ভূমিকা

আমরা বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই সন্ধিক্ষণের সূত্রপাত। এই অভ্যুত্থান একদিকে যেমন দেশের মানুষের মুক্তাকাঙ্ক্ষার জানান দেয়, অন্যদিকে জানান দেয়, এই রাষ্ট্র এখনো কীভাবে উপনিবেশের উত্তরাধিকার বহনের মধ্য দিয়ে নিষ্পেষক রাষ্ট্র হিসেবে হাজির রয়েছে।    

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে, কিন্তু বিগত পঞ্চাশ বছরে এদেশের জনগণ মুক্তি লাভ করেনি। যেমন ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক শাসনের সমাপ্তি ঘটলেও পরবর্তী দুই দশকে মানুষের মুক্তি ঘটেনি। আমরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে সাতচল্লিশে যে স্বায়ত্তশাসন অর্জন করি তা পরবর্তীতে পরিণত হয় পশ্চিম-পাকিস্তানি আধিপত্যবাদে, যা থেকে স্বাধীনতা আসে একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। কিন্তু দীর্ঘ জন-সংগ্রাম ও লক্ষ প্রাণের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সেই স্বাধীনতা পুনরায় স্বায়ত্তশাসনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। যে কারণে সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর এবং একাত্তর থেকে অদ্যাবধি পার্থক্য হয়েছে কেবল শাসকের জাত এবং চেহারায়। অর্থাৎ ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছে, জীবনযাত্রার মান কিছুটা বদলেছে এবং স্বাধীনতা পূর্ববর্তীকালে যে বৈষম্যগুলো ছিল, তার খানিকটা অবসান ঘটলেও বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি আসেনি।

মুক্তি না আসার কারণ—আমাদের বর্তমান রাষ্ট্র-ব্যবস্থা এবং শাসকগোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক চরিত্র। দেখা গেছে স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকেরাও প্রায়শই আবির্ভূত হয়েছে ঔপনিবেশিক স্বৈরশাসক রূপে। এক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক শাসকদের সঙ্গে স্বৈরশাসকদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মিল আছে—প্রথমত, বাংলাদেশের বর্তমান স্বৈরশাসকগোষ্ঠীও ঔপনিবেশিক শাসকদের মতো এদেশের সম্পদ লুট করে দেশের বাইরে নিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, ঔপনিবেশিক শাসকরা এদেশের সম্পদ লুট করে নিয়ে যেতো নিজ দেশে। কিন্তু বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীগুলো নিজ দেশের সম্পদ পাচার করে নিয়ে যায় অপর দেশে। দ্বিতীয়ত, ঔপনিবেশিক শাসকরা এই অঞ্চলের মানুষকে শুধু শোষণই করেনি, তাদের নূন্যতম মানবিক ও রাজনৈতিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত করেছে। এই বঞ্চিত করার মধ্য দিয়ে এদেশের মানুষ যেভাবে ব্যষ্টিক ও সামষ্টিকভাবে অবমূল্যায়িত হয়েছে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও সেই একই প্রক্রিয়া জারি রেখেছে এই দেশের স্বৈরশাসকরা। যেমন স্বাধীন মতপ্রকাশের টুঁটি চেপে ধরা, রাজনৈতিকভাবে সঙ্ঘবদ্ধ হতে বাধা দেয়, যখন তখন কাউকে আটক করা, গুম কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যা। এমন সব অবমূল্যায়নের প্রক্রিয়াকেই বলা যেতে পারে বিমানবায়ন। অর্থাৎ মানুষের জীবনের যে স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ তা থেকে তাকে বঞ্চিত করার প্রক্রিয়াই হচ্ছে বিমানবায়ন। এই প্রক্রিয়া সবচাইতে ভালো বোঝা যায় যখন ২০২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় এ দেশের একজন পুলিশ অফিসার তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলে, ‘গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না।’ এদেশের মানুষকে বিমানবে পরিণত করার প্রক্রিয়া এবং সম্পদ লুট করে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়ার তৎপরতা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরতান্ত্রিক ধারা এককালের ঔপনিবেশিক শাসনেরই ধারাবাহিকতা।

ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে যেমন প্রতিবাদ হয়েছে, আন্দোলন হয়েছে, গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, হয়েছে যুদ্ধ, ঠিক তেমনি হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধেও। এদেশের মানুষ ১৯৬৯-এ চেয়েছিলো স্বায়ত্তশাসন, ১৯৭১-এ স্বাধীনতা, ১৯৯০-এ গণতন্ত্রায়ন, এবং সর্বশেষ ২০২৪-এ বিমানবায়ন থেকে মুক্তি। তবে অতীতের কোনো গণঅভ্যুত্থানই না লুণ্ঠনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে; না পেরেছে বিমানবায়ন প্রক্রিয়াকে থামাতে। এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ রাষ্ট্রকল্পের অভাব। অভ্যুত্থানকে বিপ্লবে রূপান্তর করতে রাষ্ট্রকল্পের বিকল্প নেই। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা পুনরায় লক্ষ্য করছি হাজারো শহিদের আত্মত্যাগ বৃথা হতে চলেছে। এখনো জনপরিসরে আলাপ আটকে আছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা প্রদানে নতুন সংবিধান প্রয়োজন কি-না এমনতর প্রশ্নে। শুধুমাত্র সংবিধানের বৈপ্লবিক সংশোধনের মধ্যমেই ন্যায্য ও মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন নয়া রাষ্ট্রকাঠামো ও রাজনৈতিক সমঝোতা। আমাদের নয়া রাষ্ট্রকল্পে উঠে এসেছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা কীভাবে বিমানবায়ন প্রক্রিয়া জারি রেখেছে এবং তা থেকে উত্তরণের উপায়।

. বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অধিনীতি

ঔপনিবেশিক পর্বে এই অঞ্চলের মানুষ যেভাবে শাসিত হয়েছে সেই প্রক্রিয়াকে আমরা এককথায়  ‘বিমানবায়ন’ হিসেবে চিহ্নিত করি। ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ১৮ই মার্চ ১৯১৯ সালে ‘নৈরাজ্যিক এবং বিপ্লবী অপরাধ আইন’ (anarchical and revolutionary crimes act) পাস করে। এই আইনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল এ অঞ্চলের স্বাধিকার আন্দোলনকে রুদ্ধ করা। পাশাপাশি, ঔপনিবেশিক পুলিশকে ভয়ংকরভাবে ক্ষমতায়িত করা এবং যখন তখন বিনা অপরাধে গ্রেফতার, বিচার বহির্ভূত শাস্তি দেয়ার আইনি বৈধতা প্রদান করা। এরই যথার্থ নিদর্শন ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল জেনারেল রেজিনাল্ড ই ডায়ারের সাধারণ মানুষের উপরে নির্বিচারে গুলি করার নির্দেশ। কয়েক শতাধিক লোক এর ফলে মৃত্যুবরণ করে। কেবলমাত্র বিমানবকেই এমন হত্যাযোগ্য করে তোলা যায়। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের মানুষ যেমন স্তম্ভিত হয়েছিল, তেমনই আবার আন্দোলনকে ত্বরান্বিতও করেছিল। অন্যদিকে, রেজিনাল্ড ডায়ার ইংরেজদের কাছে রীতিমতো একজন মহানায়কে পরিণত হয়েছিল—তিনি যেন যথার্থ শিক্ষা দিতে পেরেছিলেন ভারতীয়দের। ঔপনিবেশিক আমলে আমাদের জীবনের কোন মূল্য ছিল না। মানুষের জীবনের যে স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ তা আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে উধাও করে দেয়া হয়েছিলো। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে একদিকে যেমন ঔপনিবেশিক আইনগুলো সম্পূর্ণরূপে বলবৎ রয়েছে, অন্যদিকে নতুন নতুন বাহিনী, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো নতুন দমনমূলক আইন এবং নিপীড়নের অভিনব সব কৌশল বাংলাদেশের মানুষকে আরও বেশি বিমানবে পরিণত করেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে রাজনৈতিক কারণে রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের পরিমাণ ঔপনিবেশিক শাসনামলের চেয়ে কম তো নয়ই, বরং আরও বেশি। এই অভ্যুত্থানের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা—আমরা খুঁজে পাই আবু সাঈদের মায়ের কথায়—“তুই মোর ছাওয়াক চাকরি না দিবু, মারলু ক্যানে”। এই আকাঙ্ক্ষা, বিমানবের মানব হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা, রাষ্ট্রের অংশীজন হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা। গণবিস্ফোরণের অভিব্যক্তির প্রধান নৈতিক প্রকাশ—বিমানবের মানবায়ন। ১৯৪৭ এবং ১৯৭১-এ রাষ্ট্রের অংশীজনদের সাথে রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপকদের কোনোরকম সমঝোতা হয়নি। ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান আমাদের সামনে মানবায়নের যে নীতি নিয়ে এসেছে, তাই হতে পারে রাষ্ট্রজন ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপকদের মধ্যে সমঝোতার মূল সূত্র। তাই ‘মানবায়ন’কে আমরা বলতে চাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সকল নীতির—অধিনীতি। এই নীতিই হবে ১৯৪৭ ও ১৯৭১-এ অপূর্ণ থেকে যাওয়া রাষ্ট্রের অংশীজনদের সাথে রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপকদের সমঝোতার মূল ভিত্তি। এই নীতিই রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার সব নীতির ভিত্তি হওয়া উচিত। যেহেতু, বিমানবায়ন ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার অন্যতম চরিত্র, ফলে বিউপনিবেশায়নের প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে মানবায়ন। এই মানবায়নের ধারণা পাশ্চাত্যের মানবকেন্দ্রিকতা বা মানবাধিকারের ধারণা থেকে ভিন্ন। প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশের অংশ রূপে মানুষের যে রূপ ও গঠন, মানবায়নের ধারণা তারই অভিব্যক্তি। মানবায়নের ধারণা বুঝতে হবে রাষ্ট্রের অংশীজনের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার সাপেক্ষে। তাই–

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অধিনীতি       রাষ্ট্রজনের বিউপনিবেশিত মানবায়ন

সংবিধান রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রের অপর নাম। শাসনতন্ত্রে শাসক ও শোষিতের ধারণা সবসময় বিরাজ করে। তাই সংবিধান রাষ্ট্রজনকে শোষিতে পরিণত করে। তাই আমরা মনে করি, চব্বিশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে সংবিধান নয় ব্যবস্থাপনাতন্ত্র। তাই আমরা মনে করি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কোনো সংবিধান থাকতে পারে না, থাকবে শুধুমাত্র ব্যবস্থাপনাতন্ত্র। বর্তমানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটি সংবিধান আছে। আছে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি ও আইন। কিন্তু, এই নীতিসমূহ প্রায় বিচ্ছিন্ন একেকটি দ্বীপের মতো যা রাষ্ট্রের একক সত্তার কোন চিহ্ন বহন করে না। ফলে, রাষ্ট্রীয় নীতিসমূহকে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন একটি অধিনীতি যা হবে বর্তমান এবং আগামীর যে কোন রাষ্ট্রীয় নীতির সংযোজন বা বিয়োজনের দার্শনিক ভিত্তি। তাই আমরা মনে করি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার অধিনীতি হবে—রাষ্ট্রজনের বিউপনিবেশিত মানবায়ন।

. বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নীতি

মানবায়নের লক্ষ্য বিমানবায়নের সমস্ত পথ, পন্থা ও শক্তিকে প্রতিহত করা, এবং রাষ্ট্রজনের মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করা। কিন্তু, মানবিক মর্যাদা নিজ থেকে প্রতিষ্ঠিত হয় না। তার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হয় সাম্যাবস্থা ও সামাজিক ন্যায়ের। যা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ন্যায্য-গণতন্ত্র, জাতিনিরপেক্ষতা, লিঙ্গনিরপেক্ষতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, শ্রেণি ও গোষ্ঠীনিরপেক্ষতার মধ্য দিয়ে। আমাদের দৃষ্টিতে, এই পাঁচ নীতি একাধারে মূল অধিনীতি মানবায়নেরই বর্ধিত ও অধীনস্ত রূপ।

.১ ন্যায্যগণতন্ত্র

গণতন্ত্র এমন একটি রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপনা যেখানে রাষ্ট্র-পরিচালনায় রাষ্ট্রজনের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। রাষ্ট্রজনের আকাঙ্ক্ষা যেমন নিত্য নয় তেমন সার্বিকও নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রাষ্ট্রজনের পরিবর্তিত আকাঙ্ক্ষার খানিকটা হলেও প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম। আকাঙ্ক্ষা যেমন পরিবর্তন হয়, আবার সবাই সকল বিষয়ে একমতও থাকেন না। ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যবস্থাপকের পরিবর্তনের একটা সুযোগ থাকে এবং সেই পরিবর্তন হয় রাষ্ট্রজনের আকাঙ্ক্ষায় ভর করে। অন্যদিকে, যেকোনো প্রকার একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা প্রায়সই উপেক্ষিত থেকে যায়। তার অন্যতম কারণ, এই ব্যবস্থাসমূহে জনগণের আকাঙ্ক্ষা কীভাবে প্রতিফলিত হবে, তার কোন স্পষ্ট ইশারা নেই; নেই জনগণের আকাঙ্ক্ষার সাপেক্ষে ক্ষমতার হস্তান্তর কীভাবে হবে, তার পথ ও পন্থা। এই বিবেচনায় রাষ্ট্রজনের আকাঙ্ক্ষা একনায়কতন্ত্রের থেকে অনেক বেশি প্রতিফলিত হয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। কিন্তু যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়, তা কখনো ন্যায্য ব্যবস্থা হতে পারে না। কেননা সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষা অনেকক্ষেত্রেই সংখ্যালঘিষ্ঠের নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর সেই সংখ্যালঘিষ্ঠ হতে পারে জাতের ভিত্তিতে, লিঙ্গের ভিত্তিতে, ভাষার ভিত্তিতে, ধর্মের ভিত্তিতে, এমন কি অর্থনৈতিক শ্রেণির ভিত্তিতেও। তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায়, তা আর যাই হোক, সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তি হতে পারে না। এই কারণে আমরা মনে করি, যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয় তা—অন্যায্য গণতন্ত্র। ন্যায্য গণতন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা, ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, গোষ্ঠী এবং শ্রেণির উপর ভিত্তি না করা, সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করা, কাউকে বিমানব না করা। পাশাপাশি রাষ্ট্রজনের আকাঙ্ক্ষার সাপেক্ষে ক্ষমতার হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দুটি নির্বাচিত সরকারের মধ্যবর্তী পর্বে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য থাকা উচিত নির্বাচনকালীন সরকার, যাতে নির্বাচনে রাষ্ট্রজনের আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটতে পারে। তাই আমরা, গণতন্ত্র নয়,  ন্যায্য-গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জোরালো দাবি জানাই।

.২ জাতিনিরপেক্ষতা

রাষ্ট্রের কোন জাতীয়তা থাকতে পারে না। জাতীয়তাবাদ ভাষাভিত্তিক হোক বা নৃগোষ্ঠীভিত্তিক হোক—রাষ্ট্রজনের মধ্যে তা বিভেদের জন্ম দেবেই । এই ধরনের নীতি একই রাষ্ট্রে বসবাসরত অপরাপর ভাষাগোষ্ঠী বা নৃগোষ্ঠীকে শুধু অপরায়নই করে না, অধিকাংশক্ষেত্রে বিমানবে পরিণত করে। রাষ্ট্রের সকল অংশীজন অর্থাৎ রাষ্ট্রজনের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অবশ্যই জাতিনিরপেক্ষ হতে হবে।

