নির্ভরশীল অঞ্চলসমূহের ওপর এর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ও তা টিকিয়ে রাখে” (Wikipedia)। “যে প্রক্রিয়ায় উপনিবেশসমূহ উপনিবেশক দেশসমূহ থেকে স্বাধীন হয়ে ওঠে। মোটাদাগে প্রবাসীদের দ্বারা সংস্থাপিত ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে বিউপনিবেশায়ন ছিলো ক্রমিক ও শান্তিপূর্ণ কিন্তু স্বদেশী বিদ্রোহীরা যেখানে জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত ছিলো সেখানে তা ছিলো সংঘাতময়” (Britannica.com)। কিহানোর আলোচনাতে, বিউপনিবেশায়ন এক বিকল্প পথ পরিগ্রহ করে এবং কিছুটা সংশ্লিষ্ট হলেও নির্দেশ করে ভিন্ন অর্থ:

যৌক্তিকতা/ আধুনিকতার ইউরোপীয় চিন্তাকাঠামোর সমালোচনা করাটা অত্যাবশ্যকীয়—এমনকি, আশু কর্তব্যও বটে। কিন্তু সমালোচনাটা যদি হয়—এর সকল বর্গসমূহের সরল নেতিকরণ, বয়ান থেকে বাস্তবতার অবসান, বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে সমগ্রতার ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিশুদ্ধ নেতিকরণ, তাহলে তা মুশকিলের ব্যাপার। যৌক্তিকতা/ আধুনিকতা ও উপনিবেশিকতার মধ্যেকার যে সংযোগ—তা থেকে নিজেকে মুক্ত করাটা জরুরি. . . অভিজ্ঞতা ও ভাব বিনিময়ের পথকে প্রশস্ত করতে, নয়া আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায়, যৌক্তিকতার আরেক ভিত্তিস্বরূপ, বিউপনিবেশিকতা হিসেবে, প্রয়োজন জ্ঞানতাত্ত্বিক বিউপনিবেশায়ন যা হয়েতো বৈধভাবেই কতিপয় বিশ্বজনীনতা দাবি জানাবে। নির্দিষ্ট কোনো নৃগোষ্ঠীর বিশেষ বিশ্ববীক্ষাকে বিশ্বজনীন যৌক্তিকতাস্বরূপ দাবি করার চেয়ে, পরিশেষে, অযৌক্তিক আর কিছুই হতে পারে না, এমনকি এইধরনের কোনো নৃগোষ্ঠীকে যদি পশ্চিমইউরোপ নামেও ডাকা হয়—কেননা, এটি আসলে প্রাদেশিকতাকেই বিশ্বজনীনতা রূপে আরোপণের দাবি করা।২১

যেসকল নৃগোষ্ঠী ইউরোপীয় ভাবাদর্শের আলোকে তাদের কল্পলোক (imaginary) গড়ে নিয়েছিলো, তারাও স্থানীয়ই [indigenous] ছিলো। যাইহোক, তাদের নিজস্ব শব্দভাণ্ডারই আমাদের জানায়, ইউরোপের বাইরে কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা স্থানে উদ্ভূত জনগোষ্ঠীই হলো স্থানীয়। কিন্তু, আধুনিকতার অলংকৃতি [rhetoric] আমাদের বিশ্বাস তৈরি করেছে যে, স্থানীয়রা ছিলো অইউরোপীয়, সভ্য ও উন্নত হওয়ার জন্য যাদের প্রয়োজন ইউরোপীয় বিশ্বজনীন ধর্ম, ধর্মনিরপেক্ষ বিজ্ঞান ও দর্শন; অর্থাৎ, [যা কিছু] আধুনিক। বিউপনিবেশায়নের পরে বিউপনিবেশিকতার কাজ হলো, রাষ্ট্রের চেয়ে জ্ঞানতত্ত্বএবং জ্ঞানের প্রতি নিবিষ্ট হওয়া ও তার পুনর্নির্ধারণ [redefined] করা; অথবা, পশ্চিমা রাজনৈতিক তত্ত্বেরাষ্ট্রের ধারণাটিকেই যা টিকিয়ে রাখে [তার পর্যালোচনা]। এখনও এটি বাতিল করা [undo] বোঝায়, কিন্তু সেই নিষ্করণ [undoing] আরম্ভ হয় “বিউপনিবেশিকতা হিসেবে জ্ঞানতাত্ত্বিক বিউপনিবেশায়ন” থেকে। এবং এটি আধুনিক রাষ্ট্র ও পুঁজিবাদী অর্থনীতি থেকে বিযুক্ত জীবনযাপনের এক অনুশীলন [praxis] ও সমবায়ী সংস্থা গড়ে তোলা বোঝায়। আমি যা বলতে চাই, সাপাতিস্তারা [Zapatista] তার একটি ভালো উদাহরণ, যদিও বৈশ্বিকভাবে “প্রয়োগ” করার ক্ষেত্রে এটিকে কোনো “আদর্শ” হিসেবে গ্রহণ করা [ঠিক] হবে না। সাপাতিস্তারাও তোমাকে এইই বলবে। যা অনুসরণ করতে হবে তা হলো, তারা কী করেছিলো এবং করতেছে, এটা নয় যে কীভাবে তা করেছিলো, কেননা, কীভাবে [প্রশ্নটি] স্থানীয় ভূরাজনৈতিক ও দেহরাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

আদতে বিউপনিবেশায়ন বলতে, একটি উপনিবেশের স্বনির্ভরতা, স্বাধীনতা ও সাবেক উপনিবেশিতের নিজস্ব এক রাষ্ট্রনির্মাণকে সমর্থন করতে, তাকে মুক্তি দেওয়া বোঝানো হতো। সুপ্ত জিজ্ঞাসাটি ছিলো এ: বিউপনিবেশায়নের কারিন্দা [agent] ছিলো কে? এটাই অনুমিত [assumed] যে উপনিবেশকেরা এই ভূমিকায় ছিলো না—বলা হয়, আলজেরিয়াকে ফ্রান্সের বিউপনিবেশিতকরণ—সেটা ছিলো উপনিবেশের পরিসমাপ্তি; স্থানীয় বা আলজেরীয়রাই কিন্তু ফরাসি ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী/ ঔপনিবেশিক আধিপত্যকে রুখে দিচ্ছিলো। পরে কী ঘটেছিলো তা ভিন্ন তর্কের বিষয়বস্তু।

এই অর্থে, বিউপনিবেশায়ন ছিলো বহুল প্রসারিত এবং এশিয়া ও আফ্রিকার স্বাধীনতাসংগ্রামসমূহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বিউপনিবেশায়ন এবং স্বাধীনতা আধুনিকতার আঠারো শতকীয় অলংকৃতির লাগসই শব্দাবলি শৃঙ্খলমোচন ও মুক্তি থেকে পৃথক অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে। আগেরটা আসন্ন বৈশ্বিক রাজনৈতিক সমাজের অভিব্যক্তি [expressions], আর পরেরটা আঠারো শতকের ইউরোপে আসন্ন ইউরোপীয়, বুর্জোয়া, শ্রেণিগোষ্ঠীর অভিব্যক্তি। আঠারো শতক প্রত্যক্ষ করেছে আসন্ন এক বুর্জোয়া শ্রেণিগোষ্ঠীর ধর্মনিরপেক্ষ শৃঙ্খলমোচন যা—বিশ শতকের প্রথমার্ধের মধ্যেই—অর্ধেক গ্রহ, “মানুষ ও প্রাকৃতিক উৎসসমূহের” উপনিবেশিকরণপূর্বক বৈশ্বিক/ সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াতন্ত্রে পরিণত হয়।২২

কিহানোর পরে এটা পরিষ্কার যে, বিউপনিবেশায়নের দায়সারা [cursory] ব্যাখ্যাটা—যার উল্লেখ আমি উপরে করেছি—বিউপনিবেশায়নকে উপনিবেশবাদের নিরসন [undoing] বলে হাজির করে এবং উপনিবেশবাদকে ব্যাখ্যা করা হয়েছিলো নির্ভরশীল অঞ্চলসমূহের ওপর একটি জাতিরাষ্ট্রের আধিপত্যপ্রতিষ্ঠা ও তা জিইয়ে রাখা হিসেবে। এই ব্যাখ্যায় মেলা অস্পষ্টতা আছে; এটি নির্দিষ্ট করে বলে না—কোন ধরনের জাতি, কোন অঞ্চলগুলো, কখন এবং কোথায়। যাইহোক, ১৯৪৫ সালের পরে, বিউপনিবেশায়নের ধারণাটি যখন সাধারণভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে, এটাই প্রতীয়মান হলো যে, আলোচনাধীন রাষ্ট্রসমূহ স্প্যানিশ বা ব্রিটিশ রাজ্য ছিলো না, বরং তা ছিলো মহিমান্বিত ফরাসি বিপ্লবপরবর্তী সময়ে আবির্ভূত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। শব্দ, ঘটনা ও প্রপঞ্চসমূহের [phenomena] ধারণাগত বিশ্লেষণ [elucidation] যে জরুরি—আবারও এটাই প্রমাণ করার মধ্য দিয়ে বিউপনিবেশায়নকে, অতি সম্প্রতি, বিপ্লব (যেমন, আমেরিকা ও হাইতির বিপ্লব) ও স্বাধীনতা সংগ্রামের (যেমন, ঊনিশ শতকে স্পেন ও পর্তুগালের কাছ থেকে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার দেশগুলোর স্বাধীনতা অর্জন) মতো পুরোনো ঘটনাবলির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে। এভাবে বুঝলে, বিউপনিবেশিকতার পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিউপনিবেশায়ন পুনর্মূল্যায়িত হয়।

