১. প্রস্তাবনা
গত ১৫ মার্চ ২০১৫ স্টার প্লাস চ্যানেলে জিমা (GIMA) এওয়ার্ড অনুষ্ঠানে একটি বিভাগ দেখলাম ফোক সং। এ বিভাগে একজন শিল্পীকে রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবামের জন্য পুরষ্কৃত করা হল। গত বছরও ফোক বিভাগে রবীন্দ্রসংগীতের জন্য পুরষ্কার দেয়া হয়। আমি এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ দেখিনি। যদিও ভারতসহ আমাদের অঞ্চলে উত্তর–ঔপনিবেশিকতাবাদ বা করণের চর্চা একাডেমি থেকে শুরু করে নানান স্তরের জ্ঞানতাত্ত্বিক অনুশীলনে চর্চিত হতে দেখছি। তাহলে প্রশ্ন হল কেন প্রতিরোধ তৈরি হয় না? এর কারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে যে,
১. আমদানি করা বিপ্লবী তত্ত্বের তত্ত্বায়ন ও পরজীবি উদাহরণ সহযোগে আহার এবং
২. কাউন্টার ডিসকোর্স হিসেবে অনুশীলনের অভাব
এর ফলাফল হিসেবে উপনিবেশের জ্ঞানতাত্ত্বিক হেজিমনি আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে—যা আজকের ব্রিটিশ–উত্তর ভারতের জাতীয় টেলিভিশনে প্রচারিত জাতীয়ভাবে দেয়া অনুষ্ঠানে পুনরাবৃত্তি করা হয়। কারণ উপনিবেশ একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক বিভাজন–রেখা তৈরি করে ‘নিজ’ এবং ‘অপরে’র দূরত্বসীমা নির্ধারণের মাধ্যমে। ব্রিটিশ কর্তৃক কৃত সকল কর্মই আধুনিক এবং বিজ্ঞানসম্মত। আর ব্রিটিশপূর্ব সবকিছুই প্রাগাধুনিক এবং বর্বরোচিত। আলোকময়তা উত্তর পশ্চিম–জ্ঞানতাত্ত্বিক বিভাজন–রেখা সমুন্নত রাখার জন্য এ বাইনারি অপজিশন/বিপরীত জোড়ের প্রকল্পটি সবসময়ই কার্যকর রাখে। ঔপনিবেশিকতা আধুনিক–জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয়ের মানকে নির্ধারণের বেশ কিছু পদ্ধতিগত বিধি–ব্যবস্থা স্থির করে। এ বিধি–ব্যবস্থার পূর্বশর্ত ছিল, একটি বৈশ্বিক মান নির্ধারণ করা। আধুনিকতা এ বৈশ্বিক মানের কেন্দ্রে অবস্থান করে। উন্নয়ন–অগ্রগতি নির্ধারণের প্রধান ভূমিকা পালন করে। মিল ইতিহাস চেতনায় উন্নয়নকে কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। আমরা অপরত্ব নির্মাণের বিপরীত জোড়ের শব্দবন্ধনীর ভেতর নিজেদের স্থাপন করিশিক্ষিত/অশিক্ষিত, অসভ্য/সভ্য, আদিম/আধুনিক, ফাইন আর্টস/ইন্ডিয়ান আর্টস, পল্লি বা লোক/আধুনিক প্রভৃতি। আজকের আধিপত্যবাদী হিন্দী ভাষা সমর্থিত সংস্কৃতির চর্চাকারীগণ নিজেদের আধুনিক হিসেবে সুপেরিয়র ধরে অপরাপর ভাষাগোষ্ঠীর গানকে ফোক হিসেবে চিহ্নিত করছে। যে স্তরে রাগ–রাগিনীর আধিক্য বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে তাকে ক্লাসিক্যাল সংগীত ভুক্ত করে থাকেন ভারতের বর্তমানের কর্তাব্যক্তিগণ। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা জরুরি যে, এ কর্তাব্যক্তিগণ সবাই জন্মসূত্রে বা হিন্দী ভাষা অধ্যূষিত অঞ্চলে বেড়ে ওঠার ভেতর থেকে অন্তর্ভুক্ত হননি। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অধিপতিশীল স্তরে কাজের ভেতর থেকে ‘টিম ইন্ডিয়া’–এ পরিণত হয়েছেন।
অর্থাৎ উপনিবেশ–উত্তর সময়েও উপনিবেশের জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রকল্প সমভাবে সচল। কারণ আজও পর্যন্ত আমরা উপনিবেশের শিক্ষাকাঠামোর মাঝেই রয়ে গেছি। ১৯ শতকের আধুনিকতার সারসত্তাকে সমভাবে অনুসরণ করে চলেছি। তাই বর্তমান সময়কে উপনিবেশ–উত্তর ঔপনিবেশিক অবস্থা হিসেবে আমি চিহ্নিত করছি। এই উত্তর–ঔপনিবেশিক অবস্থাকে নাটকের ক্ষেত্রে আল দীন বলেছেন, ‘পরজীবী নাট্যচর্চা’। পরজীবী অবস্থা প্রাচ্যের দেশগুলোতে সকল ক্ষেত্রে সক্রিয় বিধায় তালাল আসাদ একে আধুনিকতার প্রকল্প হিসেবে উল্লেখ করেছেন। লর্ড কার্জন, উপনিবেশিতদের লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘প্রাচ্যরা রাজ্যের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র’। অর্থাৎ একে যত ইচ্ছে যেমন ইচ্ছে রূপদান করা সম্ভব। কারণ প্রাচ্যের জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোটি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ প্রকল্পের অধীনে আধুনিক প্রকল্প জারি করে প্রান্তীয় এজেন্ডা সম্পূর্ণ করা হয়েছে। প্রাচ্যের মানুষ নিজেকে মনে করে ইউরো–কেন্দ্রিক সভ্যতার একটি প্রান্তীয় ব্যাপন হিসেবে। ঔপনিবেশিক শাসক চলে গেছে কিন্তু ব্যবস্থা এমনভাবে পোক্ত করে গেছে যে, আমরা তাদের জন্য এক নিরবচ্ছিন্ন ভোক্তায় পরিণত হয়েছি।
এর একটি সরস উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে বাংলাদেশের প্রভাবশালি ইংরেজি দৈনিক ‘দি ডেইলি স্টার’–এর পৃষ্ঠপোষকতায় ‘হে ফেস্টিভেল’ এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়: ইউল্যাব ও ইংরেজি দৈনিক ‘ঢাকা ট্রিবিউন’–এর পৃষ্ঠপোষকতায় ‘বেঙ্গল লাইটস’। আজকে ঔপনবিশেকি শক্তি চলে গলেওে তাঁর জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্যবাদের মধ্য থেকে নানা ধরনের ভূঁত আমরা আবার দেখা শুরু করেছি । এসব ভৌতিক রচনাসমূহ স্বভাবতই ইংরেজি সাহিত্যের সরাসরি অনুকরণ সমৃদ্ধ হচ্ছিল। আজকে এসে ঔপনবিশেকি শক্তি চলে গেলেও তাঁর জ্ঞানতাত্ত্বিক আধপিত্যবাদরে মধ্য থেকে নানা ধরনের ভূঁত আমরা আবার দেখা শুরু করেছি এসব ভূঁত এখন আন্তর্জাতিকতা নামে, মাল্টিকালচারালিজমের নামে সক্রিয় হয়ে উঠছে । রবীন্দ্রনাথরে কালওে এরকম ইংরেজি পালক লাগানো অভিজাতদের ভীড় লেগেছিল একই কান্নাকাটিতে। তাই তিনি বলছেন,
“… ইংরেজি–অভিমানী মাতৃভাষাদ্বেষী বাঙালির ছেলেকে আমরা দোষ দিতে চাহি না। ইংরেজির প্রতি এই উৎকট পক্ষপাত স্বাভাবকি। কারণ, ইংরেজি ভাষাটা একে রাজার ঘরের মেয়ে, তাহাতে আবার তিনি আমাদের দ্বিতীয় পক্ষের সংসার, তাঁহার আদর যে অত্যন্ত বেশি হইবে তাহাতে বিচিত্র নাই। তাঁহার যেমন রূপ তেমনি ঐর্শ্বয, আবার তাঁহার সর্ম্পকে আমাদের রাজপুত্রদের ঘরেও আমরা কিঞ্চিত সম্মান প্রত্যাশা রাখি । আমাদের হতভাগিনী প্রথম পক্ষটি, আমাদের দরিদ্র বাংলা ভাষা, পাকশালার কাজ করেন–সে কাজটি নিতান্ত সামান্য নহে, তেমন আবশ্যক কাজ আর আমাদের আছে কি না সন্দেহ, কিন্তু তাঁহাদের আমাদের আপনার বলিয়া পরিচয় দিতে লজ্জা করে । পাছে তাঁহার মলিন বসন লইয়া তিনি আমাদের ধনশালী নবকুটুম্বদের চক্ষে পড়েন এই জন্য তাঁহাকে গোপন করিয়া রাখি; প্রশ্ন করিলে বলি চিনি না”।1
আর তাইতো রবীঠাকুরের ভাষায় ‘ধনশালী নবকুটুম্বদের’ কাছে ‘বাংলা’ আজও ‘বেঙ্গল’ হিসেবে চর্চিত হচ্ছে। আর এতকথা বলে কি হবে? ‘রবীন্দ্র নাথ টেগোর’ আজও ‘ঠাকুর’ হতে পারলেন না খোদ ইন্ডিয়ানদের কাছে। অথবা বাংলাভাষী ইংরেজি সাহিত্যের আন্তর্জাতিকতাবাদিদের কাছে। এজন্য বেঙ্গল লাইটস ‘বিয়োন্ড আইডেন্টিটি ন্যারেটিভস: ডেফিনেশন অফ নিউওয়ার্ল্ড ফিকশন’ কনফারেন্স–এও সম্মুন্নত রাখলেন একই বিষয়কে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময়রে শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সাহিত্যের পাঠে বাংলার চেয়ে ইংরেজির গুরুত্ব প্রদানে খুবই উদগ্রীব বোধ করেছিলেন। তাঁর মতে,
“… আমাদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন যাঁহারা বাঙালি ছাত্রদিগকে অধিকতর পরিমানে বাংলা শিখাইবার আবশ্যকতা অনুভব করেন না, এমন–কি সে প্রস্তাবরে প্রতিবাদ করেন। যদি তাঁহাদিগকে স্পষ্ট করিয়া জ্ঞান জিজ্ঞাসা করা যায় যে আমরা যে দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছি সেই দেশের ভাষায় আমাদের নবলদ্ধ জ্ঞান বিস্তার করিবার, আমাদের নবজাত ভাব প্রকাশ করিবার, ক্ষমতা নূন্যাধিক/পরিমাণে আমাদের সকলরেই আয়ত্ত থাকা উচিত কি না, তাঁহার উত্তর দেয়া ‘উচিত’; কিন্তু তাঁহাদের মতে, সেজন্য বিশেষরূপে প্রস্তুত হইবার আবশ্যকতা নাই। তাঁহারা বলনে, ইচ্ছা করিলেই বাঙালির ছেলেমাত্রই বাংলা শিখিতে ও লিখিতে পারে।2
এখন কথা হচ্ছে, ইচ্ছা জন্মাবে কিনা? রবীন্দ্রনাথও একই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি যখন এসব কথা বলছেন তখনও বাংলা আধুনিক সাহিত্য হাঁটি হাঁটি পা পা করছে। তবে আজকে যখন সাহিত্য একটি পূর্ণাঙ্গ রূপের দিকে পৌঁছুতে শুরু করেছে এবং নানা বর্গে বিভাজনও করা যাচ্ছে তখন রবীন্দ্রনাথের কালের ইংরেজ নীতি নির্ধারণি ঔপনিবেশিক শক্তি ছিল। যা কিছু বাংলায় লেখা–লেখি হচ্ছিল তাঁর একটি বড় অংশই ইংরেজি সাহিত্যের সরাসরি অনুকরণ সমৃদ্ধ হচ্ছিল।যা আজও ‘বিয়োন্ড আইডেন্টিটি ন্যারেটিভস’–এর ব্যানারসহ বিভিন্ন বাংলা সাহিত্যের ছত্রছায়ায় ঘটে চলেছে।
২. উপনিবেশের মনোভঙ্গি ও প্রকল্পসমূহ
ঔপনিবেশিকরা আমাদের ইতিহাস, ভাবনা, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে যে–ভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল এবং ইতিহাসবিহীন, পিছিয়ে–পড়া, আদিম, বর্বর, রহস্যময়, অভদ্র সংস্কৃতির মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলএ চিহ্নায়নের ভাষাভঙ্গি কী ছিল তা আমাদের একটু ফিরে দেখা প্রয়োজন। একই সাথে প্রয়োজন কীভাবে আধুনিকতার দোহাই দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প জারি করেছিল যা আজও আমরা অবিকৃত রেখে হেজিমনাইজড জাতি হিসেবে অনুসরণ করে চলেছি।
বাংলায় সাম্রাজ্যবাদকে প্রকট হতে দেখি সেন, মুসলিম এবং খ্রিষ্টান সময়ে। তবে সেন ও মুসলিম সাম্রাজ্যবাদের সাথে খ্রিষ্টান–বেনিয়া সাম্রাজ্যবাদের চরিত্রগত পার্থক্য আছে। খ্রিষ্টান/ব্রিটিশদের কাছ থেকে বাংলা জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসনের স্বীকার হয় পরিকল্পিতভাবে। মিশেল ফুকো জ্ঞানকে ক্ষমতার কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তবে হেগেল ও মার্ক্স দু’জনই ক্ষমতাকে ভেবেছেন ইতিহাসের সাধারণ তত্ত্বের ক্ষেত্রে একটি অন্বেষণ হিসেবে। হেগেলের কাছে এই অন্বেষণ রাষ্ট্র নামক ঈশ্বর এবং মার্ক্সের কাছে শ্রেণিসংগ্রাম পরবর্তী রাষ্ট্রবিহীন অবস্থা। ফুকো জ্ঞাননির্ভর ক্ষমতায়নের যে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের কথা বলেছেন, সে–ভাবেই গঠিত হয়েছিল ভারতীয় সমাজ। উপমহাদেশে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছিল এক ধরণের প্রাচ্যবাদী ডিসকোর্স। এই ডিসকোর্সের কেন্দ্রে ছিল ইংরেজি–নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা। ফুকো বলেছেন, ব্যক্তির আত্মস্বরূপ হচ্ছে ক্ষমতার উপাদান, আধিপত্য বিস্তারের বিষয়। লক্ষণীয়, ঔপনিবেশিক শক্তি শোষণের স্বার্থে ভারতীয়দের এই আত্মস্বরূপকেই নিয়ন্ত্রণ করেছে। সিপাহী বিদ্রোহের পর ইংরেজদের পক্ষ থেকে শুরু হয় এই দখল প্রক্রিয়ার আয়োজন। সু–পরিকল্পিতভাবে প্রচলন ঘটানো হয় পাশ্চাত্যের বিকৃত শিক্ষার, যার বাহন ইংরেজি। জ্ঞানতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রকল্পের প্রথম আঘাতটি করা হয় ইতিহাস–বিহীন জাতি হিসেবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে। অর্থাৎ মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয় যে, তুমি শেকড়বিহীন।
এ ধাক্কাটা লাগে কোলকাতা–কেন্দ্রিক গজিয়ে–ওঠা নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে। এ শ্রেণিটি ততদিনে কেরানি হওয়ার প্রকল্পের অধীনে ইংরেজি ভাষা শিখে ইতিহাসকে ইংরেজি মানসিকতায় বুঝতে শুরু করেছে। তৎকালীন সাধারণ জনগোষ্ঠীর এ–বিষয় নিয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয় নি, যতটা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে নীল চাষকে কেন্দ্র করে। কারণ তারা ততদিনে বুঝে উঠতেই পারে নি কী ঘটে চলেছে। যেহেতু, বাবুদেরকে বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা ও প্রবন্ধ শুনিয়ে (উনিশ শতকের শুরুর দিকে এশিয়াটিক সোসাইটিকে কেন্দ্র করে ইতিহাস–সংস্কৃতি বিষয়ক যেসব সেমিনার হয়েছে স্যার উইলিয়াম জোন্স প্রমুখদের নেতৃত্বে) ব্রিটিশগণ আলোকময়তার আধুনিকায়নের নানা দিক তুলে ধরতে শুরু করলেন। নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করলেন আধুনিকতার সমরূপ হিসেবে। শুরু করে দিলেন ভারতবাসীর জন্য নানা ধরনের জাতীয় প্রকল্প। ই.বি. ম্যাকাওলের ‘মিনিট অন এডুকেশন’ এ ধরনের প্রকল্পেরই প্রথম ধাপ। ‘মানুষের চৈতন্যকে সব অর্থে করায়ত্ত’ করে নেবার কূট ভাবনার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে এ শিক্ষা–পরিকল্পনায়। ম্যাকাওলে এখানে উল্লেখ করলেন যে, ইংল্যান্ড– হলো সভ্যতার একমাত্র জিয়নকাঠি। ‘একজন ভারতীয় রক্ত ও রঙে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, মতামত, আদর্শ ও বুদ্ধিমত্তায় সে ইংরেজ’। এ–ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন মত প্রদান করলেন, ইংরেজি শিক্ষা ‘হৃদয় মনকে গড়ে তুলছে না, তা সমাজের উপরে চাপাইয়া দেওয়া হইয়াছে। এই শিক্ষা স্বাদেশিকতার বোধে ভারতীয়দের উত্তীর্ণ হতে দেয় না’। রবীন্দ্রনাথ এই জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসনের প্রতিরোধ করতে চান তার ‘তোতাকাহিনী’ দ্বারা। এই ‘তোতাকাহিনী’ ঔপনিবেশিক শিক্ষা–ব্যবস্থারই এক করুণ মর্মান্তিক উপাখ্যান এবং প্রতিবাদ।