.৩ লিঙ্গনিরপেক্ষতা 

আজকের ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে লিঙ্গনিরপেক্ষতা মানবিক রাষ্ট্র ও ন্যায্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এক অপরিহার্য শর্ত। এর সূত্রপাত ঘটতে পারে ‘রাষ্ট্রপতি’ নামক পুরুষবাচক শব্দটি অপসারণের মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও যখন একটি রাষ্ট্রে সরকারি দলিলে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ শব্দটির ব্যবহার বা প্রচলন না ঘটে, তখন সেটি নির্দেশ করে রাষ্ট্র কতখানি পুরুষালি চরিত্রে আবির্ভূত হয়। একইভাবে কেবলমাত্র নারী-পুরুষ পৃথক বর্গকে ভাগ করার মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠা পায় অপরাপর লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করার প্রয়াস। এই আলাপ শুধু অধিকার প্রতিষ্ঠার নয়, পৃথকভাবে দেখার সীমাবদ্ধতাও। বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানের ১৯, ২৭, ২৮ ও ২৯ নং অনুচ্ছেদে সমতা, সমান সুযোগ এর কথা বলা হলেও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন হয়, যা আমাদেরকে এই দিকনির্দেশনা দেয়—বিদ্যমান সাংবিধানিক অধিকার লৈঙ্গিক ভেদাভেদ দূর করার জন্য যথেষ্ট নয়।

.৪ ধর্মনিরপেক্ষতা

মানবিক মর্যাদা, সাম্যাবস্থা ও ন্যায্য-গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ থাকার অর্থ রাষ্ট্রের তরফ থেকে জনগণের ধর্মচর্চায় কোনো বাধা-বিপত্তি তৈরি করা নয় বরং রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ থাকা মানে রাষ্ট্রজনের নিজ নিজ ধর্মচর্চার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। এর পাশাপাশি কোনো রাষ্ট্রজন যেন কোনোপ্রকার ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে বিমানবায়নের শিকার না হয়, তার নিশ্চয়তা বিধান করা। একইসঙ্গে ধর্মহীনতার স্বাধীনতাও নিশ্চিত করা। অর্থাৎ ধর্মের প্রশ্নে কোনো রাষ্ট্রজনের উদাসীন কিংবা সংশয়ী থাকার অধিকার সমুন্নত রাখা। আমাদের মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ না হলে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

.৫ শ্রেণি ও গোষ্ঠীনিরপেক্ষতা 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রভাব মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই লক্ষণীয়, শুধু প্রভাবই নয়, ব্যবসায়ীরা সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীও হয়েছে। আমরা এ-ও দেখেছি চালের ব্যবসায়ী খাদ্যমন্ত্রী হয়েছেন। এছাড়া, ব্যবসার প্রসার ও বিস্তারে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রনীতি ব্যবহার করার উদাহরণ রয়েছে প্রচুর। যার ফলে, বাংলাদেশে দ্রুত বিত্তশালীদের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, পাশাপাশি ধনী এবং দরিদ্রের অর্থনৈতিক ফারাকও তেমন ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। একটি আধুনিক রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যেখানে অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করা, সেখানে বাংলাদেশে অধিকাংশ নীতি নেয়া হয় বিশেষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বা বিত্তশালীদের সুযোগ-সুবিধা মাথায় রেখে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাই রাষ্ট্রের উচিত বিশেষ কোন শ্রেণিকে অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়া থেকে বিরত থাকা। শ্রেণি প্রশ্নে নিরপেক্ষ থাকা (এর অর্থ এই নয় যে, সমাজে পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠীকে বিশেষ সহায়তা দেয়া থেকে রাষ্ট্র বিরত থাকবে)। তাছাড়া, রাষ্ট্রের উচিত নয় কোন বিশেষ পেশাজীবী সংগঠন বা এলাকাকে অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করা, যদি না সুবিধা প্রদানের পেছনে কোনো সুস্পষ্ট নৈতিক কারণ থাকে।

. বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনানীতি

বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার মৌল ধারণাটি গভীরভাবে ঔপনিবেশিক। এই পরিচালনা পদ্ধতির মূল কথা হল শাসন করা। শাসন অবধারিতভাবেই শাসক ও শাসিতের জন্ম দেয়। আমাদের নয়া রাষ্ট্রকল্পের মানবায়ন অধিনীতি তাই শাসনের বিপর‌ীতে ব্যবস্থাপনাকে রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি হিসেবে অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে করে। রাষ্ট্রের অংশীজন কখনো শাসনযোগ্য হতে পারে না। বরং, রাষ্ট্রে তার হিস্যা বড়জোর সুব্যবস্থাপিত হতে পারে। ফলে, প্রশাসক নয়, নয়া রাষ্ট্রে আমরা ব্যবস্থাপক দেখতে চাই। রাষ্ট্রের এই ব্যবস্থাপনার বন্দোবস্ত মূলত চারটি অংশে বিভাজিত হবে এবং সেগুলো স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে কাজ করবে। এই চারটি অংশ হলো- আইনসভা, বিচার বিভাগ, শিক্ষা ও নির্বাহী বিভাগ। বিচার বিভাগ ও শিক্ষাকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণের ঐতিহাসিক ও প্রায়োগিক কারণ রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে বৃটিশ আমলে ঔপনিবেশিক ভারত পরিচালিত হয়েছে মূলত ৩৭০ জন আইএসপির দ্বারা। ফলে, এই অঞ্চলে সরকার বলতে ঐতিহাসিকভাবেই কেবল নির্বাহী বিভাগকে বুঝায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, নির্বাহী বিভাগের এই অতি কর্তৃত্বের ফসলই হলো বিমানবায়ন। প্রায়োগিক দিক বিবেচনায়ও শিক্ষা ও বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা রাখতে হবে। অতি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র সবসময় শিক্ষাকে নির্বাহী বিভাগ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তার (অপ)শাসনের বৈধতা উৎপাদনের স্বার্থে। শিক্ষা যাতে সরকারি বয়ান নির্মাণের কারখানায় পরিণত না হয় সেজন্য আমরা দাবি করি শিক্ষা ব্যবস্থার স্বশাসন। অন্যদিকে, বিচার বিভাগও যাতে সরকারি নিপীড়নের বৈধ হাতিয়ারে পরিণত হতে না পারে সেজন্য তারও স্বাধীন সত্তা রাষ্ট্রের মানবায়নের জন্য অত্যন্ত জরুরি। সর্বোপরি, আমরা মনে করি শাসনের বদলে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার দিকে যাওয়ার মূল কথা হলো ক্ষমতার স্বার্থান্বেষী অতিকেন্দ্রীকরণকে ভেঙে অংশীজনকে তার যথার্থ মর্যাদা প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রে তার নায্য হিস্যা বুঝিয়ে দেয়া।

.১ আইনসভা

নয়া রাষ্ট্রের আইনসভা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট হওয়া প্রয়োজন। আইনসভার নিম্নকক্ষের নাম হবে জনকক্ষ এবং উচ্চকক্ষের নাম হবে রাষ্ট্রকক্ষ। রাষ্ট্রকক্ষ ১০০ সদস্য নিয়ে গঠিত হবে, যারা সাধারণ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত অনুযায়ী মনোনীত হবেন। অন্যদিকে, জনকক্ষ ৪০০ সদস্য থাকবে, যার মধ্যে ১০০ আসন নারী সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ। সকল জনকক্ষ সদস্য সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন। কোনো সাধারণ আইন নিয়ে দুই কক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য হলে জনকক্ষ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বা উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান হবে।