যা আমাদের বিপ্লব শব্দটির দিকে ঠেলে দেয়। এটি ইউরোপীয় উপনিবেশসমূহে আমেরিকা ও হাইতির বিপ্লব এবং [খোদ] ইউরোপের মহিমান্বিত ফরাসি বিপ্লব—উভয়কে বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়।২৩ ইউরোপের অভ্যন্তরে আর বাইরের উপনিবেশগুলোতে সংঘটিত বিপ্লবসমূহ সমগোত্রীয় নয়। ফলে, হাইতীয় ও যুক্তরাষ্ট্রীয় উত্থানসমূহকে বিউপনিবেশায়ন (স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে শব্দটি যে অর্থ লাভ করেছে) নাম দেওয়া ও তাদের ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ মোকাবিলার পরিণতি রূপে চিহ্নিত করাতেই অধিকতর অর্থ তৈরি হয়। পরিবর্তে, মহিমান্বিত ফরাসি বিপ্লবকে বিউপনিবেশায়নের ঘটনা বলে বর্ণনা করাটা [ঠিক] অর্থপূর্ণ হবে না। এভাবে, বিপ্লবও বিউপনিবেশিকভাবে পুনর্সংজ্ঞায়িত হয়ে যায়।

১৫০০ সালে উদ্ভূত বিশ্বব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ও প্রথম ধাপের এই সকল বিপ্লব/ বিউপনিবেশায়নের সমজাতীয়করণ [homogenizing], গল্পটির মাত্র অর্ধাংশকেই সমগ্র হিসেবে পেশ করে: আধুনিকতা সেই আদ্ধেক গল্পেরই আত্মরচিত অভিসন্ধি [idea]। এই উপায়ে তাদের সমজাতীয় করার ফলে, সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক এই দুইয়ের ঐতিহাসিক সম্বন্ধের ভেতর যে পার্থক্য ও সংশ্লিষ্টতা [entanglements]—তা বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে। একবার এক ফারাক তৈরি হয়ে গেলে, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের পৃথক ঠিকুজি [lineages] স্পষ্ট হয়ে যাবে। আর এভাবেই উপনিবেশিকতা, আধুনিকতার লুকানো ও অন্ধকার দিক: উপনিবেশগুলোতে [সংঘটিত] বিপ্লব ও স্বাধীনতাসংগ্রামসমূহ বাহ্যিক উপনিবেশিকতাকে (উপনিবেশসমূহের ওপর ইউরোপীয়দের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ) বদলে দিয়েছিলো অন্তরীণ [internal] উপনিবেশিকতায় (আধুনিকতার ইউরোপীয় চিত্রনাট্য অবলম্বনে স্থানীয় অভিজাতদের তত্ত্বাবধানে ঔপনিবেশিক জাতিরাষ্ট্রের নির্মাণ)

বিউপনিবেশায়ন শব্দটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, যদি না জরুরি ভিত্তিতে উদ্ভাবিত হয়ে থাকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। [আর] একবার যখন শব্দটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো, অতীতের সমধর্মী প্রপঞ্চসমূহে ভূতাপেক্ষিকভাবে [retrospectively] তা প্রয়োগ হতে থাকলো। [এর] প্রাসঙ্গিক দৃষ্টান্ত হলো, বিপ্লবের দিকে আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের বিপ্লব ও স্বাধীনতা সংগ্রামের (বা বিউপনিবেশায়নের প্রথম ধাপ) লক্ষ্যপথ [trajectory] পৃথক ও বিপরীত। আধুনিক স্বদেশি ভাষায় ‘revolution’ শব্দটি এসেছে, লাতিন revolutio থেকে; [যার অর্থ] চতুর্দিকে পাঁক খাওয়া, গ্রহ যেমন সূর্যকে ঘিরে পাঁক খায়; পরে রাজনৈতিকঅর্থনৈতিক সংস্থায় মৌলিক পরিবর্তন বোঝাতে এবং সাংস্কৃতিক ও বিষয়ীত্বের [subjectivity] রূপান্তর নির্দেশ করতে সামাজিক ইতিহাসে এর প্রয়োগ হতে থাকে। বিউপনিবেশায়নের (মূলত বলা হয় বিপ্লব ও স্বাধীনতা) প্রথম ধাপটি সংঘটিত হয়েছিলো আমেরিকায় (উত্তর, দক্ষিণ, মধ্য ও ক্যারিবীয়), আর তার নেতৃত্বে ছিলো ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত ক্রেওল/ মেস্তিজো কুশীলববৃন্দ [actors] (থমাস জেফারসন [Thomas Jefferson], সিমন বলিভার [Simón Bolívar], হোসে দে স্যান মার্টিন [José de San Martín], ফ্রান্সিসকো দে মিরান্দা [Francisco de Miranda])। এক্ষেত্রে হাইতির বিপ্লব ছিলো ব্যতিক্রম, যার কুশীলবেরা ছিলেন আফ্রিকীয় বংশোদ্ভূত, আর কিছু আফ্রিকীয়রা স্বয়ং (জন্ম যাদের হাইতিতে নয়)। পেরুর ভাইসরয়্যালটিতে [viceroyalty] তুপাক আমারু [Túpac Amaru] ও তুপাক কাতারির [Túpac Katari] অভ্যুত্থানগুলোকে দমন করা হয়েছিলো, হাইতির বিপ্লবীদের তা দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। স্নায়ুযুদ্ধের সময় শব্দটি যে অর্থ লাভ করে, সেই অর্থে এই বিদ্রোহগুলো নিঃসন্দেহে বিউপনিবেশায়নের জন্য সংগ্রাম। যাইহোক, হাইতির বিপ্লবের সঙ্গে [এগুলোর] বৈপরীত্যটা ছিলো, সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পূর্বেই তাদের রুখে দেওয়া হয়েছিলো। উভয় সংগ্রামই [পরস্পর] সংযুক্ত ছিলো, হাইতির বিপ্লবের পর দ্বীপটির নাম সন্তডোমিঙ্গো [Saint-Domingue] থেকে স্থানীয় নাম আইতি [Ayiti] রাখাই তার প্রমাণ। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে জাতিরাষ্ট্রের গঠনই বিউপনিবেশায়নের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের মধ্যেকার ঐক্যের জায়গা [common ground]২৪

বিউপনিবেশায়নের প্রথম ধাপটি, আমেরিকাতে সেই একই যুক্তির প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ঘটেছিলো, এশিয়া ও আফ্রিকাতে দ্বিতীয় ধাপটিকেও যা প্রণোদিত করে: এই উভয় শ্রেণির বিউপনিবেশিক সংগ্রামই বিভিন্ন ঐতিহাসিক মুহূর্তে, ফলে, আধুনিকতার বিবিধ অলংকৃতি ও উপনিবেশিকতার যুক্তি বাস্তবায়নের [implementation] শর্তে উদ্ভূত। প্রথম ধাপটি, ইউরোপের অভ্যন্তরেই সাম্রাজ্যের হাতবদলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট: স্পেন ও পর্তুগালের [হাত] থেকে হল্যান্ড, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, আর জার্মানির কাছে। আধুনিকতার অলংকৃতির ভিত্তি ছিলো প্রগতি ও সভ্যতা। দ্বিতীয় ধাপটি, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সাম্রাজ্যের হাতবদলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট [corresponded] ছিলো। আধুনিকতার অলংকৃতি দাঁড় করানো হয়েছিলো উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন দিয়ে। [এই] দুইয়ের মাঝামাঝি, রাশিয়ার বিপ্লবটি, উদারনৈতিকতাবাদ ও সাম্যবাদ [communism] উভয়কেই খারিজ করার মাধ্যমে, নাছিলো আগেরটির উদারনৈতিক মতাদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত কোনো বিপ্লব, নাছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ের বিউপনিবেশায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।২৫ প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের বিউপনিবেশায়নের মধ্যেকার পার্থক্য ছিলো স্পষ্ট, আর সেই পার্থক্যসমূহ ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার (CMP) সুনির্দিষ্ট রূপান্তরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলো। এই পার্থক্যসমূহ কেবল স্থানীয়ই ছিলো না, ছিলো বৈশ্বিকও। প্রথম ধাপটি, স্প্যানিশ চার্চ ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলো ও তার প্রতিফল হয়েছিলো। আর এই অর্থে, এটি ছিলো চার্চ ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধেই কেবল নয়, স্প্যানিশ চার্চ ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে—ব্রিটেনের মহান বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবের সমান্তরাল। বিউপনিবেশায়নের প্রথম ধাপটি সাম্রাজ্যিক ধারাটির সমান্তরালে ধাবিত হয়েছিলো। সমান্তরাল, তবে আশ্রিত! আফ্রিকা ও এশিয়াতে বিউপনিবেশায়নের দ্বিতীয় ধাপটি ছিলো, ইতোমধ্যেই বিরাজমান আধুনিক বুর্জোয়া ও ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্র (প্রধানত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আর হল্যান্ড) কর্তৃক প্রবর্তিত উপনিবেশিকতার প্রতিক্রিয়া, কিন্তু তা চালু হয়েছিলো স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের দ্বারা—আমেরিকার মতো ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত ক্রেওল ও মেস্তিজোদের দ্বারা নয়, হাইতির ব্যতিক্রমটি বিবেচনায় নিয়েই [বলা]