রবীন্দ্রনাথের রূপক–বিদ্রূপ বিদ্রোহের রূপ লাভ করে নি। সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত সচেতন শ্রেণিকে একাট্টা বোধের অধীনে নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়। রাজনৈতিক প্রতিরোধবিহীন ব্যবস্থায় ইংরেজ তাদের আধুনিক শিক্ষা–কাঠামোর অনুমোদন করেন। এ শিক্ষার অধীনে ইউরোপীয় ইতিহাসকে তুলে ধরা হলো। শিক্ষা দিতে শুরু করল যে, ইউরোপীয় ইতিহাস বিজ্ঞানসম্মত বস্তুগত উপাত্তের ওপর নির্ভর করে পদ্ধতিগত উপায়ে লিখিত হয়েছে। ভারতবাসীর এরকম কোনো ইতিহাস নেই। তারা ইতিহাসবিহীন। এভাবে শেকড়বিহীন জাতির শেকড়ের সন্ধানে কোলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় উইলিয়াম জোন্সের নেতৃত্বে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ (১৭৮৪)।
উইলিয়াম জোন্সের (১৭৪৬–৯৪) অনুমান, ভারত ও ইউরোপের ভাষা এবং লোকগাথার একই উৎস ছিল। তিনি মনে করেন, ভারতের অতীতের সাথে গ্রিক প্রত্ন–নিদর্শনের অদ্ভুত মিল রয়েছে। তিনি আরও মনে করেন সূর্য উদিত হয় এবং অস্ত যায় শুধুই তাদের জন্য। তিনি কল্পনা করতে পারেন না যে তাদের দ্বীপের চারপাশে ঢেউ যে প্রবাল এবং মুক্তা ফেলে যায় তা অন্য কোনো বেলাভূমির ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। তার ভাবনায়, প্রাচ্যের সাহিত্য মূলত ইউরোপীয়দের দান এবং জনসাধারণের নবজাগরণে তারা ভূমিকা রাখতে পারে যেমনটি গ্রিক সাহিত্য করেছিল রেনেসাঁকালীন।
ভারতের সাহিত্যের যুগবিভাজন হয় ইতিহাসের যুগবিভাজনের ওপর ভিত্তি করে। জেমস মিল তার ‘হিস্ট্রি অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ (১৮১৭) গ্রন্থে ভারতের ইতিহাসের সময়কে ইউরোপীয় ইতিহাসের আলোকে ‘প্রাচীন’, ‘মধ্য’ ও ‘আধুনিক’এ তিন পর্বে বিভাজিত করেন। আলোকময়তার ধারক হিসেবে ব্রিটিশ পর্বটিকে আধুনিক সময় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রাচীন পৌরাণিক স্বর্ণ যুগকে প্রাচ্যবাদীরা চিহ্নিত করেছেন স্বেচ্ছাচারিতা ও বর্বরোচিত প্রথা হিসেবে। মিলের মতে, ভারত সভ্যতার প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ে গিয়েছিল এবং একে একমাত্র পশ্চিমের অভিভাবকত্ব নিয়ে ফিরতে হবে। ব্রিটিশপূর্ব ভারতের সাহিত্যকে নিয়ে ভয়াবহ মন্তব্যটি করেন ম্যাক্স মূলার। তার মতে, ভারতের সমগ্র সাহিত্য ব্রিটিশ লাইব্রেরির একটি তাকের বইয়ের সূচিপত্রের সমান।
৩
যদিও শিরোনামে ‘বাংলা সাহিত্যের করণের’ বিষয়টি উচ্চারিত হয়েছে তাই আধুনিকতাবাদী সাহিত্য বিভাজন যা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথাগত হয়েছে যেমন: উপন্যাস, নাটক, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি ভেদ রেখায় ফেলে তুলনামূলকভাবে গত দেড়শত বছরের একটি বিরাট ক্যানভাসকে ভেবে নেয়াটা অন্যায় হবে না। কারণ এভাবেই আমরা সাহিত্য বোঝার হেজিমনিতে নিজেকে প্রযুক্ত করেছি। আর তাইতো আমি শিরোনামে ‘বাংলা সাহিত্যকে’ বন্ধনী কমা দিয়ে বেঁধে নিয়েছি। কারণ সেলিম আল দীন এখানেই তার একটি প্রকল্প হাজির করে ‘বাংলা সাহিত্যের’ পশ্চিমা কর্তৃত্ববাদীতাকে প্রথম পাল্টে দেবার কাউন্টার ডিসকোর্স হাজির করেছেন। এ ক্ষেত্রে তার বক্তব্যর দিকে ফিরে তাকানো যেতে পারে –
লেখকের জন্যে স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি তার শিল্পী স্বভাবের মধ্যেই নিহিত থাকে। কেউ গদ্যে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে পারেন, কেউ পদ্যে। কাজেই গদ্য–পদ্যের বিশেষ বিভাজন কেন্দ্রিক গুণাগুণ নির্ণয় অর্থহীন। উপরন্তু পাশ্চাত্য শিল্পরীতিতে গদ্যে ও পদ্যের যে অংশভাগ, আমি তা স্বীকার করি না। কারণ প্রাচ্যের শিল্প–মাধ্যমে শিল্পরীতিতে একটি নিগূঢ় ঐক্যবোধ কাজ করে। যে কারণে সৃষ্টিশীল গদ্য এখানে সব সময়ই কবিতার হাত ধরাধরি করে চলে। বাংলা কাব্যে প্রায় হাজার বছর ধরে পয়ার ছন্দের যে প্রতাপ আমরা প্রত্যক্ষ করি তার মূলেও এই ঐক্য–চেতনা। অর্থাৎ ছন্দ একই সঙ্গে গদ্যের প্রয়োজন মিটিয়ে তবে কবিতা, পয়ারের বিপুল শোষণ ক্ষমতার কারণে বাংলা সাহিত্যে গদ্যের উদ্ভব অনিবার্য হয়ে উঠে নি অথবা বলা যায় গদ্যের সকল সম্ভাবনাকে পয়ার ছন্দ আত্মসাৎ করে সফলভাবে নিজের প্রতাপ অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। পরবর্তীকালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ–কেন্দ্রিক নিরঙ্কুশ গদ্যের উদ্ভব যখন ঘটলদেখা যায় ইতিহাস কিংবা পুরণো কালের গদ্য অথবা সৃষ্টিশীলসর্বত্রই কবিতার সঙ্গে তার একটি গভীর ঐক্যের অভিজ্ঞান বিদ্যমান। রামরাম বসু, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, প্যারীচাঁদ মিত্রের গদ্য নিঃসন্দেহে মধ্যযুগের বাংলা কথকরীতির সমকালীন সংস্করণযমক অনুপ্রাস, ব্যাজস্তুতি কাব্যালংকার প্রভৃতিতে ঠাসা। হুতোম প্যাঁচার নক্সা, আলালের ঘরের দুলাল প্রভৃতি উপাখ্যান কথকরীতিরই উত্তরসূরি। মধুসূদন কৃষ্ণকুমারী নাটকের ভূমিকায় বলেছিলেন যে, অন্য যে–কোনো ভাষার তুলনায় বঙ্গভূমিতে বাংলা গদ্য অধিকতর গীতল ও সুমিষ্ট। মধুসূদন বাংলা ভাষার স্বভাব–গীতলতাকেই এই কথা দ্বারা নির্দেশ করেছেন। ভাষার স্বভাবের মধ্যে ভাষার সাধারণ চলার পথে শব্দপদবন্ধে গীতলতার এই নৈসর্গিক অবস্থানের কারণে বাংলা গদ্যের সঙ্গে কবিতার ভেদ নির্ণয় কখনও কখনও বহিরঙ্গ আশ্রয়ীমাত্র। তা অন্তর্ধর্মের মূল্যায়ন নয়। বঙ্কিমচন্দ্রের যুগ–দুর্লভ শিল্পভাষা সম্পর্কে এই কথা প্রযোজ্য। রবীন্দ্রনাথের মধ্যেই বাংলা গদ্য এবং পদ্যের দ্বন্দ্ব চূড়ান্তভাবে মীমাংসিত হয়েছে। তাঁর গদ্য কবিতার প্রান্তদেশবর্তী এবং এর আবেদন সর্বকালীন কবি–মনের কাছে পৌঁছে যায়। রবীন্দ্রনাথের গদ্যে কবির কল্পনাশক্তি এক গীতল শব্দের অন্বয়ে সুরের ধারায় ঝংকৃত হয়। বাংলা গদ্য–পদ্যের ভেদটাকে এ ভাষার স্বভাব–সাহিত্যরীতি এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতার আলোকে বিচার করলে দেখা যায় ইউরোপীয় সংজ্ঞাসূত্রের অধীনে তাকে বিভাজন করা যায় না। ন্যায়শাস্ত্রের ভাষা, বিভাগ–দপ্তর বা খবরের কাগজের ভাষা ব্যতিরেকে গদ্যের অস্তিত্ত্ব অন্য কোথাও আছে বলে আমার মনে হয় না।3
সেলিম আল দীনের বক্তব্যটির দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কয়েকটি বিষয়। তা হলো,
প্রথমত, পাশ্চাত্য শিল্পরীতির গদ্য/পদ্যের বিভাজনকে অস্বীকার করা।
দ্বিতীয়ত, হাজার বছরের পয়ার ছন্দের ক্ষমতার ওপর আস্থাশীলতা।
তৃতীয়ত, বাংলায় গদ্যচর্চার শুরুর কালেই সৃষ্টিশীল গদ্যে গীতলতাকে স্পষ্ট করা এবং কথকরীতির প্রকাশ খুঁজে পাওয়া।
চতুর্থত, গদ্য/পদ্যের আধুনিক ভেদ তুলে দিয়ে হাজার বছরের সাহিত্যের রীতিতে ফিরে যাবার প্রকল্প জারি করা।
পঞ্চমত, ইউরোপীয় সাহিত্যরীতির সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ।
আল দীন ইউরোপীয় সাহিত্যরীতির সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। তার কাজের দিকে ফিরে তাকালে দেখবো ১৯৭৭ সালের শকুন্তলা নাটকের মাধ্যমে প্রথম তিনি বিষয়ের দিক থেকে নিজ সংস্কৃতিতে ফিরে এসেছেন। তারপর একে একে কিত্তনখোলা, হাতহদাই, চাকা, যৌবতী কন্যার মন, বনপাংশুল, প্রাচ্য প্রভৃতি লেখার মাধ্যমে বিষয়, নিম্নবর্গের ভাষাভঙ্গি এবং আঙ্গিকের দিক থেকে সম্পূর্ণই ফিরে এসেছেন স্বদেশভূমে। গা থেকে খশিয়ে দিয়েছেন উপনিবেশের সকল তকমা। ভেঙে দিয়েছেন গদ্য/পদ্যের অর্থাৎ উপন্যাস, গল্প, নাটক, কবিতা, গানের সকল ভেদরেখা।
একজন স্ব-সচেতন, স্ব-শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে আল দীন প্রতিরোধ তৈরি করতে চেয়েছেন। তিনি পশ্চিমা আধুনিকতার জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রকল্পের পাল্টা কর্মসূচি বিভিন্ন নিরীক্ষার মাধ্যমে ঘোষণা করেছেন এবং প্রয়োগরীতিকেও নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা থিয়েটারের মাধ্যমে উপস্থাপন করে গেছেন।
আলোচনার সুবিধার্থে বর্তমান আলোচনাটিতে তথাকথিত বাংলা সাহিত্যের একটি অংশ মঞ্চ নাটককে কেন্দ্রে রেখে আলোচনা এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হল। কারণ, সেলিম আল দীনের রচনা যেহেতু নাটক হিসেবে মঞ্চায়িত হয়েছে এবং তার লেখায় প্রায়োগিক বিষয়াবলী সক্রিয় ছিল বিধায় বাংলাদেশের মঞ্চ-নাটককে আঙ্গিক বিশ্লেষণের সুবিধার্থে আলোচনাকে কেন্দ্রিভূত করা হল।
৪. বাংলাদশেরে নাট্যচর্চার পূর্বাপর
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত নুরুল মোমেনের সংলাপ নির্ভর নাটক ‘রূপান্তর’, ‘যদি এমন হত’, ‘আলোছায়া’, ‘নয়া খান্দান’ প্রভৃতি, আসকার ইবনে শাইখ-এর ‘বিদ্রোহী পদ্মা’, ‘অনুবর্তন’, ‘প্রচ্ছদপট’ প্রভৃতি নাটকের আঙ্গিক নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করনে।এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত এবং পরাধীন বাংলাদেশের মানুষের কাছে মুক্তির বারতা নিয়ে সফল ভাবে হাজির হন মুনীর চৌধুরী।তাঁর ‘কবর’ নাটকটি আজও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বার প্রযোজিত নাটক। এটাকে একটি কালোত্তীর্ণ নাট্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তাঁর অন্যান্য নাটকগুলো হলো, ‘চিঠি, ‘দণ্ড’, ‘দণ্ডধর’, ‘মানুষ’, ‘মর্মান্তিক’। সাহিত্য মূল্যের এক অনন্য প্রয়াস নিয়ে হাজির হতে দেখি সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহকে তাঁর ‘বহিপীর’, ‘তরঙ্গভঙ্গ’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘উজানে মৃত্যু’। এ এক আধুনিক পশ্চিমা চিন্তাকল্পের বাংলাদেশি উপস্থাপন। আধুনিক মানুষের সঙ্কট এখানে সচল হয়ে ওঠে। বাংলা নাটকে এবস্ট্রাক/বিমূর্ত ধারার নাটক নিয়ে হাজরি হন- সাঈদ আহমদে। তিনি রচনা করেন, ‘কালবলো’, ‘মাইলপোস্ট’, ‘তৃঞ্চা’ প্রভৃতি এর বাইরে আমরা দেখতে পাই আনিস আহমেদকে ‘মানচিত্র’ এবং ‘এলবাম’ নাটক দুটোর মাধ্যমে। সিকান্দার আবু জাফরকে পাই ‘সিরাজ-উদ-দৌলা’, ‘মহাকবি আলাওল’, ‘মাকড়সা’ ও ‘শকুন্তলা উপাখ্যান’-এ। জিয়া হায়দার-এর ‘শুভ্রা সুন্দর কল্যানী আনন্দ’ প্রতীক নির্ভর নাটক। এসবই হল ১৯৭১-পূর্ব বাংলাদেশের মানুষরে রচিত নাটক। তবে এ নাটকগুলো ১৯৭১-এর প্রস্তুতি পর্বের জন্য একমাত্র মুনীর চৌধুরী ব্যতিত আমরা আর কোনো নাট্যকারকে খুঁজে পাই না।
মূলত বাংলাদেশের নাট্যঐতিহ্য বিবেচিত হতে পারে ১৯৭১ উত্তর যুদ্ধ ফেরত তরুণদের হাত ধরে ১৯৭২-’৭৩-এ যে নাটকের ধারা শুরু হতে দেখি – তাই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সেলিম আল দীনের ‘জন্ডিস এবং বিবিধ বেলুন’, ‘সংবাদ কার্টুন’, আল-মনসুরের ‘বিদায় মোনালিসা’, ‘হে জনতা আরেকবার’, মামুনুর রশীদের ‘পশ্চিমের সিঁড়ি’। এসময়টাকে মামুন এই উদাহরণগুলো ব্যবহার করেই ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে যে,
“… এভাবেই শুরু হল। একটা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর এরকমই হয়। হঠাৎ করে সব একসাথে শুরু হয়ে যায়। নিয়ম নীতির বালাই থাকেনা। নতুন কিছু করা দরকার, সেটাই আসল কথা।”4
আর এই নতুনটা শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আশ্রয় করে। এসময়ের নাটক হয়ে উঠল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনঃপুন মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে । সেক্যুলার, অর্থনৈতিক মুক্তির, ভাষার ঐতিহ্যের, রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দের আবহমান বাংলার চিত্রকল্পের নাটক। এখানে মুনীর চৌধুরী, আসকার ইবনে সাইখ, নুরুল মোমনে, সাঈদ আহমদে ছিটকে পড়ে গেলেন। বাংলাদেশের জাতীয় নাট্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জিবিত হয়ে চেতনায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠল।
এসব নাটক চেতনায় বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারন করলেও আঙ্গিকে সে পশ্চিমা রীতিকে অনুসরণ করে। এ সময়রে নাট্যকারগণ যেমন, আব্দুল্লাহ আল-মামুন রচনা করেন, ‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘এখন দুঃসময়’, ‘সেনাপতি’, ‘এখনও ক্রীতদাস’, ‘তোমরাই’, ‘কোকিলারা’ ইত্যাদি, সৈয়দ শামসুল হক-এর ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নুরুলদীনের সারাজীবন’, ‘এখানে এখন’, ‘ঈর্ষা’ ইত্যাদি, মমতাজ উদ্দীন আহমদে-এর ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা’, ‘হরিণ চিতা চিল’, ‘বিবাহ’, ‘কি চাহ শঙ্খচিল’, ‘রাজা অনুস্বারের পালা’, ‘ফলাফল নিম্নচাপ’ ইত্যাদি, মামুনুর রশীদ-এর ‘ইবলিশ’, ‘গিনিপিগ’, ‘সমতট’, ‘মানুষ’, ‘এখানে নোঙর’, ‘জয়জয়ন্তী’ ইত্যাদি, সেলিম আল দীন-এর ‘জন্ডসি এবং বিবিধ বেলুন’, ‘সংবাদ কার্টুন’, ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’, ‘শকুন্তলা’, ‘কীর্তন খোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’।সেলিম আল দ্বীনকে এই কেরামত মঙ্গল পর্যন্ত আটকে দিলাম। তাঁকে উপরোক্ত ধারার ভেতরে চিহ্নিত করতে আগ্রহী। তাঁর বাকী কাজ নিয়ে লেখার পরর্বতী পর্যায়ে বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা করব। পাশ্চাত্য শিল্পভাবনার ওপর দাঁড়িয়ে সেলিম নিজের উপরে উল্লেখিত নাটক নিয়ে বলছেন,