বিশেষ আইন এবং ব্যবস্থাপনাতন্ত্র সংশোধনের জন্য দুই কক্ষের পৃথক অনুমোদন প্রয়োজন, যেখানে ব্যবস্থাপনাতন্ত্র সংশোধনে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট বাধ্যতামূলক। জনকক্ষের মেয়াদ পাঁচ বছর, তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে তা বিলুপ্ত করা যেতে পারে।

.২ বিচার বিভাগ

বাংলাদেশের জন্য একটি ব্যবস্থাপনাতান্ত্রিক আদালত গঠন করতে হবে, যা ব্যবস্থাপনাতান্ত্রিক বিষয়ে আইন ও প্রশাসনিক কাজ পর্যালোচনা করবে। সুপ্রিম কোর্ট ব্যবস্থাপনাকাঠামো ও অন্যান্য আইন পর্যালোচনার ক্ষমতা বহাল রাখবে। ব্যবস্থাপনাতান্ত্রিক আদালত শুধুমাত্র গণভোট দ্বারা গৃহীত সংশোধনী পর্যালোচনা করতে পারবে না। বিচারকদের নিয়োগ ও অপসারণের প্রক্রিয়া উভয় কক্ষের ভোটের মাধ্যমে হবে। বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণের জন্য উপজেলা পর্যায়ে বিচার ব্যবস্থা প্রসারিত হবে।

.৩ শিক্ষা

ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডের সুবাদে জ্ঞান আমাদের কাছে শাশ্বত চরিত্র নিয়ে হাজির হয়। যে-কারণে, তাকে প্রশ্ন করে এগিয়ে যাওয়া, কিংবা সেই জ্ঞানকেই এগিয়ে নেওয়া মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমাদের জন্য কঠিন। অথচ জ্ঞানচর্চার মৌলিক শর্তই হলো, বিদ্যমান জ্ঞানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। কেননা, যা আছে তাকে মেনে নিলে তো নতুন জ্ঞানের দরকারই পড়ে না। তাহলে চর্চার প্রসঙ্গই বা কোত্থেকে আসে! ফলে, জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে প্রথম এবং অত্যাবশ্যকীয় যে পরিবর্তনটা দরকার তা হলো: জ্ঞানের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো। অর্থাৎ, জ্ঞানকে সার্বিক বা শাশ্বত মনে করার কিছু নেই। আমাদের এই অঞ্চলে জ্ঞানকে দুইভাগে ভাগ করা হতো: একটি হচ্ছে পরমাত্মা, অপরটি সংবৃতি। সংবৃতি হচ্ছে সেই ধরনের জ্ঞান যা আপাত সত্য বা ব্যবহারিক সত্য। জৈনরা যেমন মনে করতেন প্রতিটি তত্ত্বই আংশিক সত্যকে উপস্থাপন করে। এর বিখ্যাত উদাহরণ হিসেবে যে হাতির গল্পটা পরিচিত তা জৈনদেরই গল্প। বৌদ্ধদের, বিশেষত মাধ্যমিকদের, অবস্থান এরথেকেও বৈপ্লবিক। তারা মনে করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কিত সকল তত্ত্ব আংশিক নয়, বরং সংবৃতি সত্য। অর্থাৎ ব্যবহারিক সত্য। চালু অর্থে যাকে বলা যেতে পারে “কনভেনশনাল নলেজ”। অন্যদিকে, পরমাত্মা হচ্ছে চূড়ান্ত জ্ঞান। এই চূড়ান্ত জ্ঞানও শাশ্বত নয়। মাধ্যমিকদের কাছে কোন জ্ঞানই শাশ্বত নয়।

কোনো জ্ঞানই যে শাশ্বত নয়, এই উপলব্ধিটা অত্যন্ত জরুরি। জ্ঞানকে বিচার করতে হবে ব্যবহার ও প্রয়োজনের সাপেক্ষে। “শিক্ষা” শব্দটি এখানে সংবৃত ও পরমাত্মা দুই ধরনের জ্ঞানেরই দ্যোতনা বহন করছে। যাইহোক, এখন প্রশ্ন হলো, আমরা আমাদের নিজেদের ব্যবহার ও প্রয়োজনের সাপেক্ষে কীভাবে জ্ঞান উৎপাদন করবো? এর সঙ্গে আবার যে প্রশ্নটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা হলো, জ্ঞান আসলে কীভাবে উৎপাদিত হয়? এই ধরনের মৌলিক প্রশ্নগুলোর সমাধানে আমাদের বিবেচনা করা দরকার আমাদের নিজস্ব জ্ঞানকাণ্ড থেকে কী কী গ্রহণ করে নিজেদের ব্যবহার ও প্রয়োজনের সাপেক্ষে তার সৃষ্টিশীল রূপান্তর ঘটাতে পারি। এর অর্থ কিন্তু কোনোভাবেই প্রাক-ঔপনিবেশিক অতীতকে ফিরিয়ে আনা নয়। এই বিষয়টা পরিষ্কার বুঝতে হবে। যেমন, বৈদিক সকল ধারায় জ্ঞান ছিল সার্বিক ও ঐকান্তিক এবং সেই জ্ঞান আত্মস্থ করাই ছিল শিক্ষা। মনুর বিধানানুযায়ী আবার শূদ্র ও নারী সেই শিক্ষা গ্রহণের অযোগ্য। এখন প্রাক-ঔপনিবেশিক বলে আমরা কী সেই ধারাকে মান্য করবো? মোটেই না।

ফলে, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ সংবৃত জ্ঞানকাণ্ড নির্মাণ, চর্চা ও প্রচার করবে। এই লক্ষ্যে অনুকূল ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা যেমন রাষ্ট্রের তরফ থেকে ক্ষমতা প্রয়োগ করে বলে দায়মুক্তি লাভ করে থাকে, অনুরূপভাবে রাষ্ট্রের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও রাষ্ট্রের তরফ থেকেই জ্ঞানোৎপাদনে নিয়োজিত থাকে বলে সেগুলোকে দায়মুক্তি প্রদান করতে হবে। একজন বিচারক যেমন কোনো ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার কারণে অপরাধী সাব্যস্ত হন না, তেমনই একজন গবেষকও তার উৎপাদিত জ্ঞানের জন্য, সেই জ্ঞান বিদ্যমান জ্ঞানের বিপরীতে গেলেও, দোষী সাব্যস্ত হবেন না। অর্থাৎ, বিশ্ববিদ্যালয় যে সংবৃত জ্ঞানকাণ্ড নির্মাণ করবে তা রাষ্ট্র, ধর্ম এবং সামাজিক রীতির বিরুদ্ধে গেলেও তা প্রকাশযোগ্য হবে। রাষ্ট্রের জ্ঞান হবে রাষ্ট্রজনের জন্য। যেহেতু সার্বিক জ্ঞান বলে কিছু নেই, ফলে তা পাঠ ও আত্মস্থ করারও কিছু নেই। বরং শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য হবে প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানের সংকট চিহ্নিতকরণ এবং তাকে ছাপিয়ে গিয়ে নতুন জ্ঞানের উৎপাদন। ফলে, সার্বিক জ্ঞানের নামে ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডের শিক্ষা নয়, বরং তার পরিবর্তে সংবৃত জ্ঞানকাণ্ড বা জ্ঞানতাত্ত্বিক বহুত্ববাদের চর্চা নিশ্চিৎ করতে হবে।

আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা জগৎ-জীবনবীক্ষা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। তাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগভিত্তিক বিভাজন বাতিল করে পদ্ধতিভিত্তিক বিভাজন চালু করতে হবে। প্রচলিত অভিজ্ঞতা থেকেই অপর যে সমস্যাটি সামনে আসে, তা হলো: শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক কর্তৃত্বক্রমানুযায়ী সাজানো। “শিক্ষক” এখানে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত চরিত্র, “শিক্ষার্থী” প্রান্তীয়। এই সম্পর্কের পরিবর্তন দরকার। আসলে জ্ঞানচর্চা তো সাধনা, যা নিষ্ঠা, শ্রম ও অধ্যাবসায়ের মধ্য দিয়ে নতুন জ্ঞান উৎপাদন করে। ফলে, জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত মানুষের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী হওয়া উচিৎ নয়। কেননা, শিক্ষক এখানে জ্ঞান বিতরণকারী আর শিক্ষার্থী গ্রহীতা রূপে হাজির হয়। বরং এই সম্পর্ক হতে পারে উত্তর-সাধক ও পূর্ব-সাধকের।

আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের  কোনো যোগাযোগ কিংবা জ্ঞানতাত্ত্বিক আন্তঃবিনিময় নেই। অথচ তাদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক থাকাটা খুবই জরুরি। বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে এই সকল প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে থাকে। কিন্তু তা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক স্থাপনের বিষয় নয়। যে-কারণে, আমাদের দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ পরস্পর বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বীয় পদে বহাল রেখে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বদলির বিধান করা প্রয়োজন। যেমন, একজন সহযোগী অধ্যাপক কিংবা অধ্যাপক স্ব-পদে বহাল থেকে ও সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে সেবা প্রদান করবেন। তাছাড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর যে বদলির বিধান রয়েছে, সেই বিধান মোটেও কার্যকর নেই। তা গুরুত্বের সঙ্গে কার্যকর করা দরকার। একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ সময় ধরে সেবা দেওয়ার কারণে সেবার মানের পাশাপাশি সেবাদানকারীর কর্মস্পৃহারও অবনতি ঘটে। সেই একই উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহেও অতিথি (ভিজিটিং) পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের “শিক্ষক” যেন তার স্বীয় প্রতিষ্ঠানে সংযুক্ত থেকেই আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করে খণ্ডকালীনভাবে সেখানে পাঠদান করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা প্রবর্তন করা দরকার। অন্যদিকে, স্নাতক পাঠদানের জন্য কলেজসমূহকে ঢেলে সাজাতে হবে। দেখা যায়, একসময়ের স্বনামধন্য সরকারি কলেজগুলো এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ও স্নাতক পর্যায়ের পরীক্ষা-গ্রহণের কেন্দ্রমাত্র হয়ে ওঠেছে। যার দরুন, পরীক্ষার হলসমূহে মাত্রাতিরিক্ত পাহারা দেওয়া ও অন্যান্য দাপ্তরিক কাজের কারণে শিক্ষকদের গবেষণা ও পাঠদানের  উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি-গ্রহণের পর্যাপ্ত সময় থাকে না। এতে সংশ্লিষ্ট কলেজগুলোতে গবেষণা ও শ্রেণিকক্ষে পাঠদান-প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক্ষেত্রে পরীক্ষার হল পাহারা দেওয়ার জন্য প্রত্যবেক্ষক পদে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণির আলাদা লোকবল নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। সেই প্রত্যবেক্ষকদের সহযোগিতায় একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে একাধিক কক্ষের দায়িত্ব প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষকদের ওপর দাপ্তরিক কাজের চাপ কমানো যাবে। দাপ্তরিক কাজের চেয়ে শিক্ষকদের জ্ঞানচর্চা ও গবেষণাকর্মে নিযুক্ত করতে হবে। এজন্য পরীক্ষামূলকভাবে কিছু সরকারি কলেজে শুধুমাত্র স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের জ্ঞানচর্চার সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। কলেজসমূহে শিক্ষকদের জন্য পুস্তকভাতা বৃদ্ধিসহ গবেষণা ও প্রকাশনা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণা-নির্ভর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে, কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধুমাত্র গবেষণার জন্য ঢেলে সাজানো দরকার, যেখানে কোনো স্নাতক পর্যায়ের পাঠদান চলবে না; কেবলমাত্র দুই বছর মেয়াদী গবেষণা-ভিত্তিক স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রির ব্যবস্থা থাকবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে পূর্ব-সাধক, উত্তর-সাধক ও গবেষকদের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে দায়মুক্তি থাকবে, কেননা, জ্ঞানচর্চার প্রাথমিক শর্তই হলো বিদ্যমান জ্ঞানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। ফলে, স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডি পর্যায়ের অভিসন্দর্ভ যেকোনো প্রকার সেন্সরশিপের আওতামুক্ত থাকবে। উপরন্তু, গবেষণাকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে তাদেরকে ছয় মাস মেয়াদী বাংলা ভাষা-বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি, সেই সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের  পাঠ-নির্দেশনার মাধ্যম ইংরেজি করা দরকার।

বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত পরীক্ষা পদ্ধতি গড়ে তোলা প্রয়োজন। যেখানে একটি সমন্বিত পরীক্ষার মাধ্যমে তালিকাক্রম তৈরি করা হবে। পরবর্তীতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা অনুযায়ী সেই তালিকার ভিত্তিতে প্রার্থী নিয়োগ দেওয়া হবে।  শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শীতা, নিজস্ব ভাষায় দক্ষতা, গবেষণায় আগ্রহ, বিশ্লেষণী ক্ষমতা, সাবলীল যোগাযোগের সক্ষমতা, নীতি-নৈতিকতাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিৎ। এক্ষেত্রে, বাংলাদেশের যে-সকল শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে দেশের বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেছে তাদের আকৃষ্ট করার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ।

রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য একটি বড়ো প্রতিবন্ধকতা। বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে বিরাজমান আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করা অত্যাবশ্যকীয়। যেমন শিক্ষা ক্যাডারে দেখা গেছে পদোন্নতি জনিত হতাশা বিরাজ করে, যা স্পষ্টভাবে জ্ঞানচর্চার অন্তরায়। এ-সকল কারণে, অনেকেই শিক্ষাক্ষেত্রে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অন্য চাকরিতে চলে যায়। ফলে, শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির জন্য একটি সুসমন্বিত বিধিমালা গঠন করা দরকার। সেই বিধিমালা অনুযায়ী নিয়মতান্ত্রিকভাবে পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে পদোন্নতির যে বিধান, তার একটি সমন্বিত কাঠামো থাকা দরকার এবং সরকারি কলেজসমূহের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হবে। এক্ষেত্রে অন্যান্য পেশায় বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে তা সমন্বয় করা আবশ্যক। এছাড়াও স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বৃত্তির সংখ্যা ও পরিমাণ ব্যাপকহারে বাড়াতে হবে। পিএইচডি পর্যায়ের গবেষণা বৈতনিক করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে গবেষণার মান অক্ষুণ্ন রাখার লক্ষ্যে পিএইচডি ভর্তি-প্রক্রিয়া উন্নত করা দরকার। গবেষণার প্রতিটি ধাপে জবাবদিহিতা থাকা আবশ্যক এবং পেশকৃত অভিসন্দর্ভটির হার্ডকপির পাশাপাশি সফট কপি সংশ্লিষ্ট আর্কাইভে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন, যা সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। কোনো পর্যায়ে তাতে কুম্ভিলকবৃত্তি ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তা সংশ্লিষ্ট আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে।

শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ভাষা প্রশ্ন অতীব গুরুত্বের সঙ্গে মীমাংসা করা দরকার। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিৎ করার পাশাপাশি, যারা বাংলা ভাষা জানে না তাদের জন্য, অর্থাৎ বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য (বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে), পদ্ধতিগতভাবে বাংলা ভাষা শেখার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের প্রধান ভাষা বাংলা ছাড়াও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃত আছে আরও ৪০টির মতো ভাষা। এই ভাষাসমূহের মধ্যে ১৪টির মতো ভাষা বিপন্নপ্রায়। ভাষাবৈচিত্র্য একটি ভূখণ্ডের সম্পদস্বরূপ। বিপন্নপ্রায় এই ভাষাসমূহের সংরক্ষণ ও চর্চার উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। সেই লক্ষ্যে প্রত্যেক নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নসহ প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট নৃগোষ্ঠীর ভাষায় প্রদান করা প্রয়োজন। এছাড়াও, সরকারি গুরুত্বপূর্ণ নথিসমূহ তাদের কাছে বোধগম্য করার স্বার্থে তাদের নিজস্ব ভাষায় তার অনুবাদ থাকা দরকার।

বাংলাদেশের মানুষ  উচ্চশিক্ষা, কর্মসংস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ভ্রমণের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গমন করে থাকে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা জানা থাকলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে তারা বিভিন্নভাবে তার সুফল ভোগ করবে। তাছাড়া, ভিনদেশি সমাজ, সংস্কৃতি ও জ্ঞানতত্ত্ব সম্পর্কে জানতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা জানা আবশ্যক। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা-ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে সেখানে আরবি, ফার্সি, জার্মান, ফরাসি, রুশ, চাইনিজ, জাপানিজ ও কোরিয়ান ভাষা শিক্ষা দিতে হবে। যে-সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে নামকাওয়াস্তে ভাষা-ইনস্টিটিউট রয়েছে, সেগুলোকে কার্যকর করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়াও সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য সেই প্রতিষ্ঠানসমূহে ভাষা শেখার সুযোগ থাকা দরকার।

বাংলা-অঞ্চলের জ্ঞানকাণ্ডে সংস্কৃত, পালি, আরবি, উর্দু, ফার্সি ইত্যাদি ভাষাসমূহের প্রভাব অপরিসীম। শিল্প-সাহিত্য, দর্শন ও ইতিহাসের বহু পাণ্ডুলিপি ও  দলিল সেই সকল ভাষায় রচিত। সেই সকল ভাষা ফলপ্রসূভাবে চর্চা করা আবশ্যক। সেই সকল ভাষা থেকে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যসমূহ বাংলা ভাষায় ব্যাপকভাবে অনুবাদ করতে হবে। বিভিন্ন বিদেশি ভাষা থেকে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে অনুবাদের ব্যবস্থা করতে হবে। স্নাতক পাশের সনদ লাভের জন্য, সংশ্লিষ্ট অনুষদের চাহিদা সাপেক্ষে, একজন শিক্ষার্থীকে ইংরেজি ছাড়াও অপর একটি ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক করা  দরকার।

ইংরেজি ভাষাকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা দরকার। কেননা ইংরেজি ভাষা জানা থাকলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা যায়। এই যোগাযোগ উচ্চশিক্ষা, কর্মসংস্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সুবিধাজনক। তাছাড়া, পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার জ্ঞানকাণ্ডে কেবলমাত্র ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই প্রবেশ করা যায়। জ্ঞানচর্চা ও বৈশ্বিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা এক-রকম অপরিহার্য। তাই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে, শাস্ত্র হিসেবে নয়, বরং একটি ভাষা হিসেবে কার্যকর উপায়ে ইংরেজি শেখার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে ইংরেজি যেন কোনোভাবেই ভাষার গণ্ডি পেরিয়ে ঔপনিবেশিক গরিমার প্রতীক না হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, ফার্সি কিংবা সোয়াহিলি ভাষা না জানায় যেমন লজ্জার কিছু নেই,  ইংরেজিও তেমনই একটি ভাষা যা না জানার অর্থ জ্ঞানগরিমায় ছোটো হয়ে পড়া নয়।

অন্যদিকে, বিদ্যায়তনে জ্ঞানচর্চায় দায়মুক্তিই যথেষ্ট নয়, পাশাপাশি শিল্প ও সাহিত্যচর্চায়ও অনুরূপ সুযোগ সৃষ্টি করা আবশ্যক। সেই লক্ষ্যে শিল্প ও সাহিত্য বিষয়ক সমস্ত কালো আইন নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। সমস্ত সেন্সরবোর্ডকে জবাবদিহিতার অধীনে আনতে হবে। সেন্সরের নামে যথেচ্ছাচার বন্ধ করা দরকার। তেমনই বাংলাদেশের শিল্প ও সাহিত্যকে বৈশ্বিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। সমস্ত বাংলাদেশি দূতাবাসে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গঠন করা দরকার। একইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় তরফ থেকে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহের পৃথিবীর বিভিন্ন প্রধান ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, প্রকাশনা সংস্থাসমূহের পেশাদারিত্ব বৃদ্ধিতে নিজস্ব সম্পাদনা পর্ষদ গড়ে তোলার বাধ্যবাধকতা থাকা দরকার। গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে লেখক ও প্রকাশকের মধ্যেকার লিখিত চুক্তি থাকা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন এবং এ-ব্যাপারে লেখক ও প্রকাশক উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষণ করে একটি সমন্বিত আইন তৈরি করা প্রয়োজন। অনুরূপভাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা ইনস্টিটিউটগুলোকেও কার্যকর করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় পাঠ্যগ্রন্থসমূহ সেখানে সুলভ মূল্যে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা দরকার। শিশু কিশোরদের মাঝে শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চার বীজ বপনের উদ্দেশ্যে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে উন্নতমানের বার্ষিকী প্রকাশ, বাৎসরিক সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।

.৪ নির্বাহী বিভাগ

বিউপনিবেশিত নয়া রাষ্ট্রকল্পে নির্বাহী বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদ ও প্রতিষ্ঠানকে নতুন শব্দ ও আঙ্গিকে সাজানো হয়েছে। যেমন: এখানে রাষ্ট্রপতি পদটির পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়ে রাষ্ট্রপ্রধান শব্দটি। একইভাবে, প্রধানমন্ত্রীর স্থলে মুখ্য ব্যবস্থাপক, মন্ত্রী শব্দটির বদলে ব্যবস্থাপক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী প্রভৃতি পদগুলো একাধারে রাজতান্দ্রিক, কর্তৃত্ববাদী ও পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার অভিব্যক্তি বলে মনে করি আমরা। ফলে চিন্তাগত রূপান্তরের জায়গা থেকে শব্দগুলো নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। একই ভাবে প্রশাসনের জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে ‘ব্যবস্থাপনা’ শব্দটি। পুলিশের বদলে ব্যবহার করা হয়েছে ‘নিরাপত্তা সেবা’ অভিধাটি। আইনসভায় দুটি কক্ষের নাম যথাক্রমে রাখা হয়েছে রাষ্ট্রকক্ষ ও জনকক্ষ। এছাড়াও সমগ্র রাষ্ট্রকল্পেই শাসন, প্রশাসন জাতীয় পদগুলোর ব্যবহার থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করা হয়েছে। কারণ আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি একুশ শতকে কোনো দেশের মানুষ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্ক শাসক ও শাসিতের হতে পারে না। একটি দেশ, একটি রাষ্ট্রের প্রত্যেক মানুষেরই সেই দেশ ও রাষ্ট্রের অংশীজন হওয়ার অধিকার আছে। তাই নাগরিক, সাবজেক্ট, জনগণ শব্দগুলোর বিপরীতে রাষ্ট্রজন শব্দটি বারংবার আমাদের আলোচনায় হাজির হয়েছে। 

রাষ্ট্রপ্রধান, মুখ্য ব্যবস্থাপক, জনকক্ষ, এবং রাষ্ট্রকক্ষ—এই গুরুত্বপূর্ণ পদ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা ও দায়িত্ব নতুন আঙ্গিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। নতুন কাঠামোতে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন, মুখ্য ব্যবস্থাপকের মেয়াদ সীমা, প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কার এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার কার্যক্রম পুনর্গঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপিত হয়েছে।