চার্চ ও রাজতন্ত্রকে মোকাবিলার জায়গা থেকে প্রথম ধাপটি যেখানে অংশত ইউরোপীয় বিপ্লবের (মহিমান্বিত ও ফরাসি) সমান্তরাল ছিলো, [সেখানে] দ্বিতীয় ধাপটি পরিচালিত হয়েছিলো মহিমান্বিত ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী ও বুর্জোয়া জাতিরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। মহিমান্বিত ফরাসি বিপ্লব ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্রসমূহের উত্থানের শর্ত প্রস্তুত করেছিলো, একইসঙ্গে আমেরিকায় তা পোক্ত করেছিলো প্রথম আধুনিকঔপনিবেশিক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক ভিত, আর দীর্ঘমেয়াদে প্রণোদনা জুগিয়েছিলো এশিয়া ও আফ্রিকায় দ্বিতীয় ধাপের উপনিবেশায়নে। আমেরিকায় প্রথম ধাপ এবং এশিয়া ও আফ্রিকায় দ্বিতীয় ধাপ, উভয় বিউপনিবেশায়নই উপনিবেশিকতার যুক্তিকে অক্ষত রেখে দিয়েছে। পরিবর্তন এসেছিলো আধেয়তে [content], আলাপচারিতার ধরনে [terms] নয়। বিউপনিবেশায়নের এই খামতি [shortcoming] থেকেই বিউপনিবেশিকতার উদ্ভব।

যে ঐতিহাসিক বিকল্পসড়ক [detour] আমি ধরলাম, বিউপনিবেশায়ন থেকে বিউপনিবেশিকতার রূপান্তর ও ‘বি-’ এবং ‘উত্তর-’ এর ফারাক বোঝার জন্য—তা জরুরি ছিলো। আধেয় ও প্রবিধানের [regulations] রূপান্তর সত্ত্বেও জ্ঞানের উপনিবেশিকতা সকল ক্ষেত্রেই রয়ে গেছে—আমেরিকাতে—বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘর, মঠ ও আশ্রমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। প্রাচীন সভ্যতাসমূহের (মায়া, ইনকা ও আজটেক) প্রজ্ঞা [wisdom] উৎপাদন ও হস্তান্তরে [transmit] নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানসমূহকে ধ্বংস করা হয়েছে। নিজ ভাষা ও গোত্রের জ্ঞান [knowledge] ও প্রজ্ঞা বিবর্জিত—পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষিত—দেশীয় বিদ্বান, বুদ্ধিজীবী ও সক্রিয়কর্মীদের [activist] সাম্প্রতিক আবির্ভাবের ফলে ও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের দ্বারা প্রধানত মৌখিক কথামালারই [conversations] হতাবশিষ্ট [survival] আজ অবধি টিকে আছে। আফ্রিকা ও এশিয়ার গল্প ছিলো আলাদা। চীন এবং ভারতবর্ষের বহু অঞ্চলে, যেখানে ইসলাম প্রবর্তিত হয়েছিলো, পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানসমূহকে বিদ্যমান স্থানীয় প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান, স্থানীয় ভাষা, বিশ্বাস ব্যবস্থা ও জীবনবিধানের সঙ্গে সহাবস্থান [coexist] (আগে আর পরে) করতে হয়েছিলো। পশ্চিমাকরণ সর্বদাই এক আধাআধি রাস্তা, পূর্বেও ছিলো আর এখনও আছে। বিপশ্চিমাকরণ ও বিউপনিবেশিকতা সেই শক্তি, জ্ঞান ও বিশ্বাস এবং জীবনানুশীলন থেকে উদ্ভূত—যা কখনোই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়নি। বিপশ্চিমাকরণ ও বিউপনিবেশিকতার মধ্যে ইতোমধ্যেই চিহ্নিত ফারাক থাকা সত্ত্বেও উভয়ের জন্যই, বিযুক্তকরণ সম্ভব, প্রান্তীয় চিন্তন [thinking] জরুরি। পুনরায় বললে: বিউপনিবেশিক বিষয়ীর [subjects] ভাবনা ভাবতে ও তা হয়ে ওঠার নিমিত্তে ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকা (CMP, ষষ্ঠ অধ্যায় দেখুন) থেকে বিযুক্ত হওয়াটাই বিউপনিবেশিকতার লক্ষ্য। কিন্তু বিযুক্তকরণ কেবলমাত্র প্রথম প্রদক্ষেপ। যা দাঁড়ায়, তা হলো বিউপনিবেশিকভাবে বাঁচা: অর্থাৎ, বিউপনিবেশিক বিকল্পসমূহের অনুমান [assuming] ও নিযুক্তি [engaging]। বিপশ্চিমাকরণ আন্তঃরাষ্ট্রচালিত [interstate-led] এক প্রকল্প, যা ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিবাদ করে, কিন্তু তার ভিত্তি তুলে প্রশ্ন ছোঁড়ে না।

আসল কথা হলো, বিউপনিবেশিকতা উপনিবেশের ধ্বংসাবশেষ থেকে সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র গঠনের (বিউপনিবেশায়ন) লক্ষ্য থেকে—রাষ্ট্রকাঠামো এবং কর্পোরেট ও আর্থিক কামনাবাসনার বাইরে—মুক্তির বিউপনিবেশিক দিগন্তের (বিউপনিবেশিকতা) লক্ষ্যে [তৎপরতার] ক্ষেত্রটাই বদলে দিয়েছে। আমি যা আলোচনা করতেছি, বছরের পর বছর ধরে সাপাতিস্তারা তা যাপন ও জানার অনুশীলনে নিয়োজিত।২৬ বিউপনিবেশিকতার কোনো মৌল রূপরেখা [master plan] ও প্রাধিকারপ্রাপ্ত [privileged] কুশীলব নেই। ঔপনিবেশিক ক্ষতসমূহের প্রচণ্ডতার মাপনী [scales] নিশ্চয়ই আছে। নিজেদের/ আমাদের যারা বিউপনিবেশিক চিন্তক, কুশীলব ও কর্মীরূপে [doers] সংগঠিত করে ও ক্রিয়া করে—বিউপনিবেশিকতা সেই সকল জনগণের আয়ত্তাধীন এক বহুমুখী [multifaceted] বৈশ্বিক উদ্যোগ। উপনিবেশিকতা যদি সর্বত্রই বিদ্যমান থাকে, বিউপনিবেশিক অনুশীলনও [praxis] তাহলে সর্বত্রই বিরাজমান। ফলে, বৈশ্বিক বিউপনিবেশিকতার জটিলতায় প্রাধিকারের অভিজ্ঞতার কোনো দাবি থাকতে পারে না।

ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের জটিল কাঠামোরূপে, উপনিবেশিকতাকে (CMP, ষষ্ঠ অধ্যায় দেখুন) বোঝার মাধ্যমে একজন উপলব্ধি করতে পারে যে, এটিই পশ্চিমা সভ্যতা ও ইউরোকেন্দ্রিকতার “অন্তর্নিহিত কাঠামো”, আর উপনিবেশিকতা থেকে বিযুক্ত হওয়ার জন্য, কীভাবে এটি কাজ করে সেই ব্যাপারে পরিষ্কার বোঝাপড়া থাকাটা—এক প্রয়োজনীয় শর্ত। ইউরোকেন্দ্রিকতা কোনো ভৌগোলিক সমস্যা নয়, বরং একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক, আর নন্দনতাত্ত্বিক (উদাহরণত, জ্ঞান ও বিষয়ীত্বের নিয়ন্ত্রণ) সমস্যা। তা [বিযুক্তকরণ] করার জন্য, ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার পর্যালোচনা—বিষয়ীগতভাবে [subjectively] ও কর্মসূচিগতভাবে [programmatically] তা থেকে বিযুক্তকরণ—এবং সমাভিমুখী আর সমান্তরাল প্রকল্প ও সংস্থাসমূহে নিযুক্তি, উভয় মাধ্যমেই বিউপনিবেশিকভাবে চিন্তা ও কাজ করা (করণ, অনুশীলন) জরুরি।

বিউপনিবেশিক বিযুক্তকরণের সবটা [যে] একবারেই হয়ে যাবে [তা] না, কিন্তু ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্র [domains], পর্যায় [levels] ও তোড় [flows] এবং বাদবাকি অংশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে সংহত করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রাধিকারপ্রাপ্ত অভিজাত, পুরোধা বুদ্ধিজীবী বা আত্মপরিচয়ের [ego-identity] রাজনীতিতাড়িত কোনো মৌল পরিকল্পনা নেই—কাজটাকে যা হাসিল করতে পারে। নাএটি সম্পন্ন হতে পারে রাষ্ট্রীয় রাজনীতি ও বিধিবিধান দ্বারা। তা সত্ত্বেও, সরকারের (বর্তমানের জাতিরাষ্ট্র নয়) একটি রাজনৈতিক কাঠামো এক্ষেত্রে দরকার, যা একইসঙ্গে শাসন ও আজ্ঞাপালন করবে (সাপাতিস্তারা তাই করে চলেছে) এবং জনগণের সংস্থা ও সৃষ্টিশীলতাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিবে, যাকে সমবায়ী বিউপনিবেশিক দিগন্তের একটি অংশ হিসেবে ভাবা চলে। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে, গ্রহজুড়ে ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার কর্তৃত্ব ও আধুনিকতার অলংকৃতির [rhetoric] ফাঁকা বুলি অমান্যকারী সংস্থার সংখ্যা বেড়েছে। করণের দিগন্তের জন্য চাই চিন্তনের দিগন্ত, যা একইসঙ্গে করণের যথার্থতারও দাবি জানায়।