“সন্দেহ করি আমার শুরুর দিকের রচনায় পাশ্চাত্য শিল্পরীতি এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে জীবনকে দেখাবার ভঙ্গিটাও নিতান্ত অনুকৃত”5।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জিবিত হয়ে আরও বেশ কিছু নাটক উপস্থাপিত হতে দেখি । যেমন এস এম সোলায়মান-এর ‘ইঙ্গিত’, ‘ক্ষ্যাপা পাগলের প্যাঁচাল’, ‘এই দেশে এই বেশে ইত্যাদি, আবদুল্লাহলি মাহমুদ-এর ‘সাতপুরুষের ঋণ’, ‘নানকার পালা’ এবং মান্নান হীরার ‘পাথর’, ‘খেলা খেলা’, ‘আগুন মুখা’ ইত্যাদি ।
এসব নাটকে পরিবেশন রীতিতে বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। তবে তা সবই প্রায় ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থতার অসংখ্য কারণের একটি হল পশ্চিমা আঙ্গিকে আশ্রয় করে প্রয়াশগুলো চালান হয়েছে।
এসব নাটকের বাইরে বেশ কিছু রূপান্তর এবং অনুবাদ নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ফ্রাঞ্জ ফানো এ প্রবণতাকে চিহ্নিত করেছেন এভাবে যে,
“… দেশীয় বুদ্ধিজীবীগণ আসলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি গিলেছে। অবস্থাটা অনেকটা পোষ্য-সন্তানদের মত। মনের মধ্যে নিরাপত্তার ভাবনা দানা না বাঁধা পর্যন্ত পোষ্য-সন্তান যেমন নতুন পারিবারিক কাঠামোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে, দেশীয় বুদ্ধিজীবীগণও তেমন পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে নিজের করতে চায়। তাঁরা রেবালে, দিদেরো, শেক্সপীয়র এবং এডগার এলেন পো’র সন্ধান পেয়েই সন্তুষ্ট নয়, বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তাঁদেরকে তাঁরা যথাসাধ্য আয়ত্তও করতে চেষ্টা কর”6।
এক্ষেত্রে মলিয়ের নাটককে স্যাটায়ার থেকে ভালগারে উপনীত করছে। এসব নাটক পরিবেশনকারীগণ স্যাটায়ার ও ভালগারের মধ্যকার বিভাজন রেখাকে চিনতে পারেন কিনা সেটাই বিস্ময় নিয়ে দেখি। আব্দুল্লাহ আল-মামুন খেদভরে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বক্তব্যকে ব্যবহার করে একে ‘অলীক কুনাট্যে মজি’ বলে তীরষ্কার করছেনে।7
ওপরের সকল নাট্যের চরিত্রকে বিশ্লেষণ করে দেখতে পাইযে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক,অর্থনৈতিক অসঙ্গতিকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সাথে নিয়ে নাটক রচিত এবং উপস্থাপিত হয়েছে। এসব নাটক পঞ্চাঙ্ক রীতি অনুসরণে এবং প্রসেনিয়ামের উপজীব্য করে শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্তকে আশ্রয় করে করা হয়েছে। তবে সৈয়দ শামসুল হক–এর নাটক বাংলাদেশের কাব্য নাট্যের পরিসরকে সমৃদ্ধ করেছে তা অনস্বীর্কায। পশ্চিমা বিবেচনায় তা ক্লাসিকস হিসেবেও চিহ্নিত করা যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় নাট্য আঙ্গিক নির্মাণে তাঁর ভূমিকাটি নিয়ে দীর্ঘ প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়। এ ধরনের প্রয়াস বাংলাদেশের নাটকে নয়া হলেও পৃথিবীর নাটকের ইতিহাসে নয়া বিষয় নয় এবং এ ধারাটি আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে আশ্রয় করে আঙ্গিকগতভাবে এবং কোন কোন নাটকের ক্ষেত্রে চেতনাগত ভাবে দাঁড়িয়েছে কিনা তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। এ বিষয়টি নিয়ে রচয়িতা হিসেবে তিনি ভেবেছেন কিনা তা সন্দেহাতীত নয়। এটা বলার কারণ হল আব্দুল্লাহ আল-মামুন বেশ খেদের সাথেই বলছেন,
“অনেক কাজের কাজি, সব্যসাচী লেখকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখি, সব কাজ শেষ করে বা কাজরে ফাঁকে ফাঁকে নাটক ধরেন। র্অথাৎ নাট্যরচনা তাঁদের প্রাথমিক বা প্রধান কাজ হয় না। অথচ তাঁরা যখন নাটকের চৌহদ্দিতে প্রবেশ করেন, তখন তাঁরা এমন চমক লাগান, এমনভাবে ঝলসে উঠেন যে, পরিতাপই হয় এই মর্মে যে, আহা তাঁরা কেন শুধুই নাটক লিখলেন না?” 8
৫
ঔপনিবেশিক জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসনকে আমরা ‘আফ্রিকা’ পাঠের মাধ্যমে আমরা সহজেই জানতে পারি। আফ্রিকার এক অঞ্চল পরিচিতি পায় ফ্রাঙ্কোফোন অঞ্চল হিসেবে এবং অপর অঞ্চল পরিচিতি পায় অ্যাংলোফোন অঞ্চল হিসেবে। ফ্রান্স ও ব্রিটিশরা যুগপৎ ৭০ বছরের উপনিবেশের অধীনে ক্যামেরুন, নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকীয়দের ভুলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে তাঁদের বর্ণমালাকে। ওলে সেয়িঙ্কা, নগুগিদের আমরা দেখতে পাই বিজাতীয় ভাষায় চর্চা করতে। অবশ্য নগুগি নিজ ভাষায় প্রত্যাবর্তন করেন সম্পূর্ণ প্রতিরোধীর চেহারায়। অনেকে এক্ষেত্রে বলে থাকেন, আফ্রিকার ভাষা-সংস্কৃতির প্রতিরোধের ক্ষমতা কম থাকায় তা হারিয়ে গেছে। আর বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতির প্রতিরোধের ক্ষমতা বেশি বিধায় ২০০ বছরের আগ্রাসনের পরেও তা টিকে আছে। এখানে উল্লেখ্য যে, উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝতে হবে উপনিবেশ কতটা সফল হতে পেরেছে।
এসব কারণে উত্তর-উপনিবেশিকতাবাদকে আমি উত্তর-ঔপনিবেশক পরিস্থিতি হিসেবে দেখতে আগ্রহী। এক্ষেত্রে শর্মিলা সেনের৯ বক্তব্যের সাথে একমত হয়ে আমিও বলতে চাই, উত্তর-উপনিবেশ হলো একটি পরিস্থিতি। যখন পশ্চিমা শাসন সরাসরি প্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে না কিন্তু নিয়ন্ত্রণের সকল ব্যবস্থা এমনভাবে সম্পন্ন হয়েছে যে সে এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে চাবি দেয়া পুতুলের মতো নিয়ন্ত্রিত। ‘ইজম’ বা ‘বাদ’ হলো কোনো বিশেষ কর্মসূচি বা মতবাদ, যেমন : মার্ক্সবাদ, নারীবাদ প্রভৃতি।
উত্তর-ঔপনিবেশিকতাকে উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদ হিসেবে বেশিরভাগ তাত্ত্বিকগণের উল্লেখ করার বড় কারণ হলো এর ঔপনিবেশিকতার একটি সমালোচনামূলক অবস্থান আছে, যা ঔপনিবেশিক নৃতাত্ত্বিক গবেষণাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে। ১৯৩০ সালে সমগ্র বিশ্বের ৮৪.৬ শতাংশ জমিই ছিল কোনো না কোনো বর্তমান বা প্রাক্তন উপনিবেশের অন্তর্গত। এ থেকেই বোঝা যায় উপনিবেশবাদ আমাদের পৃথিবীর ভৌগোলিক বা ঐতিহাসিক মানচিত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রক্রিয়া। উপনিবেশিত মানুষদের সংস্কৃতি বোঝার মাধ্যমে তাদেরকে কীভাবে আরও র্নিবিঘ্নে শাসন-শোষণ করা যায়—এজন্য কোন পদ্ধতি যুক্তিযুক্ত তা জানতে এ সকল এলাকায় ব্যাপকভাবেই নৃতাত্ত্বিক গবেষণা পরিচালিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে, উপনিবেশ-উত্তর সময়ে এ সকল নৃতাত্ত্বিক গবেষণা বিস্তর সমালোচনার সম্মুখীন হয়। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় নৃতাত্ত্বিক চিন্তক ছাড়াও উপনিবেশিত অঞ্চলসমূহের অনেক চিন্তক উপনিবেশবাদের ব্যাপক সমালোচনা করেন। ব্যাপক ভিত্তিতে এই সমালোচনাগুলো উত্তর-আধুনিকতাবাদ-কেন্দ্রিক হলেও এদের মধ্যেই উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদী চিন্তকগণ অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদ কথাটা যখন বলা হয় তখন ‘উত্তর’ কথাটি কেবল ঔপনিবেশিকতা পরবর্তী সময়কে নির্দেশ করে না, বরং ঐসব চিন্তা ও প্রতিক্রিয়াকে নির্দেশ করে বা ঔপনিবেশিক চিন্তাগুলোকে চাপিয়ে দেয়ার যে অন্যায় চেষ্টা, তার মুখোমুখি দাঁড় করায়।
উত্তর-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষা বর্ণমালা হারায় নি বলে স্বস্তির ঢেঁকুর তুলে লাভ নেই। ভাষার ভেতরে আত্মীকৃত করতে হয়েছে পাশ্চাত্যের শব্দ, গঠন-কৌশল, বিরামচিহ্ন প্রভৃতিকে। গদ্য লেখার কৌশল করতে হয়েছে আয়ত্ত। পালাগান, জারি-সারি, যাত্রাপালাকে গ্রাম্য সংস্কৃতির অধীন করে পারফর্মিং আর্টের অন্যতম অংশীদার ‘ড্রামা’ কে ‘নাটক’ নামে পশ্চিম থেকে আগত লেবেদেফের হাত ধরে আমাদের শিখতে হয়েছে। লেবেদেফ বাংলা নাটকের জনকে পরিণত হয়ে পড়েন। ইউরোপকেন্দ্রিক প্রসেনিয়াম থিয়েটারের অধীনে দু’একটা ময়মনসিংহ গীতিকার চর্চা করে নিজের মূলধারার সাংস্কৃতিক চর্চাকে উপস্থাপন করছি ‘এক্সপেরিমেন্টাল ড্রামা’ (!) বলে।
নাটকের ক্ষেত্রে এ পরজীবী প্রকল্পের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য ১৯৮০ সালের নবগঠিত গ্রাম থিয়েটারের ঘোষণাপত্রে সেলিম আল দীন এর বি-উপনিবেশিতকরণ প্রকল্পের প্রথম ভাষ্য ঘোষিত হয়:
বাংলাদেশের মঞ্চে…আমরা আমাদের নিজেদের জীবন, পরিম-ল ও লড়াই-এর চিত্র তুলে ধরতে চাই। গ্রাম থিয়েটার মেরুদ-হীন আপোসকামী নাট্যচর্চার বিরুদ্ধে প্রাণবন্ত ও প্রাণদায়ী নাট্যচর্চাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।…গ্রাম থিয়েটার আধুনিক নাট্যকলার সঙ্গে বাংলাদেশের নিজস্ব নাট্য-আঙ্গিকের সমন্বয় সাধনে বদ্ধপরিকর।
‘কিত্তনখোলা’ নাটকের মাধ্যমে এ প্রতিরোধী প্রকল্পের শুরু। এ বিষয়টি খোলাসা করবার পূর্বে খোদ উত্তর-ঔপনিবেশিকতা নিয়ে আরো একটু বক্তব্য উপস্থাপন জরুরি।
সাহিত্য সমালোচনায় উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদ প্রত্যয়টি ব্যবহৃত হয়ে আসছে এডওয়ার্ড সাইদের ‘ওরিয়েন্টালিজম’, তালাল আসাদের ‘কলোনিয়াল এনকাউন্টার’ এবং উত্তর-কাঠামোবাদী তত্ত্বের নানাবিধ ধারা প্রবাহিত সেই সব র্যাডিক্যাল কাজ বোঝাতে, যেগুলোর অ-ইউরোপীয় সমাজের ঔপনিবেশিক রেপ্রিজেন্টেশনের চলমানতার বিষয়ে অধিক আগ্রহী। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক অঞ্চলের যে সমস্ত চিন্তক, যাঁরা নিজেরা ঔপনিবেশিক শাসন দ্বারা নানাভাবেই নির্যাতিত, নিপীড়িত হয়েছিলেন, তাঁদের পক্ষ থেকে ঔপনিবেশিকতাবাদের সমালোচনামূলক ধারা তৈরি হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘তালাল আসাদ’-এর কথা যিনি লিবিয়ার অধিবাসী ছিলেন এবং এটি ছিল ইতালীয় উপনিবেশ। যিনি নিজে ঔপনিবেশিক শাসকদের নানা বিষয়গুলোকে কাছ থেকে দেখতে পেরেছিলেন, এমনকি ভুক্তভোগিও ছিলেন। মূলত উত্তর-ঔপনিবেশিকতা হলো উপনিবেশবাদের বিশাল ইতিহাসকে বোঝার পদ্ধতি ও তত্ত্বের একটি সমালোচনামূলক ধারা।
আর বি-উপনিবেশীকরণ হলো উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচনাসমূহকে সাথে নিয়ে প্রতিরোধের কর্মপদ্ধতি তৈরি করা। কেনিয়ার সাহিত্যিক নগুগি ওয়া থিয়েঙ্গা মনের বি-উনিবেশীকরণের যে ধারণা তত্ত্বায়িত করেছেন তার মূলকথা হলো ইউরো-কেন্দ্রিক আবর্তন-পথ থেকে সরে এসে দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সৌরম-লে প্রবেশ। সে ক্ষেত্রে দেশী মতাদর্শ-সংস্কৃতি-বাস্তবতা-স্থানীয়জ্ঞান-কিংবদন্তি-সময়চেতনা-মিথ-ইতিহাসবোধকে পুনর্জাগরিত-পুনরাবিষ্কৃত করার প্রেক্ষিতে দেশীয় ভাষায় অভিব্যক্তি প্রকাশ হয়ে দাঁড়ায় উত্তর-ঔপনিবেশিক আধিপত্য প্রতিরোধের অন্যতম পদক্ষেপ।
নাটক যেহেতু সমন্বিত ও প্রায়োগিক শিল্পকর্ম, সেহেতু নাটকে দেশীয় সংস্কৃতি, নৃত্য, কিংবদন্তি এবং ইতিহাসবোধের সর্বোচ্চ প্রয়োগ সম্ভব, যা সাহিত্যের অন্যকোনো শাখায় সম্ভব নয়। নাইজেরিয়ান নাট্যকার ওলা রেটিমি মনে করেন আফ্রিকায় উত্তর-ঔপনিবেশিকতাকে প্রতিরোধের জন্য নাটকের ফর্মগুলো ইউরোপ থেকে আমদানি করা নয়। আফ্রিকার বিপ্লবী সাহিত্যিক নগুগি ও নোবেল বিজয়ী নাট্যকার ওলে সেইঙ্কার নাটক পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, তাঁরা কতটা সফলভাবে ঔপনিবেশিক জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসনকে প্রতিরোধের হাতিয়ার হিসেবে নিজস্ব সংস্কৃতির উপাদানগুলোকে নাটকে প্রয়োগ করেছেন।
ঠিক যে কারণে নগুগি কিংবা ওলে সেইঙ্কাকে আফ্রিকান উত্তর-ঔপনিবেশিক জ্ঞানতত্ত্বের প্রতিরোধের উদ্দিষ্ট নাট্য-ঐতিহ্যের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, একই কারণে উত্তর-উপনিবেশ জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশের নাট্যকার সেলিম আল দীনকে বাংলা নাটকের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। বর্ননাত্মক নাট্যরীতিতে দেশজ সংস্কৃতির উপাদানের সফল প্রয়োগ করে বাংলা নাট্যরীতিকে দাঁড় করিয়েছেন ইউরোপীয় নাট্যরীতির মুখোমুখি।
বাংলা নাটকের বি-উপনিবেশীকরণ প্রকল্পে আল দীনের নাম বিশেষভাবে বলার কারণ একটাই, আর তা হলো : লেবেদেফের হাত ধরে বাংলা নাটকের ইউরোপকেন্দ্রিক যে পরিচিতি নির্মিত হয়েছিল দেশের মূল নাট্যধারা থেকে বিযুক্ত হওয়ার মাধ্যমে, সেখানে আল দীন প্রথম বাংলার মূল নাট্য-ঐতিহ্যকে গ্রাম্যতার খোলসমুক্ত করেন ‘ফোক ড্রামা’কে ‘বাংলা ড্রামা’ হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমে এবং গা থেকে ‘ফোক’-এর পরগাছাটিকে সাহিত্যগুণের মাধ্যমে ছাড়িয়ে দিয়ে। তিনি একই সাথে নাটকের ‘আঙ্গিক’/ফর্ম নিয়ে পশ্চিমারীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করেন। নাটকে উড়–নি, লাঠি প্রভৃতি ব্যবহারের মাধ্যমে দূরে ঠেলে দেন প্রপস ও সেটের প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে। পদ্য ও গদ্যের সংমিশ্রণে বর্ণনারীতিকে প্রসেনিয়ামের মূল ধারণা থেকে বের করে এনে দাঁড় করান পালাগান ও যাত্রাগানের আঙ্গিকে। তুলে আনেন বাংলা পরিবেশন সাহিত্যের আদি শিল্পতত্ত্ব দ্বৈতাদ্বৈতবাদকে।
