Anyone who denies the law of non-contradiction should be beaten and burned.
Until he admits that to be beaten is not the same as to not be beaten,
And to be burned is not the same as not to be burned.
Ibn Sina, al-Hikma al-‘ArudiyaDo I contradict myself?
Very well, then, I contradict myself.
(I am large, I contain multitudes.)
Walt Whitman, ‘Song of Myself‘
প্রেক্ষাপট
নির্বাণ লাভের পর গৌতম বুদ্ধ যখন বিভিন্ন স্থানে ধর্মজ্ঞান প্রদান করছিলেন সে সময়কার কথা। একদিন ভোরে, সূর্য তখনো সম্পূর্ণ ওঠেনি, বুদ্ধ শ্রাবস্তী নগরে প্রবেশ করছিলেন। তখন হঠাৎ তার মনে হলো নগরে প্রবেশের জন্য এখন অনেক ভোর। তাই তিনি নগরের পাশে থাকা মল্লিকা উদ্যানে প্রবেশ করলেন। সেখানে পরিব্রাজক পোটঠপাদ প্রায় তিনশত ভিক্ষুর সাথে তত্ত্ববিদ্যা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। বুদ্ধ উপস্থিত হলে, পোটঠপাদ তার অবস্থান ছেড়ে দিয়ে তার পাশে খানিকটা নিচে বসেন। তখন আলাপচারিতার এক পর্যায়ে পোটঠপাদ বুদ্ধকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন –
পোটঠপাদ : ভন্তে, মরণের পর তথাগতের পুনঃজন্ম হয় কি? ইহাই একমাত্র সত্য, অন্য প্রকার দৃষ্টি কি নিরর্থক?
বুদ্ধ : পোটঠপাদ এই বিষয়েও আমি কোন মত প্রকাশ করি নাই।
পোটঠপাদ: ভন্তে, তবে মরণের পর কি তথাগতের পুনঃর্বিভাব হয় না ? ইহাই একমাত্র সত্য, অন্য প্রকার দৃষ্টি কি নিরর্থক?
বুদ্ধ : পোটঠপাদ, এই বিষয়েও আমি কোন মত প্রকাশ করি নাই।
পোটঠপাদ: ভন্তে, তবে কি মরণের পর তথাগতের পুনঃজন্ম একাধারে হয় এবং হয় না ? ইহাই একমাত্র সত্য, অন্য প্রকার দৃষ্টি কি নিরর্থক ?
বুদ্ধ : পোটঠপাদ, এই বিষয়েও আমি কোন মত প্রকাশ নাই।
পোটঠপাদ: ভন্তে, তবে কি মরণের পর তথাগতের পুনঃজন্ম হয় না, এবং উহা যে হয় না তাহাও নহে ? ইহাই একমাত্র সত্য, অন্য প্রকার দৃষ্টি কি নিরর্থক ?”
বুদ্ধ : পোটঠপাদ, এই বিষয়েও আমি কোন মত প্রকাশ নাই।
(দীর্ঘ নিকায়, পোটঠপাদ সূত্র : ২৭)
বুদ্ধ এই রকম দশটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নীরব ছিলেন। আমরা অনেকেই নীরব থাকি প্রতিবাদ করে, কখনো নীরবে সম্মতি জানাই। তা কখনো যৌক্তিক, কখনো অযৌক্তিক। কিন্তু বুদ্ধের তত্ত্ববিদ্যা সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন নিয়ে নীরবতা কোন প্রতিবাদ বা সম্মতি প্রদর্শন নয় বরং এটি তত্ত্বগত একটি অবস্থান। এই নীরবতার তত্ত্বগত অবস্থান ব্যাখা করার প্রচেষ্টা করেছেন অনেক বৌদ্ধ দার্শনিক ও গবেষক। তা নিয়ে আবার যথেষ্ঠ মতান্তরও রয়েছে।
