বাংলা অঞ্চলের ইতিহাসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শিক্ষানবিশ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণার্থে প্রতিষ্ঠা করা হলেও কলেজটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আধুনিক বৈশিষ্ট্যের প্রবর্তন ও বাংলা অঞ্চলের সাংস্কৃতিক রূপান্তরে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। যে–সকল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্রিটিশরা বাংলা অঞ্চলে জ্ঞানতাত্ত্বিক উপনিবেশায়ন ঘটায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির জটিল ভূমিকা ও ভারতবর্ষের ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতের কারণে এর ক্ষমতা–প্রকরণ নির্ণয় করা সহজ ছিল না। যে–কারণে, বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিকবৃন্দ কলেজটিকে কেন্দ্র করে যে–ধরনের জ্ঞানোৎপাদন করেছেন তা চিন্তার ঔপনিবেশিক কাঠামোকে ছেদ করতে পারেনি। ফলে, বরাবর তা ইউরোকেন্দ্রিক সিদ্ধান্তেই পর্যবসিত হয়েছে, অথবা তার সরল নেতিকরণ হয়েছে মাত্র। যার দরুন প্রতিষ্ঠানটি কর্তৃক সৃষ্ট উপনিবেশিকতা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। উপনিবেশিকতা রাজনৈতিকভাবে উপনিবেশবাদের পতনের পরেও জ্ঞানতত্ত্বে তাকে টিকিয়ে রাখে। চিন্তা উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের ধরন ও ভাষা–প্রকৌশল উপনিবেশিতই থেকে যাবার কারণে ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকাটি উপনিবেশবাদের পরিসমাপ্তির পরেও অক্ষতই রয়ে যায়। এই জ্ঞানতাত্ত্বিক চোরাবালি থেকে বেরোবার জন্য প্রয়োজন চিন্তার নতুন কাঠামোর প্রবর্তন, আলোচনার নতুন মাপকাঠি ও পরিভাষা নির্মাণ যা—উপনিবেশায়নের ফলস্বরূপ সৃষ্ট উপনিবেশিকতা নস্যাৎ করে—নিজস্ব জ্ঞানতত্ত্ব সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখবে। বর্তমান প্রবন্ধে বাংলাদেশের বিউপনিবেশয়ান ও লাতিন আমেরিকার বিউপনিবেশিকতার জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসৃত হয়েছে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ সম্পর্কিত চিন্তার কাঠামো পরিবর্তনই এই প্রবন্ধের লক্ষ্য।
বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিকবৃন্দ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে বাংলা গদ্যের উদ্ভবেতিহাসের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। তাই বাংলা গদ্যের ইতিহাস লিখতে গিয়ে কথা তাঁদের যা দিয়েই শুরু হোক না কেন, মূল কৃতিত্ব আরোপ করেছেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ওপর। কেরির হাতে ভার দিয়ে ১৮০১ সালের মে মাসে কলেজটিতে খোলা হয় বাংলা বিভাগ, কথা এগিয়েছে এভাবে, নতুন বিভাগের জন্যে চাই পাঠ্যপুস্তক, আর বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনার দায়িত্ব, শ্রীরামপুর মিশনের বাইবেল ও খ্রিষ্টধর্মবিষয়ক পুস্তক–পুস্তিকা রচনার নেতৃত্ব এবং সাধারণভাবে বাংলা গ্রন্থমুদ্রণের কাজ গিয়ে পড়েছে—মুখ্যত : কেরি, ও গৌণত : তাঁর সহকারীদের ওপর। বিবরণ এই কাঠামোতেই নির্মিতি লাভ করেছে। অর্থাৎ, এই পাঠ্যপুস্তক রচনার মধ্য দিয়েই যেন বাংলা গদ্যের নির্মাণ যুগের আরম্ভ। আর তাই, গদ্যের এই প্রথম পর্বকে ‘ফোর্ট উইলিয়মের পর্ব বা ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ–শ্রীরামপুর মিশনের পর্ব’ নামেই নামকরণ করা হয়েছে। সাধারণভাবে ‘কেরির পর্ব’ বললেও নাকি এতে কোনো ভুল ছিল না।১ বাংলা গদ্যের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে অধিকাংশ ঐতিহাসিক উপর্যুক্ত কাঠামোতেই বক্তব্য পেশ করেছেন। কেউ কেউ যোগ করেছেন, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতগণ ‘বিশেষভাবে পাঠ্যপুস্তক রচনার কাজে বাংলা গদ্যের প্রয়োগ করলেও, দুরূহ জটিল বিষয়ের আলোচনাও তাঁরাই করেছিলেন’ এবং ‘বহু কিছুর চর্চায় এবং কর্ষণে’ তাঁদেরই হাতে বাংলা গদ্য যেমন অনেকটা নিশ্চিত পথ ধরতে পেরেছিল, ‘তেমনি ভাষার বিকাশপথে বাংলা সাহিত্যের পথও’ যে পাকা হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।২
অনেকে আবার শূন্যপুরাণ থেকেই আরম্ভ করে দিয়েছিলেন বাংলা গদ্যের ইতিহাস। তাঁরা উল্লেখ করেছেন, চণ্ডীদাসের চৈত্যরূপ প্রাপ্তি নামক ক্ষুদ্র পুস্তিকার কথা, যেখানে গদ্য–রচনার কিছু নমুনা পাওয়া যায়। বলেছেন, চৈতন্যের প্রিয় পার্শ্বচর রূপগোস্বামির কারিকা ছিলো একটি ক্ষুদ্র গদ্যপুস্তক। উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, সেই সময়ের বাংলা গদ্য কতো প্রাঞ্জল ও গুরুতর বিষয় রচনার সর্বতোভাবে উপযোগী ছিল। কেবল এসবই নয়, তাঁরা দাখিল করেছিলেন বাংলা গদ্যের নমুনাসমূহের এক লম্বা তালিকা।৩ বাংলা সাহিত্যে গদ্যের খামতির কথা তাঁরা মুখ বুজে সহ্য করতে পারেননি। তাই, ইংরেজ কর্তৃক বাংলা গদ্যের অনুপস্থিতির যে অভিযোগ ছিল, জাতীয়তাবাদী আবেগে, তার প্রতিবাদস্বরূপ তাঁরা মেলে ধরেছিলেন বাংলা গদ্যের নমুনার অজস্র ভাণ্ডার। ইংরেজদের বাংলাচর্চার সুবাদে, তাদেরই মতামতের ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়ায়, এভাবেই বাংলা গদ্য আলোচনার কয়েকটি ধারার উদ্ভব ঘটে। একটি পক্ষ ইংরেজদের ভূমিকাকেই অগ্রগণ্য বলে দাবি করেছেন, তো অপর পক্ষ জোর দিয়েছেন দেশীয় গদ্যের নিদর্শনসমূহের ওপর; তৃতীয় পক্ষের কাছে আবার বাংলা গদ্যের নির্মাণে ইংরেজদের ভূমিকাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।৪
হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, ‘এক সময় বাঙলা সাহিত্যের ঐতিহাসিকেরা বাঙলা গদ্য সৃষ্টির প্রায় সমস্ত কৃতিত্ব দিতেন তাঁদের [ইংরেজদের]। এখন চলছে তাঁদের কৃতিত্ব অস্বীকারের সময়। বাঙালি সম্ভবত কখনো সত্যের মুখোমুখি হবে না’।৫ তবে, সত্যটা যে আসলে কী কিংবা সেই সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সড়ক কিন্তু তিনি বাতলে দেননি। তাই কোন পথে গেলে ইতিহাস বোঝাপড়ায় সত্যের দেখা মিলবে—বাংলা গদ্যের ইতিহাস চর্চায়—এই প্রশ্নটি থেকেই গেল। বাড়তি হাজির হলো আরেকটি প্রশ্ন—ভাষার ইতিহাস কি সেই ভাষা–বলা মানুষের ইতিহাস থেকে আলাদা? অর্থাৎ, কোনো ভাষার ইতিহাসকে কি সেই ভাষা–বলা মানুষের ইতিহাস থেকে স্বতন্ত্রভাবে পাঠ করা সম্ভব? বাংলা গদ্যচর্চায় ইংরেজদের ভূমিকার পর্যালোচনা কি শুধুমাত্র স্বীকার বা অস্বীকারের মধ্য দিয়েই ফুরিয়ে যায় কিংবা বাংলা গদ্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কৃতিত্ব কি কেবল গদ্যালোচনার জমিনেই অন্বেষণ করা যথেষ্ট? এই প্রেক্ষিতে সুমন সাজ্জাদ যুক্ত করেছেন আরও কয়েকটি প্রশ্ন: ‘এই কলেজের বিদ্যাচর্চাকে ইতিহাসের ইতিবাচক যোগফল হিসেবে ভাবাই কি চূড়ান্ত? নাকি প্রশ্ন তোলা যায় যে, ঔপনিবেশিক শাসনের যে আধিপত্যবাদী মতাদর্শ সক্রিয় ছিল রাজনৈতিকভাবে, তার সাংস্কৃতিক ও ভাষিক যোজনা ঘটেছে এই প্রতিষ্ঠানে?’।৬
সুমন সাজ্জাদের প্রশ্নে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ নিয়ে নতুন বোঝাপড়া তৈরির সূত্র নিহিত রয়েছে। সেই সুতা ধরে, এই প্রবন্ধে, অনেকদূর পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা থাকবে। উল্লেখ্য যে, ঔপনিবেশিক শাসকদের হাতে গড়া একটি প্রতিষ্ঠানকে সহজেই ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠান বলে চিহ্নিত করা গেলেও, আলোচ্য কলেজটির ক্ষেত্রে কিন্তু, বেশকিছু জটিলতাও রয়েছে। যেমন, ভারতীয় কিংবা বাঙালিদের জন্য নয়, কলেজটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল শিক্ষানবিশ ইংরেজ কর্মকর্তাদের স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞাত করার জন্য। দ্বিতীয়ত, ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে ভারতবর্ষের ভাষা–পরিস্থিতি আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অননুরূপ ছিল। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে স্থানীয় ভাষাসমূহ বিলুপ্ত হওয়ার বদলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তা চর্চার পথ আরও সুগম হয়েছে। ফলে, ইংরেজদের গড়া প্রতিষ্ঠান বলেই যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠান, আর তার যাবতীয় ভূমিকাই নিন্দনীয়, বিবেচনাটি এতো সরল হওয়া অনুচিৎ। বাংলা অঞ্চলে প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা সনাক্তকরণের জন্য ভারতবর্ষের উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ায় ও এর ফলস্বরূপ উপনিবেশিকতা সৃষ্টির কর্মযজ্ঞে তা কীভাবে অংশ নিয়েছিল তার বিশ্লেষণ জরুরি। এক্ষেত্রে, সৈয়দ নিজারের ভারতবর্ষের উপনিবেশায়ন পর্যালোচনা ও পেরুর সমাজতাত্ত্বিক আনিবাল কিহানোর উপনিবেশিকতার৭ ধারণাটি পথ নির্দেশক হয়েছে; উপর্যুপরি শরণ নেওয়া হয়েছে আর্জেন্টাইন তাত্ত্বিক ওয়াল্টার দে মিগনোলোর। ফলে, বাংলা গদ্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ভূমিকা নয়, বর্তমান প্রবন্ধে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠার প্রেক্ষিত, প্রাচ্যচর্চা ও সাম্রাজ্য সংস্থাপনে এর ভূমিকা এবং কলেজটি কীভাবে জ্ঞানতাত্ত্বিক উপনিবেশায়নের হাতিয়ার হয়ে ওঠেছিলো ও এই অঞ্চলে উপনিবেশিকতা গড়ে তুলেছিল—তা–ই খতিয়ে দেখা হবে।