প্রতিটি স্তরে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা আনার জন্য একটি যুগান্তকারী প্রস্তাব করা হয়েছে। যেমন, নির্বাচনকালীন নির্বাহী পরিষদ গঠনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল নির্বাচন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার উদ্যোগ, প্রশাসনিক কাঠামোর বিকেন্দ্রীকরণ এবং নিরাপত্তা সেবা বাহিনী নামে পুলিশি কাঠামোর রূপান্তর, যা জনগণের আস্থাভাজন হয়ে কাজ করবে।

..১ নির্বাহী ও নির্বাচনকালীন নির্বাহী কাঠামো

নয়া রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধান একটি ইলেক্টোরাল কলেজের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন, যার মধ্যে উভয় কক্ষের সদস্য এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। রাষ্ট্রের মুখ্য ব্যবস্থাপক ও ব্যবস্থাপক সভা জনকক্ষের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে। কোনো ব্যক্তি টানা বা ভিন্ন সময়ে দুইবারের বেশি মুখ্য ব্যবস্থাপক থাকতে পারবে না।

জনকক্ষ বিলুপ্ত হওয়ার পর, ৯ জন সদস্য নিয়ে একটি নির্বাচনকালীন নির্বাহী পরিষদ গঠিত হবে। এই পরিষদ ১২০ কার্যদিবসের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে কাজ করবে এবং রাষ্ট্রকক্ষের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে। সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে গৃহীত হবে এবং রাষ্ট্রপ্রধান শুধুমাত্র পরিষদের সম্মিলিত পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন।

..২ স্থানীয় ব্যবস্থাপনা কাঠামো

বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যগত উভয় দিক থেকেই ঔপনিবেশিক। কাঠামোর দিক থেকে এটি অতিকেন্দ্রিভূত একটি ব্যবস্থা। যে কোন নির্দেশনা এখানে প্রবাহিত হয় উপর থেকে নিচের দিকে। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হল এ ধরনের প্রশাসনিক কাঠামো কোনভাবেই জনগণের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিবে না এবং তা মারাত্মকভাবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আক্রান্ত হবে। ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক কাঠামো  ছিল ঔপনিবেশিক সরকারবে সুদৃঢ় করার ব্যবস্থা। সেক্ষেত্রে বিউপনিবেশিত সরকারের ব্যবস্থাপনা হবে জনগণের প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা।

গণতান্ত্রিক পরিবেশে আমলা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও রাষ্ট্রজনের একটা পরিপূরক সম্পর্ক থাকার কথা। আমলাতন্ত্রের ওপরে থাকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। আর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ওপরে থাকে রাষ্ট্রজন। অর্থাৎ আমলাতন্ত্র সরকারের স্থায়ী অংশ হলেও তা এই অস্থায়ী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মেনে চলতে বাধ্য হয় বা এ পদ্ধতি কাজ করে, কারণ এই প্রতিনিধিদের পেছনে থাকে রাষ্ট্রজন। রাষ্ট্রের অংশীজনদের  যদি কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গৌণ করে তোলা যায় তাহলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় আমলাতন্ত্র। কারণ তাতে রাষ্ট্রজনকে হারিয়ে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিকরা দুর্বল হয়ে পড়েন। ফলে আমলাদের সঙ্গে অনুক্রমিক সম্পর্কের বদলে সৃষ্টি হয় চুক্তিভিত্তিক লেনদেনের সম্পর্ক। এমন সম্পর্ক তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া তখনই শুরু হয়, যখন সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রজনের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে না।

এ কারণে ব্যবস্থাপনা কাঠামোর মূল্যায়নে রাষ্ট্রজনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সরকারি সকল কর্মকাণ্ডে জনগণের মতামত গ্রহণের ব্যবস্থা থাকা উচিত। ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সেবা সংক্রান্ত অভিযোগ দাখিলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রয়োজন সরকারি কর্মকর্তাদের পারফরম্যান্স ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকল্পে কি পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর (কেপিআই) এবং তার যথাযথ প্রয়োগের নিশ্চয়তা। প্রয়োজন সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে গোপনীয় বার্ষিক প্রতিবেদনের গুরুত্ব ৩০ শতাংশে নামিয়ে এনে সেবা গ্রহণকারীদের মতামত বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পারফরম্যান্স মূল্যায়নের নির্দিষ্ট মাপকাঠি নির্ধারণ করা। পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে প্রশাসনিক ক্যাডারের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং বিদ্যমান আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করা। প্রয়োজন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আরোহ পদ্ধতি এবং স্থানীয় সরকার থেকে প্রাপ্ত সুপারিশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদানের নীতি প্রণয়ন। আরো প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসম্পন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দূরে রাখা। প্রয়োজন বদলির সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং নির্দিষ্ট সময়ের আগে বদলি করা যাবে না এমন বিধান প্রণয়ন। প্রশাসনিক বদলির প্রক্রিয়া দেখভালের জন্য স্বতন্ত্র একটি সংস্থা গড়ে তোলা উচিত এবং সংস্থার কার্যপ্রণালী যথাসম্ভব রাষ্ট্রজনের জন্য উন্মুক্ত রাখা উচিত। প্রয়োজন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র ধরে বাকি সংস্কার ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে যথাসম্ভব স্বাধীনতা প্রদান এবং বাংলাদেশ কর্মকশিনের নিয়োগ পরীক্ষাকে বিশেষায়িত করা।

..৩ নিরাপত্তা সেবা

বাংলাদেশে নিরাপত্তা সেবা নিশ্চিত করতে পুলিশি ব্যবস্থার বিউপনিবেশায়নের ওপর জোর দিতে হবে। বিউপনিবেশিত পুলিশ মানে রাষ্ট্রজনের পুলিশ। রাষ্ট্রজনের নিরাপত্তা সেবা প্রদান হবে তার প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। জনগণের স্বার্থবিরোধী কোনো ধরনের কাজ ও তৎপরতায় পুলিশের অংশগ্রহণ করা চলবে না। তাই পুলিশি ব্যবস্থায় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গোটা ব্যবস্থাকে বলপ্রয়োগধর্মী ধরনের বদলে সেবাধর্মী ধরন অনুসরণে পুনর্গঠন করতে হবে। এই পুনর্গঠন শুরু হতে পারে পুলিশ বাহিনীর নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। আমাদের পুলিশ বাহিনীর এমন নাম হতে হবে যাতে নাম শোনা মাত্রই বিগত বাহিনী থেকে তার ধরন ও বৈশিষ্ট্যগত ভিন্নতা জনগণের কাছে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তাব—জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর নাম হবে—‘নিরাপত্তা সেবা বাহিনী’। নামকরণ যেকোনো নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতাগত দিকের ইঙ্গিত। আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি, নিরাপত্তা প্রদান (পুলিশিং) একটি সেবামূলক কাজ, এটি শুধু আসামি ধরার অ্যাডভেঞ্চার নয়—পুলিশের ভেতরে এই বোধ তৈরি করতে তার নাম পরিবর্তন হল প্রথম পদক্ষেপ।

বাংলাদেশের পুলিশের কার্যকর পরিবর্তন সাধন করতে হলে সে পরিবর্তন হতে হবে নিচ থেকে উপরের দিকে। বর্তমানে আমাদের মোট পুলিশের সংখ্যা আনুমানিক দুই লক্ষ চল্লিশ হাজার যার মধ্যে কনস্টেবল, নায়েক ও এএসআই এর সংখ্যা দেড় লক্ষাধিক। এই বিপুল পরিমাণ পুলিশ সদস্যরা মামলা বা ‍সাধারণ ডায়েরি আমলে নেয়ার মতো কোন কাজে যুক্ত নয়। ফলে পুলিশের সবচেয়ে বড় অংশই জনসেবার কার্যকর কাজগুলোর বাইরে থেকে যায়। আমরা মনেকরি, কনস্টেবলরা বর্তমানে কেবলমাত্র সরকারিসেবায় ব্যবহৃত হচ্ছে, তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে ক্রমশ জনসেবামূলক কাজে যুক্ত করা উচিত।