পোটঠপাদ ও বুদ্ধের তত্ত্ববিদ্যা বিষয়ক আলোচনার দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে- (ক) যে কোন বিষয় সম্পর্কিত চারটি অবধারণ পাওয়া সম্ভব; যাকে বৌদ্ধ সাহিত্যে চতুষ্কোটি বলা হয়ে থাকে, আর (খ) সবগুলি অবধারণ অগ্রহণযোগ্য হতে পারে। এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আবার পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে চরম বিস্ময়কর। কারণ পাশ্চত্যের চিন্তায় এরিস্টটলের সহানুমানের রয়েছে গভীর প্রভাব; বিশেষ করে চিন্তার নীতির প্রশ্নে। এরিস্টটটলের নীতিগুলো হল- (i) অভেদ নীতি (Law of Identity), (ii) নির্মধ্যম নীতি (Law of Excluded middle), (iii) বিরোধ নীতি (Law of contradiction)। অভেদ নীতি অনুসারে: ‘আমি’ আমিই, অন্য কেউ নই। অন্যদিকে, আমি এখন এই কক্ষে আছি; অথবা এই কক্ষের বাহিরে বিশ্বের যে কোন স্থানে আছি – এই দুই অবধারণের মধ্যবর্তী কোন অবস্থান নেই; এই অবস্থানহীনতা-ই হচ্ছে নির্মধ্যম নীতি। আবার, আমি একই সাথে এই কক্ষে এবং তার বাহিরে থাকতে পারি না, কারণ এর অন্যথা ঘটলে তা হবে বিরোধীতা। এরিস্টটল চিন্তার এই নীতিকে বলেছেন বিরোধ নীতি। কারো চিন্তায় যদি নীতিগুলোর ব্যত্যয় ঘটে, তবে তার চিন্তা অযৌক্তিক। আর কেউ যদি তা অস্বীকার করে তবে এরিস্টটলের ভাবপুত্র ইবনে সিনার মতে, তাকে ততক্ষণ পর্যন্ত বেত্রাঘাত করা অথবা পোড়ানো উচিত, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে বেতে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া ও না হওয়ার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। অথবা তাকে ততক্ষণ পর্যন্ত পোড়ানো উচিত, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে আগুনে পোড়ানো এবং না পোড়ানোর মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারে। ইবনে সিনার হাজার বছর পূর্বে জন্মানোর কারণে বুদ্ধ রক্ষা পেয়েছিলেন সিনার বেত ও অগ্নি থেকে, কিন্তু রক্ষা পাননি পাশ্চাত্যের ‘যুক্তিহীন’ অপবাদের হাত থেকে।
পাশ্চাত্যের এই বিশেষ যুক্তি-ভাবনা, সার্বিক (universal) না হলেও বৈশ্বিক (global) ভাবনায় রূপান্তরিত হয়েছে বিগত কয়েক শতকে। যার অন্যতম কারণ বিগত কয়েক শতকের পাশ্চাত্য ক্ষমতা ও উপনিবেশ। যদিও সমকালীন গবেষকরা মনে করেন, পাশ্চাত্যের উপনিবেশের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও নৈতিক ভিত্তিপ্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে – ‘যৌক্তিক’ ও ‘অ-যৌক্তিক’ চিন্তার পৃথকীকরণের। এডওয়ার্ড সাঈদ তার Orientalism গ্রন্থে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের আত্মপরিচয় নির্মাণের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন ‘The oriental is irrational, depraved(fallen), childlike, “different”; thus the European is rational, virtuous, mature, “normal”” (Said, ২০০১: ৪০)। আনিয়া লুম্বা (১৯৯৮: ৪৭) এডওয়ার্ড সাঈদের বক্তব্যকে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন- ইউরোপীয় উপনিবেশী শক্তি “আপন” এবং “পর”এর ধারণার মধ্য দিয়ে উপনিবেশের নৈতিক ভিত্তি প্রদান করেছিলেন।