বাণিজ্য থেকে সাম্রাজ্য
ইউরোপীয় অন্যান্য ইস্ট–ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো ইংরেজ ইস্ট–ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও ভারতীয় রপ্তানি–বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে, শুরুতে ইংরেজরাও চেষ্টা করত ভারতীয় শাসকদের সঙ্গে এক–ধরনের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে; কোনো প্রকার বিবাদে না–জড়াতে; কিন্তু, ১৭৪০ সাল নাগাদ পরিস্থিতি ক্রমশ বদলাতে থাকে। ইংরেজ ইস্ট–ইন্ডিয়া কোম্পানির আচরণ হয়ে ওঠে আক্রমণাত্মক। হরহামেশাই তাদের যুদ্ধ করতে দেখা যায়—প্রতিপক্ষ পর্তুগিজ ও ডাচদের বিরুদ্ধে। এমনকি মোগলদের সঙ্গেও তারা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। অবশ্য, এই সকল যুদ্ধের পরিসর এতো বিস্তৃত ছিল না। ইংরেজদের সৈন্য সমাহারের বিস্তৃতিও ছিল অল্প। এক জায়গায় শতাধিক সৈন্য সমাহারের মতো ঘটনাও ছিল বিরল; যেহেতু, সৈন্য–সজ্জার মূল শর্তটিই ছিল—দুর্গ–নির্মাণ, ফ্যাক্টরি ও বাণিজ্যপথ রক্ষা। কিন্তু, স্থানীয় বিবাদে অংশগ্রহণ করা ক্রমেই কোম্পানির জন্য লাভজনক হয়ে ওঠে। বিশেষ করে কোনো এক লড়াইয়ে ফরাসিদের ও কিছু সংখ্যক স্থানীয় সৈন্যকে পরাজিত করার পর ইংরেজদের সাহস যায় বেড়ে; এছাড়া, সামরিক খাতকে আরও শক্তিশালী করার পেছনে তারা বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত দুই ধরনের সুবিধারই হাতছানি দেখতে পাচ্ছিল। ফলে, তাদের জন্য রাজ–রাজড়াদের মৃত্যু ছিল একইসঙ্গে বিপজ্জনক ও আকাঙ্ক্ষিত দুটিই। কেননা, সিংহাসনের দাবিদারদের মধ্যে তখন বেঁধে যেত লড়াই; লড়াইয়ের জন্য সৃষ্টি হতো সৈন্য–সহায়তার চাহিদা। কোম্পানি এক্ষেত্রে পরিস্থিতি নির্ণয়পূর্বক সৈন্য–সহায়তার মাধ্যমে বিবাদে অংশ নিত। এই সময়েই ইংরেজ ইস্ট–ইন্ডিয়া কোম্পানি ঝুঁকিপূর্ণ কয়েকটি লড়াইয়ে জড়ায় ও তাতে জয়লাভ করে; এতে তার ক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়; ১৭৪০ সালের আগে যে পরিমাণ ক্ষমতা কল্পনাই করা যেত না। এই দশকেই কোম্পানির কাঠামো ক্রমশ একটি শাসনতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষের (state) রূপ নেয়; অধীনস্ত ভূখণ্ডবাসীর ওপর যার ছিল বিচারিক ক্ষমতা; ছিল নিজ নামে মুদ্রা ছাপার অধিকার।৮ রইল বাকি এক—কোম্পানি কর্তৃক ভারতবর্ষ সম্পর্কিত জ্ঞানকাণ্ডের নির্মাণ।
১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধে কোম্পানির বিজয়ের পর থেকে কোম্পানি–শাসকদের হাতের তর্জনী সংকেতেই চলছিল সব। আগের আমলের নবাববৃন্দও প্রজাদের শোষণ করতেন, কিন্তু প্রজাদের প্রতি তাদের কমবেশি দায়িত্বও ছিল। কিন্তু কোম্পানি আমলে শাসকদের শোষণ তো বাড়লই, উল্টা দিকে প্রজাদের মঙ্গলার্থে তাদের করণীয় ছিল শূন্য। ওয়ারেন হেস্টিংসের বাংলায় আগমনের (দ্বিতীয় বার) ঘটনা ডেভিড কফ বর্ণনা করেছেন নিম্নোক্ত ভাষায়:
When Warren Hastings returned to Bengal for the second time in 1772, he found himself confronted with what a parliamentary committee spokesman once reffered to as “the most atrocious abuses that ever stained the name of civil government.” A generation of rapacious Company servants in search of quick profits had unabashedly ravaged Bengal and left the once fertile province “a confused heap as wild as the chaos itself.”৯
আসলে, ভারতবর্ষে ইংরেজ ইস্ট–ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য নির্ঝঞ্ঝাট ছিল না। ইংল্যান্ডে বিকাশমান শিল্প–বুর্জোয়ারা এই পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কেননা, ভারতীয় উন্নত মানের সূক্ষ্ম রেশমি ও পশমি বস্ত্রের সঙ্গে ইংল্যান্ডের—রুক্ষ চরকায় কাটা সুতা দিয়ে বয়ন করা—বস্ত্রের প্রতিযোগিতা করা ছিল অসম্ভব। তাই সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ভারত থেকে আমদানি করা বিভিন্ন বস্ত্রাদির বিরুদ্ধে সেখানে তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে।১০ কোম্পানির সঙ্গে ইংল্যান্ডের বিকাশমান এই বুর্জোয়া শ্রেণির দ্বন্দ্ব সহজেই মিটে যাওয়ার মতো কিছু ছিল না। যে–কারণে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কোম্পানির লুটপাট ও নৃশংসতার বিরোধিতা করার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত তারা তাদের অবস্থানের জানান দিয়েছে। এরই ভেতর ঘটে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংসতম ঘটনা। কোম্পানি শাসকদের জঘন্য অর্থলিপ্সার তীব্রতায় ভারতবর্ষে ঘটে মনুষ্যসৃষ্ট সর্বগ্রাসী দুর্ভিক্ষ। এক–সময়ের সমৃদ্ধ প্রদেশ বাংলার এক–তৃতীয়াংশ লোক এতে প্রাণ হারায়। এটি ঘটে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে। অ্যাডাম স্মিথ তার Wealth of Nations (1776) গ্রন্থেও ভারতবর্ষে কোম্পানির একেচেটিয়া বাণিজ্যের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। স্মিথ–পরবর্তী সময়েও, তার উদ্ধৃতি দিয়ে, কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যকে নানাভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। এই সকল সমালোচনার প্রতিক্রিয়ায় ও কোম্পানির কর্মকাণ্ডের ফলস্বরূপ বাজারে কোম্পানির শেয়ারের দাম পর্যন্ত ওঠানামা করতে থাকে যা কোম্পানির জন্য ভালো পরিণতি বয়ে আনেনি। ১৮০০ সালের গোড়ার দিকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোম্পানির অবস্থা ভালো ছিল না। প্রথমত—পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ব্যাপার, দ্বিতীয়ত—শিল্পবিপ্লবের কারণে ইংল্যান্ডের লোকেরাও আর ভারতীয় বস্ত্রের আমদানি চায়নি এবং ভারতীয় তাঁতিরাও কলে বোনা বস্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছু হটেছিল। ফলে, পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যেতে থাকে। গুরচরণ দাস লিখেছেন: Its commercial importance declined in India after the 1820s where it essentially became a political administrator until the British government officially took over India after 1857|১১ বাণিজ্য থেকে সাম্রাজ্য—হেস্টিংস ছিলেন এই রূপান্তরের একজন গুরুত্বপূর্ণ কারিগর। তার আমলেই কোম্পানির তৎপরতায়, বাণিজ্য–বিস্তারের পরিবর্তে, ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে সাম্রাজ্য–প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। তিনি তার পূর্বসূরীদের থেকে গুণগতভাবে নিজেকে পৃথক প্রমাণ করতেও সক্ষম হয়েছিলেন এবং তিনি হয়ে ওঠেছিলেন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ প্রশাসকদের আদর্শ।
হেস্টিংসের প্রশাসনিক সংস্কার–কার্যক্রম