আল দীনকে আমরা দেখি এক দীর্ঘ পথ-যাত্রা অতিক্রম করতে। অরুণ সেন আল দীনের নাট্টাভিযানকে চারটি পর্বে বিভাজিত করেছেন। তা হলো : ক. প্রস্তুতি ও নিরীক্ষা পর্ব, খ. প্রথম পর্ব : কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাত হদাই, গ. দ্বিতীয় পর্ব : চাকা, যৈবতী কন্যার মন, হরগজ, ঘ. তৃতীয় পর্ব : বনপাংশুল, প্রাচ্য। আমি অরুণ সেনের বিভাজনের সাথে একমত। আল দীন ‘অনিকেত অন্বেষণ’ (১৯৭২) নাট্যের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেন। এরপর একে একে লিখে যান নীল শয়তান, তাহিতি ইত্যাদি, সর্প বিষয়ক গল্প, জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা, সঙবাদ কার্টুন, মুনতাসীর, করিম বাওয়ালির শত্রু অথবা মূল মুখ দেখা, আতর আলীদের নীলাভ পাট প্রভৃতি। সেন (২০০০ : ৯৫) আল দীনের এ প্রস্তুতিকালীন পর্বে পশ্চিমা রীতিকে খুঁজে পান স্পষ্টভাবে। তিনি বলেন,
রিয়েলিজম বা ন্যাচারালিজমকে বর্জন করার যে প্রয়াসগুলো সফল হয়েছিল ইউরোপীয় নাটকে, তাদের গ্রহণ করার সময়ও তিনি ছিলেন অভিনবত্বেরই সন্ধানী। ‘থিয়েটার অব দি অ্যাবসার্ড’ চরিত্রের পারম্পর্য এবং রূপাবয়ব বা সংলাপের যুক্তিশৃঙ্খলাকে ভেঙে ফেলার, বাস্তবের মায়াকে লঙ্ঘন করার যে-যে আয়োজন করেছে, নাটককে উদ্ভট পরিসমাপ্তির দিকে নিয়ে গেছে, তার নানাবিধ লক্ষণকে তিনি ব্যবহার করেছেন।
তবে সেন একইসাথে এ কথাও স্বীকার করেছেন যে, বৈদেশিক প্রভাব থাকলেও কিন্তু সেগুলো একটি আরেকটির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তবে বিষয়ের দিক থেকে আল দীন কালিদাসের লেখনী থেকে সরে গিয়ে এক নতুন শকুন্তলাকে উপহার দেন। একে বিষয়গত এবং চরিত্রের সনাতনী সংকট চিত্রণের বি-উপনিবেশীকরণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
বি-উপনিবেশীকরণের আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ হিসেবে আমি চিহ্নিত করতে চাই ‘কিত্তনখোলা’ নাটককে। নাট্যের পশ্চিমা আঙ্গিক থেকে প্রথম তিনি নিজেকে সরিয়ে এনে দাঁড় করান বাংলার চিরায়ত বর্ণনাত্মক ভঙ্গিতে। এখানে আঞ্চলিক ভাষার ভঙ্গি এবং নিম্নবর্গের ব্যবহৃত শব্দমালা। এসব শব্দ ও বাক্য ভদ্র মধ্যবিত্তের কানে বড় আড় ঠেকে। আল দীন ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ এর মধ্যে বর্ণনাত্মক ধারায় লিখে ফেলেন কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাত হদাই। তিনি বাঙালি-নাট্যাঙ্গিকের অনুসরণে, কবিতা গান নাচ ও সংলাপের সমন্বয়ে কথকের মাধ্যমে পরিবেশন করেন তার বি-উপনিবেশীকরণের প্রথম কর্মসূচি। অরুণ সেনের মতে, “…সেলিম আল দীন তাঁর নিজের জমিতে প্রতিষ্ঠিত হলেন”। লেবেদেফ পূর্বজদের সাথে বাংলা নাট্যের যে ছেদ ঘটিয়েছিলেন তা সেলিম আল দীন আবার জুড়ে দিলেন।
পাশ্চাত্যের জ্ঞানতাত্ত্বিক ঘুণে পোকা সহজেই উবে যায় না তার প্রমাণও আল দীন রাখলেন তাঁর উল্লেখিত ত্রয়ী নাট্যের গঠন প্রকাশের ক্ষেত্রে। তিনি একে ঘোষণা করলেন, ‘এপিক রিয়েলিজম’ হিসেবে। আধুনিক ও ধ্রুপদী নাট্যের অংশীদার হতে গিয়ে পাশ্চাত্যরীতিতে মহাকাব্যের মাপকাঠিকে ব্যবহার করতে চাইলেন নিজ কাব্যের তত্ত্ববিচারে। অর্থাৎ আল দীনের বি-উপনিবেশীকরণের নিরীক্ষার শুরুটা আধুনিক সাহিত্যতত্ত্বের তুলনামূলক বিচারের অধীনে বিশ্লেষণের দোষে দুষ্ট হলো।
তবে একইভাবে আল দীন আরেকটি তত্ত্ব যা তার সাহিত্যের প্রধানতম ভিত্তি তাকে আমাদের সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরলেন। তিনি কাউন্টার ডিসকোর্স হিসেবে তাঁর নাট্যের তত্ত্বায়নও করলেন নিজেই। তিনি এই তত্ত্বকে বললেন ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদী’। ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদ’ হল সেলিমের শিল্পভুবনের অন্যতম উদ্ভাবন। তিনি বাংলাদেশের ভূমিপুত্রদের সংস্কৃতির কাছে ফিরে গিয়ে দেখেন ধর্মীয় কৃত্যর সাথে শিল্প কৌশল একাঙ্গিত হয়েছে এখানে বিস্তৃত পরিসরে। রবীন্দ্রনাথও বাংলা জাতীয় সাহিত্যের খোঁজে ধর্মকে সম্মিলনের কেন্দ্রে চিহ্নিত করেছেন। সেলিম শ্রী চৈতন্য এবং সুফীবাদী ধর্মদর্শন থেকে দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বকে গ্রহণ করেছেন। এই শিল্পভাবনাকে নিজের রচনার ভেতর থেকে একটি সেক্যুলার চরিত্র নির্ধারণ করেছেন। বৈষ্ণব ধর্ম এবং সূফী মতবাদ অনুযায়ী মানুষ যখন ঈশ্বরের দিকে ধাবিত হয় অথবা ঈশ্বর যখন তাঁর সৃষ্টির সাথে মিলে যায় তখন কিন্তু স্রষ্টা এবং সৃষ্টির ভেতরে আর কোনো ভেদরেখা থাকে না। সৃষ্টি এবং স্রষ্টার এই অভেদাত্মাতক রূপটি দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বের সূত্র বলে পরিচিত। দ্বৈতাদ্বৈতবাদী প্রত্যয়টি শিল্প মতাদর্শ হিসেবে সেলিম প্রথম প্রয়োগ করেন। সেলিমের মতে,
“এই শিল্পতত্ত্বে একের মধ্যে বহু এবং বহুর একের মধ্যে লীন হবার দৃষ্টান্ত রূপে মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্য থেকে প্রভূত দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা যায়। ধরা যাক- পাঁচালি, এ একই সঙ্গে নাট্য, নৃত্য, গীত, কৃত্য, কাহিনী, উপাখ্যান, রাগরাগিনীর বিচিত্র সঞ্চয় তাঁর এক দেহে যেন নিখিলের সমস্ত বৈচিত্র্য এক অবিভাজ্য স্বর্ণ-সঙ্কেতে জ্বলজ্বল করে”।9
সেলিম শিল্পের বহুত্বকে একাঙ্গীকৃত করে একরে ভেতর সাঙ্গিকৃত করেছেন। এক্ষেত্রে সেলিমের অবস্থান খুবই পরিষ্কার,
“আমাদরে নাটক লিখিয়েদের উচিত নাটকের সঙ্গে অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের দ্বৈতাদ্বৈত সম্পর্ক বুঝে নেয়া। “… আঙ্গিকচেতনা সঙ্কীর্ণ হলে এ মাধ্যমে মানুষ ভাস্কর্যের আনন্দ আর সংগীতরে দ্যোতনা পাবেনা”।10
তিনি ১৯ শতকপূর্ব বাংলা সাহিত্যে এ লক্ষণগুলো চিহ্নিত করলেন। উদাহরণ হিসেবে বললেন,
এ একই সঙ্গে নাট্য, নৃত্য, গীত, কৃত্য, কথা, কাহিনী, রাগরাগিণীর বিচিত্র সঞ্চয়, তার এক দেহ যেন নিখিলের সমস্ত বৈচিত্র্য, এক অবিভাজ্য স্বর্ণ-সঙ্কেতে জ্বলজ্বল করে।
তিনি দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যচিন্তার একটি পাটাতন নির্মাণের প্রস্তাব করলেন এবং প্রয়োগ হিসেবে চাকা, যৌবতী কন্যার মন, বনপাংশুল, প্রাচ্য প্রভৃতিকে হাজির করলেন। বি-উপনিবেশীকরণের এ-ধরণের প্রস্তাবনা এখন পর্যন্ত রবীন্দ্র-উত্তর সাহিত্যে আমরা আর-কাউকে হাজির করতে দেখি কী?
মিল, জোন্সদের হাত ধরে জ্ঞানতাত্ত্বিক চিন্তার অধীনে উন্নয়নমূলক-শ্রেণিবিভাজিত-বিবর্তনবাদী-ইউরো-কেন্দ্রিক যে কাঠামো আমরা ম্যাকাওলের শিক্ষা-পরিকল্পনার অধীনে গ্রহণ করেছিলাম তা আজও চর্চা করে যাচ্ছি। এ-ক্ষেত্রে আল দীনের একটি বক্তব্যের দিকে ফিরে তাকাই :
…দেখতে পাই আধুনিক পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান সাধনার পথে শ্রেণীকরণের প্রবল তাগিদ। সেই রুচি শিল্পসম্ভোগের স্পৃহায় নিত্যই উৎপাদন করে চলছে নব নব আঙ্গিক। আমরা সেই নৌকাতে সেই পালেই নিজের নাম লিখে চলেছি। সেই চলাটাকে অসম্মান করতাম না যদি না দেখতাম, নিজেদের গুনটানা বিশাল সাম্পান ডুবিয়ে দিয়ে উল্টা করতালি আদায় করতে চাই। অথচ একথা সাহস করে বলবার সময় এসেছে যে, শ্রেণীকৃত পাশ্চাত্য শিল্পরীতিসমূহ তার পদ্য, গদ্যচেতনা, ছোটগল্প, নাটক, উপন্যাস মাত্র দু’শ কি আড়াইশ বছরে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে এসেছে। আজ সেগুলোর সংজ্ঞা-সীমানা আঁকড়ে ধরে যতইনা শিল্পরচনার প্রয়াস করি, ব্যর্থ হতে বাধ্য।
বিবর্তনবাদী চিন্তাকাঠামো সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে তাঁর মেটান্যারেটিভস-এর জন্য। মেটান্যারেটিভ/মহাবয়ান-এর কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ইউরো-কেন্দ্রিকতা। আল দীন সবসময়ই এই ইউরো-কেন্দ্রিকতাকে অস্বীকার করেছেন। সংস্কৃতির বিশ্বায়নকে তিনি মেনে নেন নি। উন্নয়ন ডিসকোর্স নির্ভর ইউরো-কেন্দ্রিক সভ্যতার বিকাশকে তিনি গ্রহণ করেন নি। এ কারণেই তিনি জ্ঞানের তত্ত্বীয় বি-উপনিবেশীকরণ-এর কর্মসূচি হিশেবে দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বকে হাজির করেছেন। এ বিষয়টি তাঁর বক্তব্যের আলোকেই আমরা বুঝতে পারি, তা হলো :
‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদী’ শিল্পতত্ত্বের ক্ষেত্রে আমি এ কথা নিত্যই মনে রাখছি যে, বিশ্বনন্দনতত্ত্ব বা শিল্পসূত্রের সমকালীন ক্ষেত্রে এমন কোনো সংজ্ঞা সৃষ্টি সম্ভব নয় যা সর্বব্যাপী ও সর্বত্রগামী। এ কথাও সত্য যে, সর্বকালের জন্য প্রযুক্ত, অবশ্য পালনীয় শিল্পসিদ্ধির চূড়ান্ত নিশ্চয়তা দানকারী কোনো শিল্পতত্ত্ব জগৎ-সংসারে নেই। সঙ্গে আরও এক পঙ্ক্তি যুক্ত হলো একথা বলার জন্য যে, শিল্পতত্ত্বের শাখা-মুকুল যতই ঊর্ধ্বগামী হোক, এর মূলটা দেশকাল, ভূগোল ও জনপদেই নিবদ্ধ।
এখানে আরেকটি প্রশ্ন উঠতে পারে যে, মধুসূদন, রবীন্দ্র-অন্তঃপ্রাণ আল দীন দেশকালের সীমা নির্ধারণে সংস্কৃত ধারাকে কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন কী? আমার এ লেখায় আমি শকুন্তলাকে বিষয়ের দিক থেকে বি-উপনিবেশীকরণের প্রক্রিয়া হিসেবে উপস্থাপন করেছি, যা আরো সংশয় তৈরি করতে পারে। পূর্বেই বলেছি, আল দীন উপনিবেশের জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্যকে অস্বীকার করার জন্য একটি লম্বা জার্নি করেছেন। এ জার্নিকে তিনি উল্লেখ করেছে নিম্নরূপভাবে:
আশি-নব্বুইয়ের ঠিক মধ্যভাগে, বাঙলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের আলো অন্ধকারে একদা বেরিয়ে পড়ি। সিদ্ধাচার্যদের কৃত্যগৃহ থেকে নাটুয়াবেশী গোর্খনাথের মাদল-নৃত্য দেখে চলে যাই, জয়দেবের প্রিয় পত্নী পদ্মাবতীর নাট্যের আসরে। বহুদূর যেতে যেতে, শঙ্খ কাঁসর আর ঢোল-করতালের মিলিত ক্রেঙ্কারে খুব একজন অতি গৌরবর্ণ, উদ্দ–নৃত্যে বিভোল কান্তিময়ী পুরুষকে দেখতে পাই। কান্তিময়ী পুরুষ, কেননা তিনি একই সঙ্গে কৃষ্ণাবতার ও রাধারূপিণীও বটেন।
এই কান্তিময়ী পুরুষ চৈতন্যের কাছ থেকে তিনি প্রথম পরিচিত হন ‘অচিন্ত্য দ্বৈতাদ্বৈতবাদ’ তত্ত্বের কৃষ্ণের স্বাঙ্গীকৃত এই নিখিল, বাঙালির শিল্পরীতি ও সংস্কৃতি-চেতনার এক নৈসর্গিক ফসল। আল দীন এ শিল্পতত্ত্বের প্রতিরোধী ও প্রভাব-বলয়কে বর্ণনা করেন ঠিক এভাবে :
বাঙলায় সহস্র বছর ধরে বাইরের বিশেষ কোনো ধর্ম বা ধর্মাচারণ এবং শিল্পতত্ত্ব সহজে প্রবেশাধিকার পায় নি। নাথবাদ কিংবা অচিন্ত্যদ্বৈতাদ্বৈতবাদের প্রবল প্রভাবের কারণে বাইরের শিল্পতত্ত্ব অন্তত ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত আমাদের শিল্পস্বাতন্ত্র্যকে হরণ করতে পারে নি।
এ বক্তব্য থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে জ্ঞানতাত্ত্বিক কেন্দ্রিকতা তৈরি হয়েছে আল দীন তা অস্বীকার করেছেন। বিশ্বকেন্দ্রিকতা ভেঙে দেয়ার সাথে সাথে স্থানীয় আধিপত্যবাদকে রুখে দিয়ে শিল্পের এক বহুত্বের স্বর খুঁজে পেয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের নিজস্ব স্বরকে তিনি বাংলার জল আবহাওয়ায় বেড়ে-ওঠা পালাগান, কবিগান সহ সকল প্রক্রিয়ার ভেতরে খুঁজে পেয়েছেন এবং তাত্ত্বিক কাঠামোকেও চিহ্নিত করেছেন। অনেকে এ তাত্ত্বিক কাঠামোর দুর্বলতা খুঁজে পেতে পারেন। তবে দুর্বলতা খোঁজার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া অনুসরণ জরুরি। এ প্রক্রিয়াগত সমালোচনা শেষ পর্যন্ত বাংলা নাট্যের স্বরকে আরো ভিত্তি প্রদান করবে। কারণ উপনিবেশীকরণ প্রকল্পকে রুখে দিতে চাইলে আজকের উত্তর-ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় কাউন্টার ডিসকোর্স জরুরি। আল দীনের বড় সার্থকতা তিনি বি-উপনিবেশীকরণের কর্মসূচির তাত্ত্বিক কাঠামোকে আমাদের সামনে হাজির করেছেন। একইসাথে সংস্কৃত তত্ত্বের হেজিমনিকেও প্রতিরুদ্ধ করেছেন। আল দীন তাঁর চিন্তাকে হাজির করেন নিম্নরূপভাবে, তা হলো :
আমি বর্তমান এই বিশ্বাসে বদ্ধমূল যে প্রাক-বুদ্ধকাল, চর্যাপদ ও উত্তরকাল থেকে উনিশ শতকের প্রারম্ভ পর্যন্ত বাঙলা গান, নাট্যপালা, উপাখ্যান, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, এমন কি এদেশে প্রচলিত নানা ধর্মদর্শনের মধ্যে একটি পারস্পরিক সাধারণীকৃত নন্দনতাত্ত্বিক ঐক্য অনুধাবন করা যায়। তাতে একথা প্রমাণিত হতে পারে যে, এদেশের প্রাচীন ও মধ্যযুগের নানান শিল্পমাধ্যমে সমাজ-সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীগত শিল্পরুচি ও সৌন্দর্যবিচারের একটি সাধারণ সূত্র ছিল। বাঙালির নন্দনতাত্ত্বিক চিন্তার সূত্রবদ্ধ কোনো গ্রন্থ মেলে না এ যেমন সত্য, তেমনি মেলে না বলেই যে একালেও অনাবিষ্কৃত থাকবে, তা উচিত হয় না। এই আলোচনার রশ্মি ধরে বলা যায়, নানা মাধ্যমে ধর্মতত্ত্ব বা মুক্ত মানব-রসের স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণায় প্রাচীন ও মধ্যযুগে জীবন জগতের যে অলঙ্করণরীতি ও শৈলী তা সংস্কৃত নন্দনতত্ত্বের আশ্রয়ী নয়। কিন্তু সহস্র বছর ধরে গড়ে ওঠা আমাদের শিল্প-সৌন্দর্য বিচাররীতির ক্ষেত্রে উনিশ শতক থেকে সংস্কৃত ও পাশ্চাত্য নন্দনতত্ত্বের প্রভাব হয়ে ওঠে নিরঙ্কুশ। ক্রমে কুড়ি শতকে এসে পাশ্চাত্য প্রভাব অপ্রতিরোধ্য বলেই স্বীকৃত ও চর্চিত হয়ে আসছে। এর ফলে সহস্র বছরের শিল্পকর্মের যে দেশজ ধারাবাহিকতা আমরা দেখি, তার বিচারের ক্ষেত্রে একটি অনপনেয় সঙ্কটের সৃজন হল। সহস্র বছর ধরে যে সব রচনা আমাদের জাতির চিত্তজয়ী বলে কালজয়ী হয়ে উঠেছিল—এ্যারিষ্টটল, হোরেস, লনজাইনসের নন্দনতত্ত্বের বিচারে সেগুলো অকিঞ্চিৎকর ঠেকে। আমাদের পালা নাটকগুলো নাটকই নয়, কাব্য। বিশাল মঙ্গলকাব্য আট দিবস ধরে পরিবেশিত হত, তা নিতান্ত পুচ্ছপল্লবিত রচনা। আমাদের শিল্পরুচির ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে এই মধ্যখ-ন নাটকের কতদূর ক্ষতি করেছে সে বিচারের ভার ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দিলেও মর্মের অন্তরে এক বিষমচ্ছেদের কষ্ট পাই।