ইউরোপীয় রেনেসাঁ-উত্তর দর্শন-বিজ্ঞানের চর্চার ক্ষেত্রে মুক্ত চিন্তা যেমন ছিল গুরত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা; যা পরবর্তী সময়কালের আধুনিক দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। সে সময়কার চিন্তকরা মনে করতেন সঠিক চিন্তা এবং সুনিশ্চিত জ্ঞানের একমাত্র ধারক ও বাহক হচ্ছে এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা। যুক্তিবাদী হওয়ার অর্থই হলো এরিস্টটলের চিন্তার নীতি অনুসরণ করা। যারা তা অনুসরণ করে না তারা অযুক্তিবাদী, অনাধুনিক, পশ্চাৎপদ এবং বর্বর, যেমন- ভারতসহ সকল উপনিবেশীত দেশের জাতিগোষ্ঠি। অন্যদিকে যুক্তিবাদী, আধুনিক, উন্নত জাতি হচ্ছে ইউরোপিয়রা। সে কারণে, ইউরোপীয় উপনিবেশ ছিল ঐতিহাসিকভাবে সময়ের দাবী; কারণ যুক্তিহীন, অসভ্য ও অলস জাতির নিজেদের শাসন ভার পরিচালনা করার ক্ষমতা নেই। তাই ইউরোপীয়দের দায়িত্ব হচ্ছে শাসনের মাধ্যমে আমাদের সভ্য করে ও কর্মঠ করে তোলা, সর্বোপরি যুক্তিবাদী করে তোলা। তাই যুক্তির এই বিশেষ ধারনা ইউরোপীয়দের আত্মপরিচয়ের ও উপনিবেশের নৈতিক ভিত্তির সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। অন্যদিকে, দীর্ঘ আড়াই হাজর বছরে যুক্তিবিদ্যার যে চারটি ধারার বিকাশ হয়েছে ভারতে (যথাক্রমে: প্রাচীন ন্যায়, নব্যন্যায়, বৌদ্ধ-ন্যায় এবং জৈন ন্যায়), তা ইন্দলোজিস্টদের লেখায় আংশিক ও খণ্ডিতভাবে উপস্থাপিত হওয়ায় ভারতীয় যুক্তিতত্ত্বগুলি অগ্রাহ্য হয়েছে ইউরোপীয় বোদ্ধাদের কাছে (আলম: ২০১৩)। তাই, ভারতীয় যুক্তিতত্ত্বনির্ভর দর্শনচর্চা ইউরোপীয়দের কাছে নিতান্তই যুক্তিহীন – ইন্দ্রিয়ের-অতীত ভাবালুতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
ইংরেজ শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি। এই সম্পর্কে সমকালীন বিশ্বের অন্যতম দার্শনিক এবং যুক্তিবিদ গ্রাহাম প্রিস্ট (Graham Priest: 2014) চতুষ্কোটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, “সমকালীন পাশ্চাত্যের গবেষকরা এখনও মনে করেন- `it’s all just mysticism’। এমনকি ভারতীয় ও দূর-প্রাচ্যের অনেক গবেষক বুদ্ধের নীরবতাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘বিব্রত বোধ করেছেন’১ (Bharadwaja, 1984: 304)। তাই এই বক্তৃতায় আমি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করবো, তত্ত্ববিদ্যা বিষয়ক বুদ্ধের এই নীরবতা শুধু যৌক্তিকই ছিল না বরং এরিস্টটলের সহানুমানের মত একটি যুক্তিতত্ত্ব – চতুষ্কোটি। যা পালি নিকায় সাহিত্য ও পরবতীকালে সংস্কৃত ভাষায় রচিত বৌদ্ধ নৈয়ায়িক ও দার্শনিকদের লেখায় বিকাশ লাভ করেছে।
[1] “….. have felt ascertain level of philosophical embarrassment while diseasing them” in Bharadwaja, V. K. (1984) ‘Rationality, Argumentation and Embarrassment: A Study of Four Logical Alternatives (catuṣkoṭi) in Buddhist Logic’ in Philosophy East and West, Vol. 34, No. 3, pp. 303-319.