১৭৭৩ সালে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে ‘রেগুলেটিং অ্যাক্টস’ পাস হয়; ওয়ারেন হেস্টিংস হলেন প্রথম গভর্নর জেনারেল; তাকে সহযোগিতার জন্যে গঠিত হলো কাউন্সিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ভারতে একটি নির্ঝঞ্ঝাট প্রশাসন চালাতে গেলে ভারতকে আগে ভালোবাসতে হবে; ভারতকে ভালোবাসতে হলে ভারতীয়দের সঙ্গে মিশতে হবে; আর ভারতীয়দের সঙ্গে মিশতে হলে জানতে হবে তাদের ভাষা। ফলে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্সি ভাষার একটি অধ্যাপক পদ সৃষ্টির তাগাদা দিয়ে ১৭৭৩ সালেই তিনি একটি খসড়া প্রস্তাব দাখিল করেছিলেন। তার মতে, সিভিল সার্ভেন্টদের উর্দু–ফার্সি জেনেই ভারতে আসা উচিত। যেহেতু, উনিশ শতকের প্রথমার্ধ অবধি ফার্সিই ছিল তখনকার প্রশাসন–আইন–আদালত আর কূটনীতির ভাষা। আর হিন্দুস্থানি (উর্দু) ছিল সেই সময়কার লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা। কতিপয় নির্বাচিত ব্যক্তিকে এশীয় সংস্কৃতি–চর্চার প্রতি উৎসাহ ও সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ভাষা শেখার বিষয়টিকে হেস্টিংস সামলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এদের দ্বারাই প্রাচ্যচর্চাকারীদের প্রথম প্রজন্মটি গড়ে ওঠে। হেস্টিংস ভেবেছিলেন, সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে হলে ইংরেজদের এদেশীয়দের মতো করে ভাবতে ও কাজ করতে জানতে হবে; নয়তো ব্রিটিশদের মনে করা হবে আগন্তুক, এতে করে শাসক ও শাসিতের মধ্যেকার সৌহার্দ্য ভেঙে পড়বে, সবশেষে ভেঙে পড়বে সাম্রাজ্যই।১২ ১৭৮৪ সালে, একটি এশিয়াটিক সোসাইটির কথা মাথায় রেখে তিনি লিখেছিলেন:
Nor is the cultivation of language and science, for such are the studies to which I allude, useful only in forming the moral character and habits of the service. Every accumulation of knowledge, and especially such as is obtained by social communication with people over whom we exercise dominion founded on the right of conquest, is useful to the state : it is the gain of humanity : in the specific instance which I have stated, it attracts and conciliates distant affections; it lessens the weight of the chain by which the natives are held in subjection; and it imprints on the hearts of our countrymen the sense and obligation of benevolence.১৩
এই ধারাবাহিকতাতেই ১৭৮৪ সালে, কোম্পানির অর্থ সহায়তায়, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল। প্রতিষ্ঠানটি আসলে কারও একার মাথার কাজ ছিল না—তা হেস্টিংসই হোক, আর জোনস—এটি ছিল সামষ্টিক চাহিদার ফসল। উনিশ শতক অবধি এটি ছিল কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরই প্রতিষ্ঠান। সুপ্রিম কোর্ট বিল্ডিং–এ অথবা কারও ব্যক্তিগত বাসায় অনিয়মিতভাবে চলমান ছিল এর তৎপরতা। আসলে, ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতি দশকব্যাপী কাঁটাছেঁড়া করার পর হেস্টিংস–প্রজন্মের দরকার হয়ে পড়েছিল একটি সুগঠিত প্রতিষ্ঠানের—কারণ, ভারতবর্ষ সম্পর্কে ততদিনে ব্রিটিশদের মধ্যেও ছিল উপচে পড়া কৌতূহল।১৪ ঔপনিবেশিক যুগে প্রাচ্যচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি মজবুত করতে প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আঠারো শতকে এটি প্রকাশ করে বিপুল পরিমাণ গবেষণা পুস্তক; প্রকাশ করে সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি গ্রন্থসমূহের ইংরেজি অনুবাদ। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ওপরও এর ব্যাপক প্রভাব ছিল।
ওয়েলেসলির ‘অক্সফোর্ড অফ দি ইস্ট’
হেস্টিংসের পর গভর্নর জেনারেল হয়ে বাংলায় আসেন তার যোগ্য উত্তরসূরি লর্ড ওয়েলেসলি। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের জুলাইয়ের দশ তারিখ ওয়েলেসলি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কথা ঘোষণা করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি করতে আসা কর্মকর্তাদের এটি গড়ে তুলবে দক্ষ ও নিবেদিত–প্রাণ হিসেবে যারা জোরদার করবে ভারতবর্ষে চলমান ব্রিটিশ শাসন। সেখানে শিক্ষা দেওয়া হবে আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত ও আরও ছয়টি দেশি ভাষা। ইংরেজি আইন ও আইনশাস্ত্রের পাশাপাশি সেখানে চর্চিত হবে হিন্দু ও মুসলিম আইন। পাঠ্য হবে লাতিন, গ্রিক, ইংলিশ ক্লাসিক। ইউরোপের অতীত ও আধুনিক ইতিহাস তো থাকবেই, থাকবে এশিয়াটিক সোসাইটির সহায়তায় হিন্দুস্থানের ইতিহাস ও পুরাকীর্তি সম্পর্কিত কোর্স। শেষ পর্যন্ত যোগ হয় বিজ্ঞান—প্রাকৃতিক ইতিহাস, উদ্ভিদবিজ্ঞান, রসায়ন ও জ্যোতির্বিজ্ঞান। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে বলা হতো ওয়েলেসলির কলেজ। ওয়েলেসলির ‘অক্সফোর্ড অফ দি ইস্ট’। অবশ্য কলেজটির জন্যে কোম্পানির ‘বোর্ড অব ডিরেক্টর’দের সঙ্গে তাকে দরবারও কম করতে হয়নি। এটিকে তিনি তার প্রশাসনের একটি সেরা কীর্তি বলে মনে করতেন, এবং সেই অনুপাতে কলেজটি ব্রিটিশ প্রশাসনে ইতিবাচক ভূমিকাও রাখছিল। বলা হয়ে থাকে যে, ভারতবর্ষে ওয়েলেসলি ছিলেন একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের হোতা, রাজনৈতিক বিপ্লবের চেয়ে যার তাৎপর্য কোনো অংশেই কম ছিল না। এই বিপ্লব ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ দ্বারাই সম্ভব হয়েছিল।১৫ ওয়েলেসলির বিশ্বাস ছিল—‘ The College must stand, or the Empire must fall.’১৬
ওয়েলেসলি আসলে হেস্টিংসের কর্মসূচিরই বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই বিভাগ সাজাতে গিয়ে তাকে নজর ফেরাতে হয়েছে আগের আমলের প্রাচ্যবিদদের দিকে। বিভাগগুলো সাজানো হয়েছিল সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষ ব্যক্তিবর্গদের নিয়েই—ইতোমধ্যেই যারা স্ব–স্ব ক্ষেত্রে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল ফার্সি বিভাগকে, যেহেতু, ফার্সি ছিল মুঘল রাজতন্ত্রের ভাষা। এই বিভাগের দায়িত্ব পেয়েছিলেন নিল বি. এডমুনস্টোন : তিনি ভারতবর্ষে আসেন ১৭৮৩ সালে; ১৭৯১ সালে কর্নওয়ালিস বাংলা ভাষায় বিদ্যমান ‘ক্রিমিনাল ল’ অনুবাদের জন্যে তাকে মনোনীত করেছিলেন। ওয়েলেসলির মতো তিনিও ছিলেন অভিজাত বংশের সন্তান, পরে কাজ করেন গভর্নমেন্টের ফার্সি অনুবাদক হিসেবে, হয়ে ওঠেন কূটনৈতিক দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহী। কলেজের ফার্সি বিভাগে তাকে সহায়তা করতেন : জন এইচ হ্যারিংটন ও ফ্রান্সিস গ্লাডউইন। হ্যারিংটন ছিলেন হাইকোর্টের জজ ও এশিয়াটিক সোসাইটির সক্রিয় সদস্য। আর গ্লাডউইন ছিলেন ভাষা ব্যবহারে পারদর্শী সেনা–কূটনৈতিক—হেস্টিংস যাকে ১৭৮৩ সালে তিব্বত পাঠিয়েছিলেন। ১৭৮৫ সালে গ্লাডউইন ইংরেজি–ফার্সি শব্দভাণ্ডার সংগ্রহ মারফত নিজের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। আরবি বিভাগের জন্যে ওয়েলেসলি ঠিক করেছিলেন লে. জন বেইলিকে। ফার্সির পরেই স্থান দেওয়া হয়েছিল আরবিকে—একে তো মুসলিম দুনিয়ার ভাষা, তার ওপর মুঘল আমলের অনেক আইন বিষয়ক গ্রন্থাবলি ছিল আরবি ভাষায় রচিত। হিন্দুস্থানি ভাষা ও সাহিত্যের ভার পেয়েছিলেন জন বি. গিলক্রিস্ট। গিলক্রিস্ট ১৭৯০ সালের দিকে তার চিকিৎসক ও বণিক জীবন ফেলে কলকাতায় এসে মনোনিবেশ করেছিলেন ভারতীয় লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা চর্চায়। এই চর্চাই প্রাচ্যবিদ হিসেবে তাকে পরিচিতি এনে দেয়। তিনি উর্দু ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন, আর সংকলন করেছিলেন একটি অভিধান। এতে তার প্রতি গভর্নর জেনারেলের নজর পড়ে। ১৭৯৮ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাইলট প্রোজেক্টের ডিরেক্টর হিসেবে তিনি নিয়োগ পেয়েছিলেন। সংস্কৃত বিভাগ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিলো এইচ. টি. কোলব্রুককে। কোলব্রুক ভারতে এসেছিলেন তার আঠারো বছর বয়সে—১৭৮৩ সালে; মাদ্রাজে রাইটার পদে কাজ করতেন তিনি। প্রাচ্যচর্চায় যিনি পরবর্তী সময়ে স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন উইলিয়াম জোনসের। প্রাচ্যবিদ হিসেবে জোনসের চেয়ে, ম্যাকসমুলার, কোলব্রুককেই এগিয়ে রাখতেন।১৭
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলার্চচা
