পানির আধুনিকায়ন, বন্যা ও শহর ভাবনার সংকট

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী এখন চরম সংকটে। নদী ও পানি প্রবাহ বাণিজ্য, দখল আর উন্নয়নের নানা প্রকল্পে বন্দী। এর কারণে পুরো দেশের প্রাণ প্রকৃতি এবং সেই সাথে মানুষের জীবন জীবিকা বিপর্যস্ত। এই অবস্থা হঠাৎ করে হয়নি। ঔপনিবেশিক আমলের উন্নয়ন চিন্তা আর তার ধারাবাহিকতাতে পানি পণ্য হয়েছে, নদী ও জমিকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। বর্তমান পুঁজির আগ্রাসনে সংকট বহুমাত্রিক রূপ নিয়েছে। এই লেখায় এই সংকটের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরে বিকল্প চিন্তার ওপর জোর দেয়া হয়েছে।

১৯৮৪ সালে অস্ট্রিয়ান দার্শনিক ও সমালোচক ইভান ইল্লিশকে যুক্তরাষ্ট্রের ডালাস শহরে আমন্ত্রণ জানানো হয় শহরের মধ্যে কৃত্রিম জলাধার তৈরির প্রকল্প নিয়ে বক্তৃতা দেয়ার জন্য। সেই বক্তৃতাতে ইল্লিশ বলেন আধুনিকীকরণ ও শিল্পায়নের প্রভাবে কীভাবে শহরের মধ্যে আমরা ‘পানি’কে ‘পণ্য’ (‘stuff’) তে পরিণত করেছি, যা কিনা কেবল সীসার পাইপের মাধ্যমে স্থাপনাতে সরবরাহ করা হয় (ইভান ইল্লিশ, ১৯৮৫)। শহরে আবাস-এর সংজ্ঞার যেমন পরিবর্তন হয়েছে, পানির সংজ্ঞাও পরিবর্তিত হয়েছে। শহুরে পানির এই ধারণা আধুনিক সময়ের সামাজিক সৃষ্টি যা কিনা ফরাসি দার্শনিক গ্যাস্টন ব্যাশেলার্ড তার ‘water and dreams’ এ পানি সম্পর্কে যে ধারণা দেন তা থেকে ভিন্ন (গ্যাস্টন ব্যাশেলার্ড, ১৯৮৩)। এই ‘পানি’ আমাদের কোনো স্বপ্ন দেখায় না বা অনুপ্রাণিত করে না, বরং অধিক বৃষ্টির সময়ে যখন শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, তখন আমরা পানিকে অভিশাপ দিতে থাকি। শহরের মধ্যে এই পানিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং এর জন্য প্রয়োজন হয় প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনার।

শহরের সাথে পানির সম্পর্কের বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে যখন অধিকাংশ এশিয়া জুড়ে বন্যার প্রকোপে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। পানির এই আধুনিকায়ন বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে হলেও কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা যায়, যেমন সবসময়ই এই প্রক্রিয়ার সাথে ক্ষমতা এবং রাজনীতি গভীরভাবে সংযুক্ত ছিল। জেমি লিন্টন তাঁর লেখায় বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে পানির আধুনিকায়ন বা হাইড্রোন্যাশনালিসম ঘটে বিংশ শতকের প্রথমার্ধে যখন জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি ও উন্নয়নের নামে বৃহদাকারে নদী শাসন করা হয়, যা পরবর্তীতে শতাব্দীর শেষার্ধে অন্যান্য দেশগুলোতে বিশেষ করে তৃতীয়-বিশ্বের দেশগুলোতে অনুকরণ করা হয় (জেমি লিন্টন, ২০১০)। অন্যদিকে ম্যাথিউ গ্যান্ডি তার লেখায় আধুনিকতা, জাতীয়তাবাদ এবং স্থান যৌক্তিকতার মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি অনুসন্ধানের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, পানি নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনার সাথে মহানগরে প্রকৃতি দেখার সংস্কৃতি-র বিষয়টি গভীরভাবে জড়িত (ম্যাথিউ গ্যান্ডি, ২০১৪)।