আল দীন একে একে কথানাট্যের অধীনে লিখে চলেন চাকা, যৌবতী কন্যার মন, বনপাংশুল, প্রাচ্য, স্বর্ণবোয়াল, হরগজ, নিমজ্জন, ধাবমান। পশ্চিমা রীতিকে নাট্য রচনায়, অভিনয়ে, সময়ের দৈর্ঘ্যে তিনি অস্বীকার করেন সম্পূর্ণভাবে। বনপাংশুল ও প্রাচ্য সাহিত্যে বাংলার পাঁচালিরীতির সফল প্রয়োগ ঘটান। এ পদ্ধতিকে Orature হিসেবে উল্লেখ করেছেন উগান্ডার লেখক পিউ জিরিমি—তার মতে, বি-উপনিবেশীকরণ প্রকল্পের জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতি বিশেষ। Orature মূলত : Orality + literature । আল দীনও একই পথে হেঁটেছেন কিচ্ছা, হাস্তর প্রভৃতি ব্যবহারের মাধ্যমে। এ এক ভিন্ন নাট্যরীতি যা পশ্চিমা নাটক থেকে সম্পূর্ন ভিন্ন। এ রীতি একান্তই বাংলা নাটকের নিজস্ব স্বর।
আল দীনের ‘চাকা’ রচনা থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল রচনাকে আমি নাটক না বলে সাহিত্য বলতে আগ্রহী। এ প্রবন্ধের শুরুতেই আল দীনের বক্তব্যকে আমি যে প্রথম চারটি ভাগে বিভাজিত করেছি, সেই ভাগ গুলিতে দেখতে পাই পশ্চিমা নাট্য রচনার সকল ব্যাকরণিক সীমা ভেঙে ফেলার ইচ্ছা। তিনি শুধুমাত্র ইচ্ছা প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হন নি। তার রচনার দিকে তাকালে দেখতে পাবো গদ্য ও পদ্যের সংমিশ্রণ। গদ্যও রচিত হচ্ছে কাব্যময়তার সকল গুণাগুণ নিয়ে। এক্ষেত্রে যৈবতী কন্যার মন রচনার পরী-পর্ব থেকে খানিকটা পড়া যেতে পারে :
পরীর পায়ের নখে সাদা চন্দনের প্রলেপ। উন্মাদ জমিদার অন্ধকার ঘরে গা শুঁকতে থাকে—হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে—তোমার পায়ের নখে এত চাঁদ কেন? আমি চুমু খাবো পায়ে। শিউরে ওঠে বিন্দু। বিন্দু না পরী।
পাঠকের কাছে চাকা, যৌবতী কন্যার মন, হরগজ, স্বর্ণবোয়ালকে মনে হবে উপন্যাস পড়ছে। অসম্ভব মনে হবে এর মঞ্চে উপস্থাপনকে এবং সম্পূর্ণ রচনাটি মঞ্চে উপস্থাপনে দশ থেকে বার ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। এ-কাজটি রবীন্দ্রনাথকে আমরা করতে দেখি তার নাটক, নৃত্যনাট্য ও শেষ দিকের উপন্যাসের ক্ষেত্রে। তারাশঙ্করকে দেখি ‘কবি’ রচনার মাধ্যমে এ-প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হতে। আল দীন রবীন্দ্রনাথের এ প্রতিরোধী অবস্থাকে একটি তত্ত্বগত এবং প্রায়োগিক রূপদানে সক্ষম হয়েছেন।
রবীন্দ্র-অন্তঃপ্রাণ আল দীন রবীন্দ্রনাথের মতোই আন্তর্জাতিকতাবাদের দিকে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন। স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেও আমরা তার লেখনীকে মহাকাব্যিক প্রয়াসের দিকে এগিয়ে যেতে দেখি। ধর্ম, স্থানীয় মিথ, বিষয়-চরিত্র-সময়ের ব্যাপ্তিতে আল দীন তার প্রয়াসকে অব্যাহত রাখেন।
আল দীনের নাটকের প্রয়োগ নিয়ে কিছু প্রশ্ন প্রায়ই শুনতে পাই। তা হলো, নাটকের পরিবেশন পালা নাট্যের আদলে হলেও তা মধ্যবিত্তের থিয়েটার ফ্যান্টাসির নির্দিষ্ট সময়কে মেনে উপস্থাপিত হয়। এ নাট্যের রচনার ব্যাপ্তি কয়েক দিবসব্যাপী হলেও তা পশ্চিমা প্রসেনিয়ামকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে দেয় না। দৃশ্যের দ্বিমাত্রিক অবস্থানকে ভেঙে বহুমাত্রিক করলেও প্রসেনিয়ামের বাইরের কাঠামোকে সে ভাঙে নি কোথাও। চরিত্রের সংকট আধুনিক মধ্যবিত্তের সংকটকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। কখনও কখনও কালিন্দীর বা পরীর মনোগত দ্বৈততা ছাড়িয়ে যায় তার শ্রেণিকে। চাকা নাটকের গাড়োয়ানের চিন্তায় উঁকি দিয়ে যায় রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অসংগতির আধুনিক মধ্যবিত্তীয় বিশ্লেষণ। গাড়োয়ানকে রাজনৈতিক সচেতনতার পদ্ধতিগত বিশ্লেষকে পরিণত করে—যা বড়ই কানে ঠেকে অনেকের। এক্ষেত্রে আমি বলতে চাই যে, উত্তর-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে পিউরিটান হবার সুযোগ আছে কি-না। সংস্কৃতির মিশ্রণকে আমাদের মেনে নিতে হবে। এর ভেতরকার পশ্চিমা প্রভাবগুলো এবং স্থানীয় সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো চিহ্নিত করতে হবে। স্থানীয় সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর নিজস্ব পরিসর ও উপযোগিতা নির্ধারণ করতে হবে। উপনিবেশকের সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর তুলনায় স্থানীয় সংস্কৃতির ওপর গুরুত্বারোপ অধিক করতে হবে। অর্থাৎ কেবল আলাদা পরিচয় নির্মাণ করলেই চলবে না, বরং হাইব্রিড আইডেনটিটিকে স্বীকার করে নিয়ে প্রাক-ঔপনিবেশিক উপাদানগুলোকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনের পথ নির্মাণ করতে হবে। হোমিভাবা তার হাইব্রিডিটির আলোচনায় এ বিষয়টিকে গুরুত্ব প্রদান করেছেন। এডওয়ার্ড সাইদের মতে, সালমান রুশদি মিডনাইট চিলড্রেনসে এ-কাজটিই করেছেন। আর আল দীন তার কথানাট্যে এ-কাজটি করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে।
৬
জাতীয়তাবাদী চিন্তাই উস্কে দিয়ে থাকে বি-উপনিবেশায়নের কর্মসূচিকে। একটি সাধারণীকৃত আকাঙ্ক্ষাই প্রাক-ঔপনিবেশিক সময়ের ঐক্যের নির্ণায়ক। মানুষ তার সংস্কৃতির একটি পরিচয় নির্ধারণ করে এবং তা তুলে ধরতে চায় সমগ্র মানুষের মাঝে। শুরু হয় জ্ঞানতাত্ত্বিক সংকটের লড়াই। এ সংকট থেকে উত্তরণের কর্মকৌশল নির্ধারণ করার জন্যই সে বি-উপনিবেশীকরণ-প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। ফ্রাঞ্জ ফানো তার The Wretched of the Earth গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায় অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক অধ্যায়—এখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, স্থানীয় বুদ্ধিজীবীটি তার প্রকৃত পরিচয়কে স্মরণ করে এবং তাকে আত্তীকৃত করার প্রচেষ্টাসমূহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। সাইদ, কাবরাল, নগুগিদের কাজেও জাতীয় চরিত্র নিরূপণের কৌশল স্পষ্ট। জাতীয়তাবাদী অবস্থানের সাথে উপনিবেশের বিরোধিতা সম্পৃক্ত। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও আমরা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎসভার বার্ষিক অধিবেশনে পড়া বাংলা জাতীয় সাহিত্য প্রবন্ধে সর্বজাতি জাতীয় সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা এবং কৌশল তুলে ধরতে দেখি। তাহল,
বঙ্গসাহিত্যের উন্নতি ও ব্যপ্তি-সহকারে কেবল যে সমস্ত বাঙালির হৃদয় অন্তরতম যোগে বদ্ধ হইবে তাহা নহে, একসময় ভারতবর্ষের অন্যান্য জাতিকেও বঙ্গসাহিত্য আপন জ্ঞানান্নবিতরণের অতিথিশালায়, আপন ভাবামৃতের অবারিত সদাব্রতে আকর্ষণ করিয়া আনিবে তাহার লক্ষণ এখন হইতেই অল্পে অল্পে পরিস্ফুট হইয়া উঠিতেছে।
বাংলাদেশে বাঙালি ‘জ্ঞানান্নবিতরণে’ কিংবা ‘আপন ভাবামৃতের অবারিত সদাব্রতে’ আকর্ষণ করতে বাঙালির উদ্যমের শেষ নেই; কিন্তু অপরের ভাবমৃতের সন্ধানে বাঙালি ভীষণ নিরুদ্যম। ফলে ‘জাতীয় সাহিত্য’ বলতে কেবলই এক জাতির সাহিত্যের মুখচ্ছদ মনে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ‘জাতীয় সাহিত্যে’ মূলত খুঁজতে চেয়েছেন ‘সম্মিলিত জাতীয় হৃদয়’; জাতীয় সাহিত্যের জন্য সম্মিলন একটি জরুরি কৌশল। ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতায় পরিবর্ধিত লেখকদের অগ্রগতির তিনটি স্তরকে চিহ্নিত করেছেন ফ্রাঞ্জ ফানো।
প্রথম স্তরে দখলদার ইউরোপীয় সংস্কৃতির আত্মস্থীকরণ,
দ্বিতীয় স্তরে জাতীয় আদি সত্তা-অন্বেষণের তাগিদ,
তৃতীয় স্তরে জনগণসম্পৃক্ত জাতীয় সাহিত্য; জাতীয় সাহিত্যকে তিনি মনে করেন লড়াইয়ের সাহিত্য, বিপ্লবী সাহিত্য।
তবে কখনও কখনও এ জাতীয়তাবাদী অবস্থান প্রবলরূপ ধারণ করে থাকে। জাতীয়তাবাদের প্রাবল্য উত্তর-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে অপরাপর জাতিসত্ত্বার জন্য এক নয়া ঔপনিবেশিক শক্তিতে পরিণত হয়। আমরা যদি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্যের দিকে ফিরে তাকাই তবে দেখব প্রবল বাঙালির একটি সাহিত্য নির্মিত হয়েছে যেখানে একটি কল্পিত বাঙালিকে নির্মাণ করে বাংলাদেশ নামক বর্তমান ভুখ-ের একক মালিকানা উদযাপনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আল দীনও কি জাতীয়তাবাদের একই চোড়াগলি পথে হেঁটেছেন নাকি তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবিত পথকে বাস্তবে রূপদানের চেষ্টা করেছেন তা এখন বিবেচনার বিষয়। কারণ করণ প্রকল্প মোটা দাগে দুটো দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে।
১. ঐতিহ্য নির্ভরতা: অর্থাৎ উপনিবেশ পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরে যাবার চেষ্টা করে একটি দোষমুক্ত ভার্জিন প্রক্রিয়াকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা।
২. আধুনিকতাকে প্রশ্নাতিতভাবে নেতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা।
৩. সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের অনুশীলন করা। এবং
৪. নিজেই অপরাপর জাতিসমূহের জন্য একটি নয়া উপনিবেশ স্থাপন করা।
সাইদ, কাবরাল, নগুগিদের কাজেও জাতীয় চরিত্র নিরূপণের কৌশল স্পষ্ট। জাতীয়তাবাদী অবস্থানের সাথে উপনিবেশের বিরোধিতা সম্পৃক্ত। তবে কখনও কখনও এ জাতীয়তাবাদী অবস্থান প্রবলরূপ ধারণ করে থাকে। জাতীয়তাবাদের প্রাবল্য উত্তর-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে অপরাপর জাতিসত্ত্বার জন্য এক নয়া ঔপনিবেশিক শক্তিতে পরিণত হয়। আমি মনে করি আল দীনের নিউ এথনিক-থিয়েটার এবং ফিউশন তত্ত্বের কর্মসূচি অপরাপর জাতিসত্ত্বার জন্য এরকমই একটি হেজিমনিক প্রকল্প।
হেজিমনি২২ প্রত্যয়টি আন্তনিও গ্রামশির কাছ থেকে নেয়া। গ্রামশি হেজিমনির সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে যে, একটি সমাজ-গোষ্ঠী নানাভাবেই সংগ্রাম করতে পারে। যার মধ্যে আদর্শগত সংগ্রামও থাকতে পারে। এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর মন জয় করে তাদের চিন্তায় ও চর্চায় প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে। এ-ধরনের ক্ষমতাকে গ্রামশি বলেন হেজিমনি। হেজিমনি কখনও চিরস্থায়ী নয় এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ অথবা সমাজস্থ শ্রেণি-মডেলের কাছে হেজিমনি হ্রাস পায় না। গ্রামশি গুরুত্ব দিয়েছেন সেই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটির ওপর যার মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণি কেবল শাসনতন্ত্রের মাধ্যমেই প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে না, বরং সৃষ্টি করে এক সার্বিক কর্তৃত্ব বা হেজিমনি। কেবল রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব অবলম্বন করে এই সার্বিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের জগতে এক আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে হেজিমনিক নেতা তার শাসনের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে সাবলটার্ন (গ্রামশি এ শব্দটি ব্যবহার করেছেন সকল নিম্নবর্গীয় মানুষের ক্ষেত্রে) শ্রেণির কাছ থেকে সামাজিক সম্মতিও আদায় করে নেয়। গ্রামশির বিশ্লেষণে তাই গুরুত্ব পায় রাষ্ট্রের সঙ্গে বৃহত্তর নাগরিক সমাজের সম্পর্ক, জাতি, জনগণ, বুর্জোয়াশ্রেণি ও অন্যান্য শাসক-শ্রেণির পারস্পারিক সম্পর্ক এবং বুর্জোয়াশ্রেণির সার্বিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার ইত্যাকার প্রশ্নসমূহ।
কোনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা অর্থনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে হেজিমনি প্রয়োগ করতে পারে না। হেজিমনিক নেতৃত্ব উন্নয়নশীল, বুদ্ধিবৃত্তিক, দার্শনিক এবং নৈতিক কর্মকা-ের সাথে জড়িত। এটা আবেগের ব্যাপ্তির সঙ্গে জড়িত। তাই সকল মানুষ সম্পর্কে হেজিমনিক নেতাদের সম্যক জ্ঞান থাকতে হয়। আল দীনকে আমি এই সুশীল সমাজের একজন প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে আগ্রহী।