নিঃসন্দেহে, বিযুক্তকরণের পথ এখন দুইটা: বিউপনিবেশিকতা আর বিপশ্চিমাকরণ। উভয়ক্ষেত্রেই, যদিও প্রান্ত আলাদা, জ্ঞানতাত্ত্বিক ও আবেগাত্মক (এবং নন্দনতাত্ত্বিক) বিযুক্তকরণ বলতে প্রাণের পরিষেবায় নিয়োজিত এবং জনগণকেই—বর্তমান অবস্থার মতো—প্রতিষ্ঠানের তাবেদারি করাবে না, এমন সব প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থার কল্পনা [conceiving] ও নির্মাণ করা বোঝায়। যা আমি বোঝাতে চাই, গ্রিস ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেকার সাম্প্রতিক দ্বন্দ্ব—এর একটি পরিষ্কার উদাহরণ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা বিধিবিধান ও প্রতিষ্ঠানসমূহ রক্ষা ও সংরক্ষণের পথ বেছে নিয়েছিলো, আর তাই গ্রিক জনগণের কল্যাণকে বিসর্জন দিয়েছে। প্রাণকে প্রতিষ্ঠানের তাবেদারিতে নিযুক্ত করা আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা, ইউরোকেন্দ্রিকতা এবং ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার মূলনীতি। এই ধরনের অনুমান থেকেই—বিউপনিবেশিক হয়ে ওঠা, চিন্তা করা, আর কাজ করার আরম্ভ।

অনুশীলনযোগ্য [praxical], ধারণাগত [conceptual] ও বিশ্লেষণধর্মী [analytic] কাজের গুরুত্বে আস্থাশীল দুইজন করে বিদ্বান, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী দ্বারা রচিত এই গ্রন্থমালা ইউনিভার্সিটি প্রেসের একটি প্রকাশনা। একটি গ্রন্থমালার সামর্থ্যরে সঙ্গে সঙ্গে আমরা তার সীমাবদ্ধতাও অনুমান করতে পারি, আর এটি কী করতে পেরেছে, আর কী পারেনি তা করার—দাবি করি না।

আমরা ওয়াকিবহাল যে, সংস্থাগুলো বহু স্থানে আর বিভিন্ন উপায়ে পুনর্কল্পিত [reimagined] ও পুনরুদ্ভাবিত [reinvented] হচ্ছে। তাদের কতোগুলোর মধ্যে বিউপনিবেশিক তাৎপর্য [import] ও ব্যাপ্তি [dimension] রয়েছে, যদিও বিউপনিবেশিক বলে নিজেদের তারা নাও সংজ্ঞায়িত করতে পারে, আর উপনিবেশিকতার নিম্নোক্ত ক্ষেত্রগুলোতে [সেগুলো] জ্ঞান, সত্তা, আর যৌথ [communal] সম্পর্কের নবরূপায়ণ করেই চলেছে:

পিতৃতান্ত্রিক/ পুরুষতান্ত্রিক (খ্রিস্টীয় বিশ্বতত্ত্বএবং শেতাঙ্গ জাতিসত্তা সমর্থিত) জানা, বোঝা, আর অনুভব নিয়ন্ত্রিত বর্ণবাদ ও যৌনতন্ত্র [sexism];

জগৎ ও সমাজের পিতৃতান্ত্রিক/ পুরুষতান্ত্রিক বোঝাপড়া তাড়িত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদী রূপরেখা;

বিশ্বজনীন লেবাসে হাজির স্থানীয় এক কল্পলোকশাসিত জ্ঞান ও বোঝাপড়া, যার মধ্যে পড়ে—বিজ্ঞান, দর্শন, নৈতিকতা, নন্দনতত্ত্ব, ধর্ম—আর অবশ্যই—অর্থনীতি এবং রাজনীতি (যেমন, ইউরোকেন্দ্রিকতা [Eurocentrism])

রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সংস্থিত [entrenched] প্রাণ, তা সকল দিক থেকেই, মানুষ থেকে শুরু করে গ্রহটির হৃৎস্পন্দনও পিতৃতান্ত্রিক/ পুরুষতান্ত্রিক কল্পলোক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

বিউপনিবেশিক বিকল্প প্রস্তাব করে—গবেষণা, আলোচনা [arguing], সম্পাদনা [doing] ও জীবনচর্চার সুনির্দিষ্ট আদল ও পরিচিতি। একটি সতর্কীকরণ [caveat] জরুরি: [কেননা] এই বিউপনিবেশিক চর্চাতেও আসলে কোনো নির্ঝঞ্ঝাট জায়গা নেই। বিউপনিবেশিকতা ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার যেকোনো পরিসরেই ব্যক্তিগত ফায়দার জন্য আবাহিত [invoke] হতে পারতো। আমি যাকে সাচ্চা বিউপনিবেশিক চর্চা বলে মনে করি, কোনো বিউপনিবেশিক চর্চা যা—তা নয়, তাকে খারিজ করার জন্য বিউপনিবেশিক আলাপচারিতার মধ্যেই আপত্তি ওঠতে পারতো, কারণ একজন অনন্য “আমি” [তো] তাকে সেভাবেই বুঝেছি। বিউপনিবেশিক স্বাতন্ত্র্যবোধকে [egos] বাতিল করা যাবে না, আর ব্যক্তিগত ফায়দার জন্য ক্ষতিগ্রস্তরূপে দেখানো [playing victim] হতে পারে একটি প্রলোভন [temptation]। এই গ্রন্থমালার অভিপ্রায় তর্কটিকে, বৈশ্বিকভাবে শিখন ও করণ, যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণগত ও লৈঙ্গিক [sexualized] “সংখ্যালঘু” কর্তৃক সাধিত গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোকে আরও প্রসারিত করায় অবদান রাখা। শেষ বিচারে, পিতৃতন্ত্র তাই যেখানে বর্ণবাদ আর যৌনতন্ত্র উৎপন্ন ও প্রতিপালিত হয়। একটি সূক্ষ্ম সূত্রে নাগরিক সমাজের সঙ্গে রাষ্ট্র, বণিক সংঘ [corporation], আর্থিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ গাঁথা। পশ্চিমা জীবনের সকল ক্ষেত্রেই বর্ণবাদ ও যৌনতন্ত্র বাসা বেঁধেছে, আর তা অপশ্চিমা সমাজকেও প্রভাবিত করার সামর্থ্য অর্জন করেছে। আজকাল যেভাবে আমরা বর্ণবাদ বুঝি—তা বৈশ্বিক, কেননা, এটি ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার অন্যতম মৌলিক উপাদান, আর ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকা [তো] সেই ষোলো শতক থেকেই পশ্চিমাকরণের হাতিয়ার।

এই কারণে, বিযুক্তকরণ বর্তমান সময়ে প্রধানতম দুটি পথ অবলম্বন করে: বিউপনিবেশিকতা (সরকারব্যবস্থার রাষ্ট্রীয় ধরন থেকে বিযুক্তি) আর বিপশ্চিমাকরণ (পশ্চিমাকরণ থেকে বিযুক্তি ও শক্তিশালী রাষ্ট্র মারফত পুনর্পশ্চিমাকরণের মোকাবিলা)। উভয়ক্ষেত্রেই, যদিও প্রান্ত আলাদা, জ্ঞানতাত্ত্বিক ও আবেগাত্মক (এবং নন্দনতাত্ত্বিক) বিযুক্তকরণ বলতে প্রাণের পরিষেবায় নিয়োজিত এবং জনগণকেই—বর্তমান অবস্থার মতো—প্রতিষ্ঠানের তাবেদারি করাবে না, এমন সব প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থার কল্পনা [conceiving] ও নির্মাণ করা বোঝায়। প্রতিষ্ঠানের তাবেদারিতে প্রাণের নিযুক্তি আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা, ইউরোকেন্দ্রিকতা এবং ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার মূলনীতি। মৃত্যুর স্বাভাবিকীকরণ [naturalization] এবং এই সকল অনুমানকে গুঁড়িয়ে দিয়েই বিউপনিবেশিক চিন্তন, করণ ও হয়ে ওঠার শুরু।

স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী বিপশ্চিমাকরণ প্রসঙ্গে

পুনর্পশ্চিমাকরণ বুঝতে হলে, আগে পশ্চিমাকরণ ও আধুনিকতার সঙ্গে তার যোগসাজসটা বোঝা দরকার। পশ্চিমাকরণ বলতে আমি বুঝি, ঘটনা ও ভাবনার এক সমন্বয় যা মোটামুটি ১৫০০ সাল থেকেই আসন্নবিশ্ব ব্যবস্থাটাকে বদলাতে শুরু করেছিলো, আর পত্তন করেছিলো নতুন আরেক—যে চক্র শেষ হয় ২০০০ সালের দিকে।২৭ পশ্চিমাকরণের প্রারম্ভ ক্ষণটি আমেরিকা উদ্ভাবনকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছিলো; অর্থাৎ, প্রতীকী, সামরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, জাতিগত, লৈঙ্গিক, নান্দনিক ও বিষয়ীগত [subjectively] উপায়ে উদ্ভাবিত হয়েছিলো গোটা একটা মহাদেশ। এটি ইউরোপীয় ও প্রাক্তন আজটেক, মায়া, ইনকা, ইরোকোয়া, তাইনো, আরাওয়াক, মাপুচি ও অন্যান্য উভয় সভ্যতার বিষয়ীত্বকেই প্রভাবিত করেছিলো। সময়ের পরিক্রমায় এর প্রভাব বিস্তৃত হয়েছিলো এশিয়া ও আফ্রিকায়।