আসা যাক দক্ষিণ এশিয়াতে পানির আধুনিকায়ন কীভাবে হল, বিশেষ করে বাংলায়, যা কিনা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপে অবস্থিত, এবং এর সাথে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের কী সম্পর্ক রয়েছে, বা বর্তমান বন্যা পরিস্থিতির সাথেই বা এর সম্পর্ক কতটুকু এসব প্রশ্ন আলোচনায়।

এই গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপ অঞ্চলে ভূমি এবং জলকে আলাদা ভাবে দেখার রীতি এবং তার আনুষ্ঠানিক প্রয়োগ শুরু হয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়কাল থেকে। যদিও প্রাক-উপনিবেশিক আমলেও জমিই ছিল খাজনার প্রধান উৎস, কিন্তু মূলত ব্রিটিশ আমলেই বন ও জলাভূমি সাফ করে খাজনাযোগ্য জমিতে পরিণত করার প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটিতে আমাদের সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চলের নদীগুলোকে সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে দেখা হয়, কারণ এরা প্রতিনিয়ত গতিপথ পরিবর্তন করত। এই অঞ্চলের জল ধমনিগুলোকে আবন্ধ করার জন্য এবং খাজনাযোগ্য জমির সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য একের পর এক আইন প্রণয়ন করা হয় (কুন্তলা লাহিড়ী-দত্ত, ২০১৩)। ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ১৭৯৩’ বা ‘বেঙ্গল এলুভিওন এন্ড ডিলুভিওন অ্যাক্ট ১৮২৫’ এর মধ্যে অন্যতম। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়কালের শুরুর দিকে বাংলার জলজ প্রকৃতি সম্পর্কে কোম্পানি শাসনের (East India Company) জ্ঞান ছিল সীমিত। ধীরে ধীরে কোম্পানি প্রশাসন এখানকার আবহাওয়া সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনের সাথে সাথে প্রকৃতির উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করা শুরু করে (ইফতেখার ইকবাল, ২০১০)। আইনের পাশাপাশি প্রয়োজন পড়ে এই বাংলার নদীপথগুলোর স্থায়ী মানচিত্র তৈরি করার। যার দায়িত্ব প্রথমে দেয়া হয় ব্রিটিশ সার্ভেয়র জেমস রেন্নেল-এর উপর, ১৭৬০-এর দশকে। রেন্নেল তৎকালীন ইউরোপিয়ানদের আবিষ্কৃত ত্রিকোণমিতিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে নদীগুলোর মানচিত্র আঁকা শুরু করেন। দীর্ঘ দশ বছরেরও বেশি সময় নিয়ে তিনি যে মানচিত্র তৈরি করেন, ততদিনে নদীর গতিপথে আমূল পরিবর্তন হওয়াতে মানচিত্রগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এই সমস্যার কথা রেন্নেল তার ব্যক্তিগত জার্নালেও তুলে ধরেন (জেমস রেন্নেল, ১৭৮৩)। রেন্নেল-এর মানচিত্র প্রশ্নবিদ্ধ হলেও এই দীর্ঘ প্রচেষ্টা সফল ভাবে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে মানচিত্র-ভিত্তিক চিন্তাভাবনার সূত্রপাত ঘটাতে সক্ষম হয়। ব্রিটিশরা অনুধাবন করতে পারে যে, নদীগুলোকে শাসন করে বাঁধবন্দি করতে না পারলে খাজনা আদায়ে ব্যাঘাত ঘটবে। রেন্নেল-এর পরবর্তীতে আরও অনেক বিস্তারিত মানচিত্র তৈরি করা হয়। এভাবে মানচিত্র তৈরি, আইন প্রণয়ন এবং নদী শাসনের অবকাঠামো তৈরির মাধ্যমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে এই বদ্বীপ অঞ্চলে জল ও ভূমিকে আলাদাভাবে দেখার রীতি পাকাপোক্ত হয়।

চিত্র ১: টাইমলাইনের মাধ্যমে ব্রিটিশ উপনিবেশকালের বিভিন্ন আইন প্রণয়ন, ম্যাপ তৈরি এবং অবকাঠামোগত প্রকল্প এর উপস্থাপন।

চিত্র ২: ১৭৭০ এর দশকে জেমস রেন্নেলের আঁকা মেঘনা নদীর মানচিত্র (সূত্র: জেমস রেন্নেল, ১৭৮১)