সুশীল সমাজ হচ্ছে সমাজ-কাঠামোর মধ্যে অবস্থিত অন্যান্য সংগঠন যা অর্থনীতির উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত নয়। আবার রাষ্ট্রীয় কোনো বিভাগের সাথেও যুক্ত নয়। এই সমাজের এককগুলো হচ্ছেধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যোগাযোগের মাধ্যম, সিনেমা, নাটক ইত্যাদি। গ্রামশির হেজিমনির আলোচনার সাথে সুশীল সমাজ নানাভাবে জড়িত। হেজিমনি বোঝার জন্য তাই সুশীল সমাজের ভূমিকা ও উদ্দেশ্য বোঝা খুবই জরুরি। গ্রামশি নাগরিক সমাজকে ‘আন্তর্জাতিক জৈবিক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, নাগরিক সমাজ হচ্ছে হেজিমনিক নেতৃত্বের পরিসর। গ্রামশি হেজিমোনির ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র এবং সুশীল সমাজকে আলাদা করেছেন। প্রতিরক্ষা ক্ষমতার উৎস হচ্ছে রাষ্ট্র। আর সুশীল সমাজ হেজিমনিক নেতৃত্ব নিয়ে কাজ করে। হেজিমনিক নেতৃত্ব শিক্ষা, সিনেমা, প্রচার, প্রকাশনা, সংবাদপত্র, ব্রডকাস্টিং ইত্যাদির মাধ্যমে কর্তৃত্ব করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে এডগার রাইস বারোজ-এর ‘টারজান’ উপন্যাসের কথা। এখানে দেখানো হয়েছে আফ্রিকার জঙ্গলের ‘কালো’ ভূমিপুত্ররা দীর্ঘদিন অরণ্যে বসবাসের পরও অরণ্যের হিংস্র পশু-পাখিদের ওপর তাদের কর্তৃত্ব অর্জিত হয় না। অথচ এক সাদা চামড়ার টারজান এখানে কর্তৃত্ব স্থাপনে সমর্থ হয়। অর্থাৎ সাদাদেরকে চিত্রিত করা হচ্ছে বুদ্ধিদীপ্ত, নেতৃত্বগুণের অধিকারী, শাসকশ্রেণি প্রভৃতি গুণাবলীর প্রতিরূপ হিসেবে। লেখক একই সাথে প্রচ- রেসিস্ট হয়ে ওঠেন এভাবে যে, যে শাদা চেহারার টারজান কখনও সাদা মানুষ দেখে নি এবং যার অভিজ্ঞতায় কালো নারী ছাড়া আর কেউ নেই, সেই সাদা টারজান আফ্রিকার কালো নারীর প্রতি কোনো-ধরণের প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে না। এই টারজানকে জেনি নাম্নী এক সাদা অর্থাৎ সুন্দর, সুবেশা, রুচিশীল, ললনার জন্য অপেক্ষা করিয়ে রাখেন লেখক এবং দেখা হওয়ার সাথে সাথে দু’জনার মধ্যে প্রেম উৎপাদিত হয়। কোনো সাদা চামড়ার নারীকেই কোনো কালো চামড়ার পুরুষের প্রেমে আমরা পড়তে দেখি না। বহুল আলোচিত এবং প্রচারিত এ-উপন্যাসটি আমাদের ফ্যান্টাসির জগতে ডুবিয়ে রেখে কতগুলো শিক্ষা দিয়ে থাকে। অর্থাৎ সাদার সাথে সারসত্তাগতভাবে যুক্ত নেতৃত্ব, ক্ষমতা, প্রশাসক, বীরত্ব, সৌন্দর্য, রুচিশীলতা প্রভৃতি গুণাবলী। কালোদের থেকে তারা সকল বিষয়েই উন্নততর।
আল দীনকে আমি বাংলা নাটকের একজন নেতৃত্বদানকারী এবং নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করতে আগ্রহী। যিনি বাংলা নাটককে নিজের পায়ে চলতে শিখিয়েছেন।
উপনিবেশ-উত্তর জাতি-রাষ্ট্রসমূহে গণতান্ত্রিক চিন্তার একটি নিপীড়নমূলক বিষয় হিসেবে ‘সংখ্যাগুরু’ ও ‘সংখ্যালঘু’ জাতির বিভাজন দেখতে পাই। পারিসংখ্যানিক পদ্ধতিতে মানুষ শতকরা হিসেবের অধীনে এসে লুট হয়ে যেতে দেখে তাদের সকল অধিকার। বাংলাদেশও এ-অভিজ্ঞতার বাইরে নয়। আল দীন এরকম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ‘সংখ্যালঘু’ অর্থে ‘প্রান্তিক’ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে নিয়ে ‘নিউ এথনিক থিয়েটার’ উন্নয়ন-প্রকল্প শুরু করেছিলেন।
এধরণের জাতি-রাষ্ট্রে গ্রামশির সুশীল শ্রেণিকর্তৃক হেজিমনিক পরিস্থিতির প্রকট আকার পেতে দেখা যায়। বিশ্বের প্রায় সর্বত্র আমরা আবিষ্কার করি, প্রত্যক্ষ শাসনমুক্ত হওয়া প্রতিটি রাষ্ট্রই মূলত জাতি-রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রসমূহ অবশ্যই অ-পশ্চিমা অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত। এই ধারাবাহিকতায় ভারতবর্ষেও আমরা ধর্মনির্ভর দ্বি-জাতিতত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে ১৯৪৭ সনে দুটো রাষ্ট্র পাই। ধর্মনির্ভর জাতীয়তাবাদ সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। এ-অভিজ্ঞতা আমরা পাকিস্তান ও ভারত জুড়ে দেখতে পাই। বড় সংকটের সম্মুখীন হয় মুসলিম জাতীয়তাবাদের অধীনে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র—পাকিস্তান। সাংস্কৃতিক সংকট হয়ে ওঠে প্রকট। ভাষাকে কেন্দ্র করে সংকটটি চরম আকার ধারণ করে যা ভাষা-কেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের অধীনে এক নতুন জাতীয়তাবাদের চেহারায় রূপ লাভ করে। অতঃপর ১৯৭১-এ জন্ম নেয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঝা-া নিয়ে নতুন জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এই নয়া রাষ্ট্র ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে সংখ্যাগুরু বাঙালি জাতি পূর্বে ঠিক যে প্রক্রিয়ায় শোষিত হয়েছিল, ঠিক সেই একই পদ্ধতিতে জ্ঞানতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার চরম প্রকাশ দেখায় (এবং দেখিয়ে চলেছে) যা আমরা আবিষ্কার করি ১৯৭২-এর প্রথম প্রস্তাবিত সংবিধানের ৪নং অনুচ্ছেদে :
এ রাষ্ট্রের সকলে বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবে
তৎকালীন সময়ে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এই অনুচ্ছেদটি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। ১৯৭২ সালের গণপরিষদ বিতর্কের এক পর্যায়ে তিনি বলেন,
…আমি যে অঞ্চল থেকে এসেছি, সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় বাঙালিদের সঙ্গে আমরা লেখাপড়া শিখে আসছি। বাংলাদেশের সঙ্গে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের কোটি কোটি জনগণের সঙ্গে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সবদিক দিয়েই আমরা একসঙ্গে একযোগে বসবাস করে আসছি। কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা, চৌদ্দপুরুষ কেউ বলেন নাই, আমি বাঙালি।
…আমাদিগকে বাঙালি জাতি বলে কখনও বলা হয় নাই। আমরা কোনোদিনই নিজেদেরকে বাঙালি মনে করি নাই। আজ যদি এই স্বাধীন-বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য এই সংশোধনী পাস হয়ে যায়, তাহলে আমাদের এই চাকমা জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আমাদেরকে বাংলাদেশী বলে মনে করি এবং বিশ্বাস করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়।
এখানে উল্লেখ্য যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের অধীনে বর্তমান বাংলাদেশে যে প্রান্তিক জাতিসমূহ যেমন, চাকমা, কোচ, মান্দাই, সাঁওতাল প্রভৃতি আছে—একসময় তাদের সার্বভৌম রাজ্যের কথা প্রত্ন-ইতিহাস চর্চায় পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: ত্রিপুরা রাজ্য, চাকমা রাজ্য, জয়ন্তীয়া রাজ্য।
এ আলোচনার সূত্রপাত এ-কারণেই যে, আল দীন ঠিক যখন থেকে কথানাট্যের দিকে গমন করেছেন তখন থেকেই অনুষঙ্গ এবং কখনও কখনও মূল বিষয় হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতিসত্তা অস্তিত্বশীল হয়েছে তার রচনায়। আমার আলোচনায় আল দীন যেহেতু সাব্জেক্ট এবং তার সময় ও স্থান বাংলাদেশ এবং পরিচয়ে ‘সংখ্যাগুরু’ জাতিসত্তা হিসেবে তখন খোদ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অপরাপর জাতিসত্তার অবস্থানটিকে স্পষ্ট করার নিমিত্তে ওপরের বিষয়টির অবতারণা। এ-বিষয়টি জাতীয়তাবাদের প্রবল রূপটির সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে সাহায্য করে।
আল দীনকে দেখতে পাই বি-উপনিবেশীকরণের কর্মকৌশল প্রণয়ণ করতে এবং পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশের অপরাপর জাতিসত্ত্বাকে নিয়ে সমানভাবে ভেবে চলেছেন তাঁর নাট্যপ্রয়াসে। একারণেই বাংলাদেশ নামক জাতি-রাষ্ট্রে বাঙালি জাতিসত্তা ব্যতীত অপরাপর জাতিসত্তার পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করা জরুরি বিধায় এ-বিষয়সমূহের অবতারণা।
ঔপনিবেশিক রাজনীতির সবচেয়ে কার্যকরী কৌশল হলো একটা গোষ্ঠী বা জাতিকে এই ধারণায় প্রভাবিত করা যে তারা ইতিহাসহীন এবং সংস্কৃতিহীন। অথবা অন্তত এটুকু প্রমাণ করা যে, যদিওবা ইতিহাস বা সংস্কৃতি থেকে থাকে, তা বর্বর, অর্থহীন, পশ্চাৎপদ এবং অনুপযোগী। রেহনুমা আহমেদ ও মানস চৌধুরী বাঙালি আধিপত্যের পক্ষে উপর্যুক্ত পথেই যুক্তিমালা দেখিয়েছেন যে, বাঙালি জাতি এই অঞ্চলের সর্বাপেক্ষা ‘অগ্রসর’ জাতি। ফলে, ঈঙ্গিত করা হয়, অন্যান্য জাতির জন্য ‘শিক্ষাদানকারী’র ভূমিকায় বাঙালির অংশগ্রহণ সঙ্গত। এই যুক্তিমালাতে অপর জাতিসমূহ হচ্ছে পশ্চাৎপদ, ইউরোপ আবিষ্কৃত ‘অসভ্যে’র মতো। এর প্রধান প্রমাণ পাওয়া যায় সরকারি পাঠ্যবইয়ে প্রান্তিক জাতিসমূহের বিবরণীতে। বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মীদের একটা সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে অন্য জাতিকে পশ্চাৎপদ ভাবা। এটা হল অপরাপর জাতি সম্বন্ধে একটি ‘স্টেরিওটাইপ রেপ্রিজেন্টেশন’। অর্থাৎ ‘অপর’ হিসেবে নির্মাণ।
ঔপনিবেশিক কাঠামোতে অর্জিত জ্ঞানের চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে বি-উপনিবেশীকরণ প্রকল্পের জাতীয়তাবাদী স্বয়ংক্রিয়তায় আল দীন আবার ঢুকে পড়েন উপনিবেশের সহায়ক নৃ-বিজ্ঞানীদের কাতারে—তার ‘নিউ-এথনিক থিয়েটার’ নিয়ে। যে পশ্চিমা আধিপত্যকে প্রতিরোধ করতে চান তিনি বর্ণনাত্মক নাট্যরীতির মাধ্যমে, ঠিক উপনিবেশের জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসনের সহযোগী হিসেবে তাকে আবিষ্কার করি উত্তর-ঔপনিবেশিক জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশে।
আল দীন প্রথমে গবেষণাগার নাট্য, পরে এথনিক-থিয়েটার এবং অবশেষে নিউ এথনিক-থিয়েটার নামে একটি বাঙলা নাট্যপ্রয়াস তৈরি করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি একাঙ্গীকরণ তত্ত্ব বা ফিউশন তত্ত্বকে তার শেষ তাত্ত্বিক কাঠামো হিসেবে জুড়ে দিয়েছেন। নিউ এথনিক থিয়েটারকে তিনি দেখছেন একটি ফিউশন হিসেবে। এক্ষেত্রে তিনি ফিউশন তত্ত্বকে নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। এখানে তিনি সাহিত্য, গান, মিউজিক, চিত্রকলা তথা শিল্পকলার সকল মাধ্যমে যে-সকল ফিউশন ঘটেছে তার একটি দীর্ঘ বর্ণনাতালিকা দিয়েছেন। আমি ফিউশন তত্ত্ব ও নিউ এথনিক-থিয়েটারকে একই কাতারে রেখে বুঝতে আগ্রহী। যদিও আল দীন বাংলার সাথে সংস্কৃত নাটকের ফিউশনের উল্লেখসহ শিল্পকলার সকল ধারার ফিউশনের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি এ ফিউশনকে একটি অরাজনৈতিক এবং দূষণবিহীন প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এখানে ফিউশন যেন নন্দন-বোধের এবং সৃষ্টি-নেশার একটি অনিবার্য ফলাফল হিসেবে আল দীন দেখছেন। এখানে কোথাও তিনি ক্ষমতার রাজনীতিকে চিহ্নিত করেন নি।
এই ফিউশন তত্ত্বে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে একটি সংস্কৃতির ধারা আরেকটি সংস্কৃতির সাথে মিলিত হয়। এ-সম্মিলনের মিলিত প্রয়াসে অবিস্মরণীয় সকল শিল্পকর্মের দেখা মানুষ পেয়েছে। একটি সংস্কৃতি অন্য একটি সংস্কৃতির সাথে সম্মিলনের কথা আমরা জানতে পারি আল দীনের উল্লেখ করার অনেক পূর্বেই। আমাদের, বিশেষ করে চিত্রকলা, কবিতা, গান, মিউজিক, স্থাপত্যে ইন্দো-ইউরোপীয়ান এবং অন্যান্য প্রভাবের কথা জানি। এ-বিষয় নিয়ে বিস্তর লেখালেখি গত একশতক ধরে পারসি ব্রাউন, ফার্গুসন, আহমেদ হাসান দানী প্রমুখ অতীত-অন্বেষণ-প্রিয় পণ্ডিতদের কাছ থেকে অনেক আগেই জানতে পারি। আল দীন এ-বিষয়টিকে আবার তুলে এনেছেন। কিন্তু তিনি কতগুলো বিষয়ের সম্পর্কে খোলাসা করে কিছুই বলেন নি। যেমন, সংস্কৃতি কি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্মিলিত হতে পারে? একটি সংস্কৃতি বা শিল্পকৌশল কীভাবে ব্যাপৃত হয়? যখন সম্মিলন ঘটে তখন কোনো ক্ষমতার সম্পর্ক বিরাজিত থাকে কি? কোন কোন বৈশিষ্ট্যগুলো সম্মিলনের কারণে লুপ্ত হয়ে যায়? এই একাঙ্গীকরণ কি দুটো সমক্ষমতার সংস্কৃতির মধ্যে ঘটে থাকে? সাহিত্যে একাঙ্গীকরণ ঘটলে কোন ভাষা-কাঠামোটি এখানে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হবে? অধিপতিশীল ভাষার কর্তৃত্ব অপর ভাষার স্বরকে কীভাবে রক্ষা করবে? ইত্যাদি ইত্যাদি।
ফিউশন/একাঙ্গীকরণ তত্ত্বের অপরিহার্য অংশ হিসেবে আমি ব্যাপনকে (Diffusion) এখানে উল্লেখ করতে চাই। ব্যাপন হলো একটি প্রভাবশালী সংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য যা পরিপার্শ্বে ছড়িয়ে পড়ে অপরাপর দুর্বল সংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্মিলন ঘটিয়ে প্রভাবশালী বিষয়ের পরিচয় অক্ষুণ্ন রেখে একটি নতুন মাত্রা দেয়। এ তত্ত্বটিকে ব্যাপ্তিবাদ বা Diffusionism হিসেবে ভিক্টোরিয়ান নৃতাত্ত্বিক স্কুল সংস্কৃতির উন্নয়ন ডিসকোর্সের অধীনে ব্যবহার করে আসছে। এখানে একীভূতকরণের ক্ষেত্রে একটি ডোনার এজেন্সি এবং একটি বা একাধিক রিসিভার এজেন্সি সক্রিয় থাকবে।
এখানে প্রশ্ন হলো কে দাতা/ডোনারে পরিণত হবে এবং কেইবা গ্রহীতা/রিসিভারে পরিণত হবে? উন্নয়ন ডিসকোর্সের অধীনে এটা সংস্কৃতি-বিশ্লেষণে নিশ্চিত হয়েছে যে, উন্নততর সংস্কৃতি দাতায় পরিণত হবে এবং গ্রহীতা তুলনামূলক নিম্নতর সংস্কৃতির হবে। আল দীন তার লেখায় মিশরের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। গ্রিকরা মিশরের সংস্কৃতি দ্বারা ডিফিউস হয়েছিল। যদিও ইউরোপীয় সংস্কৃতি তা প্রথমদিকে মেনে নিতে চায় নি। ব্যাপ্তির পূর্বশর্তই ফিউশন।
ডিউফিউশন তত্ত্ব নৃতত্ত্বে ব্যবহৃত হয়েছে ভিক্টোরিয়ান স্কুলের হাত ধরে। এ তত্ত্বটিকে ব্যবহার করা হয়েছে একটি দুর্বল, পিছিয়ে-পড়া, অসভ্য, বর্বর, আদিম সংস্কৃতিকে একটি উন্নততর সংস্কৃতির সহযোগিতায় মুক্তির কৌশল হিসেবে।
আল দীন কি তবে এথনিক-থিয়েটারের রূপকল্পের অধীনে নিউ এথনিক-থিয়েটারের মাধ্যমে অপরাপর জাতিসত্তার সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে উন্নততর করার প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন? পশ্চিমা জেমস মিল, জোন্স, ফার্গুসন, লেবেদেফ প্রমুখরা যেভাবে ভারতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, নাটকের উন্নয়নকল্পে এবং আধুনিক করার প্রকল্প সরকারি তত্ত্বাবধানে করেছিল, ঠিক সেভাবেই কি আল দীন অপরাপর জাতিসত্তাকে নিউ এথনিক-থিয়েটারের মাধ্যমে হেজিমনাইজড করছেন না?