বিপশ্চিমাকরণ ১৯৫৫ সালের বান্দুং সম্মেলনেরই একটি ফসল। যদিও বান্দুং সম্মেলন ছিলো “কৃষ্ণাঙ্গ লোকেদের” প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন, উদ্বোধনী ভাষণে রাষ্ট্রপতি সুকর্ন যেটা নির্দিষ্টভাবেই বলেন, এটি ছিলো একটি রাষ্ট্রচালিত সম্মেলন। আগেই বলা হয়েছে, স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে বিউপনিবেশায়ন একটি রাষ্ট্রচালিত প্রকল্প ছিলো, একই সময়ে সদ্যোজাত রাষ্ট্রসমূহ ছিলো সেই স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ফল। বিউপনিবেশায়নের রাষ্ট্রীয় রাজনীতি সফল হয়নি, আর স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যর্থ আধুনিক/ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রসমূহ সেই ফলাফলেরই অংশবিশেষ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে যেমনটা আজকাল দেখা যায়। অপরপক্ষে, বান্দুঙের ধারাবাহিকতা [Bandung Legacies] সফল হয়েছে, সিঙ্গাপুরের মতো ও তার কিছু পরে চীন, রাষ্ট্রের রূপায়ণে যখন উপলব্ধ হয়েছে যে, রাজনৈতিক মুক্তি কূটোপায়ে [paradoxically] পুঁজিবাদকে অস্বীকারের ওপর নয়, বরং নির্ভর করে পশ্চিমা পুঁজিবাদের উদারনৈতিক ও নয়া উদারনৈতিক অনুমানসমূহের প্রত্যাখ্যানের ওপর। সেই মুহূর্তেই, বিপশ্চিমাকরণের রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে বান্দুং ধারাবাহিকতা বাস্তবায়িত হয়। বিপশ্চিমাকরণের এই রাষ্ট্রীয় রাজনীতিই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ান ফেডারেশনের পুনর্বিন্যাস ও পুনরুদ্ধারকে সম্ভব করেছিলো। যেহেতু বিপশ্চিমাকরণের রাজনীতি ও দর্শন ইতোমধ্যে ছিলোই, সেকারণে ব্রিকস [BRICS] গঠন করাও সম্ভব হয়েছিলো। বিপশ্চিমাকরণ ইরানকেও অমুসলিম রাষ্ট্রসমূহের মধ্য থেকে মিত্র নির্বাচনের অনুমোদন দিয়েছিলো। ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার ইতিহাসজাত [CMP] ব্যাখ্যানুসারে, এই দুনিয়ায় এবং এই বর্তমানে আমরা নয়া কোনো স্নায়ুযুদ্ধের ভেতরে নেই। স্নায়ুযুদ্ধ ছিলো দুটি পশ্চিমায়িত ভাবাদর্শেরই মোকাবিলা। বিপশ্চিমাকরণ, অন্যদিকে, পশ্চিমা অভিজ্ঞতা, ভাষা, রাজনীতি, ধর্মবোধ, সংবেদনশীলতা এবং সর্বোপরি জীবনচর্চার প্রবর্তন করে যা নয়া উদারনৈতিক পশ্চিমাকরণে সমর্পিত হতে অস্বীকৃতি জানায়।

পৃথিবীটা একারণে পশ্চিমায়িত হয়নি যে, উপরোল্লিখিত সীমানার বাইরের লোকজন এক ধাক্কায় সকলে খ্রিস্টীয়, উদারনৈতিক, বা মার্কসবাদী মূল্যবোধ ও বীক্ষায় দীক্ষা গ্রহণ করেছিলো, বরং অইউরোপীয় অঞ্চল, সভ্যতা, ও লোকজন পশ্চিমা সভ্যতার আদর্শ, মানুষজন, ও প্রতিষ্ঠানসমূহের দ্বারা ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপ ও অনধিকারচর্চার শিকার হয়েছিলো। পশ্চিমাকরণের প্রতিক্রিয়া স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অভিযোজন থেকে মৌনতা, মৌনতা থেকে প্রত্যাখ্যান, প্রত্যাখ্যান থেকে সংঘর্ষ ও বিভিন্ন জ্ঞানতাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, নন্দনতাত্ত্বিক বিযুক্তকরণ প্রকল্প অবধি ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকা ও আধুনিকতার বয়ানের ইতিহাসব্যাপী বিভিন্ন হয়েছে। পশ্চিমাকরণকে যারাই অনুমোদন ও গ্রহণ করেছিলো তারাই সমর্পিত হয়েছে ও চেষ্টা করেছে একে আত্মস্থ করার। যারা একে সমর্থন দেয়নি তারা প্রত্যাখ্যান করেছিলো, আর এখনও প্রতিরোধ ও বিযুক্ত করার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। যদিও প্রতিবাদ ও বিযুক্ত করার বিউপনিবেশিক বিযুক্তকরণের প্রয়াস আরও পিছিয়ে ষোলো শতকেই চিহ্নিত করা যায়, বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেই কেবল এরা দৃশ্যমান ও অপরিবর্তনীয় হয়ে ওঠে। ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে মতভেদ ও বিবাদের একটি ক্ষেত্র হলো—ওপরে যেমন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে—বিপশ্চিমাকরণ। অপরটি—বিউপনিবেশিকতা। বিপশ্চিমাকরণ বিউপনিবেশিকতা বিশ্লেষণেরই অংশ—বিউপনিবেশিক মিত্র নয়। যাইহোক, উভয়ের জন্যই সাধারণ কিছু প্রসঙ্গ রয়েছে, শেষ বিচারে, রাষ্ট্রীয় রাজনীতি ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির মাধ্যমে নয়—অন্যভাবে বিউপনিবেশিকতা বিপশ্চিমাকরণকে সূচিত করে।

এই যে গ্রন্থমালা, আমরা এখানে পেশ করে চলেছি, দুটি পরিপূরক ক্ষেত্রে বিউপনিবেশিকতাকে তা প্রেষণা জোগায়। একটি হলো উপনিবেশিকতার ব্যবচ্ছেদ—এর ইতিহাস এবং পুনর্পশ্চিমাকরণ ও বিপশ্চিমাকরণের মধ্যেকার সাম্প্রতিক বিবাদ। এই বিশেষ সংযোজন ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার ইতিহাস ও বিউপনিবেশিক ব্যবচ্ছেদ থেকেই আবির্ভূত হয় (ষষ্ঠ অধ্যায় পড়ুন)। আলোচনাধীন বিবাদটিকে বিচ্ছিন্ন একটি বৈপরীত্য জোড় [binary opposition] হিসেবে বিবেচনা করা হবে না, বরং দেখা হবে ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার জটিলতার (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বর্ণগত, জ্ঞানতাত্ত্বিক, প্রচারমাধ্যমগত ও বৃহদর্থে সাংস্কৃতিক) বিশেষ উন্মোচন হিসেবে। পশ্চিমাকরণ ও পুনর্পশ্চিমাকরণ যেখানে ইউরোপের (গ্রিস, রোম, রেনেসাঁ উত্তর ইউরোপ) এবং ইঙ্গফরাসি উত্তর আটলান্টিকের অনুরূপ ইতিহাস ও অভিজ্ঞতায় প্রোথিত, সেখানে বিপশ্চিমাকরণ ও বিউপনিবেশিকতা পশ্চিমা স্থানীয় ইতিহাসের প্রতিক্রিয়া হিসেবে, এর ভিন্নতা নিয়েই, প্রবর্তিত বহুবিধ স্থানীয় ও বিচিত্র ইতিহাসের ওপর দণ্ডায়মান।২৮ চীন, রাশিয়া, অন্যান্য ব্রিকস দেশগুলো, এবং ইরান সকলেই তাদের নিজস্ব স্থানীয় ইতিহাস থেকেই তাদের বিবাদ ও প্রত্যাখ্যানকে প্রতিষ্ঠা করে। বিউপনিবেশিকতার ক্ষেত্রে যেমন, আধুনিক পরিত্রাণের অলংকৃতির নেপথ্যে, এর ব্যবস্থাপনার যুক্তি বুঝতে, উপনিবেশিকতার ব্যবচ্ছেদকে এটি আগেই ধরে নেয়।

বিপশ্চিমাকরণ ও বিউপনিবেশিকতা স্নায়ুযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের ওপর দিয়ে প্রত্যাবর্তনের সাধ্যের বাইরে [the points of no return] পৌঁছে গেছে। স্নায়ুযুদ্ধের উভয় প্রতিদ্ব›দ্বীই, উদারনৈতিক ও সমাজতন্ত্রী/ সাম্যবাদী, একই পশ্চিমা ইতিহাসে আটক ছিলো, তারা একে বিভিন্ন উদ্দেশ্যসাধনের নিমিত্তেই কেবল নুইয়েছে [bent], যেখানে সুবিধা অস্বীকার করেছে ও মুছে ফেলেছে। সোভিয়েতরা এই কারণেই গোঁড়া খ্রিস্টানত্বকে [Orthodox Christianity] প্রান্তীয় করে তুলেছিলো ও বিপ্লবপূর্ববর্তী রাশিয়ার ইতিহাস মুছে দিয়ে চেষ্টা করেছিলো একটি “আধুনিক” রাষ্ট্র গড়ে তোলার। এই কারণে মাও সেতুংও কনফুসিয়াস ও ধর্মীয় পুনরুত্থানের সকল চিহ্নকে প্রান্তীয় করে তুলেছিলেন। বিপরীতে, হাল আমলের বিপশ্চিমাকরণ ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে—যে অর্থ [money] ও উদ্দেশ্য [meaning] ‘CMP’ ধারণ করে তার জন্য—একটি আন্তঃপ্রাচীর [intramural] বিবাদ। এটি বিকশিত হয় শাসনপ্রক্রিয়া (আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক, অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক চুক্তি ও সংস্থাসমূহ) ও সামরিক মোকাবিলার পরিসরে—যাকে বিবাদটিই সূচিত করে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে (কলা, জাদুঘর, দ্বিবার্ষিক) এটি কম আগ্রাসী পর্যায়ে ঘটে।২৯