বাঁধ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ এই শক্ত অবকাঠামোগুলো যে কেবল নদীকে আবদ্ধ করে রাখে বা বন্যা থেকে রক্ষা করে তা নয়, আমাদের জল ও ভূমি কে আলাদাভাবে দেখতেও শেখায়। এর ফলে মানচিত্র আঁকা সহজ হয়, জমির সীমানা নির্ধারণ করা সহজ হয়, সর্বোপরি খাজনা আদায় ও সহজে করা সম্ভব হয়। উঁচু এবং শুষ্ক জমির গুরুত্ব বেড়ে যায় এবং জলাশয় বা জঙ্গলগুলোকে ‘wastelands’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই যে নতুন এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের এখানে প্রচলন করানো হয়, এতে করে বিভিন্ন ধরনের লোকচর্চা হুমকির মুখে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় মসলিন শিল্পের কথা। যার জন্য এই বঙ্গীয় অঞ্চল (বিশেষ করে ঢাকা বা তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল) অনেক লম্বা সময় ধরে ছিল জগদ্বিখ্যাত (এনোনিমাস, ১৮৫১)। সূক্ষ্ম মসলিন তৈরির জন্য অন্যতম উপাদান ছিল বাতাসের আদ্রতা। মৌসুমি জলবায়ুর কারণে আমাদের এখানে কখনই আর্দ্রতার অভাব ছিল না। উপরন্তু অতিরিক্ত আর্দ্রতা সরবরাহ করতো আশেপাশের জলাশয় এবং ঘন বনাঞ্চল। কিন্তু এসব জলাশয় ও বনাঞ্চল ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাওয়াতে উপযুক্ত আর্দ্রতার অভাবে মসলিন শিল্প হুমকির মুখে পড়ে (লাবিব হোসেন, ২০২০)। অবশ্যই এর সাথে ইউরোপীয় শিল্প বিপ্লব, মসলিনের উপর অধিক কর আরোপ ইত্যাদিও জড়িত ছিল, কিন্তু আমাদের ল্যান্ডস্কেপের যে পরিবর্তন হয় তার প্রভাবও কম ছিলনা। অনেক তাঁতি যারা কিনা বংশপরম্পরায় এই শিল্পের সাথে জড়িত ছিল, তারা আর অন্য পেশায় যেতে না পেরে করুণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। আঠার শতকের শেষ দিকে এই বাংলায় বেশ কয়েকটি দুর্ভিক্ষ হয় যাতে অনেক তাঁতি মৃত্যুবরণ করে। মসলিনের মত অনেক লোকশিল্প যেগুলো আমাদের জলবায়ু এবং ল্যান্ডস্কেপের সাথে সম্পর্কিত ছিল, জল ও ভূমিকে আলাদা করে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে খাপ খাওয়াতে না পেরে সেসব শিল্পগুলো আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে শুরু করে, অনেক তৃণমূল মানুষের জীবনযাত্রা এতে ব্যাহত হয়।

চিত্র ৩: জেমস রেন্নেলের প্রথম দিকের সার্ভেতে আঁকা গঙ্গা নদীর মানচিত্র যেখানে ইউরোপিয়ানদের উদ্ভাবিত ‘ত্রিকোনমিত্রিক মেথড’ প্রয়োগ করে জল ও ভূমির পৃথকীকরণ দাগটি নির্বাচন করা হয়, সময়কাল: ১৭৬৪-৬৫ (কৃতজ্ঞতা: ব্রিটিশ লাইব্রেরি)