চতুষ্কোটি কী
সংস্কৃত শব্দ “চতুষ্কোটি (चतुष्कोटि)”, যার অর্থ হচ্ছে ‘চার স্তম্ভ’ বা ‘চার কোণ’ । কিন্তু, বৌদ্ধ সাহিত্যে “চার বিকল্পের ‘যুক্তিতত্ত্ব’কে” চতুষ্কোটি বলা হয়ে থাকে। চতুষ্কোটির প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় পালি নিকায় সাহিত্যে। পালি নিকায় সাহিত্যে চতুষ্কোটিকে বলা হয়েছে ‘ঐ চার অবস্থা’(সংযুক্ত নিকায়, ৪: ৩৮০) এবং (Jayatilleke, ১৯৬৭ :৬৯) । অর্থাৎ যে কোন বিষয় সম্পর্কে যৌক্তিক ভাবে চারটি অবধারণ থাকবে বা পাওয়া সম্ভব। পূর্বে উল্লেখিত পোটঠপাদ সূত্র ছাড়া কথাবথু, মজঝিম নিকায়, সংযুক্ত নিকায়, অঙ্গুত্তর নিকায় সহ ত্রিপিটকের অনেক সূত্রে চতুষ্কোটির ব্যবহার লক্ষণীয়। নিম্নে আরো কয়েকটি উদাহরণ প্রদান করা হল-
- (P1) ব্যক্তিটি সম্পূর্ণ সুখী
- (P2) ব্যক্তিটি সম্পূর্ণ অসুখী।
- (P3) ব্যক্তিটি সুখী এবং অসুখী
- (P4) ব্যক্তিটি সুখীও নয় অসুখীও নয়।
- (P1) আত্মা ও দেহ একই।
- (P2) আত্মা ও দেহ ভিন্ন ।
- (P3) আত্মা ও দেহ এক এবং ভিন্ন।
- (P4) আত্মা ও দেহ একও নয় ভিন্নও নয়।
(দীর্ঘ নিকায়, পোটঠপাদ সূত্র)
যে কোন বিষয় সর্ম্পকে এই চারটি অবধারণ সম্ভব, তার চেয়ে বেশিও হতে পারে না, কমও হতে পারে না। তা পরবর্তীকালে বৌদ্ধ দার্শনিক এবং নৈয়ারিকদের লেখা থেকে আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নাগার্জুন এবং তার শিষ্য আর্যদেব যথাক্রমে মূল মধ্যমক কারিকা ও চতুঃশত গ্রন্থে বলেন –
সবকিছুই হয় সৎ অথবা অসৎ অথবা
সৎ এবং অসৎ উভয়ই
অন্যথায় সৎও নয় অসৎও নয়
তা-ই ভগবান বুদ্ধের শিক্ষা ।।(মূল মধ্যমক কারিকা, XVIII : ৮)
আস্তি, নাস্তি, আস্তি এবং নাস্তি
অথবা, আস্তিও নয় নাস্তিও নয়।
এমন বাদবিধি সদা ব্যবহার হয়
সত্তা ও অন্য বিষয়ে ।।(চতুঃশত, XIV : ২২)
কে.এন. জয়তিলক (Jayatilleke, ১৯৬৭ : ৭১) এর মতে এই চার বিকল্পের বাইরে আর কোন যৌক্তিক অবস্থান নেই এবং এই চার অবধারণ যে কোন অবস্থার পূর্ণাঙ্গ চিত্র উপস্থাপন করতে সক্ষম। এটি সত্য যে, এই চার বিকল্প যে কোন অবস্থার সম্ভাব্য সকল অবস্থাকে নির্দেশ করে। কিন্তু, এই চার বিকল্পের সবগুলোই মিথ্যা বা অগ্রহণযোগ্য হতে পারে। আমরা পূর্বে দেখেছি পোটঠপাদের প্রদত্ত চারটি অবস্থানই বুদ্ধ অগ্রহণযোগ্য মনে করেন। এই ধরনের অনেক উদহারণ ত্রিপিটক ও মধ্যামিকা দার্শনিকদের লেখায় পাওয়া যায়। বিশেষ করে প্রাসঙ্গিক মধ্যামিকদের লেখায়, যেমন- নাগার্জুন ও চন্দ্রকীর্তি।
মধ্যামিকা দার্শনিকগণ মনে করেন, জগত সম্পর্কিত আমাদের সকল জ্ঞান ’দৃষ্টি জ্ঞান’, যা বস্তু সম্পর্কিত সত্যোপলব্ধি নয়। তাই আমাদের জ্ঞান পরমার্থ সত্য নয়। বরং তা সংবৃতি সত্য। কোন বিষয় সম্পর্কিত সকল বিকল্পই যে অগ্রহণযোগ্য বা পরমার্থ সত্য নয়; এমন ধারণা মধ্যামিক দার্শনিকদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এক মত মিথ্যা প্রমান করলে বিরুদ্ধ মত যদি সত্য হয় তাহলে মধ্যামিকা দার্শনিকগনের পক্ষে শূন্যবাদ যৌক্তিকভাবে প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। তাই চারটি বিকল্পের সবকটি মিথ্যা হওয়ার সম্ভবনা প্রসঙ্গপাদন পদ্ধতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। নিম্নে কয়েকটি উদাহরণ প্রদান করা হল, যেখানে চার বিকল্পের কোনটিই সত্য নয়।