পুলিশ ও জনগণের দূরত্ব ঘোচাতে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ধারণা বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। কমিউনিটি পুলিশ অপরাধ প্রবণতা কমিয়ে আনতে সৃজনশীল পদ্ধতির আশ্রয় নিতে পারে। সেক্ষেত্রে কমিউনিটি পুলিশ থানা, স্ট্রাইকিং ফোর্স এবং কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন মন্ত্রাণলয়ের সাথেও সমন্বয় করবে।

কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থায় সমাজের বিশিষ্ট নাগরিক বা নেতৃস্থানীয়দের পুলিশি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে হবে৷ কমিউনিটি পুলিশ হবে সমাজ ব্যবস্থার তথ্য সংরক্ষাণাগার। যেমন: কিশোর বা অন্য কোন শ্রেণির মধ্যে কোন বিশেষ অপরাধ প্রবণতা দেখা দিলে সামাজিক পুলিশ তা সমাজের বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে মোকাবেলার প্রস্তুতি নিবে এবং অপরাধ সংঘটনের পূর্বেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা করবে। ফলে, কমিউনিটি পুলিশকে হতে হবে সৃজনশীল পুলিশ।

পুলিশের স্বশস্ত্র ও নিরস্ত্র নামক বিভাজন বা বর্তমান কাঠামো সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করতে হবে। পুলিশি ব্যবস্থা মূলত হবে কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা। এর সাথে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলায় থাকবে স্ট্রাইকিং ফোর্স। বাকি সমস্ত পুলিশ হবে নিরস্ত্র।

জনগণকে পুলিশের সাথে সম্পৃক্ত করার সুনির্দিষ্ট কার্যপদ্ধতি থাকতে হবে। পুলিশের পুরস্কার ব্যবস্থায় অবশ্যই জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। নির্দিষ্ট সংখ্যক মনোনীতদের বিশেষ কাজের উল্লেখ করে সেখানে অনলাইনভিত্তিক ভোট বা মতামত চাইতে হবে৷ পুলিশের মূল্যায়নে জনগণের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। কারণ সেবাগ্রহীতাই সেবার মানের শ্রেষ্ঠ বিচারক।

পুলিশের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার খোলনলচে পরিবর্তন প্রয়োজন। অতিরিক্ত ড্রিল কমিয়ে আনা আবশ্যক৷ কারণ পুলিশ সেনা নয়। সামাজিক পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, স্ট্রাইকিং ফোর্স ইত্যাদি বিভাজন অনুযায়ী পুলিশের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ডি-এসকেলেশন পদ্ধতির উপর জোরারোপ করতে হবে। অভিযুক্ত মানেই অপরাধী নয়- এই দর্শনকে মাথায় রেখে পুলিশ যাতে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকে সেই কৌশলের নামই ডিএসকেলেশন। পুলিশের প্রশিক্ষণে বিশেষায়িত বিভাগ অনুযায়ী তার পাঠ্যক্রম সাজাতে হবে।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের ধরন হতে হবে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। এক্ষেত্রে Preparation and Planing, Engage and Explain, Account, Closure and Evaluate বা সংক্ষেপে PEACE মডেল অথবা Strategic Use of Evidence বা সংক্ষেপে SUE মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। ‍শরীরে ব্যাথা দেয়া গেলে সত্য বেরিয়ে আসে—এই ব্যাপক মিথ থেকে পুলিশের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। শারীরিক আঘাত কেবলমাত্র আঘাতকারীর শুনতে চাওয়া কথাকেই পুনরুৎপাদিত করে। এ সংক্রান্ত উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।

পুলিশের প্রতিটি কর্মকাণ্ড অনলাইন ডায়েরির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এবং গ্রেপ্তারের সাথে সাথে তা অনলাইন ডাটাবেজে যুক্ত করতে হবে এবং তা গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির প্রদানকৃত পরিবারের বা নিকটজনের নাম্বারে স্বয়ংত্রিয় মেসেজের মাধ্যমে জানাতে হবে। পুলিশি হয়রানি সংক্রান্ত অভিযোগ জানানোর জন্য পুলিশের ওয়েবসাইটে স্বয়ংত্রিয় ব্যবস্থা থোকতে হবে। এছাড়া থানার সকল প্রদেয় সুবিধা অ্যাপের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে। গ্রেপ্তার এবং পুলিশ হেফাজতের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশকে অবশ্যই বডি ক্যাম ব্যবহার করতে হবে। পুলিশি ব্যবস্থার আধুনিকায়নের স্বার্থে পুলিশের একটি গবেষণা সেল থাকতে হবে। অপরাধ তদন্ত পুরোপুরি পুলিশের বিশেষায়িত বিভাগের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে। তদন্ত কার্যক্রম ওসির আওতামুক্ত করতে হবে।

বর্তমানে পুলিশের তিন স্তরের নিয়োগ ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে৷ কনস্টেবল, সাব-ইন্সপেক্টর ও বিসিএসের মাধ্যমে এএসপি পদে এসব নিয়োগ হয়ে থাকে৷ পুলিশের এই নিয়োগ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং একে স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। পুলিশের নিয়োগ বিসিএসের আওতামুক্ত করে এর নিয়োগ হতে হবে স্বতন্ত্র কমিশনের মাধ্যমে। পুলিশের নিয়োগ ব্যবস্থা হতে হবে দ্বিস্তর বিশিষ্ট৷

উপসংহার

১৯৭১ সালের স্বাধীনতার মুহূর্তে বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানবিক মর্যাদার প্রতিষ্ঠা। ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান আমাদের সেই পুরনো, অথচ সর্বাধিক প্রয়োজনীয় নীতিগুলোর পুনর্বিচারের আহ্বান জানায়।  উপনিবেশের উত্তরাধিকার থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রয়োজন একটি মানবিক ও ন্যায্য রাষ্ট্রব্যবস্থা, যা গণতন্ত্র, সমতা এবং অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করবে।

২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান আমাদের শিক্ষা দেয় যে, রাষ্ট্রব্যবস্থার নয়া নির্মাণ ছাড়া মুক্তি সম্ভব নয়। মানবায়ন সেই নির্মাণেরই অধিনীতি যা ন্যায্য-গণতন্ত্র, জাতিনিরপেক্ষতা, লিঙ্গনিরপেক্ষতা, শ্রেণি ও গোষ্ঠীনিরপেক্ষতা, এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিগুলির মধ্য দিয়ে বিধৃত। একই সঙ্গে এটি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার মুহূর্তে বাংলাদেশের মানুষের সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানবিক মর্যাদার ভিত্তি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার পুনর্পাঠও।

নয়া রাষ্ট্রকল্প কোনো নতুন শাসনতন্ত্রের প্রস্তাবনা নয়; কেননা, শাসন করা কিংবা শাসনের জন্য তন্ত্র এ-সকল ধারণা আধিপত্যবাদী ও ঔপনিবেশিক চিন্তাধারার ফসল। সেই কারণে নয়া রাষ্ট্রকল্প শাসনের পরিবর্তে অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনার দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস এবং রাষ্ট্রজন রূপে মানুষের মুক্তির অভিযাত্রার নতুন ভিত্তি। একটি সৃষ্টিশীল, ন্যায্য, সমতাভিত্তিক এবং বিউপনিবেশিত রাষ্ট্রের জন্য আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।

Scroll to Top