এটা মনে রাখা জরুরি যে, যেখানে বিপশ্চিমাকরণ রাষ্ট্রচালিত ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের (নিয়ন্ত্রিত অথবা নিয়ন্ত্রিত নয়) চৌহদ্দির মধ্যে কৌশল প্রয়োগ করে, [সেখানে] বিউপনিবেশিকতা কাজ করে একটি আসন্ন বৈশ্বিক রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের পরিধির ভেতর। নাগরিক সম্প্রদায় থেকে পৃথক, সর্বোপরি যা জাতীয়, রাজনৈতিক সম্প্রদায় আজকাল জাতিরাষ্ট্র ও আন্তঃরাষ্ট্র উভয় সম্পর্ক থেকেই স্বাধীন সব সংস্থা দ্বারা চালিত হয়। কিন্তু সেই সকল কিছুর বাইরে, বিউপনিবেশিকতা আলাপের পরিভাষাসমূহের পরিবর্তনে মনোনিবেশ করে। বিপশ্চিমাকরণ, তা সত্ত্বেও, আলাপের প্রসঙ্গ নিয়ে বিবাদ করে, আর পরিভাষাসমূহকে রেখে দেয় অক্ষত। ফলে, এটি [আসলে] অক্ষত রেখে দেয় ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার কাঠামোটিকেই: উদাহরণস্বরূপ, শাসনকাঠামোর ধরন হিসেবে আধুনিক রাষ্ট্র, আর উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন, অর্থসংস্থান ও বাজারের ধরন হিসেবে অর্থনৈতিক উপনিবেশিকতা (পুঁজিবাদ)। কিহানো জ্ঞানতাত্ত্বিক বিউপনিবেশায়নের রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন। যেটা, সংক্ষেপে, আমাদের যাত্রার প্রারম্ভবিন্দু, আর আলাপের পরিভাষাসমূহ বদলের অমোঘ আহ্বান।

পরবর্তী অধ্যায়টি ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকা কীভাবে নির্মিত, রূপান্তরিত ও পরিচালিত হয়েছে, সুতরাং আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা কীভাবে কাজ করে—তা বোঝার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকবে। আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা কীভাবে ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার রূপায়ণের মাধ্যমে কাজ করে—এই বোঝাপড়া সর্বদাই একটি বিউপনিবেশিক উদ্যোগ—আর তাই বিউপনিবেশিক চিন্তন ও করণ।

টীকা

সূত্রলিপি ১: Bob Marley, “Redemption Song,” Uprising, Island/Tuff Gong, 1980.

সূত্রলিপি ২: Humberto R. Maturana, “Reality: The Search for Objectivity or the Quest for a Compelling Argument,” The Irish Journal of Psychology 8, no. 1 (1988): 25–82.

অনুবাদকের সংযোজিত টীকা

. নব্যকান্টপন্থী দার্শনিক ভিলহেল্ম ভিন্দেলবান্দ (Wilhelm Windelband) ‘নমোথেটিক’ ও ‘আইডিয়োগ্রাফিক’ পরিভাষা দুটিকে জ্ঞানের প্রতি দুটি পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে পেশ করেন। যার প্রত্যেকটি, আলাদা আলাদা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, বিদ্যায়তনের দুটি স্বতন্ত্র শাখার পরিচয় বহন করে। কান্ট যাকে ‘সাধারণীকরণ করার প্রবণতা’ বলে অভিহিত করেছেন—‘nomotheticপরিভাষাটি তার ভিত্তিতেই গড়া। এটি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বেলায় প্রযোজ্য। মোটাদাগে, এটি বস্তুনিষ্ঠ প্রপঞ্চের (objective phenomena) বিভিন্ন নমুনা ও বর্গ থেকে তাদের ব্যাখ্যাকারী সূত্র বের করে আনার প্রয়াস বর্ণনা করে (উইকিপিডিয়া)

. মানবিক বিদ্যার জন্য ‘idiographicদৃষ্টিভঙ্গি আদর্শস্বরূপ। কান্ট যাকে ‘সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করার প্রবণতা’ বলে হাজির করেছেন—এটি তার ভিত্তিতে গড়া। এটি আকস্মিক, অনন্য, আর হরহামেশাই সাংস্কৃতিক কিংবা ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রপঞ্চের (subjective phenomena) অর্থ অনুধাবনের প্রচেষ্টার বর্ণনা দেয় (উইকিপিডিয়া)

. উপনিবেশিকতা (coloniality) পরিভাষাটির প্রবর্তক পেরুর সমাজতাত্ত্বিক আনিবাল কিহানো। একে তিনি উপনিবেশবাদ থেকে আলাদা করে নেন। তার ভাবনায়, উপনিবেশবাদ নির্দেশ করে একধরনের রাজনৈতিকঅর্থনৈতিক সম্পর্ক—যেখানে একটি দেশের সার্বভৌম ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে অপর আরেকটি কর্তৃত্ববাদী দেশের ওপর—যা কর্তৃত্বপরায়ণ দেশটিকে একটি সাম্রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলে। অন্যদিকে, উপনিবেশিকতা হলো উপনিবেশায়নের ফলে সৃষ্ট হওয়া দীর্ঘস্থায়ী এক ক্ষমতাবিন্যাস যা ঔপনিবেশিক প্রশাসনের আওতাবহির্ভূত সংস্কৃতি, শ্রম, আন্তঃবিষয়ী সম্পর্ক ও জ্ঞানোৎপাদনকে সংজ্ঞায়িত করে। এই দুইয়ের সম্পর্ক হলো—উপনিবেশিকতা রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত উপনিবেশবাদকে বহাল তবিয়তে বাঁচিয়ে রাখে। বইপুস্তক, বিদ্যায়তনিক তৎপরতা, সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, প্রাত্যহিক বোঝাপড়া, সাধারণের আত্মভাবনা, আত্মবোধের উচ্চাকাক্সক্ষা ও অন্যান্য আধুনিক যাপনাভিজ্ঞতায় এটি সুপ্তাবস্থায় রয়ে যায়। ফলে, একজন আধুনিক বিষয়ী হিসেবে ব্যক্তি মূলত উপনিবেশিকতার মধ্যেই দম নেয়। একারণেই, উপনিবেশিকতা কোনো ঔপনিবেশিক সম্পর্কের সরল পরিণতি বা অবশিষ্ট নয় (Maldonado-Torres, 2010 : 97)। ‘কলোনিয়ালিটি’ শব্দটিকে আরও অনেকেই ব্যবহার করেন। আমরা যার বাংলা করি—ঔপনিবেশিকতা। কিন্তু কিহানো একে বিশেষ অর্থে নির্মাণ করেছেন, এবং ‘ঔপনিবেশিকতা’ বানানে পরিভাষাটির সেই বিশেষ অর্থ খোয়া যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় বলেই এর বানান লেখা হয়েছে ‘উপনিবেশিকতা’। এই বানানে লাতিন আমেরিকীয় বিউপনিবেশিক চিন্তনে ব্যবহৃত ‘কলোনিয়ালিটি’ পরিভাষাটির বাংলা তর্জমা নির্দেশিত হবে।

. ‘ডায়াস্পোরা’ গ্রিক শব্দ। এর অর্থ ছিটিয়ে দেওয়া (to sow over), ছড়িয়ে দেওয়া (to scatter)। খুব সম্ভবত গ্রিক ঐতিহাসিক থুসিডাইডিস (Thucydides), গ্রিকদের ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে, মানুষের বেলায় শব্দটিকে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করেন। হিব্রæ বাইবেলের দ্বিতীয় বিবরণ (ড্যুটারনমি/ ডেভারিম) নামক কিতাবের গ্রিক অনুবাদে ব্যবহৃত হওয়ার পর থেকে এটি বেশ নজর কাড়ে। শব্দটি সেখানে ব্যাবিলনে ইহুদিদের ছড়িয়ে যাওয়া নির্দেশ করে। ফলে, প্রাথমিকভাবে পরিভাষাটি মূলত—গ্রিক ও ইহুদি—এই দুটি প্রাচীন ডায়াস্পোরার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছিলো। ১৯৬০ সাল নাগাদ এটি প্রধানত ঐতিহাসিক ইহুদি ডায়াস্পোরা ও অংশত গ্রিকদেরটা বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। ইহুদিদের ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে ‘ডায়াস্পোরা’ শব্দের সমীকরণটিই জড়িয়ে যাওয়াটা বিস্ময়কর নয়। ইহুদি ডায়াস্পোরার ব্যাপক ঐতিহাসিক সংযোগ ও দৃষ্টিগ্রাহ্যতার কারণেই এটা হয়েছে। ১৯৬০ ও ১৯৭০ সালের দিকে বিদ্বানেরা দাসব্যবসার কারণে ছড়িয়ে পড়া আফ্রিকীয়দের ক্ষেত্রেও পরিভাষাটি ব্যবহার করতে শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে নাটকীয়মাত্রায় অভিবাসন বেড়ে যাওয়া, ও অসংখ্য নতুন ডায়াস্পোরা গড়ে ওঠা, এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে, ও “মুসলিম ডায়াস্পোরা’’র আবির্ভাবের কারণে প্রপঞ্চটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। স্বদেশ ও পোষকদেশের (hostlands) অর্থ ও তাৎপর্য সংক্রান্ত গভীর তর্ক ও অধ্যয়ন শুরু হয়। ‘ডায়াস্পোরা’ নিয়ে বিদ্যায়তনিক আগ্রহ ও তৎপরতা শুরু হয় মূলত ১৯৮০ সালের শেষাশেষি ও ১৯৯০ সালের শুরুর দিকে—যা এখনও চলমান আছে (https://pesd.princeton.edu/node/256)। আমরা এর বাংলা করেছি অভিনিস্ক্রমণ।