‘শূন্য’ বলা যাবে না
‘শূন্য নয়’ তাও বলা যাবে
উভয়ই, অথবা এটিও নয়, ওটিও নয়;
তাও বলা যাবে না।
তা ব্যবহার করা হয়ে থাকে সম্বৃতি হিসাবে।(মূল মধ্যমক কারিকা, XXII : ১১)
নির্বাণ লাভের পর, তথাগত
অস্তিত্বহীন বলা যেমন অশ্রেয়
তেমনি অনস্তিত্বশীল বলাও অশ্রেয়
তেমনি উভয়ই বা কোনটিই নয়
তাও বলা যাবে না।(মূল মধ্যমক কারিকা, XXV : ১৭)
সে কারণে গ্রাহাম প্রিস্ট (২০১০) এবং জয় গারফিল্ড (২০০৯) মনে করেন, এরিস্টটলের সহানুমান যেমন নির্মধ্যম নীতি (Law of Excluded middle) অনুসরণ করে, তেমনি চতুষ্কোটি নির্পঞ্চম নীতি (Law of Excluded Fifth) অনুসরন করে। কিন্তু বিহার থেকে ৫০০০ হাজার কিলোমিটার দূরে প্রায় দুই শতক পর গ্রীসের এথেন্সে এরিস্টটল তার অধিবিদ্যা (Metaphysics) গ্রন্থে নির্পঞ্চম নীতিকে সম্পূর্ণ অগ্রণযোগ্য বলে মনে করলেন। যদিও একজন অপরজনের চিন্তার সাথে অপরিচিত ছিলেন না। এরিস্টটল মনে করেন, কোন অবস্থা সম্পর্কে দুটি অবধারণা থাকতে পারে। যেমন (১) গ্লাসে পানি আছে অথবা, (২) গ্লাসে পানি নেই। যে কোন একটি সত্য হলে অপরটি মিথ্যা। সত্য মিথ্যার মধ্যবর্তী কোন অবস্থান যেমন নেই, ঠিক তেমনি এই দুই অবধারণার মধ্যবর্তী কোন অবধারণাও নেই। যাকে এরিস্টটল বলেন নির্মধ্যম নীতি এবং ল্যাটিন ভাষায় যাকে বলা হয় `tertium non-datur’ অর্থাৎ কোন মধ্যবর্তী অবস্থা প্রদান করা হয়নি। এ সম্পর্কে এরিস্টটল বলেন- “It is necessary in every case to affirm or deny and that it is impossible that there should be anything between the two parts of a contradiction.” (Aristotle, Metaphysics, Book III: 9966-26-30) | তিনি আরো বলেন- “There cannot be an intermediate between contradictory but of one subject we must either affirm or deny any one predicate. (Aristotle, Metaphysics, Book IV: CH7-P531) |
আবার ধরা যাক, R : ‘বাংলাদেশের বর্তমান রাজার মাথা টাক’। এখন আমি যদি দাবি করি R বাক্যটি সত্য, তবে বাংলাদেশে অবশ্যই একজন রাজা আছেন এবং তার মাথায় অবশ্যই টাক আছে। যদি বলি R মিথ্যা, তবে তার অর্থ হবে বাংলাদেশের একজন রাজা আছে এবং তার মাথায় চুল আছে। কিন্তু আমরা জানি বাংলাদেশের কোন রাজা নেই। এটি বিগত শতাব্দীতে ভাষাদর্শন এবং দার্শনিক যুক্তিবিদ্যায় আলোচিত সমস্যা। এ রকম হাঁ- না; অথবা সত্য-মিথ্যা, অনেক অবস্থাকেই নির্দেশ করার জন্য যথেষ্ঠ নয়। সে জন্য প্রয়োজন দুই এর অধিক বিকল্পের। তাই নির্মধ্যম নীতি সার্বিক নীতি বলে প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এরিস্টটলের এমন ধরনের চিন্তার সমালোচনা অবশ্য শুরু হয় এরিস্টটলের সময় থেকেই। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় আক্রমণটা আসে তারই নিজের লেখা থেকে। এরিস্টটল তাঁর De Interpretation গ্রন্থের নবম অধ্যায়ে স্বীকার করেন যে, ভবিষ্যত সম্পর্কিত অবধারণাগুলো সত্য বা মিথ্যা হতে পারে না। যেমন : Q: আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে।’