কোম্পানির রাইটারদের আরবি, ফারসি ও হিন্দুস্থানি ভাষা শেখানোর কাজ যখন কিছুদূর এগিয়েও গিয়েছে, তখন পর্যন্ত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ভাষা শেখানোর কোনও বন্দোবস্ত করা সম্ভব হয়নি। বাংলা–বিভাগের ভার গ্রহণ করতে পারেন, এমন কোনও ইংরেজ সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ অবগত ছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে, ১৮০১ সালের শুরুর দিকে, শ্রীরামপুর মিশন থেকে নিউ টেস্টামেন্ট–এর বাংলা অনুবাদ বেরোয়। অনুবাদকর্মটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উইলিয়াম কেরির ওপর লর্ড ওয়েলেসলির নজর পড়ে। তারই নির্দেশ মোতাবেক কলেজের প্রাধ্যক্ষ ডেভিড ব্রাউন বাংলা–বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে কেরিকে চিঠি লেখেন। ১৮০১ সালের ১ মে থেকে কেরি নিযুক্ত হন এবং ৪ মে থেকে কলেজে যোগদান করেন।১৮
ভারতবর্ষে আসার পর প্রথম দিকে কেরিকে নিদারুণ আর্থিক কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল। অর্থাভাবে শহরে টিকতে না–পেরে, কলকাতায় পৌঁছার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই, চলে গিয়েছিলেন হুগলির ধারে পর্তুগিজ উপনিবেশ ব্যান্ডেলে। ব্যান্ডেলেও সুবিধা করে ওঠতে পারেননি। ব্যান্ডেল থেকে নবদ্বীপে, নবদ্বীপ থেকে আবারও কলকাতায় ফেরেন কেরি। পরিস্থিতি এতোটাই খারাপ ছিল যে তার স্ত্রী, ডরোথি, অর্ধোন্মাদের মতো হয়ে গিয়েছিলেন।১৯ কেরি ছিলেন একজন মিশনারি, তার কাজ ছিল খ্রিস্টীয় ধর্মের প্রচার ও প্রসার। বাংলা ভাষার প্রতি তার দরদের উৎসও এটিই। ডেভিড কফ লিখেছেন, ‘Carey chose Bengali not for its inherent beauty but for its potential usefulness as the most effective medium for reaching the masses of Bengal’।২০ অর্থাৎ, বেশি বেশি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য ছিল বেশি বেশি যিশুর বাণীর প্রচার। যদিও বাংলা ভাষার সঙ্গে তার সম্পর্ক, উপর্যুক্ত রেখা বরাবর, একমাত্রিকভাবে নিরূপণ করা যাবে না, কিন্তু মাত্রাটি বিস্মরিত হওয়াও অনুচিৎ। বিশেষ করে বাংলা অঞ্চলে যিশুর বাণীর প্রচারের সঙ্গে যেখানে সাম্রাজ্য ও উপনিবেশ সংস্থাপন সম্পর্কহীন ছিল না। চার্লস গ্রান্টের বরাত দিলেই প্রসঙ্গটি সহজে বোঝা যায়। গ্রান্ট ছিলেন কোম্পানির প্রভাবশালী ডিরেক্টরদের একজন, যিনি মনে প্রাণে বিশ^াস করতেন : ভারতবর্ষের মাথা মাথা লোকগুলো খ্রিস্টান না হয়ে গেলে ভারতে ব্রিটিশ শাসন টিকিয়ে রাখা মুশকিল। কারণ, গ্রান্টের চিন্তায়, দুটো জাতির মধ্যে তখন এক অভেদাত্মা পরিস্থিতি তৈরি হবে না। এছাড়া, তিনি বিশ্বাস করতেন ইংরেজি শিক্ষা ও খ্রিস্টীয় ধর্মের দীক্ষা মানুষগুলোকে আরও পরিশ্রমী করে তুলবে, দেখা দেবে দারিদ্র্যদূরীকরণ কর্মসূচি হয়ে; আর সব কথার আসল কথা— incidentally, creat a market for British manufacturers।২১
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে কেরি পেলেন সবই। তার নিয়ন্ত্রণে তখন গোটা একটি বিভাগ। অর্থের সমস্যা নেই, লোকবলের অভাব নেই, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অন্তর্নিহিত প্রণোদনা তো আছেই। তখন তিনি কাজে লেগে যান। অভাব কেবল পাঠ্যপুস্তকের। নিজে লিখলেন, লিখিয়ে নিলেন পণ্ডিতদের দিয়ে। পণ্ডিতগণের নাম ও কর্মের তালিকাটায় চোখ বুলালে এক নজরে তাদের কর্মতৎপরতার পরিচয়টি ফুটে ওঠে। তালিকাটা নিম্নরূপ:
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতগণের নাম, গ্রন্থের নাম ও প্রকাশ সাল:২২
-
পণ্ডিতদের নাম
গ্রন্থের নাম
প্রকাশ সাল
১. রামরাম বসু
রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র
১৮০১
২. মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার
বত্রিশ সিংহাসন
প্রবোধচন্দ্রিকা
১৮০২
১৮৩৩
৩. গোলোকনাথ শর্মা
হিতোপদেশ
১৮০২
৪. তারিণীচরণ মিত্র
ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্ট
১৮০৩
৫. চণ্ডীচরণ মুন্শী
তোতা ইতিহাস
১৮০৫
৬.রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং
১৮০৫
৭.রামকিশোর তর্কচূড়ামণি
হিতোপদেশ
১৮০৮
৮. মোহনপ্রসাদ ঠাকুর
ইংরেজী–বাংলা শব্দকোষ
ইংরেজী–ওড়িয়া অভিধান
১৮১০
১৮১১
৯. হরপ্রসাদ রায়
পুরুষপরীক্ষা
১৮১৫
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সংঘটিত এই কর্মযজ্ঞের ফলে বাংলা গদ্য বিকাশের এক ভিন্ন পথ ধরল। ইংরেজরা তাদের প্রয়োজনোপযোগী করে নির্দিষ্ট ছাঁচে গড়ে নিল এক নতুন বাংলা গদ্য। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর্যালোচনাটি সরস। তিনি লেখেন:
বাংলা গদ্য সাহিত্যের সূত্রপাত হইল বিদেশীর ফরমাশে, এবং তার সূত্রধার হইলেন সংস্কৃত পণ্ডিত, বাংলা ভাষার সঙ্গে যাঁদের ভাসুর–ভাদ্রবউয়ের সম্বন্ধ। তাঁরা এ ভাষার কখনো মুখদর্শন করেন নাই। এই সজীব ভাষা তাঁদের কাছে ঘোমটার ভিতরে আড়ষ্ট হইয়া ছিল, সেইজন্য ইহাকে তাঁরা আমল দিলেন না। তাঁরা সংস্কৃত ব্যাকরণের হাতুড়ি পিটিয়া নিজের হাতে এমন এক পদার্থ খাড়া করিলেন যাহার কেবল বিধিই আছে কিন্তু গতি নাই। সীতাকে নির্বাসন দিয়া তাঁরা সোনার সীতা গড়িলেন।২৩
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই নির্ণয়কে অন্যত্রও প্রয়োগ করা চলে। অর্থাৎ, শুধুমাত্র বাংলা গদ্যের ক্ষেত্রেই এ–ঘটনা ঘটেনি, ভারতবর্ষ সম্পর্কে জ্ঞানকাণ্ড নির্মাণের ক্ষেত্রেও তারা গড়ে তুলেছিলেন অচল, অসাড়, প্রাণহীন এক ‘সোনার ভারতবর্ষ’ এবং নির্মিত সেই জ্ঞানকাণ্ডে সত্যের চেয়ে সত্যভ্রম ছিল বেশি, যা বাংলা অঞ্চলে জ্ঞানতাত্ত্বিক উপনিবেশায়ন ঘটিয়েছে।
জ্ঞানতাত্ত্বিক উপনিবেশায়ন
ইংরেজ ইস্ট–ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের ভারতবর্ষ সম্পর্কে জ্ঞান ছিল অত্যন্ত সীমিত। শাসনকার্য পরিচালনার জন্য, যে–কারণে, ভারতবর্ষ বিষয়ক তথ্যসংগ্রহ করা তাদের জন্য অপরিহার্য ছিল। আর তা কেবল মানচিত্র তৈরি এবং যাতায়াতের সুবিধার্থে রাস্তাঘাট নির্মাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রয়োজন ছিল এ–অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি ও মনস্তত্ত্বঅধ্যয়নেরও। এ–কারণেই এই অঞ্চলের শিল্প, সাহিত্য, ভাষা, দর্শন ও ধর্মের অধ্যয়ন শুরু হয়। প্রধানত এর লক্ষ্য ছিল দুইটি : এক—শাসনকার্য পরিচালনার জন্য বাঙালিসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ; দুই—আঠারো এবং উনিশ শতক থেকে প্রত্মনিদর্শনের বাজারমূল্য বৃদ্ধি। ফলে, শুরু হলো ভারতবর্ষের শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চা যা ‘ভারতবিদ্যা’ বা ‘প্রাচ্যবিদ্যা’ নামে পরিচিত। এই প্রাচ্যবিদ্যার প্রভাবেই ভারতীয় চিন্তা প্রাচ্যবাদী অপব্যাখ্যার কবলে পড়ে। সৈয়দ নিজার এই আলোচনাটি করেছেন ভারতীয় শিল্পকলা প্রসঙ্গে যা ভাষা, সংস্কৃতি ও দর্শনচর্চার ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক। তার মতে, ভারতবর্ষে শিল্পচর্চার দীর্ঘ ইতিহাস থাকলেও সেই ইতিহাসের ওপর কোনো গ্রন্থ না–থাকায় প্রত্মনিদর্শন অধ্যয়নের দ্বারাই ভারতীয় শিল্পকলার প্রথম ইতিহাস গড়ে ওঠেছিল এবং সেই ইতিহাস প্রাচ্যবাদ, উপনিবেশের রাজনীতি ও পুঁজির প্রভাবের বাইরে ছিল না। তিনি উইলিয়াম জোন্সকৃত ভারতশিল্প মূল্যায়নের বরাত দেন। যেমন, জোন্স মনে করতেন ভারতীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্প নয়; বরং প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন মাত্র; চিত্রকলা ও ভাস্কর্য এখানে ব্যবহৃত হয়েছে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হিসেবে।২৪
অপর পক্ষে, জেমস ফার্গুসন ও আলেকজান্ডার কানিংহামের ভারতশিল্পকলার পাঠ ধারাবাহিক শিল্পচর্চার যে ঐতিহ্য ভারতে ছিল সেই পরম্পরায় বিযুক্তি সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করেছে। নিজারের বিবেচনায়, সেই পাঠ ছিল একদম অপরিপক্ব; স্থানীয় তথ্য–উপাত্তের সঙ্গে যার কোনো যোগ ছিল না। তার মতে, তাদের কাজের মধ্য দিয়েই ভারতশিল্প প্রথম পর্যায়ের উপনিবেশায়নের শিকার হয়। কেননা, কানিংহাম হাজির করেছিলেন ভারতীয় শিল্পের ধর্মনির্ভর ব্যাখ্যা; ফলে তারও সুর ছিল অনেকটা জোন্সের মতোই। আরেকদিকে—জোন্স ও কানিংহামের থেকে স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা দিলেও, ফার্গুসন বললেন, ভারতশিল্পে রিয়ালিজমের ঘাটতি আছে; এই কারণে তা অনুন্নত; তার বাস্তবতাকে উপস্থাপনের ক্ষমতা নেই; আর উন্নত শিল্পকর্ম তাই, ফার্গুসনের মতে, যার বাস্তবতাকে উপস্থাপনের ক্ষমতা আছে। তার দাবি—আধুনিক ইউরোপীয় শিল্পকলা রেনেসাঁ–উত্তরকালে অনুকরণ প্রবণতাকে ছাড়িয়ে গেছে; আর সে কারণেই তা ভারতসহ অন্যান্য প্রাচীন শিল্পকলা থেকে উন্নত।২৫