এভাবে বাঁধের শক্ত দাগগুলো যা পানিকে ভূমি থেকে পরিষ্কার ভাবে আলাদা করে, আমাদের জীবনযাত্রায় গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। আমরা নিজেদের মধ্যে আত্মস্থ করতে শুরু করি যে এটাই সভ্যতা, এটাই আধুনিকতা। ইতিহাস-এর অধ্যাপক দেবযানী ভট্টাচার্য তার লেখায় উল্লেখ করেন কীভাবে এর ফলে ধীরে ধীরে বাংলার মানুষ এখানকার ‘soaking ecology’ ভুলে যেতে শুরু করে (দেবযানী ভট্টাচার্য, ২০১৯)। পানি ধীরে ধীরে পণ্যে পরিণত হয় যা মসলিন তৈরির উপাদান ‘আর্দ্রতা’ থেকে ভিন্ন। এই পানিকে হয় নদীতে আবদ্ধ করে রাখতে হয়, অথবা পাইপের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে সরবরাহ করা হয়। এর বাইরে চলে এলেই তাকে আমরা দুর্যোগ বলি। কারণ আমাদের জনবসতির জায়গাগুলোকে আমরা ঔপনিবেশিক আমলের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী গড়ে তুলেছি। আমাদের শহরগুলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই শহরে পানি শোষণ করার কোনো পরিবেশ নাই। শহরকে বন্যা সুরক্ষার নামে আমরা নদীগুলোকে বাঁধবন্দী করে ফেলেছি আর বৃষ্টির পানি বের করে দেয়ার জন্য পাম্প ব্যবহার করছি। কিন্তু অতিরিক্ত বৃষ্টি হলেই শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। শহরের ভিতরের জলাশয়গুলো ভরাট করে ফেলায় পানি যাওয়ার জায়গা থাকছে না। উপরন্তু শহর সুরক্ষার নামে শহরের বাইরের জায়গাগুলো উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে এবং অস্বাভাবিক বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আর দুর্ভোগে পড়ছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ।

তাই যে শক্ত দাগগুলো দিয়ে জল ও ভূমিকে আলাদা করা হয়, সে-দাগগুলো নিয়ে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। বন্যা নিয়ে ঔপনিবেশিক চিন্তাভাবনা আমরা আজও অনুকরণ করে যাচ্ছি। ল্যান্ডস্কেপ-স্থপতি দিলিপ দা কুনহা তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘বন্যা’ বলতে আমরা যা বুঝি, তা কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা নয়। পানি যখন শক্ত দাগগুলো অতিক্রম করে তখন আমরা তাকে বন্যা বলি, আর এই দাগগুলো যা দিয়ে জল ও ভূমিকে আলাদা করা হয়, তা মানুষেরই সৃষ্টি (দিলিপ দা কুনহা, ২০১৯)। ঔপনিবেশিক চিন্তাভাবনার ধারাবাহিকতায় বর্তমান সীমানা-ভিত্তিক, স্তর-ভিত্তিক ও শহরকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থার সাথেও এই দাগগুলো মানানসই এবং সহায়ক ভূমিকা পালন করে। একসময় ঔপনিবেশিকরা এই বাঁধগুলো বানাতে উৎসাহিত করত আর এখন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থারা এসবের জন্য তহবিল সরবরাহ করে। ঔপনিবেশিক আমলেও এর সাথে ক্ষমতা বা রাজনীতির সম্পর্ক ছিল, এখনও নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলো বাঁধ তৈরির আশ্বাস দিয়ে ভোট আদায় করে। এর সাথে আর্থিক লেনদেনেরও অনেক বিষয় জড়িত থাকে, যা আশরাফ দেওয়ান তার কিছুদিন আগে প্রকাশিত হওয়া লেখাতে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন (আশরাফ দেওয়ান, ২০২০)।

শুধুমাত্র জাতীয় সীমার অভ্যন্তরেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও অধিক শক্তিধর দেশ কর্তৃক ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নদীর নিয়ন্ত্রণ একটি প্রচলিত ঘটনা। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগের পেছনে শহর রক্ষা বাঁধের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ কর্তৃক আন্তর্জাতিক নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণের বিষয়টাও সংযুক্ত। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব ও পরিণতি সম্পর্কে আমরা অনেকেই অবগত। আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। তথ্যচিত্র নির্মাণকারী সালাউদ্দিন সুমন তাঁর একটি প্রতিবেদনে রাজশাহীর চর খানপুর সীমান্তের মানুষের এমনই এক দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেছেন (সালাউদ্দিন সুমন, ২০২০)। যদিও প্রতিবেদনে নির্মাণকারীকে শহুরে অভিধান দিয়ে দুর্দশা বর্ণনা করতে দেখা যায়, কিন্তু একইসাথে এটাও উঠে আসে যে, চরের মানুষের যাযাবর জীবনযাত্রার সাথে উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া সীমানা-ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা সাংঘর্ষিক হওয়াতে এই অঞ্চলের মানুষরা এখন চরম দুর্ভোগের সম্মুখীন। চর এলাকা যেমন আজকে এক জায়গায় ভাঙ্গে কাল অন্য জায়গায় গড়ে, তেমনি এখানকার মানুষরাও এই ভাঙ্গা-গড়ার সাথে মানিয়ে জীবনযাপন করে। কিন্তু চর খানপুর সীমান্তে চর এলাকা সড়ে গিয়ে ভারতের দিকে চলে যাওয়াতে এখানকার বাসিন্দারা উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। শুধু চর খানপুরই নয়, সীমানা অঞ্চলের নদীগুলির আশেপাশে অনেক জায়গাতেই একই রকম চিত্র দেখা যায়।