এই Q অবধারণ বা বচন সত্য বা মিথ্যা; এর কোনটাই আমরা এই মুহূর্তে সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারি না। যদি আমরা Q অবধারণাকে সত্য মনে করি, তবে তাকে অবশ্যই যৌক্তিক ভাবে অবশ্যম্ভাবী (Logical necessity) হতে হবে; কিন্তু তা অসম্ভব কেননা ভবিষ্যত অনিশ্চিত। তার মানে আমাদের এমন কিছু অবধারণা রয়েছে, যা সত্য মিথ্যা দিয়ে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
এরিস্টটলের বিরোধকে শুধু বাচনিক বিরোধ ( P and (not)P ) হিসেবে চিহ্নতই করেননি, বরং সত্তাজগতে বা বাস্তব জগতে কোন বিরোধপূর্ণ বৈশিষ্ঠ্য থাকতে পারেনা বলেও তিনি মনে করেন। এ সম্পর্কে Metaphysics গ্রন্থে তিনি বলেন- “It is impossible that the same thing can both belong and not belong to the same thing at the same time and in the same respect.” (Aristotle, Metaphysics, Book IV: 1005b19-20)
বাস্তব জগতে সকল আম সম্পূর্ণ সবুজ বা হলুদ হয় না সবসময়। একই আমে সবুজ, হলুদ এবং লাল বর্ণ একই সাথে মিলে থাকতে পারে। তাই, বাস্তব জগতে কোন অবশ্যই বিরোধপূর্ণ বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে এবং তা চতুষ্কোটির তৃতীয় অবস্থানকে নির্দেশ করে। কিন্তু, বাচনিক বিরোধ গ্রহণযোগ্য নয় চতুষ্কোটির যুক্তিতত্ত্বে। যদিও প্রিস্ট মনে করেন, এই চারটি আবধারণের সবগুলোই সত্য হতে পারে। কিন্তু জয়তিলক (Jayatilleke, ১৯৬৭: ৭১) মজিঝম নিকায় এর উদ্ধৃতি করে বলেন- “The Nikayas confirm the fact that if one of the four alternatives stated is true, then the others are false”। তাহলে আমরা বলতে পরি, চতুষ্কোটির বৈশিষ্ট্য গুলি হচ্ছে –
- যে কোন বিষয় বা অবস্থার চারটি যৌক্তিক অবধারণ সম্ভব।
- যে কোন একটা অবধারণ সত্য হলে অপরগুলি মিথ্যা। তাই সবগুলো অবধারণ সত্য হতে পারে না।
- কিন্তু সবগুলো অবধারণ মিথ্যাও হতে পারে।
এখন, আমরা একটি উদাহরণ ব্যবহার করে চতুষ্কোটি যুক্তিতত্ত্বটি ব্যাখ্যা করতে পারি।
- (P1) গ্লাসে পানি আছে।
- (P2) গ্লাসে পানি নাই।
- (P3) গ্লাসে পানি আছে এবং নেই।
- (P4) গ্লাসে পানিও নেই এবং তা পানিশূন্যও নয়।

সতীশ চন্দ্র বিদ্যাভূষণ প্রথম বৌদ্ধ যুক্তিবিদ্যাকে ইংরেজি ভাষার পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করেন ১৯২১ সালে। পরবতীতে বৌদ্ধ যুক্তিবিদ্যার উপর অনেক বই এবং প্রবন্ধ লিখেছেন অনেক গবেষক। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন টুসি (১৯২৯), শ্চেরবাৎস্কি (১৯২৭), সিয়ার (১৯৩৩), রবিনসন (১৯৫৭), জয়তিলক (১৯৬৩), গুনারতনে (১৯৮৬), টিলেমান (১৯৯৯), জয় গারফিল্ড (২০০৯) ও গ্রাহাম প্রিস্ট (২০১০)। তাদের সবাই বিভিন্নভাবে চতুষ্কোটিকে যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্ঠা করেছেন। কিন্তু, তাদের ব্যাখ্যাগুলোর সীমাবদ্ধতা ও সমস্যা রয়েছে। গুনারতনে সেট ও ভেন্-ডায়াগ্রাম ব্যবহার করে চতুষ্কোটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। আমি তা এখানে উপস্থাপন করছি। পরবর্তীতে আমি তার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করব। আমরা যদি উপরে উল্লেখিত গ্লাসে ও পানির উদাহরণে ফিরে যাই, তাহলে গুনারতনে অনুসারে চতুষ্কোটিকে নিন্মোক্তভাবে ব্যাখ্যা করা চলে।