ব্যাকরণ গ্রন্থ লিখতে গিয়ে হ্যালহেডও ঠিক একই কাজ করেছিলেন—আবিষ্কার করলেন বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ‘পড়তি দশা’র তত্ত্ব। কেননা, ইউরোপীয় ব্যাকরণের নিয়মানুযায়ী বাংলা ভাষাকে ব্যাখ্যা করা তার জন্য কঠিন হচ্ছিল। তিনি এর দায় চাপালেন বাংলা ভাষার ওপর। কারণ হিসেবে দাখিল করলেন : এক—ভাষা খুইয়ে বসেছে তার অন্তর্নিহিত সামান্য বিধি; দুই—বচন ও সাহিত্যিক অভিব্যক্তির মধ্যেও নেই কোনো স্পষ্ট ভেদরেখা। অবিধিবদ্ধ বানান ও শব্দ–প্রকরণও তাকে চটিয়েছিল বেশ। তাছাড়া, তিনি নাকি জানতেন বাংলা সাহিত্যের সুবিশাল ভাণ্ডারের কথা, অথচ খুঁজে পেতে দেখলেন আধা ডজনের একটি বেশিও প্রাচীন গ্রন্থ নেই কোথাও।২৬ হ্যালহেডের ব্যাকরণ গ্রন্থের (১৭৭৭–৮ খ্রি.) জন্য হুগলিতে ছেনি কেটে বাংলা হরফ তৈরি করেছিলেন চার্লস উইলকিনস। গ্রন্থটির উদাহরণ ও উদ্ধৃতিতে প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হয়েছিল বাংলা ছাপার হরফ। ছাপার এই হরফের জন্য কোম্পানির তাড়াহুড়ার অন্ত ছিল না। এর অবশ্য অন্যতম কারণ ছিল—জালিয়াতি থেকে নিস্তার পাওয়া।২৭ কোম্পানির কাজে বাংলা ছাপার হরফের গুরুত্ব উপলব্ধিপূর্বক হ্যালহেড তার গ্রন্থের ভূমিকাতেও উইলকিনসের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। ২৮ কোম্পানির বাণিজ্যিক ও শাসনতান্ত্রিক লাভালাভের প্রসঙ্গ তো আছেই, উপরন্তু, তার বক্তব্যে এদেশীয়দের প্রতি কোম্পানির কর্মকর্তাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিচয় মেলে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার চিন্তায় উপনিবেশক প্রভু ও উপনিবেশিত ভৃত্যের দ্বৈতবাদী সম্পর্ক স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়।
ঔপনিবেশিক জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিসরে, এভাবে প্রতিটি তৎপরতার মধ্য দিয়েই, ঔপনিবেশিক বিষয়ী ও উপনিবেশিত বিষয়ের নির্মাণ ঘটতে থাকে। ইউরোপীয় জ্ঞানকাণ্ডে উপনিবেশিত ‘অপর’ নির্ণীত হয়েছে ‘বর্বর ও অসভ্য’ রূপে; আর নিজেদের ‘আত্ম’কে ইউরোপীয়রা প্রতিষ্ঠা করেছে ‘সভ্য’ চেহারায়। ইউরোপীয় গবেষকদের দৃষ্টিতে তাই অ–ইউরোপীয় শিল্প–সংস্কৃতি–ভাষা–সাহিত্য হয়ে ওঠে আদিম, অশ্লীল, বর্বর, উন্নয়নশীল কিংবা পতনোন্মুখ। ইউরোপীয়রা ‘যুক্তিবাদী’, আর অ–ইউরোপীয়—‘অযুক্তিবাদী’। ভারতের ক্ষেত্রে এই ‘অযুক্তি’র জায়গা নিয়েছিল ‘অধ্যাত্মবাদ’। ভারত তাই চিহ্নিত হয়েছিল ‘অধ্যাত্মবাদী’ হিসেবে। এই ধরনের নির্মাণ উপনিবেশিতের ইতিহাস ও বাস্তবতা সম্পর্কে সত্যভ্রম প্রতিষ্ঠা করেছে; যার দ্বারা উপনিবেশায়নের শিকার হয়েছে উপনিবেশিতের মনোজগৎ। ফানো, নগুগিসহ অন্যান্য তাত্ত্বিকগণ এই মনোজাগতিক উপনিবেশায়নের কথাই বলেছেন। ভারতের ক্ষেত্রেও যার ব্যত্যয় ঘটেনি।২৯
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে স্থানীয় ভাষাসমূহের চর্চার মাধ্যমে একইসঙ্গে স্থানীয় ভাষায় চিন্তার নতুন ধরনেরও বিকাশ ঘটেছিল যা সেই ভাষা ব্যবহারকারী মানুষের আত্ম–উপলব্ধি ও কল্পলোককে প্রভাবিত করেছে। ইউরোপীয় চিন্তার কাঠামোতে বিরাজমান বিষয়ী ও বিষয়ের যে স্পষ্ট ভেদরেখা, নিজ ও অপর সম্পর্কিত বৈষম্যপূর্ণ যে জ্ঞান তা স্থানীয় ভাষায় আত্মস্থ হয় এবং সেই ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডে স্থানীয় অধিবাসীরা তাদের স্বীয় অবস্থান সম্পর্কেও জ্ঞাত হয়। ভাষাচর্চা যে সাদাসিধা ভাষানুশীলন নয়, তা হতেও পারে না, তার একটি স্পষ্ট নমুনা হাজির করা যাক। রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় যে গ্রন্থটি লিখে সেই কালে ১০০ টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন তার নাম—মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং। রাজীবলোচন তার গ্রন্থে লিখেছিলেন:
… অতএব দেশের কর্ত্তা জবন থাকিলে কাহারু ধর্ম্ম থাকিবে না এবং জাতিও থাকিবে না… তখন সকলে জিজ্ঞাসা করিলেন কি পরামর্শ কহ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কহিলেন সকলে মনোযোগ করিয়া শ্রবণ করুণ।
এ দেশের অধিকারী সর্ব্বপ্রকারে উত্তম হন এবং অন্য জাতি ও এ দেশীয় না হন তবেই মঙ্গল হয়। জগৎসেট কহিলেন এমন কে তাহা বিস্তারিয়া কহ রাজা কহিলেন বিলাতে নিবাস জাতে ইঙ্গরাজ কলিকাতায় কোঠি করিয়া আছেন যদি তাঁহারা এ রাজ্যের রাজা হন তবে সকল মঙ্গল হবেক। ইহা শুনিয়া সকলেই কহিলেন তাঁহারদিগের কি২ গুণ আছে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কহিলেন তাঁহারদিগের গুণ এই২ সকল সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় পরহিংসা করেন না যোদ্ধা অতিবড় প্রজাপতি যথেষ্ট দয়া এবং অত্যন্ত ক্ষমতাপন্ন বুদ্ধিতে বৃহস্পতির ন্যায় ধনেতে কুবের তুল্য ধার্ম্মিক এবং অর্জ্জুনের ন্যায় পরাক্রম প্রজা পালনে সাক্ষাৎ যুধিষ্ঠির এবং সকলে ঐক্যতাপন্ন শিষ্টের পালন দুষ্টের দমন রাজার সকল গুণ তাঁহারদিগের আছে অতএব যদি তাঁহারা এ দেশাধিকারী হন তবে সকলের নিস্তার নতুবা জবনে সকল নষ্ট করিবেক।৩০
অর্থাৎ, ঔপনিবেশিক শাসনের যে আধিপত্যবাদী মতাদর্শ রাজনৈতিকভাবে সমাজে সক্রিয় ছিল, উদ্ধৃত অংশের মতো করেই জ্ঞানকাণ্ডে তার সাংস্কৃতিক ও ভাষিক যোজনা ঘটেছে। রাজীবলোচন যে–সকল বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ‘জবন–ইঙ্গরাজ’ ভেদ বিস্তার করলেন, আর তাতে ভারতবর্ষীয় মহিমা লেপন করলেন, তার অন্যথা হওয়ার সুযোগও আসলে রাজনৈতিকভাবে সমাজে তখন গরহাজির ছিল। তিনি তার বাক্যগ্রন্থনে যে–ধরনের অলঙ্কারের সমাবেশই ঘটাতেন না কেন, তার গন্তব্য একই রয়ে যেত, কেননা তা এক–প্রকার নির্ধারিতই ছিল। ইউরোপীয় জ্ঞানকাণ্ডে ঔপনিবেশিক ‘অপর’–এর নির্মাণ সম্পর্কে তো আগেই বলা হয়েছে। তারই নমুনা পরিলক্ষিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষার্থী–শিক্ষক সম্পর্কে। নিখিল সুর লিখেছেন:
একেবারে প্রথম থেকেই কলেজের মুনশিদের প্রতি অধিকাংশ ছাত্র শ্রদ্ধাশীল ছিল না। তার অনেক নজির রয়েছে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ইতিহাসে। ১৮০৬–এর এপ্রিলে জনৈক ছাত্র মুনশি নজরউল্লাহ–এর সামনে একটা ছবি ধরে তাঁকে মাথা নত করতে বলে। সে সময় মুনশি বসে ছিলেন এবং চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াননি। তিনি ছাত্রটির নির্দেশ অমান্য করায় তাঁর কাছ থেকে ছাত্রটি চেয়ারটা কেড়ে নেয়। মুনশি এই আচরণের প্রতিবাদ করলে ছাত্রটি তাঁকে গালাগালি দিয়ে ঘোড়ায় চাবুক দিয়ে প্রহার করতে উদ্যত হয়। মুনশি অভিযোগ জানান কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু গভর্নর জেনারেল শুধুমাত্র তার কড়া নিন্দা করে কর্তব্য সারেন।… ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে এমন আর একটি ঘটনা ঘটে যেখানে কেনেডি নামে এক ছাত্র আক্ষরিক অর্থে প্রহার করে শিক্ষক আনন্দ শর্মাকে। পরের বছর প্রহৃত হন গোলাম হোসেন।… এটা ঘটনা যে, যেহেতু অধিকাংশ নেটিভ মুনশি ভাল ইংরেজি জানতেন না, তাই তাদের হেয় জ্ঞান করত অধিকাংশ তরুণ ইংরেজ ছাত্র। দিন যত গড়িয়েছিল, তারা এ বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছিল যে, তারা শাসকের জাতি, মুনশিরা শাসিত। ১৮৪০–এর দশকের পর থেকে এই ধারণা ক্রমশ শেকড় চালিয়ে দিয়েছিল অধিকাংশ তরুণ সিভিলিয়ানের মনে। অনুমান করতে অসুবিধে হয় না যে, তাদের এই ধারণাকে প্রশ্রয় দিয়েছিল খোদ কলেজের কর্তৃপক্ষ।৩১
ইউরোপ যে কাঠামোয় উপনিবেশিত বাদবাকি–দুনিয়ার সাপেক্ষে তার ‘আত্ম’কে নির্মাণ করেছে, জ্ঞানকাণ্ডে সংরক্ষণ করেছে সেই ‘আত্ম’–এর কেন্দ্রীয় ভূমিকা, সেই সাপেক্ষেই নির্মাণ করেছে ‘অপর’–এর চরিত্র। ‘অপর’–এর সঙ্গে ‘আত্ম’–এর এই সম্পর্ক ইউরোপীয় জ্ঞানকাণ্ডে সংরক্ষিত হয়েছে বিষয়ী ও বিষয়ের সম্পর্কসূত্রে। তাই, উপর্যুক্ত ঘটনাসমূহের রাজনৈতিক কারণের বাইরেও সংশ্লিষ্ট জ্ঞানতাত্ত্বিক যুক্তিবোধ উপনিবেশিত সমাজে অবশিষ্ট থেকেই গেছে। ফলে, ঘটনারসমূহের কারণ তার রাজনৈতিক অভিব্যক্তির মধ্যেই কেবল সীমাবদ্ধ থাকেনি, নিজেকে তা লুকিয়ে ফেলেছে ইউরোপীয় জ্ঞানকাণ্ডে—ইউরোপীয় যৌক্তিকতায়—গড়ে তুলেছে উপনিবেশিকতা। এই উপনিবেশিকতাই উপনিবেশবাদের রাজনৈতিক পরিসমাপ্তির পরেও সংশ্লিষ্ট সমাজে তাকে টিকিয়ে রাখে।