আল দীন তার গবেষণাগার নাট্য ‘একটি মারমা রূপকথা’ গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন এ নাট্যের শুরুটা কৃত্যের আদলে করেছেন। মূল ‘মনরি মাংৎসুমুই’র পালায় এটা ছিল না। এ পালায় ধীর লয়ের পাঙ্খু সুর বিদ্যমান ছিল। মারমা সম্প্রদায় তার ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে এ পর্বটি দীর্ঘদিন ধরে উদযাপন করে আসছে। এ পালা তাদের মনোজগতের নান্দনিক প্রয়োজন মিটিয়ে আসছে বহুদিন ধরে। আল দীন কৃত্যের পাশাপাশি এ নাট্যে হারমনিয়াম, সুরে বাংলা গানের কথা, দুটো মারমা গানে বসন্তবাহার ও ভীম-পলশ্রী রাগের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন। নাট্যের মূল নামটিকে পাল্টে বাঙালি করেছেন। একইভাবে আমরা যদি চোখ রাখি বনপাংশুলের পাতায় পাতায়, তাহলে দেখবো কথামুখ/ভূমিকাতেই তিনি উল্লেখ করেছেন, কথানাট্যের শুরুতে, সংস্কৃত কথাসরিৎসাগরের গল্প-বিভাজন থেকে মঙ্গলাচরণ বা উমাপতি বন্দনার ধাঁচ এবং লম্বক তরঙ্গ প্রভৃতি পরিভাষা গৃহীত হয়েছে। প্রশ্ন হল, এগুলোতো বাঙালির ভাষা বা রীতিএটা কী করে মান্দাই জাতিসত্তার নিজস্ব উপস্থাপন রীতিতে পরিণত হবে?
তবে ‘একটি মারমা রূপকথা’ নাট্যের ভূমিকায় আল দীন স্বীকার করেছেন যে, বাঙালি দর্শকদের মুখে রোচে সেভাবেই তৈরি করেছেন। এর মাধ্যমে মিউজিয়ামে যেভাবে কাঁচের ছোট ছোট ঘরে আদিবাসি বর্বর সংস্কৃতির জীবন-যাপনের রেপ্রিজেন্টেশনাল রাজনীতি ঘটেছে, এই নাট্যেও ‘চিড়িয়া’ হিসেবে মারমা জাতিসত্তার রেপ্রিজেন্টেশন আমরা দেখতে পাই। দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহ্যিকভাবে যে সংস্কৃতির উদযাপন তাকে আল দীন বিভিন্ন ’বাঙালিপনা‘র অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালি ভোক্তার উপযোগী করে রেপ্রিজেন্ট করেছেন। বাংলা নাটকে বর্তমানে পশ্চিমা ধারার হিপহপ যুক্ত করে ইংরেজি ভাষায় আজকের ডায়াসপোরা জেনারেশন যদি নিউইয়র্কে বাংলা নাটককে রেপ্রিজেন্ট করে তবে এটাকে অপসংস্কৃতি/সাংস্কৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখানে প্রশ্ন হলো, একটি মারমা রূপকথা নামক নাট্যে এটা কি বাঙালি আল দীনের মারমা উৎসবকে হেজিমনাইডকরণ নয়?
নিউ এথনিক থিয়েটারে বাংলা হচ্ছে, এথনিক মানুষের সংস্কৃতিকে প্রচারের দায়িত্ব নিচ্ছে। এখানে রোল্যান্ড বার্থ বা জ্যাক দেরিদা ট্রানস্ল্যাশন নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন এবং বক্তব্য বদল হয়ে যাওয়ার দোষে দুষ্টতার কথা বলেছেন সেই একই দোষটি কি আল দীন করছেন না? ভাষা, বিশেষ করে শব্দকে যদি সেমিওটিকস হিসেবে বিশ্লেষণ করি তবে তার সারসত্তাগত বিশ্লেষণকে কীভাবে দেখবো? মনরি মাংৎসুমুই শব্দদ্বয় মারমা জনগোষ্ঠীর কাছে যে দ্যোতনা তৈরি করে তা বাংলায় মারমা রূপকথা শব্দদ্বয় একই দ্যোতনা তৈরি করতে পারবে কি?
আল দীনের শেষ সময়ের কাজ ‘উষাউৎসব’ আরেকটি মান্দি জাতিসত্তার মিথ। এ-মিথটি মানব-বিবর্তনকে কেন্দ্র করে মান্দি জাতিগোষ্ঠির একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক অবস্থান। রবীন্দ্র-প্রেমী আল দীন রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত নৃত্যনাট্যের ধারাকে সমুজ্জ্বল রাখার তাগাদা থেকে এ প্রয়াসটি নিয়েছেন। যদিও তিনি তার রচনাসমূহকে কোনো শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী নন। তবে শেষ বেলার দুটো রচনা : উষাউৎসব ও স্বপ্নরমণীগণ-কে তিনি ইউরোপীয় অপেরা ও ব্যালের সংমিশ্রণে অপেরা হাউজগুলোতে যে প্রযোজনা হয়, তাকে অনুসরণ করেছেন। এ উৎসাহ তাকে যুগিয়েছে রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা নৃত্য-নাট্যটি। এ উষাউৎসবে আমরা অবাক হয়ে লক্ষ করি তিনি মান্দি জাতিসত্তাকে গারো পরিচয়ে উপস্থাপন করছেন। একইভাবে কিত্তনখোলা রচনায়ও গারো পরিচয়টি ব্যবহার করেছেন। মান্দি সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে গারো নামের পরিচয়টি তাদের গা থেকে খশিয়ে মূল পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার লড়াইয়ে লিপ্ত। সেক্যুলার ব্রিটিশ উপনিবেশ-এর অন্যতম প্রকল্প মিশনারি স্থাপন। এ-মিশনারিই বিভিন্নভাবে এদের সাংসারিক ধর্মকে লুপ্ত করে খ্রিষ্টানে পরিণত করেছে এবং পরিচয়টি পর্যন্ত নাই করে দিয়েছিল। তাদের যে বাৎসরিক উৎসব ‘ওয়ান্না’ তা চার্চের অধীনে ‘ওয়ানগালা’ উৎসব হিসেবে খ্রিষ্টীয় ভঙ্গিতে উদযাপিত হয়। গত বেশ কয়েকটি বছর ধরে মান্দি জনগোষ্ঠী আবারও চার্চের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এসে ‘ওয়ান্না’ উৎসব করছে। ঠিক এরকম একটি প্রতিরোধী অবস্থায় আল দীন এবং নাট্যতত্ত্ব বিভাগের গবেষক অধ্যাপক লুৎফর রহমান মান্দি জনগোষ্ঠীকে গারো হিসেবে উপস্থাপন করছেন। এ ধরনের পরিচয় নির্মাণ কি হেজিমনিক নয়?
অপরাপর জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক সংযুক্তি কিছু ঘটেছে কি না এ-ধরণের এথনিক থিয়েটারের ফিউশনের মাধ্যমে—তা প্রশ্নসাপেক্ষ হলেও বাংলা ভাষার বিরাট উপকার হয়েছে। আল দীন এ-ধরণের জাতিসত্তার বহু শব্দ বাংলা ভাষায় প্রচলনের চেষ্টা করেছেন। উদাহরণ হিসেবে : সুসেমি, চিদুয়াল, আৎছু, মাহারি, গিচ্চাক প্রভৃতি। ইংরেজি যেমন বিভিন্ন সংস্কৃতির ভাষায় হৃষ্টপুষ্ট। আল দীন বাংলাকেও একই প্রক্রিয়ার অধীন করেছেন।
আল দীনের এথনিক থিয়েটার হেজিমনি নিয়ে ভাবনাকে যখন উপরোল্লিখিত পদ্ধতিতে আমার ভেতর প্রশ্নের বাণ তৈরি করেছে, ঠিক তখনই আমি তার বিশ্বমানবতাবাদী প্রয়াস নিমজ্জন রচনায় ফিরে যাই। নিমজ্জনের বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বলিভিয়ার যুদ্ধ, কসোভার গণহত্যা, আফ্রিকার সংঘাতসহ সকল মানবতাবিরোধী অবস্থানকে খুঁজে পাই। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বাঙালি সাম্রাজ্যবাদী জাতি-রাষ্ট্রে অপরাপর জাতিসত্তার গণহত্যার উদযাপনকে বিরোধিতা করার জন্য আল দীনকে খুঁজে পাই না। ইকোপার্ক বিরোধী এ-সকল মানুষের সংগ্রামকে এবং ভূমির অধিকারের জন্য লড়াইয়ের চিত্র অনুপস্থিত। ওপরে উল্লিখিত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার অস্তিত্বের প্রাতিষ্ঠানিক সংকট ছুঁয়ে যেতে দেখি না আল দীনকে। আলফ্রেড সরেন, চলেশ রিছিলদের রাষ্ট্রীয় খুনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে দেখি না। এরা তখন আল দীনের বিশ্বমানবতাবাদী প্রকল্পের বাইরে অবস্থান করেন। অথচ আল দীনের বি-উপনিবেশায়নের কর্মসূচি যেখান থেকে শুরু করেন, সেই কিত্তনখোলা রচনা থেকে বিভিন্ন জাতিসত্তার উপস্থিতি তার একাধিক রচনায় দেখতে পাই।
সংখ্যায় লঘু জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন জাতি-নাম থাকার পরেও সাম্রাজ্যবাদী নৃতাত্ত্বিকগন জাতিগত ভিন্নতাকে সংখ্যার ভিত্তিতে পরিমাপের মাধ্যমে একটি একক পরিচয় নির্মাণ করেছে : ট্রাইব বা উপজাতি। এরা আবার বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গবেষণার গবেষিত বস্তু হিসেবে আদিম, অসভ্য, বর্বর, আর্দশ বর্বর, ইন্ডিজেনাস ইত্যাকার পরিচয়ে একটি সমগ্রক হিসেবে পরিচিত হয়েছে। এসব পরিচয়ের ভিড়ে হারিয়েছে নিজেদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। জ্ঞানতাত্ত্বিক হেজিমনি এমন একটি রূপ দিয়েছে যে, আমাদের বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতিসত্তা আজ নিজেই ‘উপজাতি’ শব্দবন্ধনীটি বিভিন্ন দাবি আদায়ের এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের জন্য গঠিত সংঘঠনের নামের প্রথমেই জুড়ে দিয়েছে।
‘উপজাতি’—যার সারসত্তা হলো পিছিয়ে পড়া, অ-আধুনিক, আদিম, বন্য, আদর্শ বর্বর, অশিক্ষিত, অনুন্নত—প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে একটি নিপীড়নের শব্দবন্ধনী হিসেবে পরিচিত। সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে প্রত্যেকটি জাতি একটি থেকে অন্যটি স্বতন্ত্র। এদের নিপীড়ন করার জন্য একটি সমগ্রক হিসেবে দেখা হয়। যখন সমগ্রক হিসেবে চিহ্নিত করা হবে তখন মানুষ বস্তুর রূপলাভ করে একটি সমরূপী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। এথনিক-থিয়েটার বা নিউ এথনিক থিয়েটার বলার মধ্য থেকে উল্লিখিত নিপীড়নগুলো অপরাপর জাতিসত্তার ওপর করা হয়। আমার প্রশ্ন হলো, বিশ্বনাটকে বাংলা থিয়েটার কি এথনিক-থিয়েটার হিসেবে পরিচিত। ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে যা একটি বহুজাতিক দেশ সেখানে বাংলা থিয়েটার কী এথনিক-থিয়েটার হবে এবং আল দীনের কথানাট্য কী নিউ এথনিক থিয়েটার হিসেবে পরিচিতি পাবে? এখানে প্রশ্ন হলো, কেন পাবে না? অর্থাৎ ক্ষমতার সম্পর্ক এবং দেখার ভঙ্গিটি কি হেজিমনিক নয়?
বিশ্বনাট্য-ইতিহাসে এথনিক থিয়েটারের শুরুর অতীত ধোঁয়াছন্ন। তবে এথনিক থিয়েটারকে ওল্ড ওয়ার্ল্ড ইন্সিটিটিউট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ অর্থে মধ্যযুগের বাঙলা নাট্যের ধারাও পুরাতন এথনিক থিয়েটারের অন্তর্গত হয়ে পড়ে। ১৮৪৯ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে অভিবাসিত জার্মানদের দ্বারা প্রথম আমরা এথনিক থিয়েটার নামে দ্বিতীয় পর্যায়ের রিপার্টোরি থিয়েটার হিসেবে নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখি। ১৯২০ সাল পর্যন্ত একাধিক কোম্পানির প্রযোজনায় এথনিক থিয়েটার কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। এরপর ১৯৬০-’৭০ পর্যন্ত আফ্রো-এমেরিকান থিয়েটার, হিস্পানি থিয়েটার প্রভৃতি নামে বিভিন্ন অভিবাসিত জনগোষ্ঠী দ্বারা এথনিক থিয়েটারের শব্দবন্ধনী থেকে বেরিয়ে এসে থিয়েটার পরিচালনা করে। তবে বিশেষায়িত এসব থিয়েটার অর্থনৈতিক মন্দা এবং সাংস্কৃতিক হাইব্রিডিটির তোড়ে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে মূলধারার অ্যামেরিকার থিয়েটারের সাথে মিশে গিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতির একটি ডায়াসপোরিক ভার্সান নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ এক ভিন্ন সাম্রাজ্যবাদ। সর্বৈব হরণের ভ্যাম্পায়ারিক কৌশল। এটাকে ফিউজ বলা যেতে পারে।
৫
এথনিক-থিয়েটারকে যখন আমরা সমগ্রকের শব্দবন্ধনী থেকে মুক্ত হয়ে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে পরিচিত, আল দীনকে তখন এ ধরনের শব্দবন্ধনীর নয়া ভার্সান তৈরির নন্দনতাত্ত্বিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে যুক্ত হতে দেখি। এর আবার তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রদান করতে দেখি ফিউশন তত্ত্বের মাধ্যমে। এখানে পাবলো পিকাসোর ‘কিউবিজম’ ঘরানার কথা বলা যেতে পারে। পিকাসো এই ঘরানার জন্য আফ্রিকার মুখোশের ফর্মের কাছ থেকে মূল কাঠামো ধার করে নিজের শিল্পকর্মে স্থান দিয়েছেন। এটা একটা ডিফিউজ। কিন্তু নামটি দিয়েছেন একেবারেরই পশ্চিমা শব্দের সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও গঠনের রীতি মেনে। তিনি আফ্রিকান শিল্পকর্মকে নিয়ে নিজের ভাষায় অনুবাদ করেছেন এবং নিজ সংকটকে রূপায়িত করেছেন। যেমন: গুয়ের্নিকা (১৯৩৭)। এখানে পিকাসো গ্রহীতা এজেন্সি হলেও ভাষা, প্রচার, অর্থনীতি, কর্তৃত্বের ক্ষমতায় থাকার কারণে এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক শক্ত পাটাতন স্বাধীন চিন্তার নতুন ভাবনা নির্মাণে পিকাসোকে সহযোগিতা করেছে। ফলাফল হিসেবে ফিউশনের অধীনে বিশ্ব এক অবিস্মরণীয় আর্ট-বিপ্লবকে পেলো। আল দীনের উষাউৎসব-কে এ ধরণের একটি প্রয়াস বলা যায় যা ফিউশনের অধীনে বাংলা নাটককে বা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছে এবং দেখিয়েছে নতুন পথের দিশা। আশ্চর্যজনকভাবে এ-নাটকটিকে তিনি নিউ এথনিক-থিয়েটারের অন্তর্গত করেন নি। রবীন্দ্র-উত্তর নৃত্য-গীত-নাট্যের ক্ষেত্রে উষা উৎসবকে একটি নতুন নাট্যধারা হিসেবে উল্লেখ করতে পারি—যেখানে একইসাথে কাব্য কথন এবং সাহিত্য রচনার নয়া মাত্র যোগ করেছে। নিউ এথনিক থিয়েটারের প্রকল্পটি বাদ দিলে এবং নতুন এ রচনার ধারায় গ্রহীতা এজেন্সি হিসেবে অপরাপর জাতিসত্তার ভাষাভঙ্গি ও কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে বাংলা নাটক বর্ণনানাট্য থেকে আরেক নাট্যধারার অর্থাৎ ‘নৃত্য-গীত-কথানাট্য’র এক ভিন্ন সংযোজন হিসেবে উপস্থাপিত। একে আমি চিহ্নিত করতে আগ্রহী ‘নৃত্য-গীত-কথানাট্য’ হিসেবে। তবে দুঃখের বিষয় যে আল দীন আর বেশি সময় পেলেন না আমাদের নাটকে এ-ধারাটির একটি পূর্ণ উত্তরণ ঘটাতে। তিনি যেভাবে কথানাট্যে নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে অভিগমন করেছেন এবং চরম প্রকাশ আমাদের সামনে রেখেছেন, একইভাবে ‘নৃত্য-গীত-কথানাট্য’র প্রকাশ করতে পারলেন কি? এক্ষেত্রে আল দীনকে যে শিক্ষার্থীগণ এবং তার দল ঢাকা থিয়েটার ধারণ করে তারা একটি দিশার দিকে টেনে নিয়ে যাবেন—এটাই এই বাংলা থিয়েটারের কর্মীর চাওয়া।
৭