মনে করা যাক ‘A’ হচ্ছে সেই সকল গ্লাসের শ্রেণী, যাতে পানি আছে। ‘B’ হচ্ছে সেই সকল গ্লাসের শ্রেণী যাতে পানি নেই। ‘X’ যদি হয় গ্লাস, তবে P1, P2, P3 এবং P4 যথাক্রমে (i), (ii), (iii), এবং (iv) উপস্থাপন করে।

কিন্তু গুনারতনের ব্যাখ্যার সমস্যা হল চারটি বিকল্প অস্কীকৃতির পর আমরা যে পঞ্চম বিকল্প পাই তা যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করার কোন সুযোগ থাকে না। যদিও P4-কে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় সেট তত্ত্বের মাধ্যমে। তাই আমরা প্রতীকী চিহ্ন ব্যবহার করে নিম্নলিখিত ভাবে চারটি বিকল্পের অভ্যন্তরীণ যৌক্তিক কাঠামো প্রকাশ করি। আর তার উপর ভিত্তি করে বেলনাপের (Belnap, 1977) চার সত্যমূল্য সিমেনটিক্সের খানিকটা পরিবর্তন করে চতুষ্কোটিকে যৌক্তিক ভাবে উপস্থাপন করতে পারি। নিম্নে যদি’P’ ‘গ্লাস’, ‘W’ ‘পানি’ এবং ‘:’ ‘ধারণ করা’ নির্দেশ করেঃ

আমরা একটু লক্ষ্য করলে দেখবো, P1 এর নেতিবাচক উক্তি P2 এবং P3 এর নেতিবাচক উক্তি P4 । নিম্নে একটি ছকের মধ্যমে নিষেধক প্রক্রিয়া উপস্থাপন করা হলো।

এখন, বেলনাপের চার সত্যমূল্য সিমেনটিক্সের খানিকটা পরিবর্তন করে চতুষ্কোটিকে নিম্নভাবে উপস্থাপন করতে পারি।

উপসংহার
তাই বলা যেতে পারে, বুদ্ধের এই নীরবতা ভাষা-অপ্রকাশযোগ্য অতীন্দ্রিয় কোন সত্তা বিষয়ক নয়, বরং তা প্রকাশ করে তত্ত্ববিদ্যা বিষয়ক একটি যৌক্তিক অবস্থা। পাশ্চাত্যে দার্শনিকগণও নীরবতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ইমানুয়েল কান্ট, হাইডেগার, এমনকি ভিটগেনেস্টাইনের লেখার মধ্যেও পাওয়া যায়। কান্ট মনে করতেন এমন অনেক সত্ত্বা রয়েছে যা আমাদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানা সম্ভব নয়। সে কারণে সে সকল বিষয়ে আমাদের পক্ষে কথা বলাও সম্ভব নয়, তাই সেসব বিষয়ে আমাদের নীরব থাকা উচিত। ঠিক তেমনি হাইডেগার “What being is” এ প্রশ্ন উত্থাপন করে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে বলতে চেয়েছেন কেন আমরা এই বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারি না। ভিটগেনেস্টাইন তো রীতিমত প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ছাড়া অন্য সকল বিষয়ে–দর্শন, ধর্মতত্ত্ব বা নন্দনতত্ত্ব, অধিবিদ্যা সহ অন্যান্য সকল বিষয়ে আমাদের নীরব থাকতে বলেছেন। তা হলে বুদ্ধের এই নীরবতা কেন অযৌক্তিক অতীন্দ্রিয়বাদ? অতীন্দ্রিয় সত্তাকে ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয় বলে, নীরব থাকার পরামর্শ যদি পাশ্চাত্যের প্রতিনিধিত্বশীল দর্শনতত্ত্বে থাকতে পারে, তবে বুদ্ধ তত্ত্বগত স্ববিরোধিতা এড়াতে নীরব থাকলে কেন অযৌক্তিক বিবেচিত হবেন? সেই একই সূত্রে তাঁর দর্শন ভাবনাকে যৌক্তিকতাহীন অতীন্দ্রিয় ভাবালুতা বলাই বা কতটা যৌক্তিক। আর, তাই, পাশ্চাত্যের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে, ভিটগেনেস্টাইনের (Wittgenstein, 1953: 593) ভাষায় বলতে পারি –
A One Sided Diet.