ছবি: সালাউদ্দিন সুমনের প্রতিবেদনে চর খানপুর, রাজশাহী (সালাউদ্দিন সুমন, ২০২০)

তাই এই বাঁধ তৈরির ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিকগুলো গভীরভাবে জড়িত থাকাতে এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বের হয়ে বিকল্প চিন্তার বিষয়টা মোটেই সহজ নয়। আমার মতে বৃহৎ ও জটিল বিষয়গুলোতে পৌঁছানোর জন্য প্রথমে তুলনামূলক ছোট বিষয়গুলির দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের শহর নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে। এর স্থাপনাভঙ্গি নিয়ে চিন্তা করতে হবে। বর্তমানে আমাদের নগর চিন্তা অনেকাংশে পাশ্চাত্যের নগরচিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়। কিন্তু এই পূর্ববঙ্গীয় ‘মৌসুমি জলবায়ু’-বিধৌত অঞ্চলে নগর চিন্তা করতে হবে এর পরিবেশ এবং এর মানুষের কথা চিন্তা করে। অনাদিকাল থেকেই বাংলার মানুষ এর পানি, নদনদী, জলজ ভূদৃশ্য এর সাথে মানিয়ে জীবন যাপন করে আসছে। এখানকার স্থানীয় স্থাপত্যও সেভাবেই গড়ে উঠেছিল। তার সাথে মানিয়ে নগরচিন্তা করতে হলে দীর্ঘমেয়াদী বিউপনিবেশায়নের প্রয়োজন।

প্রথমত, জল ও ভূমিকে আলাদাভাবে না-দেখে কীভাবে নগরচিন্তা করা যায়, বাঁধের শক্ত দাগগুলোর বিকল্প হিসেবে কীভাবে শহরের অভ্যন্তরে পানি শোষণের পরিবেশ তৈরি করা যায়, জলাশয়ের উপস্থিতি কীভাবে বাড়ানো যায় যা জলাধার হিসেবে কাজ করবে, ভুলে যাওয়া ‘soaking ecology’-কে কীভাবে নগর পরিকল্পনার সাথে মিলানো যায় – এসব ভেবে দেখা এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নগরের ভূমিরূপকে এমনভাবে আমাদের ভাবতে হবে যেটি পানিকে বাঁধা দেয় না, বরং বৃষ্টি ও পানিকে স্বাগত জানায়, অতিরিক্ত পানি শুষে নেয় এবং বাষ্প হতে দেয়।

দ্বিতীয়ত, এরজন্য স্থানীয় জ্ঞানের সমন্বয় ঘটাতে হবে। বুড়িগঙ্গাকে টেমস এর আদলে গড়তে চাইলে বা ডাচ প্রকৌশলী দিয়ে ডেলটা প্ল্যান বানাতে চাইলে এর ফলাফল কখনই আশানুরূপ হবে না। আমাদের পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণত ‘top-down’ পদ্ধতি অনুসরণ করে অভ্যস্ত। আমাদের প্রস্তাবিত পরিকল্পনাগুলোও তাই উপর থেকে চাপিয়ে দেয়ার মত হয়।