. ‘মিডল প্যাসেজ’ ছিলো আটলান্টিকস্থ দাসব্যবসার একটি পর্ব। ত্রিমুখী দাসব্যবসার অংশ হিসেবে যখন আফ্রিকার লক্ষ লক্ষ অধিবাসীদের দাসে পরিণত করে আমেরিকা পাচার করা হয়েছিলো। আফ্রিকীয় বাজারগুলোর উদ্দেশ্যে পণ্যবোঝাই জাহাজগুলো প্রথমে ইউরোপ ছেড়ে যেতো (ত্রিভুজের একটি ভুজ), সেখানে তারা আফ্রিকীয় রাষ্ট্রসমূহের শাসক ও অন্যান্য আফ্রিকাস্থ দাসব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দাস সংগ্রহ করতো। দাসবাহী জাহাজগুলোকে বলা হতো গিনিম্যান (Guineamen)। দাসদের নিয়ে জাহাজগুলো পরে আটলান্টিক পাড়ি দিতো (ত্রিভুজের দ্বিতীয় ভুজ)। অতঃপর, দাসবিক্রয়ের অর্জিত মুনাফা দিয়ে কেনা হতো পশুচর্ম, তামাক, চিনি, সুরা, ও অন্যান্য কাঁচামাল, যা নিয়ে জাহাজগুলো উত্তর ইউরোপ ফিরে আসতো (ত্রিভুজের তৃতীয় ভুজ)। এভাবেই ত্রিভুজটি সম্পূর্ণ হতো (উইকিপিডিয়া)

. ‘ক্যাচটুয়েন্টি টু’ (catch-22) একটি কূটাভাসমূলক পরিস্থিতি, পরস্পরবিরোধী নিয়ম কিংবা সীমাবদ্ধতার কারণে, যেখান থেকে ব্যক্তি কখনও নিস্তার পায় না। ১৯৬১ সালে যোসেফ হেলার (Joseph Heller) তার catch-22 উপন্যাসে অভিধাটির প্রবর্তন করেন। একজন ব্যক্তি যখন এমনসব নিয়ম, বিধিবিধান, বা কার্যপ্রণালীর অধীন হয় যার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই—সেসব থেকেই হরহামেশা ‘ক্যাচটুয়েন্টি টু’ উদ্ভূত হয়, কারণ সেই নিয়মের সঙ্গে লড়াই করা মানে তাকে মেনে নেওয়া। আরেকটি উদাহরণ দিয়ে এই পরিস্থিতি বোঝা যায়, যেখানে কোনো ব্যক্তির একটা কিছু দরকার যা কেবল সে তখনই পেতে পারে যখন তার সেটা দরকার নেই (যেমন, ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের জন্য ব্যাংকের কাছে এটাই প্রমাণ করতে হয় যে তার আসলে ঋণের প্রয়োজন নেই)। পরিভাষাটির একটি দ্যোতনা হলো—‘ক্যাচটুয়েন্টি টু’ পরিস্থিতির কারিগরেরা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের যথার্থতা নিরূপণ ও তা গোপন করার উদ্দেশ্যে প্রবর্তন করেছে স্বেচ্ছাচারী সব নিয়ম (উইকিপিডিয়া)

. es una herida abiertaএর ইংরেজিতে অর্থ দাঁড়ায় ‘it is an open wound’

. ‘আধুনিকতা’ শব্দটি ও এটিকে কেন্দ্র করে যতো গালগপ্পো গড়ে উঠেছে তা খোদ ইতিহাসেরই একটা সত্তাতত্ত্ব দাঁড় করায়, যা মানবিকতার ঊষাকাল থেকে আধুনিক (ও উত্তরাধুনিক) সময় ও রূপের ভেতর দিয়ে তার বিস্তৃতি ঘটিয়েছে।

. ১ জানুয়ারি, ১৯৯৪ সালে পৃথিবীর মানুষ সাপাতিস্তা আন্দোলনের কথা জানতে পারে, যখন দক্ষিণ মেক্সিকোর জিয়াপাস [Chiapas] রাজ্যের শহর ও পৌরসভাগুলো ১২,০০০ সাপাতিস্তা দখল করে নেয়। সাপাতিস্তারা মায়ান [Mayan] জনগোষ্ঠীর দুর্দশা, জিয়াপাস রাজ্যের পরিবেশগত ধ্বংসসাধন, মেক্সিকোর গরিবদুঃখী মানুষের চাহিদা ও জিয়াপাসের অর্থনীতিতে উত্তর আমেরিকীয় অবাধ বাণিজ্য চুক্তির (NAFTA) প্রতি মনোনিবেশ দাবি করেন। জিয়াপাস ভিত্তিক সাপাতিস্তা জাতীয় মুক্তি ফৌজ(EZLN) সাপাতিস্তারা সংঘবদ্ধ, যা সাপাতিস্তা আন্দোলনের প্রাণভোমরা। সাপাতিস্তা জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট (FZLN) গোটা মেক্সিকোতেই সক্রিয়। লাতিন আমেরিকার অন্যান্য গেরিলা গোষ্ঠীর অননুরূপ কেন্দ্রীয় সরকারকে উচ্ছেদ করতে সাপাতিস্তারা অস্ত্র হাতে তুলে নেয় না। বরং তারা তা করে—মায়ান জনগোষ্ঠীর অধিকারপ্রতিষ্ঠায়—আত্মরক্ষার্থে। প্রখ্যাত বিপ্লবী এমিলিয়ানো সাপাতার (Emiliano Zapata) নামানুসারে সাপাতিস্তারা তাদের নাম নিয়েছে। (https://rethinkingschools.org/articles/introduction-zapatista-movement/)

তথ্যসূত্র

  1. ক্যাথারিন ওয়ালশ, স্যান্তিয়াগো ক্যাস্ত্রোগোমেজ এবং ফ্রেইয়া স্কিউই সহসম্পাদিত যৌথ সংগ্রহ Indisciplinar las ciencias sociales: Geopolíticas del conocimiento y colonialidad del poder (কিটো: অ্যাবাই ইয়ালা, ২০০২)-এ প্রকাশিত এই অবিদ্যায়তনিকতা [Undisciplinarity] ছিলো আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা/ বিউপনিবেশিকতা প্রকল্প প্রতিষ্ঠায় ট্রেডমার্কস্বরূপ। সদ্য উদ্ধৃত বইটির রচনাসংক্রান্ত আলোচনায়, আমার অতি সাম্প্রতিক “Epistemic Disobedience, Independent Thought and Decolonial Freedom,” Theory, Culture and Society26, nos. 7/8 (2009): 1–23, প্রবন্ধটিরও, http://waltermignolo.com/wp-content/uploads/2013/03/epistemicdisobedience-2.pdf, শেকড় প্রোথিত রয়েছে।

  2. এই গোষ্ঠীর চিন্তা সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা পেতে, পড়ুন “Modernity and Decoloniality,”Oxford Bibliography Online, 2011, accessed May 27, 2016, http://www.oxfordbibliographies.com/view/document/obo-9780199766581/obo9780199766581-0017.xml.

  3. কিহানোর অভিব্যক্তিটি প্রবর্তিত হয়েছিলো ১৯৭০এর দশক জুড়ে লাতিন আমেরিকায় জারি থাকা নির্ভরশীলতার তর্কের জটিলতা বিশ্লেষণে। সম্প্রতি আবারও তিনি ধারণাটির মুখোমুখি হয়েছেন। Milson Betancourt, “Anibal Quijano: Heterogeneidad histórico estructural. parte I,” online video clip, YouTube, October 6, 2013, accessed May 23, 2016, https://www.youtube.com/watch?v=-okq89FNkTI. For more detail, see the collection of his works, Aníbal Quijano, Antología esencial: De la dependencia histórico-estructurala la colonialidad/descolonialidad del poder, selection and prologue by Alín Assis Clímaco (Buenos Aires: clacso, 2014), http://clepso.flacso.edu.mx/sites/default/files/clepso.2014eje8pacheco.pdf.

  4. Michel–RolphTrouillot, “North Atlantic Universals: Analytical Fictions,” South Atlantic Quarterly 101, no. 4 (2002): 839–58, accessed December 8, 2016, http://saq.dukejournals.org/content/101/4/839.

  5. পড়ুন Trouillot, “North Atlantic Universals.”

  6. Marc Fumaroli (preface and essay), La querelle des anciens et des modernes (Paris: Gallimard, 2001).

  7. পড়ুন Walter D. Mignolo, “The Enduring Enchantment (Or the Epistemic Privilege of Modernity and Where to Go From Here),” South Atlantic Quarterly 101, no. 4 (September 2002): 928–54.