(২০১৪ সালে সেন্টার ফর বুদ্ধিস্ট হেরিটেজ এন্ড কালচার, পালি এন্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বক্তৃতা )
গ্রন্থপঞ্জি
Aristotle (1999) Metaphysics, Joe Sachs (trans.), Green Lion Press.
Belnap, Nuel D. (1977) ‘A USEFUL FOUR-VALUED LOGIC’ in J. M. Dunn and G. Epstein(eds), Modern Uses of Multiple-Valued Logic 5-37, Reidel Publishing Company, Holland.
Bharadwaja, V. K. (1984) ‘Rationality, Argumentation and Embarrassment: A Study of Four Logical Alternatives (catuṣkoṭi) in Buddhist Logic’ in Philosophy East and West, Vol. 34, No. 3, pp. 303-319.
Cotnoir, Aaron J. “Nagarjuna’s Logic”. Analytic Philosophy and Asian Thought, (eds.) Y. Deguchi, G. Priest and K. Tanaka,( forthcoming).
Chi. R. S. Y. (1969) Buddhist Logic, Motilal Banarsidass Publication, Delhi.
Ganeri, J. (2008) ‘Towards a formal regimentation of the Navya-Nyaya technical langiage I & II’, in M. Chakraborty, B. Lowe, M. N. Mitra and S. Sarukkai eds. Logia, Navya-Nyaya & Applications- Homage to Bimal Krishna Mailal, Studies in Logic, Volume 15, London: College Publications.
Garfield, J. (1995) The Fundamental Principles of the Middle Way: Nāgārjuna’s Mūlamadhyamikakārikā. Oxford University Press, New York.
Garfield, J. & Priest, G.(2009) ‘Mountains are Just Mountains’ in Garfield, J. , D., Mario, &Tillemans, T. J (229) POINTING AT THE MOON, Oxford: Oxford University Press.
Gunaratne R. D. (1986) ‘Understanding Naagaarjuna’s Catuskoti’, Philosophy East & West V. 36 No. 3 . pp. 213-234.
Jayatilleke, K.N. (1963) Early Buddhist Theory of Knowledge, Wales: George Allen and Unwin.
Jayatilleke, K. N. (1967) ‘The Logic of Four Alternatives’ Philosophy East and West, Vol. 17, No. 1, pp. 69-83.
Loomba, A.(1998) COLONIALISM/POSTCOLONIALISM, Routledge, London.
Priest, G. (2008) Introduction to Non-Classical Logic: From If to Is, Cambridge: Cambridge University Press.
Priest, G. (2010) ‘The Logic of the Catuskoti’, Comparative Philosophy 1 , pp. 32-54.
Robinson, R. (1956) ‘Some Logical Aspect of Naagaarjuna’s System’ Philosophy East & West V. 6. pp. 213-234.
Said, E. W. (2001) ORIENTALISM, India: Penguin Books.
Stcherbatsky, Th. (1930) Buddhist Logic. Vols. 1 and 2 , Leningrad: Bibliotheca.
Tillemans, T. (1999) ‘Is Buddhist Logic Non-Classical or Deviant?’ in Scripture, Logic, Language: Essays on Dharmakirti and his Tibetan Successors, ch. 9. Wisdom Publication, Boston.
Vidyabhusana, S.C. (1921) A History of Indian Logic: Ancient, Mediaeval, and Modern Schools, Calcutta: Calcutta University.
Wittgenstein, Ludwing(1953), Philosophical Investigations, ed. G. E. M. Anscombe and R. Rhees, Oxford: Basil Blackwell.
আলম, সৈয়দ নিজার (২০১৩) ‘যুক্তির উপনিবেশিকরণ’ inThe Jahangirnagar Review, Part- C, Vol. XXIV, pp 199-210.
দীর্ঘ নিকায়, ভিক্ষু শীলভদ্র কর্তৃক অনুদত, মহাবোধি বুক এজেন্সী, কলিকাতা