স্থপতি ও স্থাপত্য ইতিহাসবিদ কাজী খালেদ আশরাফ তার বিভিন্ন লেখায় ঢাকার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য পানিকে নিয়ে চিন্তা করার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন- “Dhaka has to be built with the dynamics of water” (কাজী খালেদ আশরাফ, ২০১২, ২০১৭)। তার লেখায় যেমন বেশ কিছু বাস্তবধর্মী ও আশাবাদী প্রস্তাব পাওয়া যায়, তেমনি উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে তার প্রস্তাবের সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, “The porosity at the lower level will allow an unimpeded flow of water at different seasons” অর্থাৎ “নিচের দিকে ফাঁকা স্থান রাখা হলে বিভিন্ন ঋতুর ভিত্তিতে পানির নিরবিছিন্ন প্রবাহ ঘটানো যাবে” (কাজী খালেদ আশরাফ, ২০১৭)। তার দেয়া এই ধারণাতে ‘porosity’ কে vertically চিন্তা করা হয়েছে, যাতে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু উপরিউক্ত বিউপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পানির প্রবাহ-চিন্তা (flow-thinking) থেকে শোষণ-চিন্তাতে (soak-thinking) জোর দেয়ার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ‘porosity’ কে ‘horizontally’ও চিন্তা করতে হবে। মসলিন শিল্প হারিয়ে যাওয়া কেবলমাত্র একটি উদাহরণ। এরকম আরও অনেক স্থানীয় চর্চা রয়েছে যা পানির শোষণ-পরিবেশ থেকে প্রবাহ-পরিবেশে পরিবর্তনের ফলে হুমকির সম্মুখীন। একই সাথে আগামীর পানি-নগর প্রকল্পের বিউপনিবেশিক ধারণাতে স্থানীয়দের অংশগ্রহণ এর বিষয়টাও খুবই জরুরি। সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে ‘উপযুক্ত’ মডেল কেমন হবে। তাই বাইরের শহরগুলোর বাহ্যিক রূপ নয়, বরং যে পদ্ধতিতে শহর পরিকল্পনায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে- তা থেকে আমরা ধারণা নিতে পারি। যেমন বার্লিনের ক্রসবারগ এ ‘ইবা ৮৪/৮৭’ নগর পরিকল্পনায় স্থানীয় বাসিন্দাদের যুক্ত করা হয়েছিল। Top-down ‘ইবা ১৯৫৭’ এর প্রায় বিপরীতধর্মী ‘ইবা ৮৪/৮৭’কে এজন্য আখ্যায়িত করা হয় ‘critical urban construction’ বা ‘careful urban renewal’ এর জন্য (এসরা আকচান, ২০১৮)। এই পরিকল্পনায় আলদো রসি, উঙ্গার মাথিউস, আলভারো সিজা, রব ক্রিয়ের এর মত বড় স্থপতিরা থাকলেও সম্মিলিতভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল স্থানীয়দের অংশগ্রহণের উপর।

এখানকার জলজ প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিকল্প শহর চিন্তায় স্থানীয় জ্ঞানের সমন্বয় ঘটাতে অবশ্যই ‘bottom-up’ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। আমার মতে সমালোচকদের ভূমিকা এক্ষেত্রে জরুরি। তারা ‘top-down’ দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের জায়গা তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। সমাজবিদ্যার অধ্যাপক বোয়াভেঞ্চুরা দে সুসা সান্তস তার লেখায় ‘Ecology of knowledges’ নামক একটি ধারণা উপস্থাপন করেন, যার মূলে ছিল বিউপনিবেশায়নের জন্য স্থানীয়দের গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরা (বোয়াভেঞ্চুরা দে সুসা সান্তস, ২০১৪)।

আগামীর নগর-পানি পরিকল্পনা প্রকল্পগুলোতে রাজনীতিবিদ, প্রকৌশলী এবং নগর পরিকল্পনাকর্মীদের পাশাপাশি ঐতিহাসিক, নৃবিজ্ঞানী, স্থপতি, লেখক, সমালোচকদের যুক্ত করতে হবে এবং বিশেষ করে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের জায়গা তৈরি করতে হবে। আমাদের বাংলায় এ অঞ্চলের সাথে মিল রেখে নগর সমস্যার সমাধানগুলি আমাদের নিজেদেরকেই বের করে আনতে হবে। একইভাবে মাথায় রাখা প্রয়োজন যে নগর সমস্যা গ্রামীণ অঞ্চলের সমস্যার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই শহরকে আলাদাভাবে চিন্তা না করে সামগ্রিকভাবে চিন্তা করতে হবে। শহর-গ্রামের বাইনারির উর্ধ্বে ইকোলজিক্যাল স্কেল-ভিত্তিক চিন্তার মাধ্যমে স্থানীয় মানুষের মৌসুমী অভিজ্ঞতাকে সামনে আনতে হবে। নগর চিন্তায় পানিকে শত্রু হিসেবে না দেখে বা একে শুধুমাত্র পণ্যতে পরিণত না-করে আমাদের আবহাওয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সর্বস্তরের মানুষের গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজস্ব শহর-পরিকল্পনা করতে হবে যা নিয়ে আমরা গর্ববোধ করতে পারবো।