উপনিবেশিকতা
পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো কর্তৃক অ–ইউরোপীয় অঞ্চলসমূহে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব জারি রাখার আনুষ্ঠানিক কায়দাস্বরূপ যে ইউরোকেন্দ্রিক উপনিবেশবাদ, বলতে গেলে, তা এখন অতীত প্রসঙ্গ। অর্থাৎ, রাজনৈতিকভাবে, বিশেষত আনুষ্ঠানিক ও প্রকাশ্য চেহারায়, উপনিবেশবাদের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।৩২ ফলে, বর্তমান সময়ে যে উপনিবেশবাদের আলোচনা–পর্যালোচনা চলে তা রাজনৈতিক উপনিবেশবাদ নয়, যদি আমরা তর্কের খাতিরে ‘রাজনীতি’ বর্গটিকে সংস্কৃতি ও জ্ঞানতত্ত্বথেকে আলাদা করে নিই। উপনিবেশবাদের পর্যালোচনায় তাই ভূমি অধিগ্রহণ, সম্পদের লুট ও শারীরিক পীড়ন ছাড়াও মনোজাগতিক নিয়ন্ত্রণ ও জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রভাবও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ও মেননি, মেমি ও ফানো তত্ত্বীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন যে, প্রত্যক্ষ উপনিবেশের চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক উপনিবেশের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়। তাদের মতে, উপনিবেশোত্তর রাষ্ট্রগুলোর উপর মনস্তাত্ত্বিক উপনিবেশবাদ এখনও জারি আছে। মনস্তাত্ত্বিক উপনিবেশায়নকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায় : এক—ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ড নির্মাণপ্রকল্প, যেখানে উপনিবেশিতের ইতিহাস ও বাস্তবতার বয়ান থাকে, যাতে সত্য থেকে সত্যভ্রম থাকে বেশি; দুই—সেই জ্ঞানকাণ্ড প্রচার ও প্রসারের মধ্য দিয়ে উপনিবেশিতের চৈতন্যে আধিপত্য বিস্তার; যার ফলে, উপনিবেশিত জনগোষ্ঠী যেমন আত্মবিশ্বাস হারায় তেমনই হয়ে ওঠে অনুকরণপ্রবণ।৩৩
কিহানোও উপনিবেশায়নের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভূমিকাটিকেই প্রধান বিবেচনা করেছেন। এর দ্বারা ইউরোপীয় আত্মতত্ত্বও প্রাদেশিক যুক্তিকাঠামোটি সর্বজনীনরূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তিনি তার উপনিবেশিকতার ধারণা দিয়ে উপনিবেশিত সমাজের উপনিবেশোত্তর জ্ঞানতত্ত্বব্যাখ্যা করেছেন। তার ভাবনায়, উপনিবেশবাদ নির্দেশ করে এক–ধরনের রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক সম্পর্ক যেখানে একটি দেশের সার্বভৌম ক্ষমতা অপর আরেকটি কর্তৃত্ববাদী দেশের উপর ন্যস্ত থাকে, কর্তৃত্বপরায়ণ দেশটিকে যা গড়ে তোলে একটি সাম্রাজ্য হিসেবে। অন্যদিকে, উপনিবেশিকতা উপনিবেশায়নের পরিণতি হিসেবে গড়ে ওঠা দীর্ঘস্থায়ী এক ক্ষমতা–সম্পর্ক যা ঔপনিবেশিক প্রশাসনের আওতা–বহির্ভূত সংস্কৃতি, শ্রম, আন্তঃবিষয়ী সম্পর্ক ও জ্ঞানোৎপাদনকে সংজ্ঞায়িত করে। উপনিবেশিকতা উপনিবেশবাদ টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার এবং বই–পুস্তক, বিদ্যায়তনিক তৎপরতা, সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, প্রাত্যহিক বোঝাপড়া, সাধারণের আত্ম–ভাবনা, আত্মবোধের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও অন্যান্য আধুনিক যাপনাভিজ্ঞতায় এটি সুপ্তাবস্থায় রয়ে যায়। যে–কারণে, একজন আধুনিক বিষয়ী প্রতিদিন ও প্রতিটি মুহূর্ত উপনিবেশিকতার মধ্যেই দম নেয়।৩৪
ইউরোপীয় চিন্তা জ্ঞানের যে যৌক্তিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, কিহানোর বিবেচনায়, তার মৌলিক পূর্বানুমানটিই প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা, জ্ঞান সেখানে উপলব্ধ হয় বিষয়ী–বিষয় সম্পর্কের উৎপাদন হিসেবে যা দার্শনিক দেকার্তের আত্মতত্ত্ব (cogito) দ্বারা প্রভাবিত। তাতে ‘বিষয়ী’ বর্গটি দ্বারা নির্দেশিত হয় বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি, কারণ নিজেই তা নিজের মধ্যে ও নিজের জন্য, বয়ানের নিজস্ব পরিসীমায় এবং জাহির করার সাধ্যের ভেতর নিজেকে সংগঠিত করে; আর ‘বিষয়’ কেবল ‘বিষয়ী’/ ব্যক্তি থেকে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব–নির্দেশক বর্গই নয়, পরেরটি থেকে তা বৈশিষ্ট্যগতভাবেও পৃথক। সেখানে ‘বিষয়’ ও তার সত্তা অভিন্ন; যেহেতু, তা পরিগঠিত হয়েছে ‘সম্পত্তি’ দ্বারা—যা তার পরিচয় নির্মাণ করে ও তাকে সংজ্ঞায়িত করে। কিহানো ব্যক্তি ও ‘বিষয়ী’র এই ব্যক্তিতান্ত্রিক চরিত্রকে ত্রুটিপূর্ণ মনে করেন, কারণ, আন্তঃবিষয়ীতা ও সামাজিক অখণ্ডতাকে সকল প্রকার জ্ঞানের উৎপাদনক্ষেত্র হিসেবে অস্বীকার করার মাধ্যমে—যেকোনো অর্ধসত্যের মতো—এটি সমস্যাকে আরও ঘোলাটে করে।৩৫
একইভাবে, সমাজকে বোঝার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় চিন্তাকাঠামোয় প্রয়োগ করা হয় অবয়ববাদী ধারণা, যেখানে গোটা সমাজটাকে কল্পনা করা হয় একটি দেহের আদলে। বিশেষত, মানবদেহের গঠনানুযায়ী, এবং প্রতিটি অঙ্গ সেখানে বিন্যাসিত হয় কর্তৃত্বক্রমানুযায়ী। যে–কারণে, মস্তিষ্ক হয়ে ওঠে এমন একটি অঙ্গ—বাদবাকি দেহটাকে যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালিত করে—বাদবাকি অঙ্গ–প্রত্যঙ্গসমূহ যার প্রতি আনুগত্যের সম্পর্ক বজায় না–রেখে টিকতেই পারে না। এই নকশানুযায়ী, কারখানার ক্ষেত্রে এই পরিচালকের ভূমিকা গ্রহণ করে পুঁজিপতি, সমাজের ক্ষেত্রে এই ভূমিকা নেয় বুর্জোয়া শ্রেণি, আর উপনিবেশগুলোতে উপনিবেশকেরা। এই সূত্রেই উপনিবেশিতেরা হয়ে ওঠেছিল ‘সাদা মানুষদের বোঝা’।৩৬ সভ্যতার পথ ধরে তাদের বহন করার দায় ইউরোপীয়রা নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। দায় নিয়েছিল আলো বিতরণের। গোটা দুনিয়া জুড়ে ইউরোপীয়দের উপনিবেশ স্থাপনের আরেক উছিলা ছিল আধুনিকতা। কিহানো ও মিগনোলো একে বিবেচনা করেন উপনিবেশিকতারই উল্টা পিঠ হিসেবে।
আধুনিকতা
উপনিবেশায়নে ইউরোপীয় প্রাদেশিক যৌক্তিকতাই হাজির হয়েছিল সর্বজনীন যৌক্তিকতা হিসেবে যার আলঙ্কারিক বয়ানের নামই আসলে আধুনিকতা। মিগনোলো আধুনিকতা ও উপনিবেশিকতাকে উপলব্ধি করেন পরস্পর বিজড়িত ধারণা হিসেবে—যার একটিকে ছাড়া আরেকটি টিকতে পারে না। তার তদন্তে উপনিবেশিকতা ধরা পড়ে আধুনিকতার না–বলা বয়ান হিসেবে, শর্তগতভাবে যা মূলত একই আলাপের অংশ, একে তা অপরের পরিপূরক। এই সূত্রেই, উপনিবেশিকতা আধুনিকতার চেপে যাওয়া দিক। ফলে, তার কাছে ‘যাহাই আধুনিক, তাহাই ঔপনিবেশিক’। কেননা, এই দুইয়ের জ্ঞানতাত্ত্বিক শর্ত যে একই। আধুনিকতার বয়ান দিয়ে, তার মতে, আড়াল করা হয়েছে উপনিবেশিকতাকে, আর যা ছিল এক বৈশ্বিক মিথ্যা।৩৭ তিনি ‘উপনিবেশিকতা’ শব্দ দিয়ে নির্দেশ করেন—ক্ষমতার উপনিবেশিকতা। তার ভাষায় : ‘The expression suggests that what is imprinted in colonial cultures is the effect of the imperiality of power. And the imperiality of power in the modern/ colonial world … is written not by guns and armies but by the words that justify the use of guns and armies…।৩৮ অর্থাৎ, উপনিবেশিকতা ঔপনিবেশিক নৃশংসতাকে সত্যায়িত করেছিলো—জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে তাকে দিয়েছিল বৈধতা।
মিগনোলোর চিন্তায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র রয়েছে। তার মতে, আধুনিকতার জন্ম বিশ্বজনীন সময় ও ইতিহাসে; যে–সময় ও ইতিহাস একরৈখিক; আর, এ–কারণেই তার প্রয়োজন ইতিহাসের পূর্ব ও পরমূহূর্ত। প্রাক–আধুনিক ও তার পরবর্তী পর্যালোচনামূলক পর্ব উত্তরাধুনিক এ–সূত্রেই তার জন্য অপরিহার্য।৩৯ উপনিবেশিকতা—ফলে—স্থান ও কালেরও উপনিবেশায়ন ঘটিয়েছে। মিগনোলো লেখেন: ‘Colonization of space and time were not military, financial, or state-politics activities: they were conceptual, that is, epistemic.’।৪০ এই কারণেই, বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিকেরা যখন আধুনিক যুগের ইতিহাস লিখেছেন তাদের জন্য প্রাক–আধুনিক পর্বটি এত জরুরি ছিল। আধুনিকতার আবির্ভাবকে স্বাগত জানাতে যাদের অনেককেই একশত বছরের লম্বা ‘অন্ধকার যুগের’ কেচ্ছা ফাঁদতে হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত ইতিহাস রচয়িতা সুশীল কুমার দে দাবি করেছিলেন, ইউরোপীয়দের আগমনের পূর্বে, অর্থাৎ, মধ্যযুগের শেষ দিকে বাংলা কাব্যের মান ছিলো পড়তির দিকে। তার মতে: একই রকম বিষয় নিয়ে, একই চালে ও একই আঙ্গিকে সস্তা গৎবাঁধা পদ্য রচিত হচ্ছিল তো হচ্ছিলই। আর, কবিদেরও ছিল নাকি একটাই উদ্দেশ্য—দেবস্তুতি। ফলে, ধর্মের লেবাস ছেড়ে তাঁদের বের হওয়ার সাধ্য আসলে ছিল না, আর যা ছিল তা–ও নাকি ছিল একঘেয়েমির চূড়ান্ত; তা–ই জানান দিচ্ছিল যে, সময় ফুরিয়ে আসছে। তিনি লিখেছেন :