সেলিম আল দীনের বাংলা সাহিত্যের করণ প্রকল্প হল ‘কথানাট্য’ : সর্বজাতি জাতীয় সাহিত্যের রূপরেখা প্রণয়ন।
প্রথমেই একটি বিষয় পরিষ্কার করে নেয়া জরুরি যে, কথানাট্যকে কথকতার11 সাথে গুলিয়ে ফেললে খুবই ভুল হবে। কারণ ‘কথকতা’ হল একধরনরে হাবভাব-ভঙ্গিমা ও গীত অথবা সুর সংযোগে কোনো কাহিনী পরিবেশন। যিনি কথকতার আশ্রয়ে কাব্য-পুরাণাদি পরবিশেন করনে তিনি কথক। বাঙলায় কথকতা মহাভারতরে ধারায় আগত-পরে ‘চতৈন্যভাগবত’, ‘চতৈন্যমঙ্গল’ প্রভৃতি কাহিনী কথকতার ধারায় রচিত। সেলিমের কথানাট্য কথকতার থেকে একবারেই ভিন্ন। তিনি নিজেই ‘কথানাট্যে’র ব্যাখ্যা হাজির করেছেন এভাবে যে;
“কথানাট্য : বাঙলা পাঁচালি ও কথকতার ধারায় রচিত সমকালীন নাটক। তবে একে কথকতার পরবিশনরীতি অনুসৃত হয় না। কথানাট্যের আঙ্গিকে বর্ণনা ও সংলাপ অদ্বৈতরূপে গৃহীত। পাশ্চাত্য রীতিতে নাটক মাত্রই সংলাপ ভিত্তিক এবং সেখানে র্বণনার কোনো অবকাশ রচিত হয় না। কিন্তু মধ্যযুগের বাঙলা পাঁচালি ও কথকতার পরিবেশনায় দেখা যায়-এতে বর্ণনা-গীত-নৃত্য-সংলাপ অভূতপূর্ব ঐক্যে গ্রন্থতি। কথানাট্যে এই নিয়মটাকেই অনুসরণ করতে দেখা যায়। চাকা প্রভৃতি নাট্য গদ্যে রচিত-তাতে দৃশ্যভাগ নেই-সংলাপও অবিমিশ্র নয়। মনে হয় সমগ্র কথার নেপথ্যে এক জন র্বণনাকারী (কথক বা পাঁচালি গায়েনের মত বিদ্যমান)। তিনি বলছেন-ব্যাখ্যা করছনে এবং অন্য চরিত্রের হাবভাবও প্রদর্শন করছেন। আবার চরিত্রাভিনেতাগণ স্ব-স্ব চরিত্রের ব্যাখ্যার সঙ্গে স্বীয় সংলাপের বহির্ভূত অন্য চরিত্রের মনস্তত্ত্ব-নাট্যে বর্ণিত নিসর্গের আবহ-ঘটনা ও পরিবেশ বর্ণনায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। এ নিঃসন্দেহে বাঙলা কথকতা পাঁচালি ধারার আধুনকি সংস্করণ।”12
সেলিম আল দীন প্রথমে বর্ণনাত্মক বিষয়টির তত্ত্বায়ন করলেন এবং তা ‘চাকা’ নাটকে তুলে ধরলেন। তারপর যৈবতী কন্যার মন, হরগজ রচনাটিতে দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বের সাথে র্বণনাত্মক নাট্যের সম্মিলন ঘটালনে। নাটকের আঙ্গিকে সর্ম্পূণ রূপে আদিকল্পের স্থানান্তর হল। নাটক প্রসেনিয়াম-এ থাকল কিন্তু সে রচনা ও প্রয়োগে ফিরিয়ে আনল বাংলাদেশের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী রীতিকে তবে অনুপুঙ্খভাবে নয়। এখানে বর্তমানের শিক্ষিত শহুরে জনগোষ্ঠীর উপযোগী করে এক নয়া প্রদর্শনী। এটা সেলিম-ইউসুফের বর্তমান সময়ের স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের একটি স্বতন্ত্র ধারা নির্মাণ করল। একে ঐতিহ্য আশ্রিত দ্বৈতাদ্বৈতবাদী র্বণনাত্মক নাট্য13। এটা কথানাট্যরে এক নয়া পরিবেশনা হাজির করা হল। সেলিম এটাকে কথানাট্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
আব্দুল্লাহ আল-মামুন ‘বাংলাদেশে নাটক রচনা : ধারা ও বিবর্তন’ প্রবন্ধে বাংলাদেশের জাতীয় নাট্য ঐতিহ্য নির্মিত হয়েছে কিনা তাঁর খোঁজ-খবর করেছেন। সেখানে তিনি সেলিম আল দীনের কাজেই একমাত্র সেই ধারা খুঁজে পেয়েছেন। সমগ্র আলোচনাটিতে কেবল মাত্র সেলিম প্রসঙ্গে আলোচনাতেই তিনি মন্তব্য করেছেন যে,
“সেলিম আল দীনের নাট্যরচনায় লোকজ ঐতহ্যিরে নিরন্তর অনুসন্ধান এবং যথাযথ প্রয়োগ আমাদের নাট্য ঐতিহ্য নির্মাণে আমাদের অনেকখানি এগিয়ে দেয়”14।
সেলিমের ঐতিহ্য চেতনার নিরন্তর অন্বেষণকে সৈয়দ শামসুল হক দেখেন এভাবে যে,
“সেলিম অনবরত সন্ধান করে চলেন প্রকাশের নতুনতর মার্গ; নতুন, কিন্তু বাঙলা ভাষার সৃষ্টিবুদ্ধি এবং হাজার বছরের ধারাবাহিকতার অন্তর্গত অবশ্যই। বাঙলায় তিনি লেখেন কারণ বাংলার মানুষরে অস্তিত্ব এবং জগৎ-বোধ, যাপিত জীবনের স্বপ্ন ও যন্ত্রণা তাঁর বিষয়-অপিচ তা বিশ্বের সকল মানুষেরই মানচত্রি হয়ে ওঠে বটে”15।
সেলিমের কাজ যে একটি পর্যায়ে উপনীত হয়েছে তা আমরা দেবেশ রায়ের সমাপনি মন্তব্যে দেখতে পাই,
“সেলিম আমাদের তেমন এক স্রষ্টা যাঁকে গ্রহণ করতে আমাদের নতুন নন্দনতত্ত্ব তৈরি করতে হবে”16।
যদিও সেলিমের রচনা বিশেষ করে চাঁকা থেকে শুরু করে পরবর্তী রচনাসমূহকে তিনি নিজেও নাটক হিসেবে উপস্থাপন করেন নি। যেহেতু ঢাকা থিয়েটার একে নাটক হিসেবে মঞ্চে উপস্থাপন করেছে তাই জাতীয় নাট্য আঙ্গিক পর্বে একে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছি। দেবেশ রায় এক্ষেত্রে বশে সরল এক মতামত হাজির করেছেন,
“আমি নিশ্চয়ই সেলিমের কাজের সাফল্য, ‘বাংলা নাটককে বিশ্বমানে উন্নীত করা’-এই ভাষায় ধরতে চাই না। আমার তো কিছুই জানা নেই-কাকে বাংলা বলে, কাকে নাটক বলে, কাকে বিশ্বমান বলে। এ-বিষয়ে আমাদের জ্ঞানের বহর কীরকম তা আমাদের থিয়োরের বোল-বোলাওয়ের ভুল ইতিহাস তৈরির গল্প করতে গিয়ে আমি বলেছি।
আমি এই মুর্হুতে এর বেশি বলতে চাইছি না যে সেলিম একটি পদ্ধতি আন্দাজ করে তাঁর যন্ত্রপাতির ক্ষমতা সবে শানাতে শুরু করেছিলেন। সেই যন্ত্রপাতি ব্যবহারে লাগবে কী না-তাঁর নিষ্পত্তি সে করে যেতে পারেনি।
সেলিমের এটা ব্যর্থতা নয়। এটাই সেলিমের কল্পনা ও কাজের সামর্থের প্রমাণ যে সে তাঁর নাটকগুলিকে নাটকও বলেনি। সেগুলিকে নাটক বলেছি আমরা, অন্য কোনো শব্দের অভাবে। সেলিমও আরো নানা শব্দ বলেছে।
সেলিমের এই নাটকগুলিকে যে নাটক বলেই ডাকতে চাইছি আমরা, তাঁর কারণ প্রযোজক-পরিচালক নাসরিুদ্দনি ইউসুফ বাচ্চু এগুলোর জন্য সে-রকম একটা পাঠ তৈরি করেছেন…।”17
বাংলাদেশের সর্বজাতি জাতীয় নাট্য আঙ্গিক নির্মাণের প্রকল্প সেলিম-ইউসুফ দ্বৈরথ থিয়েটার চর্চার গোঁড়া থেকেই। আর এক্ষেত্রে তাঁরা ঝাঁপ দেন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর নানা সাংস্কৃতিক তৎপড়তার ভেতরে। একাজটি তাঁরা নিভৃত গবেষকের মত করে যেতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা এসব সাংস্কৃতিক তৎপড়তার স্থানীয় চর্চাকে বেগবান করবার লক্ষ্যে এক আন্দোলন গড়ে তোলনে সমগ্র বাংলাদেশে। এর নাম ‘গ্রাম থিয়েটার আন্দোলন’। ৯০-এর দশকরে গোঁড়ার দিকে এ আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। একে উপজীব্য করে বাংলাদেশের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যাপ্ত চষে বেড়াতে শুরু করেন সেলিম-ইউসুফ। তাঁদরে কাছে দীনেশ চন্দ্রের সেই বাংলাদেশ একে একে খুলে যেতে শুরু করে। সেলিম নাটক রচনার প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে আসতে শুরু করেন ‘চাকা’ রচনার ভেতর থেকে তিনি তাঁর রচনাকে বেগবান করবার জন্য দীর্ঘ গবেষণার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং পিএইচডির অভিসন্দর্ভ রচনা করেন ‘মধ্যযুগের বাংলা নাট্য’-এর ওপর। সৃষ্টিশীল লখেক যখন তাঁর সৃষ্টির পুষ্টি খুঁজতে গভীর গবষেণায় অভিনিবেশ করেন তখন তিনি কয়লার খনির ভেতরে সোনার ফলনতো পাবেনই। সেলিমও দেখা পেলেন বাংলাদেশের হাজার বছর বয়সি নাট্য আঙ্গিকের।
সেলিম কথানাট্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে এক সংকীর্ণ পথ থেকে বের করে ভৌগলিক সীমারখোয় স্থাপন করলেন। জাতীয়তাবাদকে একমাত্র ভাষা কেন্দ্রিকতা থেকে একটি বহুত্ববাদি ‘কল্পিত’ জাতীয় চেতনা নির্মাণে নিজেকে ব্যাপৃত করলেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার সাংস্কৃতিক কৌশলকে নিজের রচনাতে অন্তর্ভুক্ত করলেন। ‘বনপাংশুল’ এর এক অনন্য উদাহরণ। এটা আরও মূর্ত হয়ে উঠল ইউসুফ যখন এই রচনা মঞ্চে অনুবাদ করলেন। এখানে গীত থেকে শুরু করে বাদ্যযন্ত্র ও বিভিন্ন প্রপসের সংমিশ্রনে সংস্কৃতির বহুত্বকে একীকরণ/একাঙ্গীকরণ করলেন। এ এক বাংলাদেশের অন্য নাট্য। ঢাকা থিয়েটার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে স্থাপন করল। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে হয়ত ‘ধর্ম’ কেন্দ্রিক জাতীয় ঐক্য নাট্যরে মাধ্যমে যে হতে পারে তা অবলোকন করতে পারতেন। বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার আদিকল্পের স্থানান্তরের এক নয়া রাজনীতি।
পরর্বতীতে ‘ঊষাউৎসব’, ‘স্বপ্নরমণীগণ’-এ ভাষার একাঙ্গিকরণ করা হয় যা কথানাট্যের আরেকটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ যেখানে অপরাপর জাতিসত্তার ভাষা ও গীত-নৃত্যের কৌশলকে অদ্বৈত করার নিরীক্ষা করা হয়েছে। ‘বনপাংশুলে’ র্সবপ্রাণবাদী দর্শনকে ব্যবহার করা হয়েছে যা মান্দি জনগোষ্ঠীর নিজের দর্শন। এই র্সবপ্রাণবাদকে সেলিম ‘ধাবমান’ ও ‘পুত্র’ রচনাতে একীকরণের নিরীক্ষা করেছেন যেখানে মানুষ পুত্র ও গরু পুত্র এবং গাছ ও গাছে ফাঁস নেয়া পুত্ররে সম্পর্কে একীকরণ করে অদ্বৈত করা হয়েছে।
সেলিম কথানাট্যের দ্বৈতাদ্বৈতবাদী বর্ণনাত্মক পাঁচালি বাংলাদশেরে ভৌগোলকি সীমারেখার অন্তর্ভুক্ত নানামুখী সংস্কৃতি এবং দর্শনকে একীকরণ/একাঙ্গীকরণ করেন। একীকরণ/একাঙ্গীকরণ/ফিউশন ছিল সেলিমের শিল্পতত্ত্বের ক্ষেত্রে শেষ অবস্থান। এখানে তিনি,
১. শিল্পসৃষ্টির কৌশল, রচয়িতার ভাব ও উপকরণগত সংশ্লষেণ পর্যবেক্ষণ,
২. ভিন্ন এমনকি বিপরীত স্বভাবরে উপাদানের একীভূত রূপ সৃষ্টি কৌশল বিচার এবং
৩. উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর একীভূত উপাদানরূপে নঞর্থক হয়ে উঠেছে কিনা তা দেখা।18
এই তত্ত্বকে নিয়ে সেলিম উৎসাহীত ছিলেন সংস্কৃতির বহুত্বকে অদ্বৈত করতে। পাশাপাশি সমগ্র বিশ্বের ক্লাশিকস ও শিল্প প্রবণতাকে তিনি একীভূত করতে চেয়েছেন। ফিউশনের ভেতর ঘটে যাওয়া গ্রহীতা/রিসিভার এবং দাতা/ডোনার-এর শ্রেণিগত ভিন্নতাকে নিয়ে নানা ধরনের বাহাসে উপনীত হওয়া যেতে পারে। অধিপতিশীল সংস্কৃতি হিসেবে বাঙালির আধিপত্য সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হবে কিনা বা এর প্রবণতা নিয়েও বাহাসে উপনীত হবার অবকাশ রয়ে যায়। তবে এ তত্ত্বের ভেতরে ভালভাবে তাঁকালে দেখবো যে, একীকরণও মূলত অদ্বৈত করতে চায় সবকিছুকে কারণ এটা দ্বৈত নয় বহুত্ত্বকে একীকরণ করে। এ জন্য সেলিম কথানাট্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির ঐক্য স্থাপন করেছেন এবং একটি ‘কল্পিত’ জাতীয় সংস্কৃতির প্রস্তাবনা হাজির করছেনে। ১৯৭১-উত্তর বাংলাদেশে জাতীয় চেতনার বিকাশ জরুরি বলে যা আজ আমাদের সামনে উপস্থিত। এই বাংলাদেশ তাঁর দেশের সংস্কৃতির বহুত্ত্বকে স্বীকার করতে সংকীত এবং আদিবাসী প্রশ্নে নানা টালবাহানায় উপনীত। অথচ সেলিম-ইউসুফের প্রস্তাবিত ‘কথানাট্যে’ সংস্কৃতির অদ্বৈততা এক নয়া বাঙালি জাতীসত্ত্বার কথকথাকে শুধুমাত্র ভাষা কেন্দ্রিক নয় পাশাপাশি ভৌগোলিক সীমারেখায় বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার ‘কল্পনা’ নির্মাণ করবে।
টীকা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০০০, নেশন কী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবন্ধসমগ্র, রবিশঙ্কর মৈত্রী সংকলিত, ঢাকা: সময় প্রকাশন, পৃষ্ঠা ৪৬৪।[↩]
- পূর্বোক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০০০: ৪৫৭।[↩]
- দেখুন, ইশরাত হোসেন সম্পাদিত (১৯৯৭) ‘সকাল’ : কবি সৈয়দ আলী আশরাফ বিশেষ সংখ্যা-এ নাট্যকার সেলিম আল দীনের সাক্ষতকার। সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছিলেন শামীম রেজা, আসাদ আহমেদ, রন্জু রাইম। [↩]
- পূর্বোক্ত আব্দুল্লাহ আল-মামুন, ২০১৩: ৭: ১ ও ২: ৭৫।[↩]
- সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র ১: ভূমকিা দ্রষ্টব্য।[↩]
- পূর্বোক্ত ফ্রাঞ্জ ফানো, ২০০৬: ১৫৮।[↩]
- পূর্বোক্ত আব্দুল্লাহ আল-মামুন, ২০১৩ : ৭ : ১ ও ২ : ৭৯।[↩]
- পূর্বোক্ত আব্দুল্লাহ আল-মামুন, ২০১৩ : ৭ : ১ ও ২ : ৭৩।[↩]
- আল দীন, ১৯৯৫, বাঙলা দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বের পূর্বাপর, থিয়েটার স্টাডিজ, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা : ৩ : ৯।[↩]
- পূর্বোক্ত সেলিম আল দীন ১৯৯৫ : ৩ : ১১।[↩]
- এটা নেয়া হয়েছে সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র, ২০১০ : ৫ : ৬৩।[↩]
- এটা নেয়া হয়েছে সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র, ২০১০ : ৫ : ৬৪।[↩]
- বর্ণনাত্মক নাট্য : বর্ণনা ও সংলাপের মাধ্যমে পাঁচালি ও কথকতার ধারায় খানিকটা আধুনিককালের উপন্যাস বা কথা সাহিত্যের ধাঁপে রচতি নাটক। এ শ্রেণির নাট্যরে মধ্যে চাকা, যৈবতীকন্যার মন, হরগজ এবং শাঁওলী মিত্রের নাথবতী অনাথবৎ, কথা অমৃতসমান প্রভৃতি উল্লখেযোগ্য। সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র, ২০১০ : ৫ : ২২২।[↩]
- পূর্বোক্ত আব্দুল্লাহ আল-মামুন, ২০১৩ : ৭ : ১ ও ২ : ৭৮।[↩]
- সৈয়দ শামসুল হক, প্রচ্ছদ ভূমিকা, চাকা, সেলিম আল দীন রচিত, ঢাকা।[↩]
- দেবেশ রায়, ২০১৩, সেলিম-বাচ্চু-শিমুল-রাইসুল : নামাজ আমার আদায় হইল না, বাংলাদেশের নাটকনভলে : কিছু আনাড়ি আন্দাজ, কলকাতা : এবং মুশায়েরা, পৃষ্ঠা ১০২।[↩]
- পূর্বোক্ত দেবেশ রায় ২০১৩ : ১০১।[↩]
- সেলিম আল দীন, ২০০৮, শিল্পে একাঙ্গীকরণ ফিউশন তত্ত্ব, থিয়েটার স্টাডিজ, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা : ১৫ : ১১-১২।[↩]