তথ্যপঞ্জি

আশরাফ দেওয়ান (২০২০), নদীগুলো বাঁধবন্দী করার সর্বনাশ, প্রথম আলো ৪ আগস্ট, ২০২০।

[এসরা আকচান, ২০১৮] Esra Akcan (2018), Open Architecture: Migration, Citizenship and the Urban Renewal of Berlin-Kreuzberg by IBA 1984/87, Birkhauser.

[ইভান ইল্লিশ, ১৯৮৫] Ivan Illich (1985), H2O and the Waters of Forgetfulness: Reflections on the Historicity of Stuff, Dallas Institute of Humanities and Culture, 1985.

[এনোনিমাস, ১৮৫১] Anonymous. (1851). A Descriptive and Historical Account of the Cotton Manufacture of Dacca, in Bengal. London: John Mortimer.

[কাজী খালেদ আশরাফ, ২০১২] Kazi Khaleed Ashraf (2012), Designing Dhaka: A Manifesto for a Better City, Dhaka: Loka Press.

[কাজী খালেদ আশরাফ, ২০১৭] Kazi Khaleed Ashraf (2017), Dhaka Needs a Hydraulic Vision, The Daily Star, August 05, 2017.

[কুন্তলা লাহিড়ী-দত্ত, ২০১৩]Kuntala Lahiri-Dutt (2013), Dancing with The River, People and Life on The Chars of South-East Asia, Yale University Press.

[গ্যাস্টন ব্যাশেলার্ড, ১৯৮৩] Gaston Bachelard (1983), Water and Dreams: An Essay on the Imagination of Matter, Pegasus Foundation. (originally published in 1942)

[জেমি লিন্টন, ২০১০] Jamie Linton(2010), What is Water: A History of a Modern Abstraction, UBC Press.

[জেমস রেন্নেল, ১৭৮১]James Rennell (1781), A Bengal Atlas: Containing Maps of the Theatre of War and Commerce on that side of Hindoostan, London.

[জেমস রেন্নেল, ১৭৮৩]James Rennell (1783), Memoir of a Map of Hindoostan; Or, the Mogul Empire: With an Introduction, Illustrative of the Geography and Present Division of That Country: And a Map of the Countries Situated Between the Head of the Indus, and the Caspian Sea, London.

[দেবযানী ভট্টাচার্য, ২০১৯] Debjani Bhattacharyya (2019), Empire and Ecology in the Bengal Delta: The Making of Calcutta, Cambridge University Press.

[দিলিপ দা কুনহা, ২০১৯]Dilip da Cunha (2019), The Invention of Rivers: Alexander’s Eye and Ganga’s Descent (Philadelphia: University of Pennsylvania Press.

[বোয়াভেঞ্চুরা দে সুসা সান্তস, ২০১৪] Boaventura de Sousa Santos (2014), Epistemologies of the South: Justice Against Epistemicide, Routledge; 1st Edition.

[ম্যাথিউ গ্যান্ডি, ২০১৪]Matthew Gandy (2014), The Fabric of Space: Water, Modernity, and the Urban Imagination, Cambridge, MA: MIT Press.

[লাবিব হোসেন, ২০২০]Labib Hossain (2020), “A Critical Reading of the Dry and Permanent Ground Through the Practice of Muslin Weaving”, in Lindsay Bremner, ed., Monsoon Assemblages: Monsoon [+ Other] Grounds, London: University of Westminster, pg: 113-120.

সালাউদ্দিন সুমন, (২০২০), রাজশাহীর চর খানপুর সীমান্তের মানুষের সুখ-দুঃখ,Life on The Border, Char Khanpur,Rajshahi.৩০ আগস্ট, ২০২০।

Scroll to Top