If a literature after producing great things in the past does nothing more for centuries, if it shows signs of decadence and practically limits itself to trifles, then the conclusion is irresistible that it badly wants a change. Long before the stability of British rule was beyond all questions a process of decadence or dissolution had already begun which indicated a change in its spirit. The British occupation and its accompanying evils only hastened this change, so that a new era of literary history began in Bengal with the firm establishment of British rule.৪১
সুশীল কুমার দে ভাষা ও সাহিত্যের যে পড়তি দশার বিবরণ দিয়েছিলেন, তা তাঁর নিজের কথা নয়। হ্যালহেডও কিন্তু এই বিন্যাসেই কথা সাজিয়েছিলেন। কথা হলো, পড়তি দশা না–থাকলে তো ব্রিটিশদের ধাক্কায় উঠতি দশাও সম্ভব নয়। তেমনি অন্ধকার যুগ না–থাকলে—ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে—আলোকময় যুগের পত্তন হওয়াটাও অসম্ভব হয়। অর্থাৎ, এভাবে ইতিহাস ব্যাখ্যা না–করলে ব্রিটিশদের আগমনী বাদ্য জুৎসই বাজে না। আর এভাবে বাদ্য বাজানোর সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো, এতে সহজেই মনে হয়, ব্রিটিশ পুঁজি (কার্ল মার্কস যেমন বলেছিলেন) বা অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদের জন্য বাংলা অঞ্চল (ভারতবর্ষ) যেন মুখিয়ে ছিল এবং বাংলার জন্যে, শেষ বিচারে, তা এক–প্রকার আশীর্বাদই বয়ে এনেছে।
সজনীকান্ত দাস বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থে হেস্টিংস প্রসঙ্গে তার পর্যালোচনা ব্যক্ত করতে গিয়ে হেস্টিংসের গুণকীর্তনই করেছিলেন। হেস্টিংসের সাম্রাজ্যবাদী, ঔপনিবেশিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা থেকে খুব সহজেই তিনি তার সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে আলাদা করে নিয়েছিলেন। ফলে, হেস্টিংস তার চোখে ধরা দিয়েছিল ত্রাতার ভূমিকায়। এদেশের ভাষা, সাহিত্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি অনুভব করেছেন তার চিরস্মরণীয় অবদানের কথা। সজনীকান্ত লিখেছেন:
ভারতবর্ষের তদানীন্তন গর্ভনর জেনারেল বহুনিন্দিত ওয়ারেন হেস্টিংসের কথা এখানে কিছু বলা আবশ্যক। তাঁহার রাষ্ট্র–জীবন যাহাই হউক, এ–দেশের ভাষা, সাহিত্য ও শিক্ষার উন্নতিকল্পে তিনি যে পরিমাণ উদার ও সহৃদয় দৃষ্টি দিয়াছিলেন, নিতান্ত অকৃতজ্ঞ না হইলে আমরা চিরদিন তাহা স্মরণ করিব। তিনিই সর্বপ্রথম ইউরোপীয় পণ্ডিতদের দৃষ্টি ভারতের জ্ঞানভাণ্ডারের দিকে আকর্ষণ করেন। নিজের শিক্ষাদীক্ষা যাহাই হউক তাঁহার দূরদৃষ্টি ছিল অসাধারণ। জয়গর্বিত ইংরেজকে বিজিত জাতির শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি তিনিই সর্বপ্রথম শ্রদ্ধাসম্পন্ন করিয়া তোলেন। তাঁহারই চেষ্টায় এ–দেশের সংস্কৃত ব্যবহার–শাস্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি বিখ্যাত পণ্ডিতদের দ্বারা সঙ্কলিত হইয়া ফার্সী অনুবাদের মধ্য দিয়া হালহেড কর্তৃক ‘জেন্টু কোডে’ রক্ষিত হয়। তিনিই উইলকিন্সকে দিয়ে বাংলা হরফ প্রস্তুত করাইয়া হালহেডের বাংলা ব্যাকরণ মুদ্রিত করান; কলিকাতা মাদ্রাসা তাঁহার ব্যক্তিগত ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে স্যর্ উইলিয়াম জোন্স, কোলব্রুক, অধ্যাপক উইলসন প্রভৃতি ব্যক্তিগত চেষ্টা ও এশিয়াটিক সোসাইটির সাহায্যে এদেশের সংস্কৃতি–বিস্তারে যে সহায়তা করিয়াছিলেন, তাহার অনেকখানি কৃতিত্ব ওয়ারেন হেস্টিংসের।৪২
সজনীকান্ত দাসের সঙ্গে আজ অনেকেই একমত হবেন না, আর অতীতেও যে হননি তা তার বক্তব্য পেশ করার ধরন থেকেই বোঝা যায়। তাছাড়া, হেস্টিংসের ‘রাষ্ট্র–জীবন’ থেকে তার ‘উদার ও সহৃদয় দৃষ্টি’কে খুঁজে নেওয়ার শ্রমও আজ আর কেউ করতে চাইবেন না। এর কারণ, চিন্তার ধরনের পরিবর্তন। উপনিবেশের সমালোচনা এখন তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। আজ যা চোখ মেললেই দেখা যায়, পূর্বে তা–ই ছিল অন্বেষণের অতীত। কিন্তু আবারও বলা দরকার, এ–কেবল সজনীকান্তের সঙ্গে একমত বা ভিন্নমত হওয়ার প্রসঙ্গ নয় কিংবা হেস্টিংসের ভূমিকা চিহ্নিত করার প্রশ্নও নয় এটি। সজনীকান্ত বা সুশীল কুমারের চিন্তা তৈরির গোটা প্রক্রিয়াটিই এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার
মোটকথা, বাংলা অঞ্চলে ব্রিটিশ তৎপরতার সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক চরিত্র নির্ধারণই শেষ কথা নয়। ইউরোপীয় সংস্পর্শে, ইউরোপীয় জ্ঞানকাণ্ডের প্রভাবে, বাঙালিদের জীবনদৃষ্টি ও নিজেদের নিয়ে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, উপনিবেশিকতা গড়ে ওঠেছে, তাকে নস্যাৎ করতে হবে। কেননা, চিন্তার এই ধরনে যে–প্রেক্ষিত থেকেই বিচার করা হোক না কেন, তা ঔপনিবেশিক ফলই বয়ে আনে। সজনীকান্ত ও সুশীলকুমারের ক্ষেত্রে এই ঘটনাটিই ঘটেছে। একই ঘটনা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ক্ষেত্রেও ঘটে। বাংলা গদ্যের বিকাশে প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা–বিচার ঔপনিবেশিক যুক্তিকাঠামোর কাঠামোর ভেতরে থেকেই করা হয়ে থাকে। গদ্য অন্বেষণের নকশাটিই ইউরোপীয়। আর বাংলা গদ্যের এই অভাব ইউরোপীয় অভাববোধ দ্বারা জারিত। আরও গভীরভাবে বলা যায়, উপনিবেশিকতা চিন্তার মৌলিক কাঠামোটিকেই সংক্রমিত করে। এতে উপনিবেশিত চিন্তার কাঠামোতে ঔপনিবেশিক আত্মতত্ত্বসংস্থাপিত হয়। যে–কারণে, চিন্তা করার ক্ষেত্রে ইউরোকেন্দ্রিক পরিভাষা দিয়ে যা–ই চিন্তা করা হোক না কেন, তা ইউরোকেন্দ্রিক ফলই বয়ে আনে। ইউরোপ হাজির হয় ত্রাতার ভূমিকায়, ইউরোপের প্রাদেশিক ইতিহাস হয়ে ওঠে গোটা দুনিয়ার ইতিহাস, ইউরোপের জ্ঞান হয়ে ওঠে সর্বজনীন জ্ঞান। সেই জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোতে বাদবাকি দুনিয়া নিজেদের অবস্থান কেবল প্রান্তেই খুঁজে পাবে। সুতরাং, এক্ষেত্রে বদলে ফেলতে হবে আলোচনার কাঠামোটিই, আর তার পরিভাষাসমূহ। কেননা, ঔপনিবেশিক পরিভাষায় উপনিবেশিতের অভিজ্ঞতা কখনও বর্ণনা করা যায় না। ফলে করণীয় এটিই, ঔপনিবেশিক তৎপরতার মাধ্যমে যে উপনিবেশিকতা সৃষ্টি হয়েছে, জ্ঞানকাণ্ডে রয়ে গেছে সুপ্তাবস্থায়, তাকে ধ্বংস করা। আর এটি যেমন সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের চেয়ে সক্রিয় থাকে জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে, তেমনই একে জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবেই অকেজো করতে হবে।
অবশ্য পশ্চিমা বা ইউরোপীয় জ্ঞানকাণ্ডের পাল্টা এক জ্ঞানকাণ্ড নির্মাণই এখানে মুখ্য কর্ম নয়। মিগনোলো যেমন বিউপনিবেশিকতার কথা বলেছেন এবং বিপশ্চিমাকরণ থেকে তার পার্থক্যও নির্দেশ করেছেন। তার ভাষায়, বিউপনিবেশিকতা আলাপের পরিভাষাসমূহকেই বদলে দেওয়ার জোর তাগিদ জানায়, যেখানে বিপশ্চিমাকরণ আলাপের প্রসঙ্গ নিয়ে বিবাদ করে ঠিকই কিন্তু পরিভাষাগুলোকে রেখে দেয় অক্ষত। ফলে সেক্ষেত্রে ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার কাঠামোটিকেই এটি অক্ষত রেখে দেয়। অর্থাৎ, বিপশ্চিমাকরণ শাসনকাঠামোর ধরন হিসেবে আধুনিক রাষ্ট্র, আর উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন, অর্থসংস্থান ও বাজারের ধরন হিসেবে অর্থনৈতিক উপনিবেশিকতাকে (পুঁজিবাদ) অক্ষতই রেখে দেয়, তার বিবাদ চলে ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকার দখল ও নিয়ন্ত্রণের জন্য। তেমনই জ্ঞানোৎপাদনের যৌক্তিক কাঠামোটিকে না বদলে শুধুমাত্র বিষয়বস্তু নিয়ে তর্ক করলে সিদ্ধান্ত হিসেবে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যা–ই হোক না কেন বৈশিষ্ট্যগতভাবে তা ঔপনিবেশিক জ্ঞানই উৎপাদন করবে। আর তা উপনিবেশিতদের প্রান্তীয় রূপেই হাজির করবে।