  8. ওভারভিউয়ের জন্য পড়ুন “Coloniality and Modernity/Rationality.” In Globalization and the Decolonial Option, ed. Walter Mignolo and Arturo Escobar, 22–32 (London:Routledge, 2010). See also “Modernity and Decoloniality,” Oxford BibliographyOnline, 2011, accessed May 27, 2016, http://www.oxfordbibliographies.com/view/document/obo-9780199766581/obo-9780199766581–0017 .xml.

  9. ভূঐতিহাসিক বিভাজনের উপনিবেশিকতা উদ্ঘাটনে দক্ষিণ দুনিয়ার সত্তা পর্যালোচনার জন্য, দেখুন Walter D. Mignolo, “The North of the South and theWest of the East,” Ibraaz: Contemporary Visual Culture in North Africa and the Middle East, November 2014, accessed May 30, 2016, http://www.ibraaz.org/essays/108.

  10. Gloria Anzaldúa, Borderlands/La Frontera: The New Mestiza (San Francisco: Aunt Lute, 1987).

  11. পড়ুন Edgardo Lander, “Eurocentrism and Colonialism in Latin America Social Thoughts,” Nepantla: Views from South 1, no. 3 (2000): 519–32; Aníbal Quijano, “Coloniality of Power, Eurocentrism, and Latin America,” Nepantla: Views from South1, no. 3 (2000): 533–80. For an update of the question, see Walter D. Mignolo, “Spirit Out of Bound Return to the East: The Closing of the Social Sciences and the Opening of Independent Thoughts,” Current Sociology 62 (July 2014): 584–602.

  12. উদাহরণস্বরূপ পড়ুন “CNN Money,” August 23, 2017, http://money.cnn.com/2017/08/23/investing/the-impact-network-families/index.html.

  13. পড়ুন আমার The Darker Side of the Renaissance: Literacy, Territoriality and Colonization (Ann Arbor: The University of Michigan Press, 1995 [2nd ed. with new Afterword, 2003]).

  14. Mignolo, Introduction to The Darker Side of the Renaissance.

  15. Colonialism,” in Online Etymology Dictionary, 2001–2016, accessed May 23,2016,http://www.etymonline.com/index.php?term=colonialism.

  16. Colonialism,” in Stanford Encyclopedia of Philosophy, 2006, accessed May 23, 2016, http://plato.stanford.edu/entries/colonialism/.

  17. Baudelaire, “The Painter of Modern Life” [1863], repr. inThe Painter of Modern Life and Other Essays (London: Editorial Phaidon), accessed May 23, 2016, http://www.writing.upenn.edu/library/Baudelaire_Painter-of-Modern-Life_1863.pdf(emphasis mine).

  18. Michelle K., “From Singapore, to Cambridge to Duke University,” Social Text Periscope, 2013, accessed May 23, 2016, https://socialtextjournal.org/periscope_article/decolonial-aesthesis-from-singapore-to-cambridge-to-duke-university/.

  19. Progress,” Online Etymological Dictionary, accessed July 20, 2017, http://www.etymonline.com/index.php?term=progress. উপনিবেশিকতার ফলাফলটাকে দারুণভাবে আড়াল করে অ্যান্থনি গিডেন্স পেশ করেছেন আধুনিকতার এক আত্মরূপায়িত বয়ান (অলংকৃতি)। পড়ুন তার The Consequences of Modernity (Stanford, CA: Stanford University Press, 1990).

  20. Aníbal Quijano, “Colonialidad y modernidad/racionalidad,” [1992] 2007; Adolfo Albán Achinte, “Pedagogías de la re-existencia: Artistas indígenas y afro-colombianos,” in La estética en la encrucijada decolonial, ed. Zulma Palermo (Buenos Aires: Ediciones del Signo, 2009); Leanne Simpson, Dancing on Our Turtle’s Back: Stories of Nishnaabeg Re-Creation, Resurgence and Re-Emergence (Winnipeg, Manitoba: Arbeiter Ring Publishing, 2012). On Yuko Hasegawa, see “Going Both Ways: Yuko Hasegawa in Conversation with Walter D. Mignolo and Stephanie Bailey,” Ibraaz: Contemporary Visual Culture in North Africa and the Middle East, May 8, 2013, http://www.ibraaz.org/interviews/79; আরও পড়ুন Walter D. Mignolo on Yuko Hasegawa curating Sharjah Biennial 11, “Re-Emerging, Decentering and Delinking: Shifting the Geographies of Knowing, Sensing and Believing,” Ibraaz, May 8, 2013, http://www.ibraaz.org/essays/59/.

  21. Aníbal Quijano, “Coloniality and Modernity/Rationality.” Cultural Studies 21, nos. 2/3 (2007): 168–78.

  22. ইউরোপীয় এই শ্রেণিগোষ্ঠীর (বুর্জোয়া) সেই ধর্মনিরপেক্ষ শৃঙ্খলমোচন কেবলই রাজনৈতিক ব্যাপার ছিলো না; একইসঙ্গে, তা ছিলো অর্থনৈতিক, বিষয়ীগত, শৈল্পিক ও ধর্মীয় তৎপরতা। এটি এক নতুন ধরনের বিষয়ীত্বের জন্ম দিয়েছিলো, সিলভিয়া উইন্টার যাকে “Man 2” বলে নির্দেশ করেন। পড়ুন Wynter, On Being Human as Praxis (Durham, NC: Duke University Press, 2014).

  23. পড়ুন Jean Casimir, “Haïti et ses élites: L’interminable dialogue des sourds,” Worlds and Knowledges Otherwise, 2008, https://globalstudies.trinity.duke.edu/wp-content/themes/cgsh/materials/WKO/v2d3Casimir7.pdf.

  24. বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন তার ধ্রুপদী গ্রন্থ Imagined Communities: Reflections on the Origins and Spread of Nationalism (London: Verso, 1983)-তে যে তর্ক জুড়েছেন তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্র এটা নয়। ২০২৬ সালে তার একটি সংশোধিত সংস্করণ ছাপা হয়েছিলো। একদল লাতিন আমেরিকান বিদ্বান মূল তর্কটির সঙ্গে যুঝেছিলেন—Beyond Imagined Communities, ed. John Chasteen and Sara Castro-Klarén (Baltimore: John Hopkins University Press, 2003).

  25. Neither Capitalism, nor Communism but Decolonization,” Critical Legal Thinking, March 21, 2012, http://criticallegalthinking.com/2012/03/21/neither-capitalism-nor-communism-but-decolonization-an-interview-with-walter-mignolo/.

  26. সাপাতিস্তারা তাদের প্রারম্ভ থেকেই বিউপনিবেশিকতা বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। স্বয়ং সাপাতিস্তারা তাদের বিউপনিবেশিক মনে করে কিনা তা আলাদা বিষয়বস্তু। পড়ুন Mignolo, “The Zapatistas’ Theoretical Revolution: Its Historical, Ethical and Political Consequences,” Review (Ferdinand Braudel Center) 25, no. 3 (2002): 245–75. The consistent follow-up, 23 years later, is the Consejo Nacional Indigena and the participation of Luciano Concheiro. “Los pueblos Indígenas de México eligena su vocera e irrumpen en el scenario politico nacional,” New York Times Es, May 28, 2017, https://www.nytimes.com/es/2017/05/28/los-pueblos-indigenas-de-mexico-eligen-a-su-vocera-e-irrumpen-en-el-escenario-politico/?mcubz=3.

  27. Serge Latouche, L’Occidentalisation du monde (Paris: La Découvert, 1989). In 1958 Edmundo O’Gorman, in Mexico, had already advanced what Latouche would argue thirty years later, not knowing O’Gorman’s work. See his La invención de América: El universalismo de la cultura de occidente (Mexico City: Universidad Autónoma de México, 1958). The first offered a First World perspective, at the end of the Cold War, while the former offered a Third World perspective at the beginning of the Cold War.

  28. পড়ুন Walter D. Mignolo, Local Histories/Global Designs: Coloniality, Subaltern Knowledges and Border Thinking, 2nd ed. with a new preface (Princeton, NJ: Princeton University Press, 2012). আরও পড়ুন ক্যাথারিন ওয়ালশের সঙ্গে কথোপকথন, “Las geopolíticas del conocimiento y la colonialidad del poder,” in Indisciplinar las ciencias sociales: Geopolíticas del conocimiemto y colonialidad del poder. Perspectivas desde lo andino, ed. Catherine Walsh, Freya Schiwy, and Santiago Castro-Gómez (Quito: Abya Yala, 2002), http://www.oei.es/salactsi/walsh.htm.

  29. পড়ুন Walter D. Mignolo, “Enacting the Archive, Decentering the Muses,” in Ibraaz: Contemporary Visual Culture in North Africa and the Middle East, November 2013, accessed May 24, 2016, http://www.ibraaz.org/essays/77, and “Re-Emerging, Decentering and Delinking.” এই প্রসঙ্গে, এই গ্রন্থের প্রথম ভাগ পড়ুন, Walsh, “Decoloniality In/As Praxis.” AviI co–b Interculturalidad, estado, sociedad: Luchas (de)coloniales de nuestra época (Quito: Universidad Andina Simón Bolívar and Ediciones Abya-Yala, 2009), http://www.flacsoandes.edu.ec/interculturalidad/ wp-content/ uploads/ 2012/ 01/ Interculturalidad-estado-y-sociedad.pdf. AviI co–b Walsh and Mignolo, “Interculturality, State, Society: Catherine Walsh and Walter Mignolo in Conversation,” Reartikulacija, 2010, accessed May 23, 2016, https://www.academia.edu/12871436/Interculaturality State Society Catherine Walsh and Walter Mignolo in _conversation Part I.

Scroll to Top