বিউপনিবেশায়ন কেন?
পরিভাষা হিসেবে ’বিউপনিবেশায়ন’ বিগত প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। দিন দিন এর জনপ্রিয়তা যেন বেড়েই চলেছে। তবে শব্দ হিসেবে এটি যতো জনপ্রিয়—এর তৎপরতা ও লক্ষ্যপথ সম্পর্কে ঠিক সেই পরিমাণ সতর্কতা পরিলক্ষিত হয় না। বিউপনিবেশায়নকে এখনও অনেকেই ভুলভাবে ইংরেজি ‘Decolonization’ শব্দের তর্জমা হিসেবে পাঠ করেন। শুধু তাই নয়, ’বি–উপনিবেশায়ন’ ও ’বিউপনিবেশায়ন’ এই দুই বানানের মধ্যেকার পার্থক্যও অনেকের কাছে অপরিষ্কার। অথচ, বানানে এই হাইফেন থাকা ও না–থাকা ”বাংলাদেশের বিউপনিবেশায়ন তত্ত্ব” বোঝার ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। কেননা, যে সকল ডিকলোনাইজেশন ঔপনিবেশিক ক্ষমতাকাঠামোর স্থিরীকরণ করে কিংবা সার্বিকীকরণ ঘটায় ও নির্ধারিত সেই ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে পদ্ধতিগতভাবে বিরোধী সম্পর্কে যুক্ত থাকে, তাদের অনূদিত রূপই হলো ‘বি–উপনিবেশায়ন’। হাইফেন এখানে বিরোধাত্মক অর্থের দ্যোতক। অর্থাৎ, হাইফেনঅলা বি–উপনিবেশায়ন ইংরেজি ডিকলোনাইজেশন শব্দের তর্জমা মাত্র। অন্যদিকে, হাইফেনমুক্ত বিউপনিবেশায়ন বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সমস্যা–সাপেক্ষ তৎপরতা, পৃথিবীর অপরাপর উপনিবেশিত ভূখণ্ডসমূহের ডিকলোনাইজেশনের সঙ্গে যার সুনির্দিষ্ট পার্থক্য রয়েছে। যে–কারণে, বিভিন্ন ধরনের ডিকলোনাইজেশনের সঙ্গে বিউপনিবেশায়নকে গুলিয়ে ফেলা ও তাদের মধ্যেকার ভিন্নতা ধরতে না–পারা চিন্তাচর্চার দিক থেকে মারাত্মকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। বিউপনিবেশায়নের স্বতন্ত্র জ্ঞানতত্ত্ব ও রাজনৈতিক লক্ষ্যপথ রয়েছে; দার্শনিক অভিপ্রায় থেকেও তা সুনির্দিষ্টভাবে পৃথক। বিউপনিবেশায়ন কোনো প্রকারেরই জাতীয়তাবাদ বা জাতীয়তাবাদী রাজনীতি সমর্থন করে না, কেননা, তা এক ত্রুটিপূর্ণ মতাদর্শ বা মতাদর্শিক তৎপরতা; তেমনই, যে–কোনো ধরনের লিঙ্গবৈষম্য কিংবা লিঙ্গীয় রাজনীতিতে তা আস্থাশীল নয়। এমনকি, উপনিবেশায়নের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক তা–ও কোনো পূর্ব–নির্ধারিত স্থির–সূত্র দ্বারা পরিচালিত নয়, কেননা, তাত্ত্বিকভাবে তা ত্রুটিযুক্ত। তবে, “বাংলাদেশের বিউপনিবেশায়ন তত্ত্ব” দুনিয়ার অপরাপর ডিকলোনাইজেশনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল; যদিও একইসঙ্গে, তাদের তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও সর্তক।
উত্তর–উপনিবেশবাদ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এক–সময়কার উপনিবেশিত ভূখণ্ডসমূহ স্বাধীন হতে শুরু করে। এই স্বাধীন হওয়ার প্রক্রিয়া যেমন রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সাধিত হয়েছে, তেমনই যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে প্রাক্তন উপনিবেশক শক্তিসমূহের তরফ থেকে ঔপনিবেশিক শাসন বহাল রাখা অলাভজনক হয়ে ওঠাও এক্ষেত্রে দায়ী। আর, প্রাক্তন উপনিবেশিত এই ভূখণ্ডসমূহ তাদের স্বাধীনতা চরিতার্থ করেছে জাতীয় আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে। সেই কারণে, উপনিবেশ–পরবর্তী পর্বে প্রাক্তন উপনিবেশগুলোর জায়গায়, পৃথিবী জুড়ে, একে একে জন্ম নিয়েছে স্বাধীন সব জাতি রাষ্ট্র। ফলে, সদ্য স্বাধীন হওয়া এই সকল রাষ্ট্রের—ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত—সংগ্রামী অভিজ্ঞতা যেমন ছিলো, তেমনই তারা বহন করে চলেছে ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডের উত্তরাধিকার। যে–কারণে, সাবেক উপনিবেশিত ভূখণ্ডসমূহের নেতা ও তাত্ত্বিকেরা—ঔপনিবেশিক ছত্রছায়ার বাইরে—নিজস্ব ধরনের রাষ্ট্র নির্মাণ করতে গিয়ে সদ্য–পরিসমাপ্ত ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করলেও জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে তারা সেই ঔপনিবেশিক কাঠামোরই অন্তর্গত রয়ে গিয়েছিলো। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার এহেন চুলচেরা বিশ্লেষণ, সমালোচনা ও বিগত উপনিবেশের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা স্থান করে নিয়েছিলো সেই সকল রাষ্ট্রের শিল্প, সাহিত্য ও চিন্তাচর্চায়। উপনিবেশ–পরবর্তী সময়ে সদ্য স্বাধীন হওয়া এ–সকল রাষ্ট্রের শিল্প–সাহিত্য ও চিন্তাগত অভিব্যক্তি উত্তর–উপনিবেশবাদ নামে পরিচিতি পায়। এই চিন্তা জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে—ইউরোকেন্দ্রিক সমাজে বিকশিত—উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও উত্তর–কাঠামোবাদী চিন্তার প্রতি ঋণ স্বীকার করে ও তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলে। যে–কারণে, ইউরোকেন্দ্রিক জ্ঞানতত্ত্বের বাইরে উত্তর–উপনিবেশবাদের কোনো স্বতন্ত্র জ্ঞানতত্ত্ব নেই; সেই লক্ষ্য কিংবা প্রতিশ্রুতিও সেখানে অনুপস্থিত। ফলে, ইউরোকেন্দ্রিক জ্ঞানকাণ্ডটিকে ধ্বসিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এর অপারগতা স্পষ্ট। এ–কারণেই, উত্তর–ঔপনিবেশিক শিল্প, সাহিত্য ও চিন্তায় প্রাধান্য লাভ করে—ইউরোকেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামোর সাপেক্ষে—আত্মপরিচয়ের রাজনীতি, সাংস্কৃতিক সংকরীভবন ও অভিবাসনের মতো প্রসঙ্গসমূহ। যে–কারণে, এটা বোঝা খুবই জরুরি যে, কিছু ক্ষেত্রে উত্তর–উপনিবেশবাদ ও বি–উপনিবেশায়ন একে অপরকে ছেদ করলেও তারা মোটেই এক জিনিস নয়।
বি–উপনিবেশায়ন
বি–উপনিবেশায়ন নিঃসন্দেহে উপনিবেশায়নের মুখাপেক্ষী। অর্থাৎ, যেখানে উপনিবেশায়ন ঘটেনি, বি–উপনিবেশায়নের প্রসঙ্গ সেখানে অবান্তর। ফলে, বি–উপনিবেশায়ন কোনো–না–কোনোভাবে উপনিবেশায়নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হবেই। তবে, উপনিবেশায়ন ও বি–উপনিবেশায়নের মধ্যেকার এই সম্পর্ক সরলরৈখিক নয়; এমনকি, তাদের এই সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠেছে বি–উপনিবেশায়নের বিভিন্ন ধরন। বি–উপনিবেশায়নের একটি ধরন যেমন উপনিবেশ মোকাবিলায় বেছে নিয়েছে রক্তক্ষয়ী পথ, তেমনই ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া গোষ্ঠীর রাজনৈতিক সমঝোতার নজিরও রয়েছে। অন্যদিকে, ঔপনিবেশিক ক্ষমতাকাঠামোর চুলচেরা বিশ্লেষণ ও তার সমালোচনা দ্বারা—ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার মুখোশ উন্মোচনের মধ্য দিয়ে—বিদ্যায়তনিকভাবে তাকে প্রত্যাখ্যান করাও বি–উপনিবেশায়নের আরেকটি ধরন। আবার, ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে গড়ে ওঠা মন ও মনোজাগতিক ক্ষত সারিয়ে তোলায় প্রয়াসও বি–উপনিবেশায়ন। সেক্ষেত্রে, ঔপনিবেশিক ভাষা ও সাহিত্যই যেহেতু উপনিবেশিতের মনোজগতের উপনিবেশায়নের হাতিয়ার সেহেতু, বি–উপনিবেশায়ন বেছে নেয় সংশ্লিষ্ট সেই ঔপনিবেশিক ভাষাকে প্রত্যাখ্যানের পথ। বি–উপনিবেশায়নের এই দুটি ধরন উত্তর–উপনিবেশবাদকে ছেদ করে যায়। যে–কারণে, অনেকক্ষেত্রেই উত্তর–উপনিবেশবাদের সঙ্গে তা মিলে–মিশে যায়। বি–উপনিবেশায়নের অপর আরেকটি ধরন উপনিবেশায়নকে এক বিশেষ কাঠামোর বিশ্বব্যবস্থা বলে পেশ করে যা গোটা দুনিয়ার অধিবাসীদের একটি ইউরোকেন্দ্রিক ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসে; যেখানে গোটা পৃথিবীর শ্রম বিভাজিত হয় পুঁজিবাদী পদ্ধতিতে, মানুষ শ্রেণিকৃত হয় বর্ণবাদী মানদণ্ডে, সমগ্র পৃথিবীতে কায়েম করা হয় ইউরোকেন্দ্রিক যৌক্তিকতা। ঔপনিবেশিক এই জ্ঞানতত্ত্ব প্রত্যক্ষভাবে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটলেও—উপনিবেশ–পরবর্তী পর্বে—জ্ঞানকাণ্ডের বিভিন্ন মাধ্যমে ঠিকই বিরাজমান থেকে যায়। বি–উপনিবেশায়নের এই ধরনটি প্রত্যক্ষ উপনিবেশের পরিসমাপ্তির পর জীবন–যাপনে যে “উপনিবেশিকতা” রয়ে যায়, তা থেকে বিযুক্তকরণের প্রস্তাব করে; বলে জ্ঞানতাত্ত্বিক অবাধ্যতার কথা। এই ধরন বিউপনিবেশিকতা নামে পরিচিত। ফলে, পদ্ধতিগতভাবে ডিকলোনাইজেশনের ধরনসমূহ হলো: ১। জাতীয়তাবাদী বি–উপনিবেশায়ন (রক্তক্ষয়ী কিংবা সমঝোতাপূর্ণ) ২। বিদ্যায়তনিক বি–উপনিবেশায়ন ৩। ভাষাগত কিংবা সাহিত্যিক বি–উপনিবেশায়ন ৪। জ্ঞানতাত্ত্বিক বি–উপনিবেশায়ন (বিউপনিবেশিকতা)। বাকি রইলো বাংলাদেশের বিউপনিবেশায়ন তত্ত্ব।
বিউপনিবেশায়ন কী?
বাংলাদেশে বিশ শতকের আশির দশকে, ইংরেজি ‘Decolonization’ শব্দের তর্জমা হিসেবে “ব্যুপনিবেশন” শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বলে রাখা ভালো, সংস্কৃত ব্যাকরণের বিধান অনুযায়ী এই বানানটিই শুদ্ধ। কিন্তু এই শুদ্ধ বানানটির চেয়ে একুশ শতকের গোড়ার দিকে “বি–উপনিবেশায়ন” বানানটিই জনপ্রিয়তা পায়। দুনিয়াজুড়ে চলমান বিভিন্ন ধরনের ডিকলোনাইজেশন সংক্রান্ত আলাপালোচনা বাংলা ভাষায় পেশ করতে গিয়ে “বি–উপনিবেশায়ন” শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকে। “বি–উপনিবেশায়ন” শব্দের সামর্থ্যের জায়গাটা হলো, ”উপনিবেশায়ন” শব্দটিকে তা আস্ত রেখে দেয় এবং এই আস্ত রাখার মধ্য দিয়ে উপনিবেশায়নের নিপীড়নমূলক কাঠামোর অর্থগত দ্যোতনা টিকিয়ে রাখতে পারে; সেইসঙ্গে হাইফেনসহ “বি” উপসর্গ হাজির হয় বিরোধাত্মক অর্থের রেশ নিয়ে; যার ফলে, ইংরেজিতে “ডিকলোনাইজেশন” শব্দটি আসলে যা বলতে ও বোঝাতে চায়, “বি–উপনিবেশায়ন” শব্দে তার যেন অনেকটাই ধরা পড়ে। শব্দটি তার ধারণাগত পরিচয় হিসেবেও ডিকলোইজেশনকেই পেশ করেছে। বিশেষ করে তা হাজির করেছে বাংলা ভাষায় ফানো, নগুগি ও সায়িদের চিন্তাভাবনা। ফলে, বি–উপনিবেশায়ন নির্দিষ্ট যে তাত্ত্বিকের লেখা পেশ করেছে, আলোচনা কিংবা তর্জমা করেছে, তার অবলম্বিত জ্ঞানতত্ত্ব ও সংশ্লিষ্ট রাজনীতিই তা প্রচার করেছে; আলাদা করে তার কোনো স্বতন্ত্র রাজনৈতিক কিংবা দার্শনিক রূপরেখা ছিলো না। তবে, এ–কথা অনস্বীকার্য, তার এই বহুবিধ না–থাকা, বি–উপনিবেশায়ন সংক্রান্ত এই সকল আলাপালোচনা ”বাংলাদেশের বিউপনিবেশায়ন তত্ত্ব” গড়ে ওঠায় ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশে বি–উপনিবেশায়ন সংক্রান্ত আলাপালোচনা ও লেখালেখি মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক ছিলো। ঠিক একইসময়ে, বিশ শতকের শূন্য দশকের শেষাংশে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিত্যকার চর্চার সূত্র ধরে স্বতন্ত্র এক বিউপনিবেশায়ন ভাবনা বড়ো হতে থাকে। কিন্তু, বলতেই হবে, তা তখন বিকাশের একদম প্রাথমিক পর্যায়ে ছিলো; যার রূপরেখা ক্রমান্বয়েই স্পষ্ট হতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতাতেই ২০১৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলাদেশ দর্শন সংঘ কর্তৃক, দীর্ঘ ছয় মাসব্যাপী “বাংলাদেশের বিউপনিবেশায়ন তত্ত্ব” শীর্ষক বক্তৃতামালার আয়োজন করা হয়। সেখানে বক্তৃতা করা হয় দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, লিঙ্গ, সাহিত্য, চিকিৎসা, ভাষা, সংবিধান ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গে। সেই আয়োজনে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিকেরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের নিজস্ব প্রস্তাবনা পেশ করেন। অর্থাৎ, বিউপনিবেশায়ন এক সংঘবদ্ধ তৎপরতার নাম। আর, ২০১৫ সালকে, সেই সংঘবদ্ধ তৎপরতার, “বাংলাদেশের বিউপনিবেশায়ন তত্ত্বের”, প্রাতিষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের কাল বলা যেতে পারে। তখন থেকেই বিউপনিবেশায়ন নামটি দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থাকে। যদিও ঠিক তখনও বিউপনিবেশায়ন ভাবনা তাত্ত্বিকভাবে সংহত রূপ লাভ করেনি; গড়ে ওঠেনি এর নিজস্ব জ্ঞানতত্ত্ব। যে অভাব পূরণ হয়, ২০১৭ সালে প্রকাশিত ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা গ্রন্থটির মধ্য দিয়ে। বিউপনিবেশায়ন সেখানে পৃথক জ্ঞানতত্ত্ব, স্বতন্ত্র বিশ্লেষণ–পদ্ধতি, পৃথক রাজনীতি ও বিদার্শনিক অবস্থান নিয়ে হাজির হয়। তাছাড়া, জ্ঞান কী? জ্ঞানের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিৎ, জ্ঞানচর্চার মৌলিক শর্তসমূহ কী, মোটকথা বিউপনিবেশিত জ্ঞানচর্চার রূপরেখা কী হবে, এই নিয়ে পরের বছর প্রকাশিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়: উদ্ভব, বিকাশ এবং বিউপনিবেশায়ন।
ইংরেজি ভাষায় “Post-” প্রিফিক্সটি “পরবর্তী” কিংবা “পশ্চাৎ” অর্থের রেশ বহন করে। যেমন, “Post-modernism”, “Post-structuralism”, “Post-colonialism”, “Post-humanism” শব্দগুলোর ক্ষেত্রে “Post-”এর অর্থগত দ্যোতনা সময়ের বিচারে পরবর্তী, সম্পর্কের বিচারে বিরোধী, বিশ্লেষণের পদ্ধতি বিচারে সমালোচনামূলক। অন্যদিকে “De-” নির্দেশ করে “বিপরীত কিছু করা”, “পাল্টা কিছু করা”, “বিযুক্ত করা”, “হ্রাস করা” এ–ধরনের অর্থ। ডিকলোনাইজেশনের বিভিন্ন ধরনসমূহে “De-” প্রিফিক্সটির উপর্যুক্ত অর্থগত দ্যোতনাসমূহই পরিলক্ষিত হয়। ইংরেজি ভাষায় এই “De-” এসেছে লাতিন থেকে। লাতিন ভাষায় এর অর্থগত রেশ: হইতে, নিম্নে ও দূরবর্তী। লাতিন বংশোদ্ভূত “De-” প্রিফিক্সটি অর্থের বিচারে সংস্কৃত “বি” উপসর্গের কয়েকটি ক্ষেত্রকে ছেদ করে গেলেও “বি” উপসর্গের অর্থগত পরিধি নির্দিষ্ট সেই ক্ষেত্রগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয়। ভাবের দিক থেকে ”বি” উপসর্গ শব্দভেদে নিম্নোক্ত প্রকারে অর্থ প্রদান করে: ১। পৃথকভাব (যেমন: বিয়োগ, বিশ্লেষ); ২। বিবিধ ভাব (যেমন: বিচিত্র, বিবিধ); ৩। অতিশয় ভাব (যেমন: বিকীর্ণ); ৪। মোহ ভাব (যেমন: বিমনস্ক, বিমুগ্ধ); ৬। বৈপরীত্য ভাব: (যেমন: বিকর্ম, বিক্রয়, বিকল্প); ৭। বিরোধী ভাব (যেমন: বিবাদ, বিজাতীয়); ৮। বিশেষ ভাব (যেমন: বিকচ, বিকর্তন, বিবেচ্য, বিরচন, বিভূষণ, বিনীত, বিশিষ্ট); ৯। অভাব (যেমন: বিধবা, বিস্মৃতি); ১০। বিকৃতি বা বৈরূপ্য ভাব (যেমন: বিকট, বিকার, বিকৃত); ১১। বিস্তারিত ভাব (যেমন: বিকথন, বিস্তীর্ণ)। বিউপনিবেশায়নের “বি”—বিরোধী ভাব নয়—বৈপরীত্য ভাবের দ্যোতনা বহন করে। কারণ, বাংলাদেশের বিউপনিবেশায়ন তত্ত্ব উপনিবেশায়নের ঢালাও বিরোধিতা করে না; তা উপনিবেশায়নের সার্বিকীকরণ ঘটায় না; সার্বিকীকরণপূর্বক তার সঙ্গে নির্ধারিত ও স্থির কোনো সম্পর্কে আবদ্ধ হয় না। বিউপনিবেশায়ন সমস্যা–সাপেক্ষ। উপনিবেশায়ন যেখানে সমস্যা রূপে হাজির নয়, সেখানে বিউপনিবেশায়ন অপ্রাসঙ্গিক।
বাংলাদেশের বিউপনিবেশায়ন হাইফেন মুক্ত। হাইফেনের এই না–থাকা এখানে কোনো খেয়াল নয়, নিয়মের নেহায়েৎ লঙ্ঘন নয়, বরং সামান্য এক যতিচিহ্নের সুচিন্তিত প্রয়োগ। সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী, শব্দ গঠনের ক্ষেত্রে, পাশাপাশি দুইটি স্বরের বেলায়, যে–সকল ক্ষেত্রে সন্ধির নিয়ম প্রযোজ্য হবে সেখানে সেখানে সেই বিধি অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক; সন্ধি করা না–গেলে, কিংবা উচিৎ না–হলে সেখানে হাইফেন ব্যবহার করতে হয়। সমাসবদ্ধ করা হলেও তাকে হাইফেন যোগে নির্দেশ করা হয়। বোঝাই যায়, সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম এখানে অনুসরণ করা হয়নি। সন্ধি কিংবা সমাস আসলে বাংলা ব্যাকরণের কিছু না। ফলে, সেই নিয়মের জবরদস্তি প্রয়োগেরও কিছু নেই। তাছাড়া, সংস্কৃত ভাষা থেকে আস্ত “উপনিবেশায়ন” শব্দটিই বাংলা ভাষায় সরাসরি গৃহীত হয়েছে। উপনিবেশায়ন একটি প্রক্রিয়া—”বি” উপসর্গ যোগে—তার বিপরীত প্রক্রিয়ার নাম রাখা হয়েছে বিউপনিবেশায়ন। এই শব্দ গঠন করতে গিয়ে বাংলাদেশি কানের জন্য এর সন্ধি করার প্রয়োজন পড়েনি। সাতটি অক্ষরের বড়োসড়ো এই শব্দটিকে অনায়াসে পড়ে ফেলা গিয়েছে: বি–উ–পো–নি–বে–শা–য়োন্। প্রথম ছয়টি মুক্তাক্ষরের প্রবাহ একটি মাত্র বদ্ধাক্ষর দ্বারা শেষ হয়েছে। শব্দটি গঠিত হয়েছে একটি নামপদ রূপে। বিউপনিবেশায়ন একটি নাম। “বাংলাদেশের বিউপনিবেশায়ন তত্ত্বের” সংক্ষিপ্ত নাম। নামের ক্ষেত্রে হাইফেনের এই ব্যবহার দৃষ্টিতে ছেদ আনে। মনে হয় আড়ম্বর। কেননা, শব্দটি এখানে গঠনসর্বস্ব নয়, গঠন তার অর্থকে নিয়ন্ত্রণ করবে না, বরং অর্থগত তাৎপর্যেই এর পরিচয়। সবেচেয়ে বড়ো কথা, হাইফেনঅলা সেই বি–উপনিবেশায়নের কাজ ছিলো ডিকলোনাইজেশনকে বাংলাদেশে প্রচার করা—তাকে তো পৃথকভাবে উপস্থাপন করা জরুরি। কেননা, বিউপনিবেশায়নের লক্ষ্য কিংবা উদ্দেশ্য তা নয়। ফলে, তাদের দুইয়ের মধ্যেকার বানানের এই চেহারাগত ভেদটুকু রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য এ–ও স্বীকার করতে হবে যে, তাদের কর্মপরিধির তাৎপর্যগত পার্থক্য এতোটাই ব্যাপক যে সামান্য এই হাইফেন সেই বিশাল ভেদ রক্ষায় কতটুকু সামর্থ্য রাখে তা নিয়ে দুশ্চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে। উচ্চারণের ক্ষেত্রে আবার হাইফেনের এই থাকা কিংবা না–থাকা ধরা পড়ে না। এরচেয়েও বড়ো ঝুঁকির ব্যাপার হলো, ইদানিং দেদারছে, না–বুঝে, হাইফেন ছাড়াই যত্রতত্র যে–কেউ “বিউপনিবেশায়ন” শব্দটি ব্যবহার করছে। ফলে, ”বাংলাদেশের বিউপনিবেশায়ন তত্ত্ব” বোঝার ক্ষেত্রে এর পৃথক জ্ঞানতত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি।
পৃথক জ্ঞানতত্ত্ব
উপনিবেশায়নের সুবাদে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ পৃথিবীর অ–ইউরোপীয় ভূখণ্ড ও সেখানকার অধিবাসীদের সম্পর্কে জ্ঞান তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিলো। সফলভাবে উপনিবেশ পরিচালনার জন্য জ্ঞানোৎপাদনের এই কর্মকাণ্ড তাদের জন্য এক–রকম অপরিহার্যই ছিলো। ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়ায় অ–ইউরোপীয় সমাজের বৈশিষ্ট্যসমূহ ব্যাখ্যাত হয়েছে ইউরোপীয় মানদণ্ডে—এক বিশেষ ধরনের কর্তৃত্বক্রমানুযায়ী। যেখানে ইউরোপীয় জ্ঞান, ইউরোপীয় সমাজ, ইউরোপীয় নীতি কিংবা ইউরোপীয় আদর্শ বিবেচিত হয়েছে কেন্দ্রীয় রূপে। যে–কারণে, পৃথিবীর অপরাপর জ্ঞানকাণ্ডসমূহ ও জ্ঞানোৎপাদন–প্রক্রিয়া হয়ে পড়েছিলো প্রান্তীয় । তাই, জ্ঞান নয়, সেগুলো সাব্যস্ত হয়েছে সংস্কার কিংবা কুসংস্কার রূপে। এর কারণ কী? এর কারণ, ইউরোপীয় সমাজের—কেবল ইউরোপীয় নয়, সকল সমাজেরই—বিকাশের নিজস্ব ধরন আছে। বিশেষত, প্রতিটি অঞ্চলেই বিদ্যমান সমস্যাসমূহের সমাধান করে–করে বিকশিত হয় সেই অঞ্চলের জ্ঞান; গড়ে ওঠে জ্ঞানকাণ্ড। ষোলো–সতেরো শতকের ইউরোপেও তা–ই হয়েছে। কিন্তু, সমস্যা ভিন্ন জায়গায়। তাদের জ্ঞানকাণ্ডই যে এক ও অদ্বিতীয় নয়, এই জ্ঞানটুকু ইউরোপীয়দের ছিলো না। অনুরূপ, ইউরোপীয় যৌক্তিকতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আধুনিকতা যে গোটা দুনিয়ার মুক্তিদায়ী প্রকল্প হতে পারে না, এই বোধটুকু তাদের বড়ো বড়ো দার্শনিকদেরও ছিলো না। যে–কারণে, তাদের জ্ঞানকাণ্ডকেই তারা চাপিয়ে দিয়েছে গোটা পৃথিবীর ওপর; সেটাকেই ধরে নিয়েছে প্রামাণ্য হিসেবে। ফলে, তাদের জ্ঞানকাণ্ড পরিণত হয়েছিলো উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার মোক্ষম মন্ত্রে; শোষণ ও বৈষম্যের সর্বজনীন হাতিয়ারে। অথচ, ইউরোপীয় জ্ঞানের বিকাশপথ একান্তই ইউরোপীয় সমাজ–সাপেক্ষ। জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াইয়ে সেই সমাজের নিজস্ব ইতিহাস আছে, যা অ–ইউরোপীয় সমাজে অনুপস্থিত। তাদের সেই লড়াই, লড়াইয়ে অর্জিত ফলসমূহই, তাদের জ্ঞানের চরিত্র নির্মাণ করেছে। জ্ঞানের এই চরিত্রই জ্ঞানতত্ত্ব।
ইউরোপীয় জ্ঞানতত্ত্ব ব্যক্তিকে একক ধরে বিকশিত হয়েছে; যার নেপথ্যের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে কার্তেশীয় আত্মতত্ত্ব; যেখানে একেক ব্যক্তি যেন বিচ্ছিন্ন একেকটি দ্বীপের মতো অবস্থানপূর্বক একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়—সমাজ গঠন করে। উপরন্তু, ব্যক্তি সেখানে এমন এক সংহত একক, যা সময়ের এক সরলরৈখিক প্রবাহ ধরে বিকশিত হয়। ফলে, ইউরোপীয় জ্ঞানতত্ত্বে ব্যক্তির এক–ধরনের সারবস্তুও পাওয়া যায়। মার্কসের বিচারে, ব্যক্তিগত সম্পত্তিই সেই জিনিস যা দ্বারা ব্যক্তির ধারণার বাস্তবায়ন ঘটে। একই নিয়মে ব্যাখ্যাত হয়েছে ইউরোপীয় সমাজ যা তার অনুন্নত দশা থেকে ক্রমান্বয়ে—প্রগতির পথ ধরে—এগোতে এগোতে উন্নতির শিখরে পৌঁছে যায়। এই প্রগতির আলোকেই ইউরোপ নিজেকে অপরাপর অ–ইউরোপীয় সমাজের তুলনায় উন্নত ও বিকশিত রূপে চিনে নেয়। ”প্রগতি”র এই ধারণা গোটা আধুনিক ইউরোপকে এতোটাই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে যে, মার্কসের মতো চিন্তাশীল ব্যক্তিও—প্রগতির ফাঁদে পড়ে—উপনিবেশের অনিবার্যতা স্বীকার করে বসেছেন। সেটা ঘটেছে চিন্তার গতিমুখকে একরৈখিক বিবেচনা করার কারণে। এর দ্বারা এ–ও প্রমাণিত হয় যে, চিন্তা কিংবা জ্ঞানচর্চা কোনো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, ক্ষেত্র–সাপেক্ষে এর অন্তর্নিহিত গাঠনিক সূত্র থাকেই। বলতেই হবে, ইউরোপীয় চিন্তার ইতিহাস মোটেও এতো সরল নয়। কেননা, ইউরোপীয় দার্শনিক কিংবা সমাজতাত্ত্বিকদের পারস্পরিক চিন্তার মধ্যেই ব্যাপক বৈসাদৃশ্য ও বিরোধিতা ছিলো, আর এখনও আছে। যেমন, আধুনিকতার তাত্ত্বিক প্রস্তাবনাসমূহ—উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে—খোদ ইউরোপীয় চিন্তাকাঠামোর ভেতরেই ব্যাপকভাবে সমালোচিত। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কারণ, জ্ঞানতত্ত্বের দিক থেকে তা একই রয়ে যায়। এ–কারণেই, উত্তর–আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা উত্তর–কাঠামোবাদী চিন্তা–ভাবনা দ্বারা আধুনিকতা ও ইউরো–আমেরিকান জ্ঞানকাণ্ড সমালোচিত হলেও সেই সমালোচনা উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর কোনো কাজে লাগে না; বরং ইউরোপীয় জ্ঞানতত্ত্বকেই তা শক্তিশালী করে। ইউরোপীয় জ্ঞানকাণ্ডের এই চরিত্রটি গঠিত হয়েছে খ্রিস্টীয় ভাবজগৎ, পুঁজিবাদী উৎপাদন–পদ্ধতি ও বর্ণবাদী সমাজ–ব্যবস্থা দ্বারা; যেখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, জ্ঞানের সর্বজনীনতা, ”মানুষ” ধারণার সার্বিকীকরণ, সময়ের সরলরৈখিক হিসাব, প্রগতি–উন্নতি, “অপর”–এর অবমূল্যায়ন, সেইসঙ্গে “নিজ”–এর অভিভাবকত্বের দাবির মতো প্রসঙ্গসমূহ তার গঠনকারী নিয়ামকরূপে কাজ করে।
বাংলাদেশের বিউপনিবেশায়ন তত্ত্ব ইউরোপীয় জ্ঞানতত্ত্বের ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সতর্ক। উপনিবেশায়নকে এটি একটি সুসংহত প্রক্রিয়া বলে চিহ্নিত করে। শাসন যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠু পরিচালনার পাশাপাশি, যার লক্ষ্য ছিলো এক ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডের নির্মাণ। হয়েছেও তাই। ঔপনিবেশিক সেই জ্ঞানকাণ্ডে উপনিবেশিতের সত্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে; সেখানে উপনিবেশিতের বাস্তবতা ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা অবমূল্যায়িত হয়; উপনিবেশিতের জীবন–প্রক্রিয়া সম্পর্কে সেখানে হাজির করা হয় এক–ধরনের সত্যভ্রম। একে তো ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ড উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর নিজস্ব জ্ঞানকাণ্ড থেকে তাদের বিচ্ছেদায়ন ঘটায়; দ্বিতীয়ত, উপনিবেশিত জনগোষ্ঠী যখন—ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ড নির্দেশিত—সেই বিকৃত বাস্তবতাকেই তাদের সত্য বলে মেনে নেয়, এতে তারা দ্বি–বিচ্ছেদায়নের কবলে পড়ে। ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডের প্রভাবেই উপনিবেশিত আত্মসত্তায় ”দ্বৈতচিত্ত” জন্ম নেয়। ঔপনিবেশিক প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা ও সেই জ্ঞানকাণ্ডে প্রতিষ্ঠা পাবার প্রচেষ্টা দুই–ই যখন একইসঙ্গে ক্রিয়া করে—চিত্তের সেই দশাই দ্বৈতচিত্ত। বিউপনিবেশায়ন কার্তেশীয় আত্মতত্ত্বে কিংবা ইউরোপীয় চিন্তার ইতিহাসে ব্যক্তির ধারণা যেভাবে বিকশিত হয়েছে, তাতে আস্থাশীল নয়। কেননা, ইউরোপীয় জ্ঞানতত্ত্ব ইউরোপীয় সমাজ–সাপেক্ষ, তা ইউরোপীয় সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যেই বিকশিত। অপরাপর জ্ঞানতত্ত্বকে তা প্রভাবিত করা কিংবা অনুপ্রেরণা যোগানোর ক্ষমতা রাখলেও, অপরাপর সমাজের সমস্যা–সমাধানে তা অক্ষম। এটি এখন প্রমাণিত। যে–কারণে, বিউপনিবেশায়ন ইউরোপীয় জ্ঞানতত্ত্ব পরিহারপূর্বক বাংলা–অঞ্চলের প্রাক–ঔপনিবেশিক জ্ঞানতত্ত্বের সৃষ্টিশীল রূপান্তর ঘটানোর মধ্য দিয়ে নিজস্ব বিশ্লেষণ পদ্ধতি গড়ে নেয়। বিউপনিবেশায়নে গুরুত্ব লাভ করে অভিমুখিতা, আত্মসত্তা, আত্মসত্তার বিচ্ছেদায়ন, দ্বি–বিচ্ছেদায়ন, দ্বৈতচিত্ত, বি–বিচ্ছেদায়ন ও বিদর্শনের মতো ধারণাসমূহ।
বিউপনিবেশায়ন জাতীয়তাবাদ নয়
বিউপনিবেশায়ন আত্মসত্তার কথা বলে যার কোনো বিশেষ রূপ নেই; বিভিন্ন শাখা–প্রশাখার মধ্য দিয়ে তা প্রবাহিত হয়; এমনকি, বিশেষ কালে তার কোনো সামান্য চিত্রও নেই। আত্মসত্তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনশীল; প্রয়োজনের সাপেক্ষে নির্মানাধীন; যে প্রয়োজন ভৌগোলিক ও কালিক। বিউপনিবেশায়ন মনে করে, স্থান–কাল নিরপেক্ষ ও স্থির কোনো ব্যক্তিসত্তা আদতে অবাস্তব। তাই তা আত্মসত্তার ধারণা নির্মাণ করে। আত্মসত্তার এই ধারণা পরিগঠিত হয় বৌদ্ধ সাহিত্য ও দর্শনে ব্যবহৃত চিত্তের ধারণা থেকে। ‘চিত্ত’ পালি শব্দ; যার অর্থ হচ্ছে—সচেতন চিন্তার প্রবাহ। চিত্ত সর্বদা বিষয়কেন্দ্রিক হলেও, এটি কোনো মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা নয়; বরং একটি চলমান প্রক্রিয়া। কোনো বিষয় সম্পর্কিত এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন যে চিন্তা চলতে থাকে তা–ই চিত্ত। যে–কারণে, প্রবাহিত ভাবনাজগতের সঙ্গে তার পূর্বাপর সম্পর্ক থাকলেও তা কোনো সামান্য সম্পর্ক নয়। অথচ, ব্যক্তির ধারণা নির্মাণে এই ধরনের কল্পিত একটা সামান্য সম্পর্ককেই ধরে নেওয়া হয়—যা ভ্রম মাত্র। ঘূর্ণায়মান বৈদ্যুতিক পাখার উদাহরণ দিয়ে এর ব্যাখ্যাটা পরিষ্কার হয়। পাখাটি চালু অবস্থায় তার ডানাগুলোকে পরস্পর সংযুক্ত ও বৃত্তাকার মনে হলেও ডানাগুলো কিন্তু সেই–রকম বৃত্তাকার নয়—ফলে, সেটি তার ভ্রমাত্মক একটি রূপ। মানুষের দৃষ্টিতে প্রতিটি পাখার পূর্বের অবস্থানের রেশ থেকে যাওয়ায় তাদের বৃত্তাকার বলে ভ্রম হয়। তেমনই ব্যক্তির যে সার্বিক চরিত্রটি ইউরোপীয় দর্শনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়, তা–ও এই বৃত্তাকার পাখার মতোই এক–ধরনের ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণ। বিউপনিবেশায়ন যেহেতু ব্যক্তির ধারণায় আস্থা পোষণ করে না, সেহেতু ব্যক্তির মুক্তির জন্যে—ইউরোপীয় পথ ধরে—তাকে শ্রমের বিচ্ছিন্নতা দূরীকরণ কিংবা ব্যক্তি–সম্পত্তির বিলোপসাধনের পথকেই একমাত্র বলে মেনে নিতে হয় না। অথবা তাকে বেছে নিতে হয় না ইউরোপীয় মতাদর্শের উদারনৈতিক পথ।
ফলে, বিউপনিবেশায়ন যে বিচ্ছেদায়নের কথা বলে তা মার্কসীয় বিচ্ছিন্নতা নয়। তবে, শ্রমের বিচ্ছিন্নতাকে মার্কস বিস্তৃভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার বিশ্লেষণে বিচ্ছিন্নতা চারটি মাত্রা নিয়ে ধরা পড়ে। এক) উৎপাদিত পণ্য থেকে বিচ্ছিন্নতা; দুই) উৎপাদনের প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্নতা; তিন) ব্যক্তিসত্তা থেকে বিচ্ছিন্নতা; চার) প্রজাতি সত্তা থেকে বিচ্ছিন্নতা। যদিও এগুলো পৃথক নয়, বরং একটি অপরটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তারপরও, মার্কস বর্ণিত বিচ্ছিন্নতার তৃতীয় মাত্রাটি বিউপনিবেশায়ন বর্ণিত বিচ্ছেদায়নের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। কিন্তু, এক–রকম মনে হলেও তা পৃথক: কারণ, ব্যক্তিসত্তা কিংবা ব্যক্তিসত্তার এমন কোনো সারবস্তুতে বিউপনিবেশায়ন আস্থা রাখে না যা থেকে মূলত বিচ্ছেদায়নটা ঘটে। আত্মসত্তার বিচ্ছেদায়ন সংঘটিত হয় একটি অঞ্চলের অভিমুখিতা থেকে। যেহেতু কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বহুলোকের চিত্তের কোনো সাধারণ চরিত্র থাকা সম্ভব নয়। ফলে সামষ্টিক চিত্তেরও কোনো নির্দিষ্ট রূপ থাকতে পারে না। অথচ, বিভিন্ন ঘরানার চিন্তা–কাঠামোতে হরহামেশাই এই ধরনের সামষ্টিক চিত্তের এক সামান্য চিত্রের পূর্বানুমান পরিলক্ষিত হয়—যা ত্রুটিযুক্ত। ফয়েরবাখের বরাতে মার্কস যাকে ”প্রজাতি সত্তা” বলে মেনে নিয়েছেন। পরবর্তী পর্বে তিনি গড়ে নেন ”শ্রেণি”র ধারণা। এমনকি, জাতি–রাষ্ট্রসমূহ ”জনগণ”–এর যে ধারণা প্রচার করে, তা–ও সেই একই দোষে দুষ্ট। দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ করে; অথবা বিশেষ আদর্শের ঝাণ্ডাবাহী হয়। তেমনই, জাতীয়তাবাদের “জাতি” এক কাল্পনিক, মনগড়া, জিনিস—তার কোনো ভিত্তি নেই। ভাষা–ধর্ম–বর্ণ–ভূখণ্ড–লিঙ্গ যাকেই আশ্রয় করা হোক না কেন, সেগুলোর কোনো থোক, অপরিবর্তনশীল, সত্তা নেই। যে–কারণে, জাতীয়তাবাদী রাজনীতি মাত্রই নেহায়েৎ এক আরোপিত সারবস্তুর পূজা করা ছাড়া আর কিছু নয়। এই কিসিমের কাল্পনিক ও মনগড়া এক সামষ্টিক সত্তা খাঁড়া করে সেই বরাবর গোঁয়ারের মতো ধেয়ে যাওয়ার প্রয়াসকেই বলে দ্বি–বিচ্ছেদায়ন।
বিউপনিবেশায়ন বড়ো পরিসরে কোনো অঞ্চলের অভিমুখিতা লক্ষ্য করে; সেই সাপেক্ষে পর্যালোচনা করে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের স্বতঃস্ফূর্ত জীবন–প্রবাহ। কেননা, ঐতিহাসিক সামষ্টিক চিত্তের একটি সামান্য চিত্র ও অভিমুখিতা পাওয়া সম্ভব। আর, দীর্ঘকালিক ব্যবধান বিবেচনার কারণে অভিব্যক্তি ও অভিমুখিতার এক সামান্য চিত্র পাওয়া গেলেও তা অপরিবর্তনীয় কিংবা শাশ্বত নয়; ভবিষ্যতে তারও পরিবর্তন নিশ্চিত। কিন্তু সেই পরিবর্তন, কালের প্রবাহে সংঘটিত স্বতঃস্ফূর্ত রূপান্তর, জোরপূর্বক ঘটানো কোনো পরিবর্তন নয়। কিন্তু, উপনিবেশায়নের ফলে জোরপূর্বক এই পরির্বতনটাই ঘটানো হয়। এতে সংশ্লিষ্ট অঞলের অভিমুখিতার বদল ঘটে। সে–কারণে, প্রাণ ও প্রকৃতির সঙ্গে সেই অঞ্চলের মানুষের সম্পর্কের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়; বদলে যায় তাদের নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া ও সম্পর্কের ধরন; এর প্রভাব পড়ে মানুষে–মানুষে সম্পর্ক নির্ণয় ও চর্চার ধরনেও; কেননা, এই বদল স্বতঃস্ফূর্ত নয়; বহিরাগত স্বার্থে জোরপূর্বক ঘটানো এই পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অভিমুখিতা থেকে আত্মসত্তার বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ব্যাহত করে জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ; প্রাণের বহুমাত্রিক সম্ভাবনাকে নাকচ করার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত জীবনকে তা খর্বকায় করে তোলে; উপনিবেশায়ন মানবের বিমানবায়ন ঘটায়।
নয়া–উপনিবেশক
কোনো অঞ্চলের অভিমুখিতা থেকে আত্মসত্তার বিচ্ছেদায়নের ফলে তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ ব্যহত হয়। কিন্তু, বিচ্ছেদায়নের পর, আত্মসত্তার কোনো স্থির রূপ নির্ণয়পূর্বক সেই রূপে ফিরে যাওযার তাগাদা অবান্তর। আত্মসত্তার এই ফিরে যাওয়ার চেষ্টা, সেই লক্ষ্যে তার কোনো কল্পিত রূপের নির্মাণ, এবং আরোপিত সেই আত্মসত্তায় ফেরার প্রয়াস দ্বি–বিচ্ছেদায়নের শর্ত তৈরি করে। আত্মসত্তায় ফিরে যাওয়ার কিছু নেই, উপায়ও নেই। আত্মসত্তা স্থির ও অপরিবর্তনশীল কিছু নয়। ফলে, ফিরে যাওয়ার চেষ্টাই ভ্রমাত্মক। এ–কারণে, বিউপনিবেশায়নে দ্বি–বিচ্ছেদায়নের ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কেননা, এই প্রক্রিয়ায় নিহিত থাকে দ্বি–বিচ্ছেদায়নের কবলে পড়ার ঝুঁকি। ইতোমধ্যে অনেকেই বিউপনিবেশায়নে শামিল হয়ে এই দ্বি–বিচ্ছেদায়নের কবলে পড়েছেন। তাছাড়া, যা ঘটে গেছে, যার ফল বর্তমান আছে, তাকে অস্বীকার করাটাই সমাধান নয়। যে–কারণে, বিউপনিবেশায়ন ঘটে যাওয়া উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়া ও তার প্রভাবকে অস্বীকার করে না, জীবন থেকে ঘষে ঘষে তাকে মুছে ফেলার প্রস্তাব দেয় না। আগেই বলা হয়েছে, বিউপনিবেশায়ন সমস্যা–সাপেক্ষ তৎপরতা। যেখানে সমস্যা নেই, সেখানে বিউপনিবেশায়ন অপ্রাসঙ্গিক। যেখানে সমস্যা আছে, কিন্তু সমস্যার কারণ উপনিবেশায়ন নয়, সেখানেও বিউপনিবেশায়ন অকার্যকর। উপনিবেশায়ন ও বিউপনিবেশায়নের সম্পর্ক অনেকটাই রোগ ও সংশ্লিষ্ট ঔষধের মতো। কেবল রোগের সাপেক্ষেই যেমন ঔষধের উপাদানসমূহ কার্যকর হতে পারে, তেমনই উপনিবেশায়ন সমস্যা রূপে হাজির থাকলেই কেবল বিউপনিবেশায়ন কার্যকারিতা লাভ করে।
যেমন, কোনো সমাজ কিংবা রাষ্ট্র মূলত একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের অধিবাসীর পরস্পরের আশা–আকাঙ্ক্ষা ও জীবনস্পৃহাজাত চুক্তি। এই চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্র সেই ভূখণ্ডের অধিবাসীদের জীবন। ফলে, তারা কীভাবে পরিবার গঠন করবে, সামাজিক কিংবা রাষ্টীয় সম্পত্তির বন্টনে শরিকানা–ব্যবস্থা কেমন হবে, কেমন হবে মালিকানার ধরন, কোন আইন দ্বারা তারা পরিচালিত হবে, কেমন হবে বিচার ব্যবস্থা, জ্ঞানের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙিগ কেমন হবে—এ–রকম হাজারো প্রসঙ্গে করা চুক্তি কিংবা বন্দোবস্ত। এখন যদি কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, জীবনের প্রবাহ স্বতঃস্ফূর্ত রাখার জন্য যে চুক্তি, যে বন্দোবস্ত তা যদি প্রাণের টিকে থাকাকেই অসম্ভব করে তোলে তাহলে তা তো সেই নির্দিষ্ট সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের জন্য সমস্যা। এহেন সমস্যার সমাধানের পথ অন্বেষণ করা সেই সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের জ্ঞানচর্চার দায়। যদি দেখা যায় এই সমস্যার কারণ, ঔপনিবেশিক কাঠামোর রাষ্ট্রব্যবস্থা, তাহলে সেই রাষ্ট্রের বিউপনিবেশায়ন ঘটাতে হবে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে, কিন্তু বিগত পঞ্চাশ বছরেও এদেশের জনগণ মুক্তি লাভ করেনি। অনুরূপ, ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক শাসনের সমাপ্তি ঘটলেও—পরবর্তী দুই দশকে মানুষের মুক্তি ঘটেনি। বলা যায়, সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর এবং একাত্তর থেকে অদ্যাবধি শাসন–ব্যবস্থায় কেবল পার্থক্য হয়েছে শাসকের জাত এবং চেহারায় । অর্থাৎ, সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর এবং তৎপরবর্তীকালে শাসকের চেহারা বদলেছে, ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছে, জীবনযাত্রার মানও কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। এমনকি, সাতচল্লিশের পর সমাজে কিংবা রাষ্ট্রে যে বৈষম্যগুলো ছিলো তার খানিকটা অবসানও ঘটেছে স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে; কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ অবরুদ্ধই থেকে গেছে। এই না–হওয়ার অন্যতম কারণ—আমাদের বর্তমান রাষ্ট্র–ব্যবস্থা এবং শাসকগোষ্ঠীর চরিত্র। ঔপনিবেশিক শাসকেরা স্বাধীন বাংলাদেশে প্রায়শই আবির্ভূত হয়েছে স্বৈরশাসক রূপে। এক্ষেত্রে, ঔপনিবেশিক শাসকদের সঙ্গে স্বৈরশাসকদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মিল আছে—প্রথমত, বাংলাদেশের বর্তমান স্বৈরশাসকগোষ্ঠীও ঔপনিবেশিক শাসকদের মতো এদেশের সম্পদ লুট করে দেশের বাইরে নিয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, ঔপনিবেশিক শাসকরা যেমন এই অঞ্চলের মানুষকে শুধু শোষণই করেনি, তাদের মানবিক ও রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মধ্য দিয়ে তাদের অবমূল্যয়ন করেছে, স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশেও তেমনই সেই একই প্রক্রিয়া জারি রেখেছিলো এই দেশের স্বৈরশাসকেরা। স্বাধীন মত প্রকাশের টুঁটি চেপে ধরা, রাজনৈতিকভাবে সঙ্ঘবদ্ধ হতে বাধা দেয়া, যখন তখন কাউকে আটক করা, গুম কিংবা বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা—এই সকল অবমূল্যায়নের প্রক্রিয়াই বিমানবায়ন। অর্থাৎ মানুষের জীবনের যে মূল্য সেই মূল্য থেকে তাকে বঞ্চিত করার প্রক্রিয়ার নামই হচ্ছে বিমানবায়ন। এর অর্থই হলো মানুষকে বস্তুর কাতারে দাঁড় করিয়ে দেয়া; এবং তা সবচেয়ে বেশি পরিমাণে হয় যখন এ–দেশের একজন পুলিশ অফিসার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলে ‘গুলি মারি একটা, মরে একটা, অন্য অন্যগুলো দাঁড়ায়া থাকে‘। এদেশের মানুষকে (নাগরিকের ধারণা কি দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশে) বিমানবে পরিণত করার প্রক্রিয়া এবং সম্পদ লুট করে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়ার তৎপরতা থেকে এই–ই প্রতীয়মান হয়—এদেশের শাসক গোষ্ঠীর স্বৈরতান্ত্রিক ধারা—এক–কালের ঔপনিবেশিক শাসনের যে বৈশিষ্ট্য—তারই উত্তরাধিকার বহন করে।