অনুরূপভাবে, ইংরেজ কর্তৃক বাংলা গদ্য বিষয়ক প্রস্তাব ও তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ জাতীয়তাবাদী বয়ান উভয়ই ইংরেজ কর্তৃক নির্ধারিত প্রামাণ্যকেই স্বীকৃতি প্রদান করে। ফলে, তর্কটিও চলে সেই আদর্শের দখল–বেদখল নিয়ে। একই ঘটনা ঘটে বাংলা অঞ্চলে পুঁজির ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও। সেক্ষেত্রেও ইউরোপীয় পরিভাষাসমূহকে অক্ষত রেখেই চলে প্রসঙ্গ নিয়ে বিবাদ। অনুরূপ, সুশীলকুমার ও সজনীকান্তের চিন্তাও ঝুঁকিতে পড়ার কারণ যথাক্রমে তাদের ইংরেজ ও হেস্টিংস প্রীতি নয়— চিন্তার পরিভাষাসমূহকে অক্ষত রেখে দেওয়া। অর্থাৎ, কোন কাঠামোতে একটি সমস্যা তৈরি হচ্ছে ও তার সমাধানের প্রয়াস করা হচ্ছে সেটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, তা সুনির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ডের ভিত্তিতেই কেবল অর্থপূর্ণভাবে কার্যকর হয় এবং তা প্রকাশের পরিভাষা সমূহও নির্ধারিত থাকে। অর্থাৎ, যেকোনো চিন্তার ক্ষেত্রে যুক্তির একটি নিজস্ব ছক থাকে যা দ্বারা নিরূপিত হয় তার সত্য। উপনিবেশিত জ্ঞানকাণ্ড উপনিবেশিকতার কারণে যুক্তির ঔপনিবেশিক ছক অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। ঠিক এই কারণেই, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ সম্পর্কিত চিন্তার কাঠামো ও পরিভাষাসমূহের পুনর্গঠন না–করলে উপনিবেশিকতা তৈরিতে এর ভূমিকা নির্ধারণ করার কাজটি সরল হবে না।
* বর্তমান প্রবন্ধটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের গবেষণা পত্রিকা সাহিত্যিকীর ৫৩তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিলো।
তথ্যসূত্র ও টীকা
১. গোপাল হালদার, বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা অখণ্ড (ঢাকা: মাটিগন্ধা, ২০১৭), পৃ. ২৯০
২. মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (আধুনিক যুগ) (ঢাকা: আহমদ পাবলিশিং হাউস, ২০০৬), পৃ. ৫৬
৩. দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য [দ্বিতীয় খণ্ড], (কলকাতা: গ্রন্থপীঠ, ১৩৬৭ [১৯৬০–১]) পৃ. ৬৬১–৬
৪. মো. মনিরুল ইসলাম, “বাংলা গদ্যের ইতিহাসচর্চায় ঔপনিবেশিক প্রভাব”, বিশ্ববাংলাবীক্ষণ ২(১), ২০২২, পৃ. ১–১১
৫. হুমায়ুন আজাদ, কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০১১), পৃ. ৮৪
৬. সুমন সাজ্জাদ, আধুনিকতা ও আত্মপরিচয় মতাদর্শিক নির্মিতি ও সাহিত্যিক বিস্তার, (সিলেট : চৈতন্য, ২০১৬), পৃ. ২৭৯
৭. উপনিবেশিকতা (coloniality) পরিভাষাটির প্রবর্তক পেরুর সমাজতাত্ত্বিক আনিবাল কিহানো। একে তিনি উপনিবেশবাদ থেকে আলাদা করে নেন। তার ভাবনায়, উপনিবেশবাদ নির্দেশ করে এক–ধরনের রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক সম্পর্ক—যেখানে একটি দেশের সার্বভৌম ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে অপর আরেকটি কর্তৃত্ববাদী দেশের ওপর—যা কর্তৃত্বপরায়ণ দেশটিকে একটি সাম্রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলে। অন্যদিকে, উপনিবেশিকতা হলো উপনিবেশায়নের ফলে সৃষ্ট হওয়া দীর্ঘস্থায়ী এক ক্ষমতাবিন্যাস যা ঔপনিবেশিক প্রশাসনের আওতা–বহির্ভূত সংস্কৃতি, শ্রম, আন্তঃবিষয়ী সম্পর্ক ও জ্ঞানোৎপাদনকে সংজ্ঞায়িত করে। এই দুইয়ের সম্পর্ক হলো—উপনিবেশিকতা রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত উপনিবেশবাদকে বহাল তবিয়তে বাঁচিয়ে রাখে। বই–পুস্তক, বিদ্যায়তনিক তৎপরতা, সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, প্রাত্যহিক বোঝাপড়া, সাধারণের আত্ম–ভাবনা, আত্মবোধের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও অন্যান্য আধুনিক যাপনাভিজ্ঞতায় এটি সুপ্তাবস্থায় রয়ে যায়। ফলে, একজন আধুনিক বিষয়ী হিসেবে ব্যক্তি মূলত উপনিবেশিকতার মধ্যেই দম নেয়। এ–কারণেই, উপনিবেশিকতা কোনো ঔপনিবেশিক সম্পর্কের সরল পরিণতি বা অবশিষ্ট নয়। ‘কলোনিয়ালিটি’ শব্দটিকে আরও অনেকেই ব্যবহার করেন। আমরা যার বাংলা করি—ঔপনিবেশিকতা। কিন্তু কিহানো একে বিশেষ অর্থে নির্মাণ করেছেন, এবং ‘ঔপনিবেশিকতা’ বানানে পরিভাষাটির সেই বিশেষ অর্থ খোয়া যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় বলেই এর বানান লেখা হয়েছে ‘উপনিবেশিকতা’। এই বানানে লাতিন আমেরিকীয় বিউপনিবেশিক চিন্তনে ব্যবহৃত ‘কলোনিয়ালিটি’ পরিভাষাটির বাংলা তর্জমা নির্দেশিত হবে।
৮. Ian Barrow, The East India Company, 1600–1858 (United States of America : Hackett Publishing Company, 2017), p. 68-9
৯. David Kopf, British Orientalism and the Bengal Renaissance, (Calcutta : Firma K. L. Mukhopadhyay, 1969), p. 13
১০. হামজা আলাভী, ভারতবর্ষ : সামন্তবাদ থেকে উপনিবেশিক পুঁজিবাদে উত্তরণ, অনু. এনামুল হাবীব (ঢাকা: উৎস প্রকাশন, ২০১৮), পৃ. ৫১–৫২
১১. Gurcharan Das, “Introduction”, The East India Company, By Tirthankar Roy (India: Portfolio, 2015), p. xxi
১২. David Kopf, Ibid, p. 16-21
১৩. সজনীকান্ত দাস, বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস (কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ২০০৭), পৃ. ৫৭
১৪. David Kopf, Ibid, p. 31
১৫. Ibid, p. 46-48
১৬. Robert Rouiere Pearce, Memoirs and Correspondence of the Most Noble Richard Marquess Wellesley, Vol. 2, (London : 1846), p. 212
১৭. David Kopf, Ibid, p. 50-51
১৮. সজনীকান্ত দাস, উইলিয়াম কেরি (কলকাতা: বঙ্গীয়–সাহিত্য–পরিষৎ, ১৯৮২), পৃ. ২৪–২৫
১৯. শক্তিব্রত ঘোষ, উইলিয়ম কেরী: জীবন ও সাধনা (পশ্চিম বঙ্গ: বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬০), পৃ. ২১–২৫
২০. David Kopf, Ibid, p. 92
২১. Ibid, p. 142-43
২২. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিত [সাহিত্য–সাধক–চরিতমালা—১৪] (কলকাতা: বঙ্গীয়–সাহিত্য–পরিষৎ, ১৩৬৬ [১৯৫৯–৬০]), পৃ. ৬–৭
২৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, “ভাষার কথা”, রবীন্দ্র–রচনাবলি [পঞ্চবিংশ খণ্ড] (ঢাকা : ঐতিহ্য, ২০১৬), পৃ. ২৮৩
২৪. সৈয়দ নিজার, ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা (সিলেট: চৈতন্য, ২০১৭), পৃ. ৪৭–৪৯
২৫. পূর্বোক্ত, পৃ. ৫০–৫১
২৬. David Kopf, Ibid, p. 57-58
২৭. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৩৮৬ [১৯৮০]), পৃ. ৫–৬
২৮. Nathanial Brassey Halhed, A Grammar of the Bengal Language (Hoogly: 1778), p. xxiv
২৯. সৈয়দ নিজার, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৪
৩০. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩২–৩৩
৩১. নিখিল সুর, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ২০২১), পৃ. ৫৯–৬০
৩২. আনিবাল কিহানো, “ঔপনিবেশিকতা ও আধুনিকতা/ যৌক্তিকতা”, অনু. মনিরুল ইসলাম, রাষ্ট্রচিন্তা, নবম সংখ্যা, ২০২২, পৃ. ২০৫–২৯
৩৩. সৈয়দ নিজার, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৫–৪৭
৩৪. Nelson Maldonado-Torres, “On the Coloniality of Being”, Globalization and the Decolonial Options, Ed. Walter D. Mignolo & Arturo Escobar (London & New York : Routledge, 2010), p. 97
৩৫. আনিবাল কিহানো, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০৫–২৯
৩৬. পূর্বোক্ত
৩৭. Walter D. Mignolo & Catherine E. Walsh, On Decoloniality (United States of America: Duke University Press, 2018), p. 141
৩৮. Ibid, p. 140
৩৯. Ibid, p. 117
৪০. Ibid, p. 140
৪১. Sushil Kumar De, Bengali Literature In The Nineteenth Century (1757-1857) (Calcutta : Firma K. L. Mukhopadhyay, 1940), p. 40
৪২. সজনীকান্ত দাস, বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৪–৫৫
৪৩. Walter D. Mignolo & Catherine E. Walsh, On Decoloniality (United States of America: Duke University Press, 2